Friday, September 22, 2023

বঙ্গবন্ধুর খুনির স্বীকারোক্তি

দর্পণ কবীর :

প্রশ্ন নয়, যেন মহাকালের স্রোতে আটকে থাকা অন্ধকারের জগদ্দল পাথর সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে এসেই পড়ল। প্রশ্নটা কঠিন নয়, তবে প্রশ্নটার জবাব দিতে গেলে একতাল গভীর অনুরাগ, চাপাকান্না, ক্ষোভ-ক্রোধ, ঘৃণা দলা পাকিয়ে মনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এমন প্রশ্ন শুনলে পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। আমি যেই পাল্টা প্রশ্ন করতে যাব, ফোনের ও-প্রান্ত থেকে অভিজ্ঞ আইনজীবী খান সাইফুর রহমানের কণ্ঠ ফের শোনা গেল।
‘কী ভাবছেন, দর্পণ কবীর? প্রশ্নটার জবাব দিন। খুব সংক্ষেপে বলবেন। আমি আবারও বলছি, কাল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। আমরা ও আপনারা অনেকগুলো মাস এই মামলার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনার কী মনে হয়, রায় কী হতে পারে?’
আমার মনে তখন সু-করুণ সুর বইতে শুরু করেছে বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও জঘন্য হত্যকা- নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে বলে। ঠিক কথা নয়, আমার মতামত জানতে চাইছেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আইনজীবী খান সাইফুর রহমান। মামলার চূড়ান্ত শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। এই শুনানির দিন সরকার পক্ষের প্রবীণ আইনজীবী অহিদুল হক আইনের ধারার উল্লেখ, যুক্তির শাণিত কথা ও ভাষা প্রয়োগে সাহিত্যের পেলম মেশানো বক্তব্য রেখেছিলেন আদালতে। তার বক্তব্য বুকে বিঁধে আরও রক্তাক্ত হয়েছে অনুভূতি। অনুভবে এই রক্তস্রোত প্রবলভাবে যখন বইছিল, ঠিক তখন খান সাইফুর রহমান জানতে চাইলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল ও নারকীয় খুনের তা-বে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেমন রায় আশা করছি। আমি নিজেকে সংযত করে প্রশ্নের জবাবে বললাম,
‘আমি মনে করি প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তাদের মৃত্যুদ- আশা করছি। এমন রায় হওয়া উচিত।’
আমার জবাবে খান সাইফুর রহমান সন্তুষ্ট হতে পারলেন না বলে মনে হচ্ছিল। যদিও আমি তার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে অনুমান করছিলাম, তার কপালে ক’টি বলিরেখা পড়েছে। খান সাইফুর রহমান অস্বস্তির কণ্ঠে ফের প্রশ্ন করলেন,
‘আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে? আসামিরা এই খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তা কি প্রমাণিত হয়েছে?’
জবাবে আমি একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলি,
‘বলেন কী! আদালতে ভিডিও প্রদর্শন হলে আমরা দেখেছি যে, এই নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়ে লন্ডনে গিয়ে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক নিজেরা সাক্ষাৎকার দিয়ে এই হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেছে। এরা তো আত্মস্বীকৃত খুনি? এর চেয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ আর কী চাই? আপনার কী মনে হয়, বলুন তো?’
আমার উত্তেজনা ও চাপারাগ হয়তো টের পান খান সাইফুর রহমান। তিনি বলেন,
‘যদি রায়ে তাদের ফাঁসি হয়, তাহলে উচ্চ আদালতে এই আসামিরা রেহাই পাবেন বলে আমি মনে করি।’
‘আগে দেখুন কাল রায়ে কী দ- ঘোষিত হয়!’
