Thursday, November 30, 2023
বাড়িSliderবীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম

বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম

এই যুদ্ধ, এই সংগ্রাম শুধু পুরুষরা একা করেনি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত তারা নারী। এ সংগ্রাম সফল হয়েছে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

ড. জেবউননেছা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপণ করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার আগুনঝরা ভাষণ সাধারণ মানুষকে বঞ্চনার নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছিল। পাক-হানাদার বাহিনীর ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের গণহত্যা সাধারণ মানুষকে করেছিল আশ্রয়হীন, গৃহহীন এবং শরণার্থী। দীর্ঘ ২৬৬ দিনের যুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবনে ঘটে যাওয়া সব স্মৃতিই এখন একটি করে গল্প। এত এত ইতিহাস, এত এত হত্যা, এত এত পৈশাচিকতা, বর্বরতা কি পাঁচ-দশ পৃষ্ঠা বা কয়েক রাতে গল্প করে শেষ করার মতো? ইতিহাসের পাতা খুললেই ভেসে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা। জেগে ওঠে দেশের মুক্তিকামী মানুষরা। মনের ক্যানভাসে সেসব ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে।
এই যুদ্ধ, এই সংগ্রাম শুধু পুরুষরা একা করেনি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত তারা নারী। এ সংগ্রাম সফল হয়েছে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কেবল অনুপ্রেরণাই নয়, নারীরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণও করেছে। তারা প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে চিকিৎসক, আশ্রয়দাত্রী, শব্দসৈনিক, সুরসৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। নারীদের বিশাল অংশগ্রহণে সম্ভব হয়েছে যুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত নারীরা মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে কাজ করেছে। নিজ উদ্যোগে সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছে। স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। ’৭১-এ সংগ্রামী নারীদের অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করার মতো নয়। নারীদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পেরেছে। ইতিহাসের নানা স্তরে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে গর্বিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিতে বেশকিছু নারী সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ১৪ নারী আইন পরিষদের সদস্য হন। অতঃপর ১৯৬৯-এর ১১-দফা আন্দোলন। সেই আন্দোলনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ এতটাই বেগবান হয়েছিল যে ১৯ মার্চ ছাত্রীমিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে আন্দোলন স্তিমিত করার প্রচেষ্টা চালায়। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। এ নিবন্ধে ১৯৭১ সালে পাঁচ বীর নারী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতির চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো :

সুলতানা কামাল
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল বিশ্রামগঞ্জের সোনামুড়া হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রƒষার কাজ শুরু করেন ক্যাপ্টেন আখতারের সাথে। পরে তার স্ত্রী টুকু তাদের সঙ্গে যোগ দেন। আশ্চর্যের কথা এই যে, তারা কেউই কোনোকালে নার্সিং করেননি। কিন্তু সে-সময় সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী যে কাজে তাদের একত্রিত করেছিল, তার নাম ‘স্বাধীনতা’।
সোনামুড়া ছিল একেবারে সীমান্তে। তাই যুদ্ধে আহত মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা শেলিং-এ আহত গ্রামবাসী অনবরত আসতে থাকত হাসপাতালে। তাছাড়া ম্যালেরিয়া তো ছিলই। কারণ ছেলেরা জঙ্গলে মাচা বেঁধে, পুকুরের পানি খেয়ে যুদ্ধ করেছে। তারা তিনজন সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন সেবা-শুশ্রƒষা করে তাদের সারিয়ে তুলতে। মেলাঘরে টিলার উপর বাঁশের তৈরি ব্যারাকে ছেলেদের ক্যাম্প। কেবল ছাত্রদের নিয়ে ১২টি কোম্পানি। এছাড়া রেগুলার কোম্পানি, এক্সপ্লোসিভ কোম্পানি এবং স্পেশাল কোম্পানি ছিল। সব মিলিয়ে ১৬ প্লাটুন। তাদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার।
বিশ্রামগঞ্জে একটি নতুন হাসপাতাল তৈরি করলে তারা সেখানে একসাথে কাজ করতে শুরু করেন। ৪০টি বিছানা ছিল বাংলাদেশ হাসপাতালে। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি লম্বা একটি ব্যারাকের মতো। সেখানে পরপর ৪০টি বিছানা রোগীদের জন্য। প্রতি ২০টি বিছানার মাঝে অল্প খানিকটা জায়গা ডাক্তার ও নার্সদের বসার জন্য। আবার অন্যদিকে অন্য ২০টি বিছানা। সাথের অন্য একটি ঘরে ছিল অস্ত্রোপচার কক্ষ। এর সঙ্গে লাগানো একটি ঘরে ওষুধপত্র ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি রাখা হতো। সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. মবিন, ডা. সামসুদ্দিন, ডা. নাজিম ও ডা. ফারুক মাহমুদ। এছাড়া কয়েকজন প্যাথলজিস্ট ছিলেন। নার্স ছিলেন পাঁচজন। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী আমাদের হাসপাতাল দেখতে এসেছিলেন। নভেম্বরে যখন ক্রমশ মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাথে একসাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা কার্যকর হতে থাকল, সে-সময় বিশ্রামগঞ্জ ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে যান।

