Friday, September 22, 2023
বাড়িউত্তরণ-২০২১দ্বাদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর-২০২১৮৩তম জন্মদিনে শেখ ফজলুল হক মণিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

৮৩তম জন্মদিনে শেখ ফজলুল হক মণিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ড. জেবউননেছা

একজন গল্পকার, প্রাবন্ধিক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ শেখ ফজলুল হক মণি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ নুরুল হক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। মা আছিয়া বেগম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজ বোন। তারা ছিলেন তিন ভাই তিন বোন। তিনি গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, ঢাকা নব কুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কারাগারে থাকাবস্থায় ড. আলীম আল রাজী আইন কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন ষাট দশকের একজন উদীয়মান গল্পকার, যিনি তৎকালীন সময়ে ‘বৃত্ত’ নামক একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রবন্ধ লেখার পাশাপশি ‘অবাহ্নিতা’ শিরোনামে একটি গল্প লিখেন, যেটি টেলিফিল্ম হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। তার লেখা ৬টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘গীতা রায়’। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক শ্রমিক ধমর্ঘট এবং ৬-দফা আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা দায়ের করা হয়।
দীর্ঘদিন কারাভোগ করে ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের সময় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭১ সালে মে মাসে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট ‘মুজিব বাহিনী’ নামে ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া নামক পাহাড়ি স্থানে ৪টি সেক্টরে গঠিত হয়।
ষাট দশকে পল্টনের আওয়ামী লীগের অফিসের নিচতলায় ছিল সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’র অফিস। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে পত্রিকার দপ্তর ৮১ মতিঝিলের দোতলায় ছিল। ধীরে ধীরে শেখ মণি একজন শক্তিশালী প্রাবন্ধিক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কনভেনশনে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। একই সময়ে তিনি তেজগাঁও আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি বিনোদন সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তার সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশ করেন। তার ইচ্ছে ছিল পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকার মতো একটি উন্নত ম্যাগাজিন প্রকাশ করার। দৈনিক পত্রিকায় তার একটি বিশেষ প্রতিবেদন রঙিন অক্ষরে প্রকাশ হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে তিনিই প্রথম করেছিলেন। জার্মান থেকে পত্রিকা প্রকাশের জন্য গজ অফসেট প্রিন্টিং মেশিন আমদানির সব ব্যবস্থা করেছিলেন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ এবং ‘দৈনিক বাংলা’র পর ‘বাংলার বাণী’ই ছিল বড় ও আধুনিক প্রকাশনা ব্যবস্থা। তিনি পত্রিকার খুঁটিনাটি প্রেস, ফটোগ্রাফ, মেকআপ এবং কম্পোজ প্রভৃতির ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান রাখতেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘পিপলস’-এ নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় দল বাকশাল গঠন করলে শেখ ফজলুল হক মণিকে দলের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান। অকালপ্রয়াত গুণী এই মানুষকে জানাই ৮৩তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

৬৯তম জন্মদিনে
সুলতানা কামালকে স্মরণ

ক্ষণজন্মা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল ‘দৌড়, ঝাঁপ, নিক্ষেপ’ গ্রন্থের লেখক ধারাবাহিকভাবে ৯ বছরের প্রাদেশিক চ্যাম্পিয়ন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ কাজী আব্দুল আলীমের কাছ থেকে খেলাধুলার কৌশল শেখেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মেজর হামিদ নামে একজন কোচ পূর্ব পাকিস্তানে আসতেন, তার কাছ থেকেও তিনি বিশেষ কিছু কৌশল রপ্ত করেন। ১৯৬৮ সালে ১ হাজার ২০০ ভোটের অধিক ভোট পেয়ে কলেজ ছাত্রী সংসদে ছাত্রলীগ মনোনীত ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন সুলতানা আহমেদ। পারিবারিক নাম ছিল খুকী। বন্ধুমহলে খুকী নামেই পরিচিত। বিয়ের পর যার নাম হয় সুলতানা কামাল। ১৯৫২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বকশীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম দবিরউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম জেবুন্নেসা। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। পৈতৃক বাড়ি রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইলে। মৃধা বাড়ি নামে তাদের বাড়ি সমধিক পরিচিত। ১৯৬৭ সালে মুসলিম গার্লস স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ), ঢাকা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন রোকেয়া হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ৩৮৯। স্নাতকে পরীক্ষার রোল ছিল ৯৭৪। ১৯৬৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্নাতকে ক্লাস শুরু করেন, স্নাতক সম্পন্ন করে একই বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তার স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা শুরু হয় ২১ জুলাই ১৯৭৫। ৭ আগস্ট পর্যন্ত চলে লিখিত পরীক্ষা। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ ছিল মৌখিক পরীক্ষা। কিন্তু তিনি মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
শৈশবে তিনি আন্তঃবিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করার পর আর থেমে থাকেননি। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্তঃবিদ্যালয় অ্যাথলেট হিসেবে পুরস্কৃত হন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে মোহামেডান ক্লাবের পক্ষে লং-জাম্পে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য রোকেয়া হলের মাঠে এবং আজিমপুর গার্লস স্কুলে অনুশীলন করতেন। লাহোরে গিয়ে প্রায় ১০ দিন ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে অলিম্পিকে পাকিস্তান লং-জাম্পে ১৬ ফুট অতিক্রম করে রেকর্ডসহ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডলসে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ব্লু সনদপত্রটি ১১.০৮.১৯৭০ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষার পরিচালকের স্বাক্ষর সংবলিত সনদপত্র অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তিনি ১০০ মিটার হার্ডলস, হাইজাম্পে এবং লং-জাম্পে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৭৩ সালে অল ইন্ডিয়া রুরাল গেইমসে (নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা) রৌপ্য পদক জেতেন। এই পদক জয়ের পর বঙ্গবন্ধু তার কাছে জানতে চেয়েছিলেনÑ কি পুরস্কার চাস এই অর্জনে? উত্তরে সুলতানা বলেছিলেন, ক্রীড়া কমপ্লেক্স চান। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি ১৯৭৩-এ শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। ধারাবাহিকভাবে ১৯৭৩, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামে জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার হার্ডলসে ১৭.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম হন। সুলতানা কামালের দল ভারতে খেলতে গেলে পুরো খেলোয়াড় দলকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্মারক দেন। সেই স্মারকটি এখনও সংরক্ষিত আছে। তিনি ২২টি স্বর্ণপদক অর্জন করেন এবং ১০-এর অধিক রৌপ্যপদক লাভ করেন। ৫০-এর অধিক সনদপত্র অর্জন করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ক্রীড়া ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০০) এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (১৯৯৭) সম্মাননা অর্জন করেন। ঢাকার ধানমন্ডিতে স্থাপিত হয়েছে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স। তিনি বেঁচে থাকলে ক্রীড়াক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে একজন অনুসরণীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন জাতীয় সম্পদকে অসময়ে হারানো দেশের জন্য বেদনার। তার সকল স্মৃতি সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য। সেই সাথে সবার সাথে প্রাণ হারান ২২ বছর আট মাস বয়সী বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল। ঢাকার বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহিদদের সাথে তিনি চিরতরে শায়িত আছেন। অফুরন্ত শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ক্রীড়া জগতের কিংবদন্তি সুলতানা কামাল আপনাকে। ৬৯তম জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য