Tuesday, April 30, 2024
বাড়িকূটনীতিগাজায় মানবিক বিপর্যয় ও বিশ্ব-ভাবনা

গাজায় মানবিক বিপর্যয় ও বিশ্ব-ভাবনা

এই যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলে, এই অস্ত্রের খেলা বন্ধ না করলে, সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। আমরা শান্তি চাই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিমালা খুবই স্পষ্ট, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরা সেই নীতিতে এগিয়ে চলেছি।

সাইদ আহমেদ বাবু: ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে। সে-সময় বলা হয়, ইসরায়েল হবে ইহুদিদের এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক, যেটি আরবরা মানেনি। এর ধারাবাহিকতায় প্রথম আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটি চলছে এখনও। ইয়াসির আরাফাত প্যালেস্টাইনি আন্দোলনের প্রতীক, সময়ের এক কিংবদন্তি। তিনি আরবদের বাইরে প্যালেস্টাইনিদের একটা আলাদা পরিচয়, একটা সত্তা গড়ে তুলতে পেরেছেন। ১৯৬৭-র পরেই তিনি বুঝতে পারেন যে আরব দুনিয়ার নেতারা সব সময় যে যার নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। প্যালেস্টাইনের সংগ্রাম কখনোই তাদের প্রাথমিক গুরুত্বের তালিকায় আসবে না। তার এটাও জানা ছিল যে পশ্চিমা দুনিয়ায়, বিশেষ করে আমেরিকায় আরব নেতাদের প্রতিপত্তি নগণ্য; বরং উল্টোটাই সত্য। আরব দুনিয়াতে মার্কিন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তির মাত্রা ক্রমবর্ধমান।
১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না-হলেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। তিনি ধরতে পেরেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া উপায় নেই। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলি দমন-পীড়ন চলছিল, প্যালেস্টাইনিদের কথা কেউ কানেই তোলেনি, তুলল তখনই যখন প্যালেস্টাইনিরা সহিংস আন্দোলনে নামল, নেমে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিল সরবে। তার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্যালেস্টাইনিরা বহু আবেদন-নিবেদন করেছিল, কোনো ফল হয়নি। কিন্তু প্যালেস্টাইনি যোদ্ধা এবং সংশ্লিষ্ট ইন্তিফাদা শুরুতে বিশ্বের নজর কাড়ল। বস্তুত, দুনিয়াকে বাধ্য করল তাদের প্রতি নজর দিতে এবং প্যালেস্টাইনিদের বৈধ অধিকার পুনরুদ্ধারের গোটা বিষয়কে এক টানে বিশ্ব-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এনে হাজির করল। যে-সিদ্ধান্তটির জন্য আরাফাতের প্রশংসা প্রাপ্য, তা কিন্তু যুদ্ধ নয়, শান্তির সঙ্গেই জড়িত। দীর্ঘকাল সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে শেষটায় যে আরাফাত আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষের একটা শাস্তিপূর্ণ সমাধান সূত্রের দিকে গেলেন, ইসরায়েলি রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে মেনে নিলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষ দুই রাষ্ট্র সমাধানে ঐকমত্য হয়। সেটাই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছে অমীমাংসিত সংঘাতে। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার ঘটনা নতুন নয়; কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল (ইয়ম কিপুর) যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীর পরদিন, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার স্বাধীনতাকামী হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) কার্যকর নজরদারি প্রযুক্তি এবং চৌকষ ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে (অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড) ইসরায়েলের ভেতরে আক্রমণ করে। তাদের হামলায় ২৯৯ সৈনিকসহ নিহত হয় প্রায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নাগরিক। আক্রমণের মাত্রা, কৌশলের দিক থেকে হামাস ইসরায়েলকে বিস্মিত ও পরাভূত করেছে। অতীতে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালানোর অনেক কৌশল অবলম্বন করেছে হামাস। তবে আগে কখনো এত দুঃসাহস দেখায়নি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এই হামলা ইসরায়েলকে বিস্মিত করেছে। এমনকি ইসরায়েলের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, এটি ছিল তাদের জন্য ঐতিহাসিক অপমান।
জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ‘হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলও গাজায় হামলা শুরু করে। ২৩ দিন ধরে হামাসের সঙ্গে চলমান এই যুদ্ধে গাজায় ৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু। এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরায়েলের আত্মরক্ষায় সমর্থন জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।
বিমান থেকে প্রচারপত্র ছেড়ে গাজা ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ইসরায়েল, এতে টানা বোমাবর্ষণের মধ্যে থাকা ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারপরও গাজা শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা কোথাও যাবেন না এবং ইসরায়েলের আদেশ অমান্য করবেন। ধারাবাহিক হামলায় গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা। মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটেছে গাজায়। গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ এ বক্তব্য জাতিসংঘের।
নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কারণে হামাসের ভয়ংকর হামলা ন্যায্যতা পেতে পারে না। ওই ভয়ংকর হামলার কারণে ফিলিস্তিনি মানুষের সম্মিলিতভাবে যে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাও ন্যায্যতা পায় না।’
