- আনিস রহমান
ঝুপ! ঝুপ! ঝুপ!- কুয়োর ভেতর বেশ কবার শব্দ ওঠে। পোড়ো কুয়ো। আশপাশে বুনো ঝোপঝাড় ছাপিয়ে কেবল শান বাঁধানো মুখ উঁচিয়ে আছে। ভেতরে ঘোলা জল। সঙ্গে পুরু শ্যাওলার মিশেল। কুয়োর ভেতর চোখ ফেললে আঁশটে কেমন গন্ধ এসে ঠেকে নাকে। পাড়ার দুষ্টরা খেলার ছলে কুয়োর চাতাল মাড়ায় কখনও-সখনও। এছাড়া ওদিকটায় কারও পা-ই পড়ে না বলতে গেলে। অথচ সে কুয়োতলায় শব্দ! অর্থি খিড়কি খুলে তাকায় বাইরে। কুয়ো লাগোয়া দেয়াল। দেয়ালের ওপাশেই চারতলা বাড়ি। এ পাড়ায় একমাত্র চারতলা বাড়ি। বোম্বায়াদের বাড়ি ওটা। ওবাড়ি থেকে আধলা ইট ছুড়ে মারছে এক ছেলে। লাগাতার। ছেলেটা ও বাড়িতেই ফাইফরমাশ খাটে মেলাদিন ধরে।
ও ইট ছুড়েই যাচ্ছে। কোনোটা সান বাঁধানো পাড়ে ঠোকর খেয়ে এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়ছে। কোনোটা আবার সিধে কুয়োর জলে। তখন শব্দ ওঠে। ঝুপ ঝুপ।
অর্থির দৃষ্টি উত্তুরে দেয়ালে। কালচিটে পড়া দেয়াল। কোথাও শ্যাওলার পুরু ছোপ। তাই ব্রাশ ঘষে চুন দিয়ে- সাদা করা হয়েছে দেয়ালের অনেকটা জুড়ে। সাদা রং ছাপিয়ে অনেকগুলো স্লোগান মূর্ত হয়ে উঠেছে অক্ষরে অক্ষরে। ছাত্রলীগের ১১-দফা। আওয়ামী লীগের ৬-দফা দাবি মানার কথা লেখা আছে ওতে। আরও আছে লেখা জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। অর্থি অপলকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে দেয়াল লিখনের দিকে। বারবার পড়ে যায় দেয়াল লিখন। পাড়ার রাজনীতিকরা অনেকদিন হলো এ চিকা মেরেছে দেয়ালে। অথচ লেখাগুলোর ওপর এখন ব্রাশের টানা আঁচড়। হয়তো মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছিল কেউ। স্লোগানগুলো যখুনি পড়েছে অর্থি কেমন যেন দোলা লেগেছে মনে। এবার অর্থি চোখ ফেরায় ছেলেটির দিকে। অবাক চোখে দেখে যায় ওর কাণ্ড। অর্থিকে দেখে ছেলেটির ইচ্ছের পলতে কে যেন আরও খানিকটা উসকে দিল ভেতর থেকে। আরও দ্রুত ঢিল ছুড়তে থাকে ও। ঢিল ছোড়ে, আবার তাকায় অর্থির দিকে। আবার ঢিল। সে-সঙ্গে হাসি। আর বলছে, ইহা পার সব বাঙালি এক এক কোরে পাকরেঙ্গে, মারেঙ্গে, ফের কুয়ে মে ফ্যাক দেঙ্গে।
একরত্তি ছেলের কথা শুনে অর্থি অবাক মানে। মুখে কোনো রা সরে না। বিড়বিড় করে কেবল বলে, ছেলেটার সাহস কত! কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না ওকে। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি ঢোলক বাজে যেন।
অর্থিরা শশি মোহন বসাক স্ট্রিটের এ বাড়িতে এসেছে প্রায় দুবছর হবে। আগে ছিল মালিবাগে। এরও আগে মহাখালি। সরকারি কলোনিতে।
এ পাড়ায় এসে প্রথম চোটেই বেশ হোঁচট খায় অর্থি। বাঙালি পরিবার হাতে গোনা কটি। বাকি সব বিহারি উর্দুভাষী। অর্থি আসা অবধি খেয়াল করেছে বিহারিরা বাঙালিদের সঙ্গে পারতপক্ষে মেশে না। আর কথা বললেও কটাক্ষের তেতো সুর কণ্ঠে। কখনও ধমকের সুরেও কথা বলে। কিন্তু ওই বোম্বাইয়া পরিবারের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক অনেকটা আত্মীয়ের মতোই। এ ওর বাড়ি যাচ্ছে। আসছে। ভালো কিছু হলে পাঠাচ্ছে ট্রে সাজিয়ে। অথচ ও বাড়ির ছেলের মুখে আজ এ কী শুনছে!
