Friday, March 29, 2024
বাড়িউত্তরণ ডেস্কবাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ভাষণ

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ভাষণ

উত্তরণ ডেস্ক: আপনার আন্তরিক বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এখানে আসতে পেরে এবং আমার প্রতি যে ভালোবাসা দেখানো হলো তাতে আমি অভিভূত। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর এটি আমার বিদেশে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।
আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমার ১৯৭১ সালের স্মৃতি মনে পড়ছে। বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে রত, তখন আমার বয়স ৩৬ এবং আমি সংসদ সদস্য। সে-সময়কার অনেক ঘটনার সঙ্গে আমাদের অনেকে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী আমাদের বাংলাদেশের ভাইবোনদের বীরোচিত সংগ্রামের খবর পরিবেশন করত। ভারতে আমরা সেইসব বুলেটিন গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতাম, কেননা সব ভারতীয়ের মন-প্রাণ তখন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একতারে বাঁধা। সীমান্ত পেরিয়ে আসা লাখ লাখ গৃহহীন মানুষের অসহায় অবস্থা, ভারতের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা আমাদের জনগণের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল এবং তারা সেই ভাগ্যহীন মানুষের বেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন। সেই প্রয়োজনের মুহূর্তে বাংলাদেশের ভাইবোনদের বিপদে সাহায্য করতে তারা সর্বান্তঃকরণে এগিয়ে এসেছিলেন। এই অঞ্চলের গর্বিত মানুষের চিত্র এবং ন্যায়-বিচার ও মর্যাদার জন্যে তাদের সাহসী সংগ্রাম সেদিন প্রত্যেকটি ভারতীয়র চেতনায় দাগ কেটেছিল।
আমার মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের ১৫ই জুন রাজ্যসভায় আমার একটি আলোচনা শুরু করার সুযোগ হয়েছিল, যেখানে আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করা। আমার বক্তব্যের প্রামাণ্য দলিল আছে। একজন সদস্য, আমার মতামত জানতে চান যে কীভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করা যাবে। আমি বলেছিলাম, “আমি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি, যার মানে হচ্ছে, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান। রাজনৈতিক সমাধানের মানে হচ্ছে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে বস্তুগত সাহায্য প্রদান….।” আমি রাজ্যসভাকে বিশ্ব ইতিহাসের অনেক উদাহরণ দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, এ-রকম অবস্থায় হস্তক্ষেপের নজির আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী তাদের করণীয় কর্তব্য অনুধাবন করে সময় নষ্ট না করে সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের গর্বিত জনগণের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল করেছিলেন।
আমি বিনম্রচিত্তে এই মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করছি, যদিও আমি মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদান ছিল যৎসামান্য।
১৯৭১ সালের ২ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৫৯তম আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আমাদের বিভিন্ন দেশের বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযোগ হয়েছিল। আমরা তাদের নিজ নিজ সরকারকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে রাজি করানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। একই সফরে ‘সংসদীয় শুভেচ্ছা দল’-এর সদস্য হিসেবে আমার যুক্তরাজ্য ও জার্মান ফেডারেল রিপাবলিক ভ্রমণের সুযোগ হয়। আমার ওপর এসব দেশের সংসদ সদস্যদের বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত করার দায়িত্ব ছিল। সেই ভ্রমণে প্রাক্তন সাংসদ ও বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের কর্মী স্বগীয় এইচ ডি মালব্য আমার সঙ্গে ছিলেন। পরে আমাকে ত্রিপুরা, অসম ও মেঘালয়-সহ ভারতে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং শিবিরগুলিকে কার্যকর ও বাসযোগ্য করে তুলতে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সেইসব দিনের কথা যখন মনে হয়, ভাবি, সংগ্রামের সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতেও অনেকেই আমার চেয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। কাজেই আমাকে যে বিশেষ সম্মান দেওয়া হলো, তা আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। এক বিখ্যাত লেখকের কয়েকটি ছত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের সে-সময়কার মনোভাব ব্যক্ত করা পঙ্ক্তিগুলি হলো :

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান।
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।”

মহামহিম, আমাকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান করে সৌজন্য প্রদর্শনের জন্য আমি আপনাকে এবং বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনাদের পাশে থেকে, আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, এমনকি আপনাদের জন্য যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের এভাবে স্মরণ করার জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। গত বছর আপনাদের আতিথেয়তা ও সম্মাননায় ভূষিত গর্বিত ভারতীয়ের সংখ্যা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নিদর্শন। আমি তাদের পক্ষ থেকে এবং ভারতের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।
আজ আমি সেইসব আত্মেৎসর্গকারী নিরপরাধ লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করি, যারা তাদের পরের প্রজন্মের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, যাদের স্মৃতি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শহিদ মিনারের পাথরে খোদিত রয়েছে। তারা আমাদের দেখিয়েছেন ন্যায়ের জন্য লড়াই করে দুর্বলতম ব্যক্তিও জয়ী হতে পারে। আপনার সরকার ইতিহাসের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। আজ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এই জেনে গর্ববোধ করেন যে, তাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত বৃথা যায়নি। বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে নিয়োজিত। ১৯৭১-এর মতো ২০১৩ সালেও ভারতের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের পাশে আছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে সমান অংশীদার হিসেবে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে চলব। আমরা উভয়ই একই অবিভক্ত সভ্যতার উত্তরসূরি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ভারত ও তার জনগণ বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের অবশ্যমান্য স্বার্থ রয়েছে। তবে আমাদের সহযোগিতার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা এখনও সদ্ব্যবহার করা হয়নি। এই সফরকালে আমার আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের দুদেশের সরকার সহযোগিতার একটি সর্বার্থসাধক কাঠামো তৈরি করেছে। আমাদের প্রচেষ্টা হবে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা কীভাবে আমাদের জনগণ ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনে, তা দেখার। এটি আমাদের সম্পর্কের সাফল্যের লিটমাস পরীক্ষা।
আমরা ভারতে বাংলাদেশের চমৎকার অগ্রগতি দেখে খুশি। যে আশাব্যঞ্জক পথিকৃতির মতো বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে, তা অনুসরণযোগ্য। আমি বাংলাদেশের জনগণ Ñ তার কৃষক, শিল্পোদ্যোক্তা, চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী এবং আরও যারা সৃজনশীল প্রতিভার প্রতিনিধিÑ সবাইকে আমার শ্রদ্ধা জানাই।
মহামহিম, ব্যক্তিগতভাবে আমার এই ভূখ-ের সঙ্গে গভীর যোগ আছে। আমার স্ত্রীর পরিবারের শিকড় এখানে, তার শৈশবের প্রথম ও সুখের বছরগুলি তিনি এখানেই অতিবাহিত করেছিলেন। আমি আপনাদের উষ্ণ সৌজন্য প্রদর্শনে আপ্লুত। আমি এই সম্মানের ভেতর ভারত ও বাংলাদেশের দৃঢ় বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের একটি শক্তিশালী বার্তা দেখতে পাচ্ছি। আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমাকে প্রদত্ত সম্মান গ্রহণ করে অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করছি।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। আপনারা আমার ও আমার স্ত্রীর প্রতি যে উষ্ণ ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমরা আন্তরিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক অগ্রগতি এবং আমাদের দুদেশের জনগণের সমৃদ্ধি কামনা করি।

    জয় হিন্দ্।
        জয় বাংলা ॥
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য