অধ্যাপক মাহফুজা খানম
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মাহফুজা খানম ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৬২-এর হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে সক্রিয় ছাত্র-রাজনীতি ছাত্র-আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) ৬-দফাকে জনতার দাবিতে রূপান্তরিত করার প্রয়াসে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ছাত্রসভা, জনসভা করেন। তিনি ’৬৯, ’৭০-এ গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণের পর সংগঠিত হতে থাকলেন। তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল কমরেড সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের। তিনি যেভাবে নির্দেশ পৌঁছাতেন সেভাবে কাজ করতেন। মূলত কাজ ছিল টাকা তোলা, ওষুধ জোগাড় করা, পুরনো কাপড় সংগ্রহ করা এবং এগুলো যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়া। লেনদেনটি হতো সাধারণত আমার আব্বা মুস্তাফিজুর রহমান খানের জিন্নাহ এভিনিউস্থ বীমা অফিসে শহীদুল্লাহ কায়সারের মারফত। লিফলেট সাইক্লোস্টাইল করে বিলি করতেন অথবা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দিতেন। লিফলেট সাইক্লোস্টাইল করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। সাইক্লোস্টাইল করে দিতেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের বেয়ারা হীরালাল ও গঙ্গা। এছাড়া কখনও কখনও নটর ডেম কলেজ থেকেও সাইক্লোস্টাইল করে আনতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরি থেকে বিভিন্ন সময় প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে আসতেন বেয়ারাদের সহযোগিতায়। এছাড়া অপারেশনে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আহত হলে তাকে নানা জায়গায় রেখে ডাক্তার এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। সে-সময় অনেক ডাক্তারই তাদের সাহায্য করতে। এলিফ্যান্ট রোডের পলি ক্লিনিকের ডা. আজিজুর রহমান ও তার স্ত্রী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সাহায্য করতেন, অপারেশন করতেন। এসব আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আবার ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে রাখা বা স্থানান্তরিত করতে হতো নানা কৌশলের মাধ্যমে। এক বাড়িতে বেশিদিন রাখা যেত না। বিভিন্ন সময় নির্দেশমাফিক অস্ত্র বহন করে জায়গামতো পৌঁছে দিতেন। এসব অস্ত্র সাধারণত বাজারের চটের থলির নিচে রেখে উপরে বাজার নিয়ে যেতেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসহ নির্দেশমাফিক নিজের বাড়ি, আত্মীয়দের বাড়ি, রাজনৈতিক সহকর্মীদের বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশমতো তাদের চলাচলের ব্যবস্থা করতেন রেকির মাধ্যমে। ওপারের চিঠিপত্র বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন নির্দেশমতো ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে একটি অপারেশন করেন তার আপন ছোট দুই ভাইসহ। পরে অবশ্য তার দুই ভাই ধরা পড়ে। এলিফ্যান্ট রোডে তার মেজোবোনের বাড়ির সামনে থাকতেন জাহানারা ইমাম (পরবর্তীতে শহিদ জননী)। জাহানারা ইমাম তার বড়বোনের সহপাঠী ছিলেন। মে/জুন মাসের কোনো একসময় উনার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। জাহানারা ইমামের সঙ্গে সে-সময় বিভিন্ন কাজ করেছেন তার নির্দেশমতো। ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক শাহাদাতের ছোটভাই ফাত্তাহ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সময় টাকা, ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে যেতেন। পুরো ৯ মাস তার পুরানা পল্টনের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয়দের থাকা-খাওয়ার অবাধ ব্যবস্থা ছিল।