শত বিরোধ থাকলেও এমন স্পর্ধা নিয়ে কখনও কথা বলেনি কেউ। অন্তত অর্থির মনে পড়ছে না। অর্থি প্রমাদ গোণে। ওর মনে হয় কোথাও বেসুরো কিছু বাজছে।
অর্থিদের বাড়ি যেন কোনো পোড়ো জমিদার বাড়ি। এল প্যাটার্নের আদল। বাড়ির সামনে খোলা মাঠ। মাঠের উত্তরেই বোম্বাইয়াদের হোল্ডিং। রাস্তার পাশেই। ওদিকে রাস্তাজুড়ে ঢাউস এক নৌকো। বাঁশের তৈরি। মানিকগঞ্জ থেকে ছৈয়াল এনে বানানো হয়েছে। ভারী দৃষ্টিকাড়া হয়েছে নৌকোটি। অর্থিদের মাঠেই তৈরি হয়েছে এটি। টানা পনেরো দিন, রাতে দিনে খেটেখুটে তবে শেষ হয়েছে কাজ। এ এলাকা থেকে শেখ মুজিব নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল বলে লোকের উৎসাহের কমতি ছিল না। তাই নৌকোটি রাস্তাজুড়ে টাঙ্গিয়েই শুরু হয়েছিল নির্বাচনী প্রচার। জুতসই একটা নৌকো গড়বে এমন পণ করেই সবাই নেমেছিল কাজে। বজরা নৌকো যেন। অথচ ছেলেটি দেয়ালের ওপর বসে বসে নৌকোর গায়ে সাঁটা পোস্টার ছিঁড়ছে টেনে টেনে। নানা ছাদের পোস্টার। তাতে শেখ মুজিবের ছবি। একসময় নৌকোর বৈঠা ধরে হ্যাঁচড়-পাঁচড় করল খানিকক্ষণ। তারপর দেয়াল টপকে ভেতর বাড়ি। খানিকবাদে ফিরে এলো হ্যারিকেন হাতে। দেয়াল বেয়ে উপরে উঠল। বৈঠার মাথায় ঝুলিয়ে দিল হ্যারিকেনটা, দোল দিল খানিক। তারপর হাসি। রাজ্যির হাসি যেন ওর চোখে-মুখে।
ছেলেটির কা- এতক্ষণ সেলুনে বসে দেখছিল পাঁচু মুন্সি। পাড়ার মসজিদের মোয়াজ্জিন। পান চিবুচ্ছিল জুত করে। মুখের চিপটি পাশের ড্রেনে ঢেলে দিয়ে গদগদ হয়ে বলে, ‘আরে ও আব্বাসÑ তুম বহুত আচ্ছা কাম দেখা দিয়া, তোমারে হ্যারিকেনম্যা তেল হ্যায়? তো নৌকা ম্যা ঢালদো। অর একঠো ম্যাচিসকা তিলকা মারদো।’ বলেই হো হো করে হেসে ওঠে পাঁচু মুন্সি। সঙ্গে রামা গু-া, নইম পালোয়ানসহ আরও কজন। পাঁচু মুন্সি আরও খানিক সময় ফ্যাঁচর ফ্যাঁচর করে মসজিদের দিকে পা বাড়াল। তোম কাঁহা জারা পাঁচু ভাই। গদ গদ সুরে প্রশ্ন করে টেডি হাজী। আবি চাল জারা। আজানকা টাইম হো জায়া। কণ্ঠে আনন্দের ঢেউ।
নির্বাচন হয়ে গেছে দুমাসের ওপর। শেখ মুজিব জিতেছে। জিতেছে তার দল। তাই নৌকোটারও যতœ-আত্তির কমতি নেই। নৌকোর গায়ে একটুও আঁচড় পড়তে দেয়নি কেউ। অথচ সে নৌকো নিয়ে এমন ত্যাঁদড়ামো দেখে অর্থি যেন শূন্যে দোল খেতে থাকে। তখুনি গেটের ছোট পাল্লা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে বাবা। পেছনে মুটে। তাও দুজন। মাথায় ঝাঁকা ভরতি আনাজ পাতি, মাছ। অন্যাটায় মুদি বাজার।
বাবাকে সব খুলে বলে অর্থি। বাবা ঘামে ভেজা গেঞ্জি উঠোনের তারে মেলে দিতে দিতে শোনে। খানিক সময় চুপ থেকে বলে তুই শুনিসনি, অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দিয়েছে ইয়াহিয়া। আজ শুরু হবার কথা ছিল। তাই নিয়ে হয়তো ফুর্তি-টুর্তি একটু করছে। বলেই চুপ মেরে থাকল কিছুক্ষণ। আজ কার্ফু জারি হতে পারে। রাস্তায় আর্মি নেমেছে। লোকজন অফিস ছেড়ে সব বাজারমুখো হচ্ছে। আমিও হপ্তা খানেকের বাজার করে এনেছি। বাইরে যাসনে আজ। বাজে কিছু ঘটতে পারে।
বেলা তখন তিনটে হবে। দরজায় প্রচণ্ড জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। অর্থি এবং বাবা দুজনেই এলো দরজার কাছে। আনমনে খানিক সময় কী যেন ভাবে। শেষে দরজা খুলে দাঁড়ায়। বাচ্চু দাঁড়িয়ে। বাচ্চু গুণ্ডা নামেই চেনে লোকে। ও যদি ইচ্ছে করে তবে যে কাউকে মানুষের বিষ্টা পর্যন্ত খাইয়ে ছাড়ে। ডাকাবুকো লোক। ওকে দেখেই অর্থির বুক কেঁপে ওঠে যেন। তবে বাবা স্বাভাবিক। পাশের হোল্ডিংয়ে কোনো বাড়িঘর হয়নি। বস্তিজুড়ে আছে। এ বাস্তির-মালিক-সর্দার সবই বাচ্চু গুণ্ডা। ওর চেহারা এমনিতেই রুখু। তার ওপর এখন আরও গম্ভীর মনে হচ্ছে। ঘরে ঢুকেই বাচ্চু বলে রহমান ভাই আপকা সাথ মেরা কুচ প্রাইভেট বাত হ্যায়।- প্রাইভেট বাত? বলুন!
