Thursday, April 25, 2024
বাড়িSliderমুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে...’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে…’

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানে নির্বাচন। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ।

দিলীপ চক্রবর্তী:

ক.
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের এবার ৫০ বছর। আর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির শেষ নায়ক, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি একেবারেই তরুণ সাংবাদিক। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি, কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি রণাঙ্গনের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, আমাদের পত্রিকায় তার ভাষণের রিপোর্ট করার সুযোগও আমার হয়েছিল। ঐ স্মৃতি বর্তমান বৃদ্ধ বয়সেও আমাকে ‘তারুণ্য’ উপহার দেয়।
এটি সত্য, গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে কিংবা ছয়ের দশকে কলকাতার সংবাদপত্রে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের খবর এখানকার সংবাদপত্রে কিংবা রেডিওতে কমই প্রচারিত হতো। তখন দূরদর্শন ছিল না- অতএব এতে প্রচারের প্রশ্নই ওঠে না। উপরন্তু পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, লুটতরাজের খবর, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। এমনকি ঐ দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় বাঙালির জীবনদান, ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়গুলোও ভারতের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়নি। এমনকি কলকাতার বাংলা সংবাদপত্রেও প্রথম দিকে এ বিষয়ে ধারাবাহিক গুরুত্ব পেত না।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে কাশ্মীরের মসজিদে রক্ষিত ‘হযরত বাল’ চুরির কথা বলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং আমাদের পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। আমার মনে আছে ঐ সময় গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী শক্তি বামপন্থি শক্তি দাঙ্গা প্রতিরোধে রাস্তায় নামে। এক কঠিন সংগ্রাম। আমার মনে আছে পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি এক বিবৃতি দেয়। বিবৃতির বয়ান ছিল-

“দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে পূর্ব্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও”

এই বিবৃতি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কলকাতার প্রায় সমস্ত দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আসে। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেননি। আমি এখানে তখন বামপন্থি ছাত্র সংগঠন এআইএসএফের সঙ্গে যুক্ত। আমার মনে আছে ঐ বিবৃতিটি পশ্চিম বাংলাতেও দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অস্ত্র হিসেবে আসে। আমরা ঐ বিবৃতিটি ব্যাপকভাবে প্রচার করি। বিবৃতির ভাষা এবং আবেগ আমাদেরও সাহস জুগিয়েছিল, সমৃদ্ধ করেছিল এবং পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি এখানকার মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯৬৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রথম কলকাতায় বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির উদ্যোগে ২১শে ফেব্রুয়ারি বড় করে পালিত হয়। বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত ছিলেন এর প্রধান উদ্যোগী। আমার সাংবাদিক জীবনে ঐ সময়ে হাতেখড়ি। ঐ খবরের রিপোর্ট করারও সুযোগ হয়েছিল আমার। শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হওয়ায় ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক গণ-আন্দোলন হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্তির পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দুই বছরের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ অথবা বাঙালির কাছে নয়, তিনি বিশ্ববাসীর কাছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ নামে খ্যাত হন।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানে নির্বাচন। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ। ঐ সময়ের সংবাদ ভারত ও পশ্চিম বাংলার সংবাদপত্রে গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মার্চে ভারতের লোকসভা নির্র্বাচন এবং পশ্চিম বাংলার বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিম বাংলায় আর এক অস্থির অবস্থা। বাংলাদেশে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সংবাদের পাশে পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের সংবাদ উঠে আসে। ৩ মার্চ বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, তার ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আমাদের পশ্চিম বাংলা এবং ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

