ব্রাজিল একসময় পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। স্বাধীনতার পরে এর যে খুব বেশি উন্নতি হয়েছে, তা নয়। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈষম্য, প্রগাঢ় দুর্নীতি, অশান্তি, সমাজবিরোধী এবং মাদকের রমরমা আছে। বিশ্বের কাছে ব্রাজিলের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়।
সাইদ আহমেদ বাবু: আমার লক্ষ্য পূরণ হবে যদি আমার রাজনৈতিক জীবনের শেষে সব ব্রাজিলীয়রা দিনে তিনবেলা খেতে পায়- প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম দিন অফিসে এসেই লুলা দা সিলভা সারাবিশ্বকে তার অভিপ্রায় জানিয়ে দেন। বামপন্থি নেতাকে নিয়ে ব্রাজিলের স্বপ্ন দেখা তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে যায়। তার জীবন কেটেছে সংগ্রাম করেই। তিনি চান দারিদ্র্য দূর করতে, মুদ্রাস্ফীতি রুখতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যনীতির উন্নতি ঘটাতে। ক্ষমতা গ্রহণের পর লুলার প্রতিশ্রুতি তিনি ব্রাজিল থেকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও দুর্নীতি দূর করাসহ ব্রাজিলকে ‘নতুন করে গড়ে তুলবেন, লড়বেন পরিবেশ আর দরিদ্রদের জন্য।’
ব্রাজিল একসময় পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। স্বাধীনতার পরে এর যে খুব বেশি উন্নতি হয়েছে, তা নয়। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈষম্য, প্রগাঢ় দুর্নীতি, অশান্তি, সমাজবিরোধী এবং মাদকের রমরমা আছে। বিশ্বের কাছে ব্রাজিলের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ব্রাজিলের আছে পেলে, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর। ব্রাজিলের যা কিছু উজ্জ্বলতা, তা ফুটবল আর পেলের জন্য।
একজন দক্ষ কর্মী লুলা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। একটি শক্তিশালী ও বৃহত্তর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন লুলা। দলটি ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসে এবং ১২ বছর ক্ষমতাসীন থাকে। দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্র-বিপদ মোকাবিলা করে অনেক জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ব্রাজিলের ২০২২ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে অতি-দক্ষিণপন্থি বলে পরিচিত ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোকে অল্প ব্যবধানে পরাজিত করে ৭৭ বছর বয়সী বর্ষীয়ান বামপন্থি নেতা লুলা দা সিলভা তৃতীয়বারের মতো পুনরায় ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরলেন। যদিও দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান খুবই কম ছিল। প্রকাশিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মোট বৈধ ভোটের ৫০.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন লুলা। অন্যদিকে বলসোনারো পেয়েছেন ৪৯.২ শতাংশ ভোট।
জয়ের খবর আসার পরেই লুলা ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার একটি ছবি টুইট করে লেখেন ‘গণতন্ত্র’। জানান, ‘খণ্ডিত’ ব্রাজিলে ‘শান্তি এবং একতা’ ফিরিয়ে আনা আশু প্রয়োজন। ব্রাজিলের রাজনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী, পরাজিত প্রার্থী তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে তার বক্তব্য প্রকাশ করেন এবং বিজয়ীকে অভিনন্দন জানান। তারপর বিজয়ী প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। কিন্তু রক্ষণশীল বলসোনারো সেটি করেননি। তার দাবি, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কারচুপি করা হয়েছে। পরাজিত প্রার্থী বলসোনারো নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনলেও, তা প্রমাণিত হয়নি। লুলার দাবি, এই ভিত্তিহীন অভিযোগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বলসোনারো তার সমর্থকদের খেপিয়ে তুলেছেন। এছাড়া বলসোনারোর সমর্থকরা নির্বাচনের পর থেকেই ব্রাজিলের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ করে আসছিলেন। এদিকে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