বাচ্চু অর্থির দিকে তাকায়।
কহিয়ে কেয়া বাত হ্যায়? ব্যাটা তুম উস রুমমে চলা যাও। হাম তোমারি আব্বাসে বাত করেঙ্গে। তোমার আব্বুকা সাথ থোরা বাত হ্যাঁয়। অর্থি ধীরপায়ে চলে আসে।
বাচ্চু মুখ সরিয়ে আনে বাবার কানের কাছে। ‘সব বাঙালিকে ঘরকা না লিস্ট হো গিয়া। আজ রাতমে হামলোক বাঙালিকো ঘরমে হামলা কারেঙ্গে। বাঙালিকো মার দেঙ্গে। হামলোক হুকুম পায়ে। ইসলিয়ে আপলোককা ইহা রহেনা সহি নেহি হ্যায়। আপলোক ইসকে আগেই চলে যাইয়ে। আজ রাতমে হামলা হোগা। সব প্রোগ্রাম ঠিক হো গিয়া। আবি স্রেফ কাম করনা হ্যায়।’ বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়ল বাচ্চু। দরজার কাছে গিয়ে নিচুস্বরে আবার বলল, ‘ভাই হাম আপসে বহুত মহব্বত করতে হ্যায়। ইসলিয়ে হাম আপসে এহি বাত ছুপা নেহি সাকতে হ্যায়। মেরে রেহেতেওয়ে আপকা কই লোকসান হোক হাম চাতে নেহি।’
বিকালের আগেই চারদিক থেকে ঢিল এসে পড়তে থাকে অর্থিদের বাড়ির আঙিনায়। আঙিনা ছাড়িয়ে পেছনে মেলা খোলা জায়গা। চারদিকে সুড়কির ঢিবি। তবে মাঝে মাঝে বুনো ঝোপঝাড়। বাবা গলা বাড়িয়ে ধমক দিল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। উল্টো দশ কথা শুনিয়ে দিল চ্যাংড়া ছেলেপুলেরা। একইভাবে ঢিল দিল ডাক্তার হকের বাড়িতে। কাজীদের বাসায়। হান্নান উকিলের মেয়ের কপাল কেটে গেছে দু-ইঞ্চির মতো। অমূল্য নাগের টি স্টলে বয়াম ভেঙেছে গোটা চারেক। অর্থিদের বাড়ি অনেক বড় আর খোলামেলা বলে ওরা সবাই একে একে এসে ভিড় করে। অর্থির বাবার সঙ্গে ওরাও গলা মেলায়। কিন্তু ছেলেগুলো বেপরোয়া। বরং এবার কেবল ঢিল নয়। গ্ল্যাক্সো, অস্টারমিল্কের ডিব্বায় কেরোসিন ভরে তাতে আগুন দিয়ে ছুড়ে মারতে থাকে। তখন অন্ধকার ঘনিয়ে। তার মধ্যে আগুনের হল্কা। গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে। শঙ্কিত হয়ে সবাই ঘরে চলে আসে। এরই মধ্যে অন্ধকার আরও খানিকটা ঘনিয়ে আসে। তখুনি নারায়ে তাকবির শব্দে প্রকম্পিত হলো পুরো পাড়া। অর্থিদের বাসায় যারা জড়ো হয়েছে, সবার কপালে পুরু ভাঁজ। ঝুপ করে আলোও নিভে যায়। পাড়াজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। গাজী জহির তেতো গলায় বলে, এটাও মাওরা শালাদেরই কাজ। ডাক্তার বলল, ওদের ব্লু প্রিন্ট অনুযায়ীই হচ্ছে সব। রহমান, লোহানী ওরা গলা খাঁদে নামিয়ে বলে, গোপন খবর পেয়েছি। ওরা আজ রাতে সবকটি বাঙালি বাড়িতে আগুন দেবে। নারায়ণ বলে, দাদার বাসা রোডের ওপরেই। তার ওপর একতলা বাড়ি। এখানে নিরাপত্তা কম। ডাক্তার ওর সঙ্গে একমত। ঠিকই বলেছে নারায়ণ, বরং আমাদের বাড়ি দোতলা ছিল। গলির ভেতরেও। কিন্তু রাস্তা পার হব কেমন করে? এ কথায় সবাই চুপ মেরে যায়। কপালের ভাঁজ আরও পুরু হয়। নারায়ণ বলে আমি একটু দেখে আসি রাস্তায় ওরা আছে না-কি। অর্থিও লাফিয়ে ওঠে, বলে, কাকু আমিও যাব। বাবার সাবধানী কণ্ঠ, বাড়ির বাইরে যেও না। অর্থি নিষেধ মানল না। খানিকবাদে ওরা ফিরে আসে। খবর হচ্ছে, নাজ লন্ড্রির ওখানে। ওদিকে মসজিদের সামনেও একদল লোক। ওরা জড়ো হয়ে নর্তন-কুর্দন করছে। হাতে রামদা তলোয়ার, বন্দুক। বেরোলেই নজরে পড়ে যাবার শঙ্কা। সবাই যার যার বাড়ির জন্য ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়ে। অর্থি জানালো, আবুলদের বাড়ির সামনে পেল্লায় একটা হ্যারিকেন ঝুলিয়ে রেখেছে। মুর্শিদাবাদ বাড়ি ওদের। সাতচল্লিশের পর ঢাকায় এসেছে মুসলিম লীগের চ্যালা। এমনি উঠ-বস। ঘর-বার করে করে আরও ঘণ্টা দু’ কেটে গেল। হঠাৎ গেটে কড়া নাড়ার শব্দ। সবাই চমকে ওঠে। ফেঁসো গলায় রহমান, কে? আমি পিন্টু। নারায়ণ কাকুর খোঁজ পাচ্ছি না। জলদি দরজা খোলো। ওকে দেখে একরাশ বিস্ময় মেশা প্রশ্ন সবার, কেমন করে এলে? এ বাড়ির ছাদ, ও বাড়ির দেয়াল টপকে তবে এসেছি। লাভলু দা’কে না-কি স্টেপ করেছে গুণ্ডারা। হাসপাতালে নিয়ে গেছে কোনোরকম। পান্না কাকু মসজিদ থেকে বেরিয়েছে মাত্র। ইউনুসদের বাসার ইকবাল না-কি পাশের সেলুন থেকে ক্ষুর নিয়ে ওর পিঠে, পেটে, হাতে বেশ কটি পোঁছ দিয়ে দিয়েছে। কাকুর সারাশরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।
তুই এত কিছু দেখলি কোত্থেকেরে পিন্টু? অর্থি মার কথায় খলবলিয়ে ওঠে। আমি ফিরোজাদের বাড়ির সিঁড়িঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলাম সব।
এখন রাস্তার অবস্থা কেমন দেখলি?