লায়লা হাসান
১৯৭১-এ অসহযোগ আন্দোলনের প্রারম্ভে লায়লা হাসানের স্বামী সৈয়দ হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠিত হয়। তিনিও শিল্পীদের সেই সংগ্রামে যুক্ত হন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে প্রাবন্ধিক এবং রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ছায়নট-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হক, অধ্যাপক সন্জিদা খাতুন, তার তিন সন্তান ও তরুণ কাশিনাথ (বর্তমানে অধ্যাপক) বোরখা পরে দুরুদুরু বক্ষে তারা পাড়ি দিলেন অজানা অনিশ্চিতের পথে। রিকশা, নৌকা, বাস ইত্যাদিতে পার হয়ে একসময় কুমিল্লায় পৌঁছান। রাতে এক সহৃদয় ব্যক্তি তাদের আশ্রয় দেন। পথের ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত তারা নিমিষেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়েন। পরদিন তারা আবার যাত্রা করে পাকিস্তান ও ভারতের মাঝামাঝি ভূখণ্ডে আশ্রয় নেন আগরতলা শরণার্থী শিবিরে, যেটি একটি স্কুল বা কলেজ। আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে দুর্বিষহ তিন-চার দিন যাত্রা করে বাসে ও ট্রেনে কাটিয়েছেন।
কলকাতায় ঠাঁই পান মামাশ্বশুর অ্যাডভোকেট সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহর বাড়িতে। যেখানে হাসান ইমামসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী অনেকে প্রাথমিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। অতঃপর দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেন। দেশবাসী যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নাটক করেছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন, বেতারে ও শিবিরে গিয়ে। তাদের একটি সংগঠন ছিল যার মূল দায়িত্বে ছিলেন সর্বজনাব ওয়াহিদুল হক, সন্জিদা খাতুন, মোস্তফা মনোয়ার, শাহরীয়ার কবীর, সৈয়দ হাসান ইমামসহ অনেকে। আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রয়াত দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। সংগীত, নাট্য, আবৃত্তি শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য আলেখ্যানুষ্ঠান পরিবেশন করতেন। আলেখ্যানুষ্ঠানের মূল বিষয়টি ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও নিরীহ বাঙালিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কাহিনি।

কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা
কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জ্বর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর ছেলেদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে নারীরা প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ডামি (কাঠের) রাইফেল দিয়ে প্রতিদিন সকালে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে একটি ছাত্র ব্রিগেড গড়ে তোলা হয়। ব্রিগেড পরিচালনায় রোকেয়া সুলতানা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি ২৫ মার্চ পর্যন্ত ৪০-৪৫টি মহল্লায় রোকেয়া সুলতানার নেতৃত্বে মেয়েরা কমিটি গঠন করেন। ২৫ মার্চের পর তাকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার ওপারে, ঢাকা সদরের নবাবগঞ্জ-দোহার এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে থাকতে হয়েছে। পালিয়ে থাকা অবস্থায়ও স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করেছেন। জুলাই মাসের প্রথমদিকে ঢাকা থেকে ছয় দিনে ৫২ মাইল হাঁটার পরে মাগুরা ও যশোর হয়ে ভারতে পৌঁছান। এরপর বনগাঁ ক্যাম্পে দায়িত্ব পান বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে বক্তৃতা প্রদান করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার। তার মূল দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক মোটিভেশন, তরুণদের ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্য বাছাই করা। তখন কিছুদিন বনগাঁ, কিছুদিন কলকাতা- এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পে বক্তৃতা করেন। কলকাতার সল্টলেকে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ শরণার্থী পরিবারকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তার চেষ্টা করতেন। এ-কাজে সে সময়ে মূলত তৎকালীন কংগ্রেস ও সিপিআই সংগঠনের নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলো বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল। তাদের সাথে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন। প্রখ্যাত বিপ্লবী ইলামিত্রের নেতৃত্বে এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরীর সহযোগিতায় রাজনৈতিক মোটিভেশনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। ২৭ নভেম্বর তিনি এবং আরও কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধা যশোর ও খুলনা সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে টানা সাত দিন সভা করে বক্তৃতা দিয়ে ৩ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে কলকাতা ফিরেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের দিন ৪০টি গাড়ি একইসাথে যশোর রওনা দেয় সকাল ১০টার দিকে। তিনি ঐ দলে ছিলেন। ২০ জানুয়ারি ১৯৭২, ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় তিনি যোগ দেন। ১৯৭২ সালে ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে কাজী রোকেয়া সুলতানা ভিপি নির্বাচিত হন।