আমার এ-কথায় তিনি বলেন,
‘যারা এই মামলা দীর্ঘদিন কভার করেছেন, আমি তাদের মতামত নিচ্ছি আজ। তাই আপনাকে ফোন করেছি। আপনাদের মতামতও এক ধরনের রায়। কিছু মনে করবেন না।’
‘না, ঠিক আছে। মনে করার কী আছে? আপনি আইনজীবী হিসেবে যা করার, করবেন।’
শুভাশিস জানিয়ে ফোন রেখে দিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আইনজীবী খান সাইফুর রহমান। এরপর আমার চিন্তার মধ্যে আদালতের নানা ঘটনা পেখম ছড়াতে লাগল।
১৯৯৯ সালের ঘটনা। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকাজ চলছিল বিশেষ এক আদালতে। এই আদালতের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হতো পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত একটি ভবনে। আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে ভবনটিতে রোববার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল অবধি বিচারকাজ হতো। ছোট্ট কক্ষে এই বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছিল বলে স্বল্পসংখ্যক আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকতেন। আসামিদের বসতে দেওয়া হতো সাংবাদিকদের পাশে। বিশেষ আদালত হলেও কক্ষের উপস্থিতি ছিল আসামি, আইনজীবী, সাংবাদিক ও পুলিশে ঠাসা। জুডিসিয়াল বিশেষ বিচারক গোলাম রসুল যখন বিচারকাজে বসতেন তখন আদালত কক্ষে সুনশান নীরবতা নেমে আসত। বিচারক গোলাম রসুল বিচারকাজের সময়ে কারও কথা বলা বা ফিসফিস বরদাশত করতেন না। এমন কী আদালতের বিচারকাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরঞ্জিত কথা বা ভুল ব্যাখ্যার পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো রিপোর্টেরও ছাড় দিতেন না। তিনি নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়তেন এবং কোনো পত্রিকায় ভুল বা অতিরঞ্জিত কথা প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করতেন আদালত কক্ষে। এ-ধরনের রিপোর্ট আদালত অবমাননার শামিল বলে মামলাটি পরিচালনা সম্পন্ন হওয়া অবধি বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আদালতে ‘ক্ষমা চেয়ে’ রেহাই পান। বিচারিক কাজে গোলাম রসুল ছিলেন কঠোর ও ন্যায় পরায়ণ। তাকে আমরা খুব সমীহ ও শ্রদ্ধা করতাম। দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিশেষ আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিতাম। আদালতের গুরু-গম্ভীর কাজের বিপরীতে ছিল ঘনঘন সংক্ষিপ্ত বিরতি, যা ছিল এক পশলা স্বস্তির মতো। বিচারক গোলাম রসুল ঘনঘন ধূমপান করতেন বলে প্রতিদিন বিরতিও ছিল ঘনঘন। এই বিরতিকালে আমরা সাংবাদিকরাও গল্প করতাম। আমি চোখ বুলিয়ে নিতাম খুনিদের মুখায়ব। লক্ষ করেছি, খুনিরা সব সময় থাকত নির্বিকার, ভাবলেশহীন। আদালতে সাংবাদিকদের বসার স্থান অনেকটা নির্ধারিত ছিল। আমি যে চেয়ারটায় বসতাম, এর পাশে বসতো খুনি কর্নেল শাহারিয়ার। তার পাশে আরেক খুনি মেজর ফারুক। তার পেছনে বসতো তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আমি সময় পেলে খুনিদের দিকে চেয়ে থাকতাম। পর্যবেক্ষণ করতাম। লক্ষ করে দেখেছি, মেজর ফারুক সব সময় চুপচাপ ও নির্লিপ্ত থাকত। তাহের ঠাকুরের চোখে-মুখে ভয় ও আশঙ্কার মেঘ জমে থাকত। কর্নেল শাহারিয়ারের আচরণ ছিল একটু চঞ্চল টাইপের। সে কথা বলতে চাইতেন। আমি একটা সময় তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। মনের ভেতর সত্য অনুসন্ধানের আগ্রহ তো ছিল। চা-বিরতির সময়ে আমি কথা বলতাম কর্নেল শাহারিয়ারের সঙ্গে। প্রথম-প্রথম আলোচনা ছিল কুশলবিনিময়ের। এরপর আমি কথা নিয়ে যাই ১৫ আগস্টের কাপুরুষোচিত হত্যাকা-ের দিকে। বিভিন্ন দিন, বিভিন্নভাবে একই প্রশ্ন করতাম। একই ঘটনার কথা অন্যদিনও অন্যভাবে করতাম। উদ্দেশ্য ছিল- যা আগে বলেছিল, তা পরেও ঠিক বলছে কি না। তথ্য যাচাই করে নেওয়ার মতো করে প্রশ্ন করতাম। এসব কথা হতো সংক্ষিপ্ত চা-বিরতির সময়ে। অনেক সময় জবাবটা সম্পূর্ণ হতো না, পরের চা-বিরতিতে শেষ হতো। কর্নেল শাহারিয়ারের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর নিয়মিতভাবে চলতে থাকে। একদিন কর্নেল শাহরিয়ারকে প্রশ্ন করলাম,
‘আচ্ছা, এমন এক ভয়াবহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন? কেন এমন কাজ করেছেন? আপনার কি এর জন্য অপরাধবোধ লাগে না?’
জবাবে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছিলেন। আমি আবারও প্রশ্নটা করলে সে পরে বলেছিলেন,
‘আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে তাকে গ্রেফতার করা হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে সেদিন রাতে অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু অপারেশনে গিয়ে সবকিছু পাল্টে যায়। আমাদের যদি কেউ বলতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে, তাহলে একজন সৈনিকও এই অপারেশনে অংশ নিত না- বলে আমি মনে করি।’
একই প্রশ্ন একাধিক দিন চা-বিরতির সময়ে নানাভাবে উত্থাপন করেছিলাম। জবাবটা একইরকম পেয়েছি। ফের প্রশ্ন করেছিলাম,
‘তাহলে হত্যাকাণ্ডের খবর কে কে জানতো বা কাদের পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় আপনার?’