এদিকটায় এখন গু-ারা নেই। মশাল হাতে উত্তরে গেছে এক দঙ্গল। সবার হাতে কিরিচ, রামদা, বন্দুক। কালো ফতুয়া আর কালো হাফপ্যান্ট পরা সবারই। মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। ভয়াবহ দৃশ্য।
ডাক্তার অধৈর্য হয়ে বলে, এবার বলো- রাস্তা পার হয়ে আমাদের গলিতে ঢুকতে পারব কি-না?
পিন্টু বলে এখুনি সুযোগ। যা করার এখুনি করতে হবে।
সবাই ঝটপট তৈরি হয়ে নেয়। হাতে হাতে এ ঘর-ও ঘর বন্ধ করে সবাই। এদিকে অর্থির ছোটটা পৃথুর দুদিন ধরে বমি আর পায়খানা। ডাক্তার-কাজী ওকে কোলে তুলে নেয় হ্যাঁচকা টানে। নিসর্গকে নেয় বাবা। অর্থি ওর মায়ের হাত চেপে ধরে পায়ে পায়ে মেইন গেটের কাছে আসে। গেইটের ছোট ডালা আস্তে করে খুলে মাথা বাইরে গলিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকায় পিন্টু। পেছনে ডাক্তার। ওরা ইশারায় ডাকে সবাইকে। পেছন পেছন সবাই আসে। পুরো এক দঙ্গল মানুষ রাস্তাজুড়ে। এদিক-ওদিক তাকায় ওরা। বেশ কটা বাড়ির বারান্দায় হ্যারিকেন ঝুলছে। জ্বলন্ত। প্রমাণ করতে চাইছে ওরা মুসলিম লীগের সমর্থক।
পায়ে পায়ে কিছু পথ পেরোতেই নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর বলে চার-পাঁচজন কালো মুখোশধারী চলে আসে ওদের সামনে। রামদা উঁচু করে ঘাড়ে বসিয়ে দেবে শুধু। হঠাৎ একজন মুখের নেকাব খুলে ফেলে- ‘আরে রহমান ভাই!’ ‘ওরা চেয়ে দেখে বাচ্চু গু-া।’ ইতনে রাত মে আপ কিঁউ হায় ইয়া পার। ইহা পার খতরা হায়। আপ চলে যাইয়ে। হামতো আপকে খবর দিয়া। আপ বহুত রিস্ক লে লিয়ে ভাইয়া? আপকা আনা সহি নেই হুয়া। বলেই কোমর থেকে টর্চ বের করে বারকয়েক বটম টেপে। ঝিলিক ঝিলিক আলো জ্বলে ওঠে। ‘আপ সব লোক কাহা যারা হ্যায়?’
এই গলির ভেতর। রহমানের সংশয় মেশা উত্তর।
বাচ্চু টর্চের আলো ফেলে গলির ভেতর অনেকটা পথ এগিয়ে দেয় ওদের। ফেরার পথে রহমানের কানে কানে বলে, ‘বাঙালিকে চার পাঁচ ঘরমে আগ লাগায়া গিয়া হ্যায়। অর আজ রাত মে প্রোগ্রাম হাম বহুত সে ঘরমে আগলাগানেকে লিয়ে হ্যায়। তো হাম আপকো জবান দিয়া হ্যায়, হাম আপকা ঘর জড়–র দেখেঙ্গে। হাম বিহারি হ্যায়Ñ আপ বাঙালি হ্যায়Ñ মাগার ইয়ে বলনা গুনাহ হোগা হামার এ্যা মজব মে নেহি হ্যায়। কিউক্যা আপ মেরে সাত মেরে পরসমে বহুত দিনকে র্যাহেনি ওয়ালে হ্যায়। মানাকে হাম বস্তিমে র্যাহেতে হ্যায়, ভাই তুম মেরে ওপ্পর ভরসা রাখো।’ পিঠে দুটো চাপড় দিয়ে আবার কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে দ্রুত মেইন রোডে ছুটে যায় বাচ্চু গুণ্ডা।
গলিটা সামনে গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। ওরা ওখানটায় যেতেই ভারী গলার শব্দ, ‘ভাই তোমলোক কোন হো? ইদার কাঁহা জারেহো তুমলোক?’ কেউ কোনো উত্তর না দিয়ে ধুড়মুড় করে পা বাড়ায় সামনের দিকে। এক এক করে মুখগুলো দেখছিল হাওয়ালদার। আরে আপতো রহমান ভাই হ্যায় না? এদিকে কোথায় যাচ্ছ?
হাওয়ালদার ভাই হ্যায়?
কাম সে আরা হ্যায়। কারেন্ট নেহি। ইসিলিয়ে হাম হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পিনকে হাওয়া মে বাইঠে হুয়ে হ্যায়। আপ ইহা কিউ আয়া হ্যায়?
নিরাপদ কোথাও যাব বলে! রহমানের সংশয় মেশা কণ্ঠ।
আপ পাগল হায় না কিয়া। আপ মেরে ঘর আইয়ে। কই বাৎ নেহি। আপলোক আইয়ে। বলেই ভেতর নিয়ে গেল অর্থিদের। অন্যরা চলে গেল। ওদের অনেকেরই বাসা এদিকে। অন্যরা ছাদ বেয়েও যেতে পারবে পেছনের লেনে।
ছোট্ট মতো একটা ঘরে ওদের বসতে দিল। মাল-পত্তর আর কাপড়ে ঠাসা। তার ওপর অন্ধকার। মুহূর্তে হাঁপিয়ে ওঠে ওরা। অর্থির মায়ের বুক ঢিপঢিপ করছে। মুখ কাছে এনে বলে, বিহারিদের ঘরে আসাটা কী ঠিক হলো! অর্থির বাবা ঘামছে। হাওয়ালদার স্টিলের আলমারি থেকে বন্দুক বের করে! খানিক সময় নাড়াচাড়া করে বন্দুক সাফ করতে করতে হাওয়ালদার বলে, ‘আজ জুলুসমে (মিছিল) গুলি চালা হ্যায়। মেরা ডিউটি ফার্ম গেটমে থা। বহুলোক মারা হ্যায়। কেয়া করেঙ্গে। হামলোক তো নকরি করতে হ্যায়। হুকুম মাননা মেরা কাম হ্যায়। লেকিন ইয়াহিয়াকো চাহিয়ে শেখ মুজিবকো হুকুমত দেদেনা চাহিয়ে। ইসিলিয়ে শেখ মুজিব বহুত জাদা ভোট পায়া- বলেই বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সাতচল্লিশ সাল মে সেপারেশনকা বাদ হিন্দুস্তান ছোড়কে আইয়ে। ইহা আগার কুচহো তো কাহা যাওঙ্গা?’ বলেই তাড়া লাগায় জলদি করে খাবার দেয়ার জন্যে।
হাওয়ালদার সাব যা বলছে, মন থেকে বলছে?