হামাস শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করার প্রত্যয় জানিয়েছে। গাজার সীমান্তজুড়ে ট্যাংক ও প্রায় ৩ লাখ সেনা মোতায়েন করে বড় ধরনের স্থল হামলার প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। ইসরায়েল নির্বিচারে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপ করায় গাজার আকাশে এখন শুধুই বারুদের ধোঁয়া আর মাটিতে সারিসারি লাশ। গাজায় ২৩ লাখ মানুষের খাবার, পানি, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেখানে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এদিকে খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধসহ গাজায় পুরোপুরি অবরোধ আরোপ করার ইসরায়েলের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন। সংস্থার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছেন, আন্তর্জাতিক এবং মানবাধিকার আইন অবশ্যই বহাল রাখতে হবে। অতিসত্বর সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করে ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে আরব লীগ।
গাজায় বিরতিহীন বিমান হামলার কারণে এবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজায় চালানো হামলার জন্য ইসরায়েলকে বড় আঘাত সইতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ইসরায়েলের নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার অবশ্যই রয়েছে। তবে গাজায় কোন কৌশলে তারা যুদ্ধ করছে, সেটি ভাবনার বিষয়। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে নেতানিয়াহু বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রনেতা ইসরায়েলি এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরব লীগ। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি এ হামলাকে ‘ভয়াবহ এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলা একটি ‘গণহত্যা’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধ’। বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফর বাতিল করে দিয়েছে জর্ডান।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ‘কঠোর ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে মিশর। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমা হামলা ওই অঞ্চলে চলমান উত্তেজনা আরও বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি করবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনতে তাদের একত্রে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে ফিলিস্তিন সংকট সমাধান সম্ভব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহীত নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ সার্বক্ষণিক ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অতীতের মতো ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। সারাদেশের সব মসজিদে ফিলিস্তিনিদের জন্য জুমার নামাজে বিশেষ মোনাজাত এবং একদিনের শোক পালন করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে ইসরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলে, এই অস্ত্রের খেলা বন্ধ না করলে, সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। আমরা শান্তি চাই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিমালা খুবই স্পষ্ট, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরা সেই নীতিতে এগিয়ে চলেছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্ব নেতৃত্বের উচিত মানবতার ধস ঠেকানো। ফিলিস্তিন সংকটের পেছনে বহুপক্ষীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির দায় সংশ্লিষ্ট কেউই এড়াতে পারে না। বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। এছাড়া আরও প্রায় ৬ লাখ ফিলিস্তিনি চরম সংকটে রয়েছে। বছরের পর বছর অবরুদ্ধ হয়ে থাকা আজকের গাজা আরও ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কোনোভাবে মানবতার এমন বিপর্যয় মেনে নিতে পারি না।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান কড়া ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন। এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতি তুরস্কের অবস্থানে বদল ঘটেছে। তুরস্ক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে প্রস্তুত। এরদোয়ান বলেন, মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে শান্তি ও যুদ্ধবিরতিতে সাহায্য হবে। গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সৌদি আরব রাষ্ট্র হিসেবে সরাসরি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বীকৃতি দেবে না বলে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, তলে তলে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছিল। প্রভাবশালী ও তেলসমৃদ্ধ দেশটির সঙ্গে ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন রূপ দিতে পারত তারা। ইসরায়েল নিজেও ঐতিহাসিক এক অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেত।
