Saturday, April 27, 2024
বাড়িSliderগণতন্ত্রের বিজয় উদযাপনের মেলা

গণতন্ত্রের বিজয় উদযাপনের মেলা

পৃথিবীতে সব থেকে মধুর ভাষা বাংলা। এত চমৎকার ভাষা কোথাও আছে কি না জানি না। হয়তো এটি আমাদের মাতৃভাষা বলে এমনটা মনে হয়।

সাদিকুর রহমান পরাগ : ২০২৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য নবযাত্রার বছর। কারণ এই বছরের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশে^র বুকে এটি একটি বিরল ঘটনা।
এই নির্বাচন বানচাল করতে দেশি-বিদেশি চক্র সক্রিয় ছিল। সরকার পদত্যাগের তথাকথিত একদফা আন্দোলনের নামে আবারও শুরু হয় বিএনপি-জামাতের আগুন সন্ত্রাস ও হত্যা-খুনের রাজনীতি। সেই সঙ্গে চলেছে ক্রমাগত বাংলাদেশ-বিরোধী মিথ্যা প্রচারণা ও সাইবার সন্ত্রাস। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অযাচিত হস্তক্ষেপ, স্যাংশন, ভিসানীতি, বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকিসহ অনেক কিছুই এদেশের জনগণকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।
গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার সমুন্নত রাখতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে কোনো কিছুই নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সকল ধরনের অনিশ্চয়তা ও প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের নবযাত্রা।
রাজনীতির আকাশের কালো মেঘ সরে গিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। বইমেলা ‘পড়ো বই গড়ো দেশ : বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত মাসব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এই বইমেলা আজকে বিশে^র মাঝে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বটতলায় ৩২টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই মেলা হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় জীবনের অপরিহার্য অংশ। বাঙালির প্রাণের এই মিলন মেলার জন্য সারাবছর উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকেন লেখক-প্রকাশক-পাঠকরা।
এদেশের সাহিত্যচর্চায় সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। আর অমর একুশে বইমেলায় প্রতিবছর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিজয়ীদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০২৩ সালের জন্য ১১টি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী ১৬ জনকে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ তুলে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগৃহীত রচনা : দ্বিতীয় খণ্ড’ এবং বিগত ২০ বারের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রদত্ত ভাষণের সংকলন ‘প্রাণের মেলায় শেখ হাসিনা’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন।
এবারের মেলায় ৩৭টি প্যাভিলিয়নসহ ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি মাঠে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭৬৪টি স্টল রয়েছে।
আমাদের নবযাত্রার প্রথম বইমেলা- দুটি কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। একটি হচ্ছে স্বস্তির সুবাতাস, আরেকটি হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন।
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যে সংশয়-ষড়যন্ত্র-সন্ত্রাস-উত্তেজনা বিরাজ করছিল, সফলভাবে নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তার উত্তরণ ঘটেছে। এমনি প্রেক্ষাপটে নির্বাচনোত্তর একটি উৎসবমুখর পরিবেশে মাসব্যাপী বইমেলার আয়োজন নিঃসন্দেহে জাতীয় জীবনে মানসিক স্বস্তি ও প্রশান্তির উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই, গণতন্ত্রের বিজয় উদযাপনে বইমেলার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।
অমর একুশে বইমেলা আমাদের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে-
* “সাহিত্য-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ যথা- বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পরিচালিত হবে। জ্ঞানী-গুণীজনকে সংযুক্ত করে সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা হবে।
* লোকঐতিহ্য তথা লোকমেলা, বইমেলা, যাত্রাপালা, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য-গীত ও অন্যান্য সুস্থ বিনোমূলক অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বাধা, জঙ্গিদের হামলা ও অপপ্রচার নির্মূল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
* বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা যেমন- গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, চারু ও কারুশিল্প, স্থাপত্য, আবৃত্তি, সংগীত, যাত্রা, নাটক, চলচ্চিত্র, সৃজনশীল প্রকাশনাসহ শিল্পের সব শাখার ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধন ও চর্চার ক্ষেত্র প্রসারের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো হবে।
* উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে।
* দেশি-বিদেশি বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও সাহিত্য অনুবাদে সহায়তা করা হবে।
* লেখক-শিল্পীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা উৎসাহিত করা হবে।”

জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ হতে পারে না। আর সে-জন্যই তিনি পড়ার অভ্যাসের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘পড়ার অভ্যাস সবার থাকা উচিত। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা যদি শিখায় সেটি ভালো হয়।’
প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে বদলে যাচ্ছে আমাদের চেনা পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে মানুষের যাপিত জীবন। জীবন হয়ে উঠেছে অনেক বেশি গতিময়, বেড়ে গেছে কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা। তাই প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। আর এজন্যই প্রকাশক ও সৃজনশীল লেখক-গবেষকদের বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি অডিও ভার্সন, ডিজিটাল ভার্সন প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এখন প্রকাশকদের শুধু কাগুজে প্রকাশক হলে চলবে না, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে। তাহলে আমরা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব। বিদেশেও পৌঁছাতে পারব। লেখার পাশাপাশি অডিও থাকবে, এমনটাই করা উচিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।’
বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে আমাদের যেমন আহরণ করতে হবে, তেমনি আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যকেও বিশে^র কাছে উপস্থাপন করতে হবে। আর এজন্য তিনি সবাইকে অনুবাদের ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অনুবাদ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্য আছে, অনুবাদ না করলে আমরা কীভাবে জানব? পাশাপাশি আমাদের বইগুলোও বাংলা থেকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী বক্তৃতায় আমরা ইশতেহারের প্রতিফলনই দেখতে পাই। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কীভাবে এদেশের প্রকাশনা শিল্প ভূমিকা রাখতে পারে, তারও একটি দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এখন এই দিক-নির্দেশনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে যদি এদেশের লেখক-প্রকাশকরা এগিয়ে আসেন, তাহলে নিঃসন্দেহে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অন্যতম কারিগর হয়ে উঠবেন তারা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’- এ ৪টি স্তম্ভের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
অমর একুশে বইমেলা যেভাবে এদেশের মানুষের মেধা ও মননের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছে, তেমনিভাবে আগামীতেও স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে কার্যকর অবদান রাখবে। স্মার্ট নাগরিক হতে হলে সবার আগে দরকার মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। আর সেই জ্ঞানচর্চার বাহন যদি হয় মাতৃভাষা, তাহলে সেই জাতিকে কখনোই ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
আর তাই প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করতে চাই- তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে সব থেকে মধুর ভাষা বাংলা। এত চমৎকার ভাষা কোথাও আছে কি না জানি না। হয়তো এটি আমাদের মাতৃভাষা বলে এমনটা মনে হয়।’

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য