শপথগ্রহণ শুরু হয় ব্রাজিলের সদ্য-প্রয়াত ফুটবল কিংবদন্তি পেলে ও সাবেক পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। লুলার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। লুলা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো দেশটির রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ারে বসলেন। অতি দক্ষিণপন্থি বলসোনারোর সমর্থকরা সেনাশাসন চালুর দাবিতে যেভাবে ভাঙচুর চালাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে- লড়াই কঠিন। সদ্য-সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর আমলে ব্রাজিলে বেড়েছে দারিদ্র্য। মধ্যবিত্তের জীবনে কষ্ট বেড়েছে। সে-সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি। আর সেটিই কাজে লাগিয়েছেন লুলা। লুলার এ ফিরে আসাটা ঐতিহাসিক। ভোটের ফল মেনে নিলেও তিনি নিজ হাতে লুলাকে উত্তরীয় পরাবেন না বলে আগেই জানিয়েছেন। তাই লুলার এবারের শপথ ভিন্নরকম ছিল। লুলা বলেছেন, ব্যক্তিগত ও আদর্শিক কারণে যারা দেশকে পিছিয়ে দিয়েছেন, তাদের ওপর প্রতিহিংসার মনোভাব পোষণ করবেন না তিনি এবং তার প্রশাসন।
গত ৮ জানুয়ারি প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী সহিংস বিক্ষোভে বলসোনারোর সমর্থকরা দেশটির কংগ্রেস, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ এবং সুপ্রিমকোর্টে ব্যাপক হামলা চালায়। সরকারি ভবনে তাণ্ডবে অভিযুক্ত অন্তত ৪০০ জনকে আটক করে পুলিশ। প্রেসিডেন্ট ভবন ও এর আশপাশে পতাকা গায়ে জড়িয়ে অবস্থান নেয় বলসোনারোর অনুসারীরা। ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর হাজার হাজার কট্টরপন্থি সমর্থক লুলার জয় প্রত্যাখ্যান করে। অনেক বিক্ষোভকারী বলসোনারোর পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হয়। তারা চায় প্রেসিডেন্ট লুলা কারাগারে ফেরত যাক। ২০১৭ সালে দুর্নীতির দায়ে ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন লুলা। তারা পুনর্নির্বাচন, এমন কী পরিস্থিতি নিরসনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপেরও দাবি জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত ক্ষোভের এমন বিস্ফোরণ ঘটল। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ব্রাসিলিয়াতে বলসোনারোর সমর্থকদের একটি শিবিরে ভাঙচুর চালান সশস্ত্র কর্মকর্তারা।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের কাছে পরাজিত হন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ট্রাম্প। তিনি সেই নির্বাচনে জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগ করেন। প্রথা ভেঙে তিনি বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন। একইভাবে গত বছরের অক্টোবরে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে অনিয়মের ভিত্তিহীন অভিযোগ করেন বলসোনারো। তিনিও দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে প্রথা ভাঙেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দু-বছর আগে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর তার সমর্থকরা ক্যাপিটলে তাণ্ডব চালিয়েছিল। একই কায়দায় ব্রাজিলের উগ্র-ডানপন্থি সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সমর্থকরা দেশটির কংগ্রেস, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ও সুপ্রিমকোর্টে হামলা চালায়। এ ঘটনাকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হামলার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা ৮ জানুয়ারি ঘটনাটির জন্য বলসোনারোকে দায়ী করে এক ভাষণে বলেছেন, এতে যারাই জড়িত থাকুক, শাস্তি পেতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১ জানুয়ারি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ঘিরে প্রায় ৮ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। হামলার প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট লুলা বলেন, ‘যারা এভাবে ভাঙচুর করেছে, তাদের উগ্রবাদী বলতে পারি। তারা এমন কাজ করেছে, যা আমাদের দেশের ইতিহাসে আগে আর কেউ করেনি। তাদের সবাইকে খুঁজে বের করা হবে। শাস্তি দেওয়া হবে।’
ব্রাজিলের পরাজিত প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর রোলমডেল ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্প যে কাজটি করেছিলেন, বলসোনারোও দেখালেন একই কাজ। কারচুপির অলীক গল্প বলে সমর্থকদের উত্তেজিত করলেন; পরিস্থিতি এমন দিকে নিয়ে গেলেন যাতে করে ক্ষুব্ধ মানুষ যোগ দেয় বিদ্রোহে। ২০২০ সালে পুনর্নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প খোদ মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন; আগামীতে কারচুপি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সমর্থকদের। বলসোনারোও একই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনের আগেই সমর্থকদের সতর্ক করে বলেন, ২০২২ সালের নির্বাচনে তিনি যদি হেরে যান, বুঝতে হবে জালিয়াতি হয়েছে!
