Saturday, May 18, 2024
বাড়িSliderপ্রতিশোধ

প্রতিশোধ

শায়লা রহমান তিথি: দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পেরুতেই নৌহাটি গ্রামে নাজমত চেয়ারম্যানের সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগে তাকে সবাই নজু মিয়া নামেই চিনত। খ্যাতির পেছনে কারণ গাঁয়ে একটি পাঠশালা, একটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা আর তিনটি মসজিদ নির্মাণ করা। গরিব মানুষদের বেশ দান খয়রাতও করত। একমাত্র ছেলেকেও টাকা-পয়সা খর্চা করে বিদেশে পাঠিয়েছে। তবে টাকা দিয়ে স্ত্রী মায়ার মন জয় করতে পারেনি। সংসারে মায়া একটি নীরব প্রাণী। শুধু তার চোখে নাজমত একরকম কঠিন ঘৃণা দেখে। তাতে নাজমত এর কাজকর্মের অসুবিধা হয় না।
লোকে জানে না নাজমতের আয়ের উৎস। নাজমতের অনেক কিছুই লোকে জানে না, টেরও পায় না। বিশ একর জমির ওপর তার সুবিশাল পাকা দোতলা বাড়ি। চারদিক ঘিরে উঁচু প্রাচীর। পশ্চিমে বিশাল দিঘি। পূর্বদিকে পারিবারিক কবরস্থান। আর সারা বাড়ি ঘিরে আছে বড় বড় নানা জাতের গাছপালা। খালি গাছপালাগুলোর দিকে তাকালে নাজমত মাঝে মাঝে একটু থমকে যায়। কী যেন একটা শব্দ তাকে খোঁচা মারে।
একাত্তরের শেষদিকে এক গভীর রাতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তার পায়ে গুলি করেছিল। ভাগ্য ভালো জান নিয়ে ফিরেছে। এ ঘটনাটিকে পরবর্তী সময়ে নাজমত ‘যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাজাকারদের গুলি লেগেছে’ বলে চালিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপারটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয় তার ছোট ভাইটি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হওয়ার পর। পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে ভাইটিও শায়িত আছে। সেদিন ডিসেম্বরের এক দুপুরে বারান্দায় বসে কেটে ফেলা বাঁ পায়ের ব্যথাটাতে যখন হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখন সামনের খেলার মাঠ থেকে ভেসে আসে জয় বাংলা চিৎকার। ছেলেপুলেরা খেলছে। দুজন গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। তার জীবনের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম শব্দ। এক পায়ে ভর করে নাজমত ছেলে দুটোকে চিনে নেয়।
সেইদিন সন্ধ্যায় বড় একটা গর্ত করা হয় শহিদ ভাইটির কবরের পাশে। নামানো হয় ভারী একটা বস্তা। গর্তের মুখে ভরাট করে দুটি চারা গাছ একসাথে পুঁতে দেয়া হলো। বাতাসে বড় গাছগুলোর পাতা ঝরে পড়ে শহিদ ভাইয়ের কবর আর সদ্য লাগানো গাছগুলোর চারপাশে। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ার গায়েও উড়ে আসে পাতা। মায়া পাতাগুলো আঁচলে চেপে ছলছল চোখ নিয়ে চলে যায় দিঘির কাছে। এক জীবনে স্বামী নাজমতের অনেক কিছু নীরবে সয়ে গেলেও এত নিষ্পাপ দুটো প্রাণের বিনাশকে মেনে নিতে পারছিল না তার ৫২ বছরের জীবন। শেষবারের মতো তাকায় চারপাশের বড় গাছগুলোর দিকে।
এশার নামাজ শেষ করে দিঘির পাড় দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নাজমতকে আবার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। টাকা তো আসেই খরচ করার জন্য। কাজের লোকজনের মুখ বন্ধ করা কোনো ব্যাপার না। মাঝরাতে আরও একটা গর্ত খোঁড়া হয়। শুধু ঐ মুহূর্তে কোনো গাছ পাওয়া গেল না লাগানোর জন্য।
ক্লান্ত নাজমত বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবে সকালবেলা কোনো গাছ খুঁজে নেবে। খোলা জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসতে লাগলো। সেই সাথে নাজমতের কানে ভেসে আসে নানারকমের কণ্ঠস্বর। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে কোথাও কোনো জনমানব নেই। তার বাড়ির চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন বয়সী বিভিন্ন রকমের গাছ উঠানজুড়ে হাঁটাহাঁটি করছে আর জয় বাংলা জয় বাংলা সেøাগান দিচ্ছে!

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য