নু রু ল ই স লা ম: ১৯৬৯ সালের গোড়ার দিকে আমার এক বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর এম রশিদের কাছ থেকে আমি একটি বার্তা পাই। সে আমাকে জানায়, বঙ্গবন্ধু যত শিগগির সম্ভব ঢাকায় আমাকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এর আগে কখনোই আমার সাক্ষাৎ হয়নি, এমনকি সাক্ষাতের চেষ্টাও করিনি। পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়ে আমার কাজ সম্পর্কে আমার বন্ধু রশিদ বিশদভাবে অবগত ছিল। পাকিস্তানের পরপর দুটি অর্থ কমিশন সম্পর্কে আমার যন্ত্রণাদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জক অভিজ্ঞতার কথা সে জানত। আমার সন্দেহ যে রশিদই সম্ভবত আমার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিল। আমি রশিদের কাছে এ-ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলে যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আমার কাজ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবগত আছেন এবং আমি তাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি, সেটা জানার জন্য তিনি নিজে থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বিশেষ আগ্রহী। আমাদের দুজনেরই বন্ধু এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর বাড়িতে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের এই বন্ধুটি পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই ঢাকায় চলে আসেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ভালো জানাশোনা ছিল। সাক্ষাৎকালে বঙ্গবন্ধু আমাকে বোঝালেন যে তিনি বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন অনুভব করছেন, যারা তার স্বাধিকারের দাবি ও ৬-দফার প্রতিটি দফাকে জোরালো ও বিস্তারিতভাবে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করবেন এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবেন। তার ধারণা যে আগামী দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কঠিন বোঝাপড়া করতে হবে। তিনি আরও বললেন যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা ও সেসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করার জন্য তার যে টিম রয়েছে, আমি যেন একজন সদস্য হিসেবে তাতে যোগ দিই। আমি তার আহ্বানে সাধ্যমতো সহযোগিতার আশ্বাস দিই।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া তৈরি করা। এর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক স্টিয়ারিং গ্রুপ বা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়, তাতে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও কামাল হোসেন। সংবিধানের খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব ছিল কামাল হোসেনের ওপর। আর পেশাজীবী বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন মোজাফফর আহমেদ, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, খান সরওয়ার মুরশিদ এবং আমি। বঙ্গবন্ধু আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। এ ব্যাপারে তার উৎসাহের অন্ত ছিল না। আর আমরাও খসড়া প্রণয়নের সময় তাকে তার সব চিন্তা-ভাবনা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে বলতাম। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পর তাজউদ্দীন ছিলেন এ ব্যাপারে সবচেয়ে কর্মতৎপর ও উৎসাহী একজন আলোচক।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশ একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় (ফেডারেল) সরকার ব্যবস্থার অধীনে চলছিল। ৬-দফা কর্মসূচি সেই ব্যবস্থার আওতায় প্রচলিত অর্থে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল না। ৬-দফা কর্মসূচির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে মৌলিকভাবেই ভিন্ন ছিল। এই কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল যে শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আওতায় থাকবে। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের শুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ; মুদ্রা, ব্যাংকিং নীতি ও প্রতিষ্ঠান; আর্থিক নীতি (রাজস্ব, সরকারি ব্যয়সহ) এবং বৈদেশিক লেনদেনের বিষয়গুলো থাকবে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে। একক মুদ্রা থাকলেও এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে মুদ্রা বা সম্পদ পাচার হবে না। এমনকি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও সব আঞ্চলিক সরকারগুলোর অধীনে থাকবে।
এই বর্ণনা থেকে পরিষ্কার যে ৬-দফা কর্মসূচিতে কাস্টমস ইউনিয়ন বা অর্থনৈতিক ইউনিয়নের কথা বলা হয়নি। আমদানি শুল্ক বা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। প্রতিটি অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় বা হার ও কাঠামোর কথা বলা হয়েছিল। এক অঞ্চল যদি কোনো বিদেশি পণ্য আমদানি করে, তবে সেই নির্দিষ্ট পণ্য অন্য অঞ্চলে রপ্তানি করতে পারবে না। কিন্তু দুই অঞ্চলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পণ্যের অবাধ চলাচল থাকতে পারবে। এর কারণ যে অঞ্চলের শুল্কহার কম, সে যদি উচ্চ শুল্কহারসম্পন্ন অঞ্চলে পণ্য রপ্তানি করে, তাহলে উচ্চ শুল্কহারসম্পন্ন অঞ্চলের রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি তার অভ্যন্তরীণ শিল্পকে যদি কোনো সুরক্ষা দিয়ে থাকে, তা-ও টিকবে না। এর বাইরেও উচ্চ শুল্কহারসম্পন্ন অঞ্চল তৃতীয় দেশ থেকে সুলভ মূল্যে পণ্য আমদানি করার মাধ্যমে এক অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ পণ্যে অন্য অঞ্চলের প্রবেশাধিকার নষ্ট