খ.
২৫ মার্চ মধ্যরাত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্তের বন্যায় তাদের ভাসিয়ে দিতে চায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আবেদনে উদ্দীপ্ত মানুষ যার হাতে যা ছিল তা নিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নামেন। শুরু হয় এই গ্রহে নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ।
২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশে প্রতিরোধের খবর আসেছিল- খবর আসছিল শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধের এবং মানুষের আত্মদানের। প্রকৃত ঘটনা কি হতো তা বোঝার জন্য কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক নিজের মতোন করে সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করে।
যশোরে এবং খুলনায় সংগ্রাম শুরু হয়েছে। ২৭ মার্চ স্থির করলাম স্বরূপনগর, হাকিমপুর হয়ে ইছামতি অতিক্রম করে আমি বাংলাদেশে যাব। এরপর যশোর এবং খুলনা যেখানেই পারি যাব। কমিউনিস্ট নেতা রমেন মিত্র-ইলা মিত্রের বাড়িতে বসে এই পরিকল্পনা, এরাও উদ্বিগ্ন। রমেনদা আবার আমাকে একা ছাড়তে চান না। তিনিও যাবেন। কিন্তু তার বয়স হয়েছে। তাই স্থির হলো ইছামতির এই পাড়ে তিনি একজনের বাড়িতে থাকবেন। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তার অবস্থান হবে সেখানে। কার্যানুযায়ী কাজ। ২৭ মার্চ রাত্রে সীমানায় হাকিমপুরে অবস্থান। হঠাৎ হৈচৈ ওপারে ‘খান’ ধরা পড়েছে। খবর নিয়ে গ্রামবাসী চারজন পাকসৈন্যকে ধরে বেঁধে রেখেছে। মুক্তিবাহিনীকে খবর দিয়েছে- বিচার তারাই করবে। ২৮ মার্চ ভোরে নৌকা করে ওপারে যাওয়া। রমেনদা উদ্বীগ্নভাবে থাকলেনÑ তখন টেলিফোন নেই। যশোর শহর আর খুলনায় প্রতিরোধের ডাক মুখে মুখে আসছে। নদী অতিক্রম করে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মী দুজন গ্রামবাসী। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বাঁশবনের মধ্যেই উদোম শরীরে এক কিশোর। দু-আঙ্গুল জড়ো করে আমাদের তাক করে বলছে ‘গুড়–ম, গুড়–ম’ তারপরই খিলখিল হাসি। এরপর চিৎকার করে বললÑ জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! আমি তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম-
‘তুমি গুড়ুম-গুড়ুম করলে কেন?’
– ‘ক্যান গুড়–ম কইর্যা ইয়াহিয়ারে মারুম’ ছেলেটি বলল। তারপরে বলল, ‘আমাকে একটি বন্দুক দিবা?’ ছেলেটির চোখে-মুখে সূর্যের আলো পড়ছে। আমার মনে হয়েছিল নবীন বাংলাদেশ জাগছে। আমি ঐ কিশোরের ছবি তুললাম। বাংলাদেশের মাটিতে ঐ আমার হোল প্রথম ছবি। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার সম্পাদিত ছবির বই ‘তমসা থেকে আলোয়’ এ ছবিটি পেছনের মলাটে ব্যবহার করেছিলাম।
স্থির করলাম যশোর যাব। কিন্তু গ্রামবাসীরা জানাল শহরে প্রবেশ নিষেধ। রাস্তায় ব্যারিকেড, সোজা রাস্তায় যাওয়া যাবে না। ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনী, শহরবাসী এবং সংলগ্ন আন্দোলনের গ্রামবাসীরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ। এদের সঙ্গে দেড়দিন কাটিয়ে শহর আর গ্রামের অবস্থা দেখে ২৯ মার্চ ফিরছি। ফেরার পথে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ। আমার পরিচয় জানার পর তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি আমার নাতির মতন, তোমাকে কই, আমার বয়স পাঁচ কুড়ি হইতে আর চাইর বছর বাকি। আমার বিবি গত হইয়াছেন। আমি এখনও লড়তে পারি। একটা বন্দুক পাইলে স্বাধীনতার লাইগ্যা লড়তাম।’ তিনি বৃদ্ধ বলে তাকে শহর থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। তার ক্ষোভ এ কারণেই। আসার সময়ে, ঐ বৃদ্ধ বললেন, ‘জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!’
বাংলাদেশে যখন গ্রামে প্রবেশ করি তখন বাঁশপাতার মর্মর ধ্বনির সঙ্গে এক শিশুর আর্তি চোখে পড়েছিলÑ ফেরার সময়ে ‘নানা’ (বৃদ্ধ)-র আর্তিও চোখে পড়ল। স্বাধীনতার লড়াই-এ তারা কীভাবে অংশ নিতে চায়, ‘এই সময়ে’-এর কাহিনি সবিস্তারে লিখিছিলাম। লেখার শেষে উল্লেখ করেছিলাম “ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের কাহিনি শুনেছি, জনতার হাতে হাতে চাপাত্তি ঘুরেছিল সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থনে। বীর তিতুমীরের কাহিনি শুনেছি, লাঠি, তীর-ধনুক সম্বল করেই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ভিয়েতনামের কাহিনি শুনেছি, জনতার ব্যাপক ঐক্য আর সাধারণ অস্ত্র নিয়েই ভিয়েতনামবাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেন এই তিন সংগ্রামের সমন্বয় করেছে।” আমি লিখেছিলাম “ইয়াহিয়ার কামানে যেমন কোকিলের ডাক বন্ধ হয়নি, বাঁশপাতার মর্মর ধ্বনিও স্তব্ধ হয়নি, তেমনি স্তব্ধ হবে না বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা।”