বলসোনারো অবশ্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রতি অভিযোগ জানাননি। তার অভিযোগ ছিল নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বিষয়ে। মেশিনগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বিচারপতি আলেহান্ড্রে দি মোরায়েসের নেতৃত্বে সুপিরিয়র ইলেক্টোরাল কোর্ট। এই কোর্টকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বস্তুনিষ্ঠ কোনো অভিযোগ বা প্রমাণ কিছুই ছিল না। লুলা তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের সঙ্গে সহিংসতার ঘটনা নিয়ে বৈঠক করেছেন। ৮ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি আলেকজান্দ্রে দে মোরায়েস ব্রাসিলিয়ার গভর্নরকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য অস্থায়ীভাবে ৯০ দিনের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
লুলার প্রশাসন এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা তদন্ত করে দেখবেন কীভাবে কী ঘটল, কারা জোগালো পরিকল্পনা ও ইন্ধন। বিরোধীদলীয় বহু সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারপতি মোরায়েসকে এরই মধ্যে বসানো হয়েছে গভর্নর রোচার পদে। তবে আগামীতে প্রতিপক্ষের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট লুলা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসে মুসিও এবং আইনমন্ত্রী বিচারপতি ফ্লাভিও দিনো দো’র ওপর। আমরা আশা করব, এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন তারা। নইলে ব্রাজিলের রাজনীতি আবার ‘ফ্যাসিস্ট’-‘কমিউনিস্টে’ ভাগ হয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বলসোনারো হয়তো এই স্বল্প ব্যবধানকে চ্যালেঞ্জ করার পথ বেছে নেবেন। তার ঘনিষ্ঠজনরা পরাজয় মেনে নিলেও এখনও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার ও বলসোনারোর মিত্র আর্তুর লিরা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছার বিরোধিতা করা উচিত না।’ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট লুলা রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করেন। সরকারি আদেশ অনুসারে, এই সময়সীমা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার রাজধানীর সব সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেন, ৮ জানুয়ারির দাঙ্গা দমনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন প্রেসিডেন্ট লুলা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি বলেছেন, তিনি সংবিধানকে মেনে চলবেন এবং রক্ষা করবেন। তিনি ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচাবেন। ১০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলবেন। বর্ণ ও লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে তার সরকার কাজ করবে বলে জানান। লুলার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। কিন্তু ছিলেন না সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। ঐতিহাসিকভাবে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকেন। কিন্তু ব্রাজিলের সেই নীতি ভেঙে ক্ষমতা থাকতে থাকতেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলসোনারো। বর্তমানে তিনি ফ্লোরিডায় আছেন বলে জানা গেছে। অনুষ্ঠানে ছিলেন স্পেনের রাজা এবং জার্মানি, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, চিলি, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে ও পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট। হামলার বিষয়ে বলসোনারো গণমাধ্যমকে জানান, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ গণতন্ত্রের অংশ, তবে এভাবে হামলা করা ও সরকারি ভবনের ক্ষতি ‘সীমা লঙ্ঘনের’ সমতুল্য। বলসোনারোর এই দাবিতে খুব একটা সুবিধা হবে না বলেই ভাবছেন বিশ্লেষকরা। কারণ ইতোমধ্যে লুলার বিজয়কে অনুমোদন দিয়েছে দেশটির নির্বাচনী আদালত (সুপেরিয়র ইলেক্টোরাল কোর্ট বা টিএসই)। একইসঙ্গে দেশটির শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক মিত্ররাও এই ফল মেনে নিয়েছেন। বলসোনারোর দাবির বিপরীতে টিএসই’র নেতা ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারক আলেকজান্দ্রে দে মোরায়েস একটি রুলিং জারি করেছেন। এই রুলিং অনুযায়ী, বলসোনারোর দলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত মাসের ভোটের উভয় রাউন্ডের পূর্ণাঙ্গ অডিট প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে তিনি বলসোনারোর ডানপন্থি জোটের দাবি নাকচ করে দেবেন। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ আসার খবরটি ছড়িয়ে পড়লে ব্রাজিলের মুদ্রার দর পড়ে যায়। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রাজিলের রিলের দাম ১.৩ শতাংশ কমে যায়। লুলার অর্থনৈতিক নীতিমালা ও ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কার কারণে আগে থেকেই ব্রাজিলের মুদ্রা নড়বড়ে অবস্থানে ছিল।