আশালতা বৈদ্য
বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্য ১৯৬৮ সালে জীবনের প্রথম মিছিলে অংশগ্রহণ করেন কোটালীপাড়া থানা হেডকোয়ার্টারে প্রথম পদার্পণ করেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেন। ১৯৭১-এ ঢাকা থেকে কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হন। তার বাবার কাছে তারা দাবি করেন, একজন যোদ্ধা দিতে হবে, সে ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক। তার বাবা দুঃখের সাথে জানালেন তার তো কোনো বড়ছেলে নেই যে যুদ্ধে যাবে। কিন্তু পাশ থেকে দৃঢ়তার সাথে জানান, তিনি যুদ্ধে যাবেন। উপস্থিত সবাই তার কথা শুনে বিমূঢ়। এটুকু বয়সে আবার মেয়ে হয়ে এত সাহস আর শক্তি! খুশিতে উচ্ছ্বসিত কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন, ‘এই তো চাই, এভাবেই সংগঠিত হবে যোদ্ধা, আসবে দেশের মুক্তি।’ মেয়ের এত আগ্রহ দেখে তার বাবাও আর আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন, ‘ও নিজে থেকে যুদ্ধে যেতে চাইলে আমি অবশ্যই বাধা দেব না, দেশের জন্য ওকে আমি উৎসর্গ করলাম।’
পরদিন থেকে তিনি যোদ্ধা সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন। হেমায়েত উদ্দিনের দলবলও বাড়ি বাড়ি ঘুরে যোদ্ধা সংগ্রহ করলেন প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৪৫ জন মেয়েযোদ্ধার নাম লেখা হয়ে গেল। তাদের অনেকে তার সমবয়সী এবং একই স্কুলে পড়াশোনা করতেন, আবার অনেকে বেশ বড়। কেউ কেউ আবার বাইরে থেকেও এসেছেন। শুরু হলো প্রশিক্ষণ। দুটি ক্যাম্পে ছেলে আর মেয়ে যোদ্ধাদের আলাদা করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। ক্যাম্প দুটি হলো- জহরের কান্দি হাইস্কুল আর লেবুবাড়ি প্রাইমারি স্কুল।
ফরিদপুর এলাকার কমান্ডার বাবুল আকতার লেবুবাড়ি প্রাইমারি স্কুলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। বিশেষ করে গেরিলা আক্রমণ, পাক-আর্মিদের প্রতিহত করা, যুদ্ধের এসব গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশলগুলোতে তার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রশিক্ষক বাবুল আকতার এবং হেমায়েত উদ্দিনকে মুগ্ধ করেছিল। প্রশিক্ষণ শেষে অন্যদের চেয়ে অনেক কম বয়সী হওয়া সত্ত্বেও তিনিই পেয়েছিলেন নেতৃত্ব এবং তিনি তার প্রশিক্ষক বাবুল আকতারের কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন একটি পিস্তল এবং দলনেতা হওয়ার সুবাদে পেয়েছিলেন অস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। প্রশিক্ষণ শেষে দেখা যায়, প্রায় ৩০০ মেয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছে। কিন্তু মোট ৪৫ জন মেয়ে প্রশিক্ষণের পুরোটা ভালোভাবে রপ্ত করেছে। সে-কারণে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরো দলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। দলগুলো : ফাস্ট এইড গ্রুপ, সরাসরি অস্ত্র হাতে যোদ্ধা, গোপন তথ্য সরবরাহকারী, খাদ্য সংগ্রহকারী এবং বিচার বিভাগে অংশগ্রহণকারী দল। সবগুলো দলের টিম লিডার এবং কমান্ডার হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রাখলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক কিছু দপ্তর ছিল। প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর মধ্যে আইন বিভাগীয় দপ্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বিভাগে সবাইকে নেওয়া হয় না। বিশেষ করে মেয়েদের কিন্তু তিনি প্রায় জোর করেই এই বিভাগে বিচারক হিসেবে নিজের জায়গা করে নিলেন। এই বিচারকরা পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরদের বিচার করত। যুদ্ধের সেই ৯ মাসের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দলবল নিয়ে। সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অনেকবার। ঘাগরবাজার, কলাবাড়ি, পয়সারহাট, রামশীল, বাঁশবাড়িয়া এবং যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ ছিল পয়সারহাট ও রামশীল এলাকায়। এই যুদ্ধে প্রচুর রাজাকার আর পাকসেনা মারা যায় এবং কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন মারাত্মকভাবে আহত হন। এভাবে একে একে ৯ মাস অস্ত্র নিয়ে এদিক-সেদিক বনবাদাড় পেরিয়ে তিনি শত্রু নিধন করেন।
১৯৭১ সালে নারীরা প্রণোদক, পরামর্শক, নিয়ন্ত্রক, সংগঠক, সাংস্কৃতিক প্রণোদক, প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী, সশস্ত্র যোদ্ধা, বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সরবরাহ, বার্তাবাহক, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, বস্ত্র, ওষুধ, তহবিল সংগ্রাহক, খাদ্য ও আশ্রয়দাত্রী হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। কোনোভাবে ’৭১-এ নারীর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি এত অল্প পরিসরে শেষ করতে চাওয়া দুঃসাধ্য বিষয়। সমাজের সব স্তরে নারীদের ’৭১-এর নারীর ভূমিকা জানা প্রয়োজন। নিবন্ধ শেষে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেসব বীর নারী যোদ্ধাকে, যারা প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধকে সফল করেছেন। ভক্তিভরে স্মরণ করি সেসব নারীকে, যারা সম্ভ্রম হারিয়েছে। দেশের স্বাধীন পতাকার জন্য রক্ত ঝরিয়েছে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি লাখো শহিদের মায়েদের। যেভাবে ’৭১-এ নারীরা নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায়, নিরলস প্রচেষ্টায় তাদের সেসব দুঃসহ দিন অতিক্রান্ত করেছে, ঠিক সেভাবে আমাদের নারীসমাজ এগিয়ে যাবে এবং পৌঁছাতে সক্ষম হবে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে। বিজয়ের মাসে নারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই সালাম এবং লাল সবুজ পতাকার শুভেচ্ছা।

লেখক : অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধগঠিত হলো জলবায়ু ঝুঁকি তহবিল
পরবর্তী নিবন্ধরণাঙ্গনের ডায়েরি
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য