গ.
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১ এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের রিপোর্টার হিসেবে আমি কাজ করেছি। কখনও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সঙ্গে খোকন চৌধুরী ছদ্মনামে। বাংলাদেশের গ্রামে, শহরে ঘুরে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকবাহিনী রাজাকার আলবদরদের অত্যাচারের নির্দশনগুলো দেখেছি, আবার কলকাতায় এবং ভারতের বিভিন্ন বড় শহরে মুক্তিযুদ্ধের সাথে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানও লক্ষ করেছি। আবার সেনাবাহিনী স্বীকৃত রণাঙ্গনের রিপোর্টার হিসেবেও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে রয়েছি, প্রত্যক্ষ করেছি। এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা আমার ‘৭১-এর রাতদিন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।
যুদ্ধের প্রথম দিকে ১৩ দিন কখনও পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে অথবা জিপে করে মুক্তিবাহিনীর সাথে আমি এদেশের ২৮১ মাইল পর্যন্ত সফর করেছি। রংপুরের লালমনিরহাট, মঙ্গলহাট সেখান থেকে ভুরুঙ্গমারি, পটেশ্বরী, নাগেশ্বরী হয়ে কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম থেকে দিনাজপুরের পঞ্চগড়। এরপর বগুড়া, মহাস্থান, শিবগঞ্জ, দীগরগাছি, রসুলপুর, পাঁচবিবি, করন্দপুর। এই সমস্ত জায়গায় রাতও কাটাতে হয়েছে। অবস্থা বুঝে আত্মগোপন করে মিথ্যেও বলতে হয়েছে। কিন্তু এখানেও বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কোথাও আশ্রয় চাই না গ্রামের কিছু মানুষ ভয় পাচ্ছে, এরা মোহাজেদ হলে পাকমিলিটারি গ্রাম জ্বালাবে। তবে মায়েরা সব জায়গাতে এক। আমার মনে আছে, করন্দপুরের কিছু মহিলা বলছিলেন ‘কোন আবাগীর পুলা! ওরা এই হানেই থাকুক, আর যা গুলিগালা! কই যাইবে?’ একজন বলল, ‘ওরা মোজাহেদ হউক, আর যাই হউক, ওরা দেশের লাইগাই লড়তাছে।’

১২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। পৃথিবীটা দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল একদিকে পাকিস্তান-চীন, আমেরিকা, অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণতান্ত্রিক শক্তি।