কী জানি। ভনিতা না তো! উত্তেজিত কণ্ঠ অর্থির মায়ের। হয়তো ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার গু-াদের হাতে তুলে দেয় কি না!
অতটা নেমক হারামি করবে না। ওকে চিনি অনেকদিন ধরে। কণ্ঠে আস্থা বাবার।
অন্ধকার ঘর। ওরা কজন। বড় করে নিঃশ্বাসের শব্দ। মাঝে মাঝে ওদের সামনে দিয়ে হাওয়ালদারের হাঁটাহাঁটি। ভাই হাম আপনে বিবি অর দোনো লাড়কিকো ভেজা দিয়া মোহাম্মদপুর উসকে মামাকা ঘরমে। হাম সারাদিন তো নকরি করতে হ্যায়। কিস টাইম কেয়া প্রবলেম হোগা ইশিলিয়ে হামনে ভেজা দিয়া।
এবার গলার সুর কিছুটা তরল হয়ে আসে রহমানের। দুঃখের সঙ্গে যেন হাসি পায় ওর। আপনাদের আবার বিপদ কী, বিপদ তো আমাদেরÑ বাঙালিদের।
‘লেকিন মুল্ক তো বাঙালিকা হ্যায়।’
অর্থির মা ভেতরে ভেতরে অস্থির। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। মাঝে মাঝে চাপাগলায় বলছে তোমাকে কতবার বললাম এ পাড়ায় আসার দরকার নেই। কতবার বারণ করলাম। বাবা বারণ করল। নুরুদা বলল, এখানে সব বিহারিদের আড্ডা। সব জেনে-শুনে তারপরও এসেছো এখানে! আসলে মরণ আমাদের ডেকে এনেছে এ পাড়ায়।
অর্থির বাবা ভ্রু কোঁচকায়। কথা বলে না।
রহমান যখন পুরনো ঢাকায় বাড়ি কেনার মতলব করছে, তখুনি আত্মীয়-স্বজন কেউ সাঁয় দেয়নি। পাড়াটা অবাঙালিদের দখলে বলে। বাঙালিদের নিরাপত্তা নেই বললে চলে। বিহারি বাঙালির গ-গোল ফি সময় লেগেই আছে। ছুতোনাতা অজুহাতে সব বিহারি একাট্টা যখন-তখন। মারমুখো হয়ে তেড়ে আসে বাঙালিদের দিকে। এমনি এন্তার কথা শুনেছে নূরুর কাছ থেকে। ওর কেমনতর এক আত্মীয় আছেন এ পাড়ায়। সেই সুবাদে অনেকদিন থেকে আসা-যাওয়া ওর।
অর্থিরা যেদিন প্রথম এলো এ পাড়ায়, সেদিনই বুঝল নূরুর কথা হাড়ে হাড়ে সত্যি। একরত্তি মিশেল নেই মিথ্যের।
সব কটি বাড়ির গেটে ছালার চট ঝুলছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জলের ট্যাপ। তাতে লম্বা কিউ। ঢাউস বালতি, গামলা, ডেক্চি নিয়ে সবার অপেক্ষা। এর মধ্যে পান থেকে চুন খসার জোটি নেই। প্রথমে ঠোঁটে ঠোঁটে, তারপর হাতে হাতে শেষে বালতি ডেকচি দিয়েই আঘাতের চেষ্টা। সে সঙ্গে কথার তুবড়ি, খিস্তি খেউড় তো আছেই। আর বিষয়টি যদি হয় বাঙালি-অবাঙালিতে তবে তো রক্তারক্তি অবস্থা। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তখন। বাঙালি ঘর হাতেগোনা। ওদের মধ্যে আবার বড় একটা অংশ এসেছে ওপার বাংলা থেকে। ল্যান্ড এক্সচেঞ্জ করে। ওদের বেশির ভাগই যেন বাঙালি সত্তা খুইয়েছে দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে খাঁটি পাকিস্তানি ঠাওরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা অহরহই। অবাঙালিদের চেয়ে এক কাঠি বেশি পাকিস্তানি সাজবার চেষ্টা অনেকেরই। পেছনের স্মৃতিগুলো হুড়মুড় করে অর্থির মায়ের মাথায় জেঁকে বসে।
অর্থিরা এ পাড়ায় এসেছে ঊনসত্তরের শেষাশেষি। অর্থির বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরুবার পর। তার আগে ওরা থাকত মালিবাগে। তার কদিন আগেই মোহাম্মদপুর মিরপুরে বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা হয়। তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার নানা জায়গায়। সে-সময় অনেক বাঙালি মারা যায় বিহারি তল্লাটে। ওদের বাসার সিধে পুবে ছিল ঢাউশ পুকুর। তার পাশেই বাসস্ট্যান্ড। এদিকটায় বাঙালিদের জোর। বাঙালিরা এক জোট হয়ে বাস থেকে অবাঙালিদের নামিয়ে আনছে। আর খান ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে পুকুরের জলে ছুড়ে মারছে। কী ভয়াবহ সে দৃশ্য! মনে হলে এখনও কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ে। আমাদেরও তেমন কিছু হবে না তো? অর্থির মায়ের কণ্ঠে কান্নার দশা।
অত ভেঙে পড়ো না।
আমাদের আসলে ডাকতার কাকুদের বাসায় যাওয়াই ঠিক ছিল। আরও অনেকে আছে। শলা-পরামর্শ করে কিছু একটা করা যেত। এখন একা একা বেঘোরে প্রাণ যাবে আর কী? উনি বললেন আর বাবাও সুড়–ৎ করে ঢুকে পড়লেন! অন্যরা ভাববে কী?