সামরিক শক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং ফিলিস্তিনি সব মানুষকে শাস্তির যে পথ ইসরায়েল গ্রহণ করেছে, আন্তর্জাতিকভাবে তার সমালোচনা শুরু হয়েছে। যে-কারণে বড় ধরনের স্থল অভিযান ইসরায়েলের জন্য গুরুতর নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনী যে নির্বিচার বোমা হামলা চালাচ্ছে, তাতে অসংখ্য বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির বিষয়ে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমা নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন জর্ডানের রানি রানিয়া আল আবদুল্লাহ। পশ্চিমা নেতাদের এ অবস্থানকে ‘নির্লজ্জ দ্বিচারিতা’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। চলমান সংঘাতের মধ্যে গাজা উপত্যকার পরিস্থিতিকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রুশ প্রেসিডেন্ট গাজার ফিলিস্তিনিদের ‘সম্মিলিত শাস্তির’ নীতির বিরোধিতাও করেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষ, নারী, শিশু এবং পুরো পরিবার মারা যায়। পুতিন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জন্য দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির চাবিকাঠি।’ তিনি ‘কিছু শক্তির’ ধর্মীয় ও জাতীয় অনুভূতি নিয়ে খেলার প্রয়াসের নিন্দাও করেন, যাতে তাদের ‘বৈরী স্বার্থের’ জন্য অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এ সময় তিনি বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন চলমান উত্তেজনা প্রশমনে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করছে সৌদি আরব। মোহাম্মদ বিন সালমানের অফিস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়, একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা, তাদের আশা-আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করা এবং একটি ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি অর্জনে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো অব্যাহত রাখবে সৌদি আরব।
গাজায় ইসরায়েলের চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবিতে মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর ইস্তাম্বুল, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, নিউজিল্যান্ড, হেলসিংকি, হ্যাসলহোমসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর রাজধানী শহরগুলোতে বৃহৎ পরিসরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধসহ স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা ও সেখানকার অধিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় হাজার হাজার সমর্থক অংশ নেয়।
আনাদোলু এজেন্সি সূত্র জানিয়েছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনীর মধ্যে চ্যাটেলেট স্কয়ারে ফিলিস্তিনের পতাকা বহন করে তারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। তারা ‘মানবতা হত্যা করা হচ্ছে’, ‘গাজার পাশে প্যারিস রয়েছে’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’ বলে সেøাগান দিতে থাকে।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে লন্ডনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে। তারা ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর দাবি জানায়।
গাজায় মানবিক সংকটের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ইসরায়েল এখন সমালোচিত নাম। গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে, ডেমোক্রাটিক পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা ও আমেরিকান মুসলিমরা আসন্ন ২০২৪ ভোটে মুসলিম ভোটারদের ভোট তাকে আর দেওয়া হবে না।
ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় থাকা ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় জরুরিভাবে মানবিক বিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য বেশির ভাগ রাষ্ট্র। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে ২২টি আরব দেশ। এর পক্ষে ভোট দেয় ১২০ দেশ। আর বিপক্ষে ভোট পড়ে ১৪টি। ভোটদানে বিরত ছিল ৪৫টি দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।
গত ১৭ অক্টোবর গাজার আল-আহলি হাসপাতালে বোমা মেরে প্রায় ৪৭০ সাধারণ ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর আরব ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের মানুষ যে-মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছুটা শক্ত অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। এর কয়েকদিন পরই আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার নিন্দা জানাতে এবং ইসরায়েলি হামলা বন্ধে প্রস্তাব পাস করতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে অনুরোধ করতে শুরু করেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে বেশির ভাগ দেশের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। কিন্তু ইসরায়েল সে প্রস্তাবকে সামান্যতম পাত্তা দেয়নি।
আজকে হয়তো আরব নেতারা ফিলিস্তিনের বিষয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের মধ্যে খুব কম দেশের ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলা এবং কথামতো কাজ করার ক্ষমতা আছে। তবে এবার আরব নেতাদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয়, তাদের হয়তো মুখ খুলতে হবে এবং তারা যে তাদের কথাকে কাজে পরিণত করতে চান, তার প্রমাণও দিতে হবে। আর সেই প্রমাণ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আরব দেশগুলো যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হতে পারে। তবে ইসরায়েল এবার আগের হামলাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক তৎপরতা নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের এই নগ্ন গণহত্যা যদি এখনই বন্ধ না-হয়, তাহলে তা আরব বিশ্বে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