৭৪ বছর বয়সী বামপন্থি নেতা লুলা দা সিলভা ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে জরিপে এগিয়ে ছিলেন তিনি। শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতা লুলা ২০১৭ সালে মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং প্রায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর এ সুযোগেই চার বছর আগে বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে অবশ্য লুলাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২০২১ সালে দেশটির শীর্ষ আদালত তার ওপর আনা অভিযোগ বাতিল করেন। এরপরে আবারও রাজনীতিতে ফেরেন লুলা। নতুন করে তার উত্থান ঘটে ব্রাজিলের রাজনীতিতে। লুলা দা সিলভা নিজের শাসনামলে ব্রাজিলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তার দুই মেয়াদে দেশের লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।
অন্যদিকে, ৬৭ বছর বয়সী বিতর্কিত জইর বলসোনারো সেনাবাহিনীর একজন সাবেক ক্যাপ্টেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ছুরি হামলার শিকার হসেক্সিস্ট (লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকারী), হোমোফোবিক (সমকামীবিরোধী), পরিবেশবাদী অন্দোলনবিরোধী এবং বর্ণবাদী হিসেবে পরিচিত। সেই হামলার ফলে বেশ কয়েকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তার বিরোধীরা একজন অতি-ডানপন্থি স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে। নিজের বিতর্কিত বক্তব্য এবং নীতির জন্য তিনি দেশে-বিদেশে সমালোচিত। মূলত এসব কারণে বলসোনারোর জনপ্রিয়তা ও সমর্থন লুলার চেয়ে কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লুলাও স্বীকার করেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ব্রাজিলের মানুষ ডান-বাম দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তার অন্যতম প্রধান কাজ হবে যতটা সম্ভব এই বিভক্তি দূর করে উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করা। ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশ, বিশ্ব মানচিত্রে যাদের অবস্থান ষষ্ঠ। লুলার দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি যখন ব্রাজিলের গরিব মানুষের জীবন বদলে দিতে শুরু করে, তখনই পশ্চিমা শক্তি তার পথও কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে। নারী-পুরুষের মজুরি সমতা, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য খাত, ডে কেয়ার ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন লুলা। তার এই উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিপক্ষের সন্দেহ ও সমালোচনা থাকলেও সাধারণ মানুষ তার কথায় আস্থা রাখছে।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য লুলার ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তার জনপ্রিয়তা আরও ঊর্ধ্বমুখী করে। কতটা ঊর্ধ্বমুখী করেছিল সেটি বোঝা যায় যখন তিনি ২০১১ সালে অফিস ত্যাগ করেন। তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল ৯০ শতাংশের ওপরে। এ-কারণে লুলাকে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাকে একজন বিশ্বনন্দিত আকর্ষণীয় ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। যাকে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মার্কিন আধিপত্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে লুলা সোচ্চার ছিলেন নিজের রাজনীতির শুরু থেকে। মার্কিনীরাও চুপ করে বসে থাকেনি। তাকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে কঠিন ছকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে। লুলাকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রাজিলের প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের কব্জায় নিয়ে লুলার বিপ্লবাত্মক জনমুখী কর্মসূচিগুলো থামিয়ে দেওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা করতে পারেনি। তিনি রাজনীতির মঞ্চে ফের ফিরে এসেছেন। ভোটের রাজনীতিতে লুলাকে হারিয়ে তার অনুগত শাসককে দিয়ে দেশ চালাবেন; কিন্তু সে-কাজ হবে বড়ই কঠিন। তা বুঝতে পেরেই আইন-আদালতের মারপ্যাঁচে লুলাকে আমৃত্যু জেলে রেখে হত্যার বন্দোবস্ত করে পশ্চিমা শক্তি। কিন্তু এর মধ্যেই ‘অপারেশন কারওয়াশ’ নামে সেই ঘৃণ্য নীল নকশা প্রকাশ হয়ে যায়। প্রমাণ হয়ে যায়, সেটি ছিল মিথ্যা ও সাজানো নাটক। এ-কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
রক্ষণশীল মার্কিনপন্থি শাসক বলসোনারোর আমলে ৩ কোটির বেশি ব্রাজিলবাসী চরম খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে পড়ে। দরিদ্র হন অন্তত ১০ কোটি মানুষ। এ জন্য করোনাকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এসবই বর্তমান শাসকের গরিববিরোধী নীতির ফল। বিশেষত আমাজন বন উজাড়ে তার নীতি বিশ্বজুড়ে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছে। অন্যদিকে লুলা আবারও অঙ্গীকার করেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে দেশে খাদ্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন, লাতিন আমেরিকা আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করবেন, ব্রিক্স দেশের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করবেন এবং বিশ্ব পরিচালনার নতুন কাঠামো গঠনের চেষ্টা করবেন। বলসোনারোর সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করে আসছেন লুলা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফও। এরই মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিয়ে নতুন করে এ মন্তব্য করলেন দেশটির বামপন্থি এই প্রেসিডেন্ট।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