বাবা আড়চোখে তাকায় অর্থির দিকে। চোখে বিরক্তি।
বাবা খানিক সময় ঝিম মেরে থেকে গলা খাকারি দেয়Ñ
হাওয়ালদার সাব
শব্দ নেই।
হাওয়ালদার ভাইÑ
নিঝঝুম!
ভাইয়া, ভাইয়াÑ
খটখট শব্দ
ওরা চুপ। চোখাচোখি।
খানিক বাদে হাওয়ালদারের কণ্ঠ- মুচকো বলিয়ে রহমান ভাই? আন্দেরে মে নজর নেহি আরা হ্যায়।
ভাই আপকো সাথ থোরা বাৎ হ্যায়। অর্থির বাবার করুণ কণ্ঠ।
বকরি বনকে হাম আরে হ্যায়। ওরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। অন্য কোথাও চলে যেতে চাইলে এবার হাওয়ালদার আর বাদসাধে না। আগে আগে টর্চ জ্বেলে ওদের পথ করে দেয়, ডাক্তার সাহেব ক্যা ঘরমে যাউঙ্গে তো? সিধা যা কে ডাইনে হাত মে ঘর হ্যায়।
আমি চিনি ভাইয়া। আমাদের জন্যে আপনার আবার কোনো তকলিফ হোক চাই না, তাই ওদের ওখানেই যাচ্ছি।
‘ঠিক হ্যায় ভাই ঠিক হ্যায়। আজ কালকা দিন বহুত খারাপ হ্যায়। জিত নেই জাননেওয়ালা হোক, ভরসা নেহি কিয়া যায়েগা। কিসমত খারাপ হ্যায়। হাম টর্চলাইট হাত মে লিয়ে হ্যায়। আপলোক আগে চলিয়ে। বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হাওয়ালদার।
ওরা এগোয়।
আলো এগোয়।
শেষে আলো ফিরে যায় আবার হাওয়ালদারের ঘরে।
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ডাক্তারের বাড়ি অবধি যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন ওরা। অর্থি শার্ট খুলে ফুঁ-ফা দিয়ে ঘাম তাড়াবার চেষ্টা। বাবা শরীর কেচে ঘাম নামাচ্ছে রুমালে। মা কপাল চেপে বসে থাকে ঢের সময় ধরে। তাই দেখে অর্থি কাছে গেলÑ অসুবিধে হচ্ছে মা? একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ে, কিচ্ছু না। কিন্তু ওর সারামুখ ঘামে ভিজে জবজবে। চোখ লালচে। অর্থি পাখা এনে জোরসে বাতাস চালায়- মা যেন টাল রাখতে পারছে না। ডাক্তার কাজী চটজলদি এসে পালস্ দেখে। চোখ। শেষে প্রেসারটা মেপে নিলেন ঝটপট। মানসিক খুব ধকল গেছে, একটু ঘুমোতে পারলেই ঠিক হয়ে যাবে। শেষে রহমানের দিকে তাকিয়ে খানিক শ্লেষের সুরে বলল, যেখানে বিহারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঘর ছেড়ে বেরুলেন, অথচ মাঝপথে সেই বিহারিদের ঘরেই ঢুকে পড়লেন সুড়সুড় করে, আমাদের কোনো জানান না দিয়েই!
এ কথায় রহমান কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। হ্যারিকেনের আলোয় ওর লাজরাঙা মুখ এড়ায় না অর্থির। শেষে মুখে খানিক হাসি টেনে ফেঁসোগলায় বলে, কী মনে করে যে ঢুকে পড়লাম বুঝতে পারছি না। গিয়ে বুঝলাম এভাবে আপনাদের ছেড়ে আসাটা উচিত হয়নি। সেই থেকে ফাঁক খুঁজছিলাম কোনো অজুহাতে বেরিয়ে আসার জন্যে। আপনার ভাবী আসলে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। বলে খানিকটা শুকনো হাসি ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা মুখে। অমনি নারায়ে তাকবির, আল্লাহ আকবর চকিত ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে নীরবতা। ঝটপট জানালা-দরজা লাগিয়ে সবাই উন্মুখ চোখে তাকিয়ে থাকে গলির দিকে। আড়পাতে। কোন দিকে রে?
মনে হচ্ছে গ্যারেজের ওদিকে-
গলিতে ঢুকে পড়েনি তো!
তেমন তো মনে হচ্ছে না।
অন্ধকারে সবাই জানালা ঘেঁষে তাকিয়ে। কে প্রশ্ন করছে, আর কে উত্তর দিচ্ছে বোঝার উপায় নেই। আনমনে বলে যাচ্ছে যেন কেউ। ধারা বর্ণনার মতো উত্তর দিয়ে যাচ্ছে অন্য কেউ।
খানিক বাদে আগুনের ক-ুলি লতিয়ে ওঠে ঠাটারি বাজারের মোড়ে। হায় হায় গুঞ্জন ওঠে। সবাই দুদ্দাড় করে পশ্চিমের জানালায় ভিড় জমায়, খানিক ইতিউতি তাকিয়ে কে যেন বলে, নিত্যলালের দোকানে কিংবা পাশের কালীমন্দিরে আগুন দিয়েছে।
ওদিকে একসার বাঙালির ঘর আছে। তার ওপর একেবারে মেইন রোডের ধারে। বুদ্ধি করে সরে পড়েছে কি না কে জানে?