এমনি সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা। রাত্রের অন্ধকারে বগুড়ার দীগরগাছি থেকে যাচ্ছি আত্মগোপন করে। পাকমিলিটারি বগুড়া দখল করেছে। বড় রাস্তা তাদের দখলে। আমার সঙ্গে বগুড়ার তরুণ হায়দার আলী আরও কয়েকজন। জায়গার নাম অঞ্চল নিষ্প্রদীপ করে রাখা হয়েছে পাক সৈন্য আর রাজাকারদের আক্রমণের আশঙ্কায়। এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা- আমরা নিজেদের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থলে যাওয়ার গ্রামের পথের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বৃদ্ধ আমাদের দিকে তাকিয়ে কি ভাবলেন জানি না। তারপরে বললেন, ‘বুঝতে পারছি তোমরা কারা? আমার বয়স হলেও ইচ্ছে তোমাদের সঙ্গে যাই। তারপরে আস্তে বললেন, জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!’
এপ্রিলের পর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমি অনেকবারই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে গিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের খবর নিতে। আমি দেখেছি মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা পরস্পরের দেখা হলে ধ্বনি দিচ্ছেন জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ক্ষিপ্ত পাকবাহিনী ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। তাদের চোখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের জনগণ অপরাধী, কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবর্ষ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমর্থক। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ভারতবর্ষ বিশ্বজনমত সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতের মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সামগ্রিক যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় যাত্রা শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধের মধ্যেই আমি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম যশোর শহরে। ২৯ মার্চ ঢুকতে পারিনি কিন্তু ৮ ডিসেম্বর যশোর স্বাধীন। আমি অবশ্য মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সঙ্গে যাইনি। গিয়েছিলাম নিজের মতন করে। মুক্তিবাহিনীর যশোরের তিনজন ইতোমধ্যে আমার অতি পরিচিত। ডা. রবিউল হক, কাজী টুলু, কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা। ওরা বাড়ি যায়নি অনেকদিন। কিন্তু দেখা হলে বাড়ির কথা হতো। ওদের গল্প শুনে আমি নিষ্প্রদীপ যশোর শহরে রবীন্দ্রনাথ রোডে ওদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যুদ্ধের সময়ে অনেকে বাড়ি ছেড়ে গেলেও বৃদ্ধ কাজী এনামুল হক এবং তার স্ত্রী যশোরে থেকেই গেছেন। তারা নিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধ জয়ী হবে- তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানেরা অবশ্যই বাড়ি ফিরে আসবে যুদ্ধের মধ্যে। আমার কাছে তার ছেলে-মেয়েদের কথা শুনে কী আনন্দ তাদের! আমি তাদের বাড়িতেই সেদিন রাত কাটালাম। ১০ মাইল দূরে আরও যুদ্ধ। কামানের গোলায় আকাশ লাল। পরদিন যশোরে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের জনসভা। তিনি স্বগর্বে বলেছিলেন- আর কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকায় উড়বে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসছেন। তাজউদ্দীন সাহেব এবং সকলে মিলে ধ্বনি দিয়েছিলেন জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! এই ধ্বনির গর্জন মনে হয়েছিল কামানের গোলার চাইতে অনেক বেশি জোরালো।
১২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। পৃথিবীটা দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল একদিকে পাকিস্তান-চীন, আমেরিকা, অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণতান্ত্রিক শক্তি। কলকাতায় তখন মিছিলে ধ্বনি-

“বিশ্বে আসছে নূতন দিন
ইন্দিরা মুজিবুর কোসিগিন।”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উভয় দেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যা ভোলা যায় না। কলকাতায় সমস্ত বড় দুর্গাপূজা ম-পে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান আর ভারতরতœ ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের ভাই ফোঁটা দিয়ে হিন্দু বোনেরা যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে ভাইয়ের সুস্থ জীবন কামনা করছে।

ঘ.
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের আগে আমি কখনও বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। কিন্তু তার ছবি দেখেছি পত্রিকায়। তার বক্তৃতা শুনেছি রেডিওতে এবং রেকর্ডে।
৬ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রথম কলকাতায় এলেন। সমস্ত কলকাতা সেদিন রাস্তায়। বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ সভায় সেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতরতœ ইন্দিরা গান্ধী। ঐ সভার রিপোর্ট নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমার হঠাৎ মনে হলোÑ আরে ওনাকে তো দেখেছি আমি অনেক আগে, অনেকবার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একটি গান লিখেছিলেন। এটি অংশুমান রায়ের কণ্ঠে বিশ্ববাসী শুনেছেন।
এই গানের একটি পঙ্ক্তি ছিল-

“শোনো, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।”

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রামে-গঞ্জেও মানুষের কণ্ঠে ছিল মুজিবের কণ্ঠ। আমার যেন মনে হয় সারাবিশ্বেই মানুষ যেখানে মাতৃভাষার জন্য লড়ছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ছেন, স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, সেখানে তাদের কণ্ঠেই আছে যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননাপ্রাপ্ত ভারতীয় সাংবাদিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য