হামাসকে নির্মূলে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সামরিক সহায়তা এখন বড় সমালোচনার মুখে পড়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারাও বুঝতে পেরেছেন, প্রায় এক মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় অব্যাহতভাবে বোমা হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক বাসিন্দাকে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ বেড়েছে খোদ মার্কিন প্রশাসনে। কর্মকর্তার বলছেন, গাজায় যেভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থনও পুরোপুরি পায়নি যুক্তরাষ্ট্র।
এতগুলো আরব রাষ্ট্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র মিলে এই কুৎসিত-অমানবিক-ঘৃণ্য ইসরায়েলের মোকাবিলা করতে যদি অপারগ হয়, তবে তা আরব রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতাই নয়, অপদার্থতাও বটে। প্রাণ যায় তো কেবল হতভাগ্য নারী-শিশুসহ নিরীহ জনগণের। সাহস তো রাখতেই হবে মনে। তবে এই অমানবিক ক্রিয়াকলাপ অবশ্যই আমাদের ভাবায়। আরব রাষ্ট্রগুলোর যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে সব কূটনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দ্রুত এই হত্যাকারীদের দমন করে দেখিয়ে দিক। তা না পারলে তুলে দিক জনতার আদালতে। তারপর সারাবিশ্ব চেয়ে চেয়ে দেখুক জনতার আদালত মনুষ্যত্বহীন ওই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঠিক কী রায় দান করে।
প্রায় ৮ হাজার নিরীহ-নির্দোষ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় কোন স্বার্থে, কোন আদর্শে? এবারে সারাবিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম, বহু মৌলভি, ধর্মগুরু ও ইমাম, পাদ্রি দ্ব্যর্থ ভাষায় এই অমানবিক হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছেন। সব ধর্মেই মুষ্টিমেয় মৌলবাদী ও ভ্রষ্টাচারীর জন্য অসংখ্য সাধারণ মানুষকে দুর্বিপাক সহ্য করতে হয়। ইসরায়েলের এই নগ্ন গণহত্যা ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা দেখে আমরা শিউরে উঠি, মানুষ কী করে এমন হিংস্র হয়, ভেবে স্তব্ধবাক হই। কিন্তু মানবসভ্যতার তো এদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা। এই হত্যাকারীদের যারা উসকানিদাতা, তারা কি জোর করে সভ্যতাকে পিছিয়ে দিতে চাইছে?
এখন সময় এসেছে ফিলিস্তিনের গাজায় বোমা হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক বাসিন্দাদের হত্যাকারী ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার। এ-ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে মুসলিমদের উচিত তাদের মনোভাব আরও সোচ্চারভাবে জানানো, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত গাজা হত্যারোধে তৎপর ভূমিকা নেওয়া। একটা আগাম মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ চালাতে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে এবং আরও বেশি করে তাদের যারা উসকানি দেয়, তাদের বিরুদ্ধেও। যারা সন্ত্রাসবাদকে ঘৃণ্য ঘোষণা করতে অপারগ, তাদের হয় নতুন করে শেখাতে হবে, তা অমান্য করতে হবে পুরোপুরি। আর যারা মতবিরোধের হাত টেনে হত্যা ও সন্ত্রাসকে ছাড়পত্র দিয়ে চলেছেন, তাদের কণ্ঠস্বরকেও করা জরুরি। যে-গরল আজ তারা ছড়াচ্ছেন, আগামীকাল তারা ফিরে হানা দেবে আমাদের প্রত্যেককে। আরব রাষ্ট্রগুলো বর্তমানে অনেক বেশি পশ্চিমানীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। এটি বিশ্বাসের কারণে নয়, সুবিধা লাভের আশায়। একসময় মুসলিম নেতারা আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির কথা বলতেন। এখন সে-কথা বলারও কেউ নেই। তারপরও বলব, আমরা আশা হারাতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন : “যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়-/তবে পরান খুলে/ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে”- পরান খুলে মনের কথা, সাহস করে সত্য কথা বলতে হবে। পৃথিবীতে সকল ধর্মে যে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছে, তারাও এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার ও ‘গণহত্যার’ প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের নিউইয়র্ক দপ্তরের পরিচালক ক্রেইগ মখিবার। তিনি বলছেন, গাজায় ‘গণহত্যার অকাট্য প্রমাণ’ রয়েছে। গত সপ্তাহে দেওয়া পদত্যাগপত্রে জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা লিখেন, “যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বেশির ভাগ সরকার এই নৃশংস হামলায় সম্পূর্ণভাবে জড়িত।” এর আগে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা জশ পল। পদত্যাগপত্রে জশ পল লিখেন, “এক পক্ষের প্রতি অন্ধ সমর্থন থেকে বাইডেন প্রশাসন (প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন) এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অদূরদর্শী, ধ্বংসাত্মক ও অন্যায্য। আমরা প্রকাশ্যভাবে যে ধরনের মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন দিই, এটা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।” ইসরায়েল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া ও চিলি। রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে জর্ডান। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। এদিকে সংঘাত শুরু হওয়ার পর ৯ সাংবাদিক হত্যার ঘটনার তদন্ত চেয়ে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। এই ৯ সাংবাদিকের মধ্যে আটজন ফিলিস্তিনি আর একজন ইসরায়েলি। আরএসএফের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। বিশ্বের প্রতিটি দেশের বিবেকবান মানুষ যদি যার যার অবস্থান থেকে ইসরায়েলি হামলার ও ‘গণহত্যার’ করা হয়, তাহলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আসতে পারে।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য