সরবার উপায় কোথায়? আমরা কেউ কি ঘুণাক্ষরে জানতাম আজ সন্ধায় এমন তা-ব ঘটবে। আজ কদিন ধরেই তো থমথমে সবকিছু। তার মানে যে জ্বালাও পোড়াও আর খুনোখুনি শুরু হয়ে যাবে তা কে জানত। হঠাৎ সাপের জিভের মতো লকলকে আলো আশপাশে অনেক কটি বাড়ি, কার্নিশ, ঝুলবারান্দা, জানালা চেটে যায়। সবাই শুয়ে পড়ে তখন ফ্লোরে। দুদ্দাড় শব্দ। তারপর নিঝঝুম। কেবল অনেকগুলো মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুত ওঠা নামার শব্দ। যেন কোনো অজগর ফুঁসছে অন্ধকারে। অমনি দক্ষিণ কোণ থেকে বাঁচাও, বাঁচাও, মেরে ফেলল বাচ্চাদের কান্না। মেয়েদেরও গলা ওপরে। চিৎকার! শুধু বাঁচার তাড়না!
সবার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ এখন যেন দ্রিমিদ্রিমি বাজছে। এরই খানিক বাদে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, তোমার নেতা আমার নেতাÑ শেখ মুজিবÑ শেখ মুজিব। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। এমনি নানা সেøাগানে মুখর হয়ে ওঠে পূর্বপাড়ার পুবে কোথাও। সমীর আর পিন্টু পেছনের ঝুলবারান্দায় আসে হামাগুড়ি দিয়ে। খানিক মাথা উঁচিয়ে, আড় পাতে, হাটখোলা-টিকাটুলির দিকেই-
দোদুল, উৎকণ্ঠিত। ধারে-কাছে কোথাও!
না দাদা, ওদিকে হাটখোলাতেই! খানিক উত্তেজিত হয়ে ওঠে জহুর হক। গবেটগুলো শুধু ওদিক স্লোগান দিচ্ছে, এদিকে মানুষ বাঁচলো কি মরলো কোনো খোঁজ নিতে পারে না?
ওদিকটায় বাঙালি পাড়া বেশি। তাই সবাই একজোট হয়ে মিছিল করছে। মনে বল জোগাচ্ছে। আমরা তো বিহারিদের দুর্গে আছি। এ দিককার পুরো এলাকাটা তো বিহারিদের। কয়েক ঘর বাঙালি আমরা হাতে গুনেই বলা যায়। একটু ভারী অথচ ধীরলয়ে কথাগুলো আওড়ায় কাজী। শেষে ওর উৎকণ্ঠা আর চেপে রাখতে পারে না, প্রকাশ পায় পুরোপুরি। আমাদের এখানে থাকাটা বোধহয় আর ঠিক হচ্ছে না। রাতটা কোনোরকম কাটিয়ে অন্ধকার থাকতে থাকতেই এ পাড়া ছাড়তে হবে।
কোথায় যাব ছেলেপুলে নিয়ে? বিষণœ গলা অধীর ঘোষের!
ডাক্তার এবার চটে ওঠে। কিন্তু গলা থাকে খাঁদে। এর জন্যে দিল্লি বিলেত যেতে হবে না। কোনোরকম হামা দিয়ে রেললাইন পেরোতে পারলেই বুঝবেন- এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। ও দিকটায় বাঙালিদের জোর। দেখছেন না কেমন স্লোগান দিচ্ছে, শুনলেই বুকটা বড় হয়ে যায় স্টেডিয়ামের মতো। ওর কথায় মৃদু হাসি ওঠে ঘরজুড়ে।
দীপকদের বাসা পাশের লেনে। ঘুরপথে যেতে হয়। আবার এদিক দিয়ে দেয়াল টপকে দু-বাড়ি পেরোলেই ওদের বাড়ি। গভীর রাতে ও আবার এলো। উৎকণ্ঠিত গলায় ডেকে ওঠে, কাকা বাবু, কাকা বাবু রেললাইন পেরোতে পারলেই হলো, ওপাশে বাঙালিরা আছে দলে দলে। যারা যাচ্ছেÑ সঙ্গে সঙ্গে স্কর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ঝুট-ঝামেলা সবই সামাল দিচ্ছে ওরা। সবাই উদার মনে গ্রহণ করছে সবাইকে। মানুষের মনটা যে কত বড়, এখন না দেখলে বোঝা যায় না। কথা বলতে বলতে ওর চোখে জল চলে আসে। হাটখোলায় পিসিমাদের বাসায় ফোন করেই এতসব জানলাম। তোদের বাসার ফোন কাজ করছে রে দীপক?Ñ জী কাকু।
আমাদেরটা তো কমপ্লিটলি ডেথ। বলেই আবার রিসিভার তুলে নিয়ে খানিকক্ষণ খটরমটর করলেন ডাক্তার কাজী।
শেষমেশ ঠিক হয় অর্থিরা দীপকের পিসিমাদের ওখানেই যাবে। দীপকদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ওদের। হাটখোলায় বিরাট বাড়ি ওদের। রুম গুণে শেষ করা যাবে না। অথচ মানুষ সাকুল্যে চারজন। আর ঠিকে-বাধা ঝি মিলে সাতজন। পিসিমাদের সঙ্গে অর্থিদের আসা যাওয়াও আছে। ঈদে, পুজোয় এ ওর বাড়ি নিমন্ত্রণ খেয়েছে কতবার। সেদিক থেকে ওখানে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্য পেল অর্থির মা। আর সবচে স্বস্তি হচ্ছে দীপকদের বাসার সবাই ওখানে যাচ্ছে। দীপকদের বাড়ির সঙ্গে অর্থিদের দুধ-চিনি সম্পর্ক। সুতরাং সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করে নেয় ওরা। রাত ফুরোবে ফুরোবে তখন গিয়ে পৌঁছল হাটখোলায়, দীপকের পিসির বাড়ি। অর্থির মা ওদের জন্যে বরাদ্দ ঘরেই ঝিম মেরে বসে থাকে। কখনও ঘর থেকে বেরিয়ে বড়জোর সামনের বারান্দা। কখনও সিঁড়ি ভেঙে বাগানে। অফুরন্ত অবসর। হাত নিশপিস করে। সময় কাটে না। দিনভর ছিল কত ব্যস্ততা। অথচ এখন হাত-পা ঝাড়া। কখনও কখনও দারুণ বিষণœ লাগে। বাড়ির কথা মনে হয়।
এক সকালে পিসিমা ঘরে আসে, বৌদি সারাক্ষণ একা একা, আমি তো রান্নাঘরেই ব্যস্ত। আসুন, ওদিকে আসুন আমার কাজও হবে, আপনার সঙ্গে কথাও হবে। মা যায়। রান্নাঘরের সামনে আনাজ, শাক, মাছের স্তূপ। দীপকদা’র মা কুটনো বাছায় হাত লাগাচ্ছে। অর্থির মায়ের হাত নিশপিস করে। ইচ্ছে করে, আনাজটা কেটে দেয়। বাটনাটা বেটে দেয়। কিন্তু আবার ভাবে, ভিন্ন ধর্মের ছোঁয়া কী ওরা খাবে? নিজেকে গুটিয়ে নেয় পরোক্ষণেই। ওদিকে পিসি খুন্তিতে মাখা ঝোল চেখে লবণ দেখতে দেখতে ভাবে, বৌদিকে দেব না-কি শাকগুলো কুটে-বেছে দিতে। সময়ও কাটবে। মনও ভালো থাকবে। আবার তখুনি ভাবনাটুকু গুটিয়ে নেয়, ভাববে বিপদে পড়ে দুদিনের জন্যে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ কাজ করিয়ে নিচ্ছে।
একদিন এমনি কাজের ভিড়ে, পিসি ছুটছে এদিক-ওদিক। উদাস চোখে মা বাইরে তাকিয়ে। পিসি হোঁচট খায়। শেষে কাছে এসে বলে, বৌদির বুঝি বাড়ির কথা মনে পড়ছে? নিন সবজিগুলো কেটে আমাকে একটু হালকা করুন। আপনার মন দেখবেন দিব্যি ভালো হয়ে গেছে। বলেই কলকল করে হেসে ওঠে পিসি। মাও খলবল করে কুটা-বাছায় হাত লাগায়। ডাঙার মাছ যেন জল পেল। মায়ের মুখে হাসি। পিসিরও। সময়টা সুন্দর কাটছে যেন এবার।
অর্থিরা এখানে আছে বলে ফি দিনই বাবা রাতে এসে দেখা করে যায়। সঙ্গে এক ঝুড়ি বাজার বিশেষ করে মুরগি আনলে পিসি বলে, দাদা, আপনাদের ধর্ম মতো কেটে দিয়ে যান। বাবা বলে কোনো অসুবিধে নেই। আপনারাই কেটে নেবেন আপনাদের মতো। এ নিয়ে এ ওকে ঠেলে। আর হাসির রোল পড়ে যায় ঘরজুড়ে। বিশেষ করে খাবার সময় দারুণ আনন্দ লাগে অর্থির। পিন্টু দা, সমীর দা, খোকন কাকু, পিসেমশায় সবাই মিলে বারান্দার লাইন ধরে খেতে বসে। কখনও বাবাও আসে। তখন আরও মজা হয়।
এক রাতে অর্থি ওর মায়ের কাছে এসে বসে। ওর চোখে-মুখে হাসি জড়িয়ে বলে, মা দেখেছ এখন টগর পিসি আমাদের সঙ্গে বসে খাচ্ছে। অথচ ওদের বাসায় একদিন খাবার ঘরে ঢুকে পড়েছি। টগর পিসি ছুচি ছুচি বলে থালার সব ভাত ফেলে দিল উঠোনের এক কোণে।
মা বলল, আমরাও তো ওদের কাটা মুরগি খাচ্ছি। ওরা তো ধড় থেকে মাথা একেবারে দু-টুকরো করে ফেলে। সবই আসলে আমাদের মন থেকে তৈরি। পথের যেমনি সরু গলি আছে, মনেরও তেমনি আছে অলিগলি সরু পথ। ওখানকার ভাবনাগুলোই যত অনর্থ ঘটায়। সংকীর্ণতায় ঢেকে থাকে। ওসব ছাইপাস মনে ঠাঁই না দিলেই তো মন কত বড় হয়ে যায়। ভাবনাগুলো সব সুন্দর হয়ে ওঠে। আসলে আমরা অকারণে এ ওকে দূরে ঠেলে দেই। কাছাকাছি হই না কখনও। তাই তো যত অঘটন ঘটে। যত অনর্থের সৃষ্টি হয়। আর সবটাতে দোহাই দেই ধর্মের। অর্থি জানালা গলে বাইরে তাকায়। হাসনাহেনার গন্ধ বাতাসে। এক থোক সর্বজায়া দুলছে বাতাসে। ওদিকে তাকিয়ে আনমনা অর্থি। অস্ফুটে বলে ও, মা সব সময় যদি এমন থাকত!
কী এমনি যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব? দাঙ্গা-মারামারি!
না, এই যে আমরা একসঙ্গে খাচ্ছি। ছুঁচি বলে খাবার ফেলে দিচ্ছি না! দূরত্ব তৈরি করছি না পরস্পরের মধ্যে!
মা অর্থির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলকে। মনে হয় অর্থি নয়, অনেক দূর থেকে কেউ কথা বলছে! খানিক বাদে মা বলে, আসলে যে কোনো সংকটই বোধহয় মানুষের মনকে অনেক বড় করে তোলে। অনেক উদার।
সে থেকে অর্থির কানে শুধু বেজে যায়… উ… দার… দার… দার!
লেখক : গল্পকার