এর জবাবে কর্নেল শাহারিয়ার বলেছিলেন,
‘সঠিক জানি না। তবে শাহারিয়ার, ফারুক তো নিশ্চয়ই জানত! আবার এমন হতে পারে, আমাদের অপারেশনে নামিয়ে দিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে!’
‘যারাই জানত বা যারা জানত না, এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের দায় তো এড়াতে পারেন না। আপনি নিজেও সরাসরি অংশ নিয়েছেন এই অপারেশনে। সেনা আইনে বিচার হলে তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পেতেন না। মৃত্যুদ- কার্যকর হতো, কী বলেন?’
আমার এ প্রশ্নে কর্নেল শাহারিয়ার নিচু গলায় আমার কাছে জানতে চায়,
‘আপনার কী মনে হয়? আমাদের ফাঁসি হবে?’
‘হুম।’
জবাব দিই। সে বলে,
‘আমারও তাই মনে হয়। আবার সরকার বদলে গেলে ফাঁসির রায় কার্যকর হবে না। আমরা মুক্ত হয়ে যাব।’
‘মুক্ত হয়ে গেলে কী করবেন? কাউকে আবার খুন করবেন?’
জানতে চাইলে সে নিচু গলায় বলে,
‘না। এবার মুক্ত হলে পত্রিকা বের করব।’
‘কেন? পত্রিকা বের করার কথা ভাবছেন কেন?’
‘পত্রিকা বের করলে অনেক কিছু করা যায়। অনেক কথা বলা যাবে। যা সাধারণ মানুষ জানে না। আপনি আমার পত্রিকায় কাজ করবেন?’
জানতে চাইলে আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলি,
‘না। আমি খুনিদের পত্রিকায় কাজ করব না। আমার বিবেক দংশন করবে।’
‘কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত যে আমি খুন করেছি?’
প্রশ্ন করে কর্নেল শাহারিয়ার। আমি বলি,
‘আদালতে মামলা চলছে। মামলার রায়ে যদি আপনি রেহাই পান, সে অন্যকথা। প্রতিদিন যা দেখছি এবং যা শুনছি মামলার কার্যক্রমে, এতে মনে হচ্ছেÑ এই জঘন্য হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু কথা বলছেন, মনে হচ্ছে আপনি কতটা সরল প্রাণের মানুষ যেন!’
কর্নেল শাহারিয়ার চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর থেকে কর্নেল শাহরিয়ার আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না। আমিও ভাব জমানোর চেষ্টা করিনি। মামলার চূড়ান্ত শুনানির দিন সরকারি আইনজীবী অহিদুল হক যে বক্তব্য রাখেন, তখন আদালত কক্ষে এক ধরনের বিষণ্ন কাতর মৌনতা নেমে আসে। অহিদুল হক এদিন আদালতে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের কী হৃদয় বিদারক বর্ণনা, খুনিদের কী নির্মমতা, হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের ভিত কীভাবে ভেঙে দেওয়া, একটি জাতির ললাটে কতটা কলঙ্ক তিলক এঁকে দেওয়া ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেন। তার ভাষাশৈলীতে ঘটনার বর্ণনা যেন উপস্থিতিদের মানসপটে বর্ষার ঢল নামিয়ে দিচ্ছিল। ঐ সময়ে আমি বারবার দৃষ্টি রাখছিলাম খুনি ফারুকের মুখের ওপর। কোনো ভাবান্তর দেখিনি খুনির চোখে-মুখে। এক ফোঁটা বিষণ্নতার ছায়াও ছিল না। আদালতে সরকারি আইনজীবীর বক্তব্য শেষ হলে আমি কর্নেল শাহারিয়ারের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘কী মনে হয়? আপনাদের ফাঁসি হবে?’
জবাবে সেও ফিসফিসে কণ্ঠে বলে,
‘যা করেছি, এতে আমাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ই হবে!’
কথাটা মনে আসতেই আমার মনে হলো খান সাইফুর রহমানকে ফোন করে একজন খুনির স্বীকারোক্তির কথাটা বলে দিই। এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত জবাব হবে। আমি খান সাইফুর রহমানকে ফোন করি। ও-প্রান্তে ফোন রিসিভ করলেন তিনি। বললেন,
‘কী ব্যাপারে, ফোন করলেন কেন?’
‘আপনাকে একটা কথা বলা দরকার বলে ফোনটা করলাম।’
‘কী কথা, বলুন।’
‘এই মামলার একজন আসামি আমাকে শুনানির শেষ দিন বলেছিল, তাদের ফাঁসি হবে। আপনি কি খুনির ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেন?’
প্রশ্নটার জবাব দিলেন না তিনি। ‘পরে কথা বলব’ বলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দিলেন। আমি নিজের মনে হেসে উঠি। বেদনার অতল নিংড়ে যে হাসি বিজয়ের আখ্যান রচনা করে, ও-ধরনের হাসি আমার মুখে অনেকক্ষণ ঝুলে থাকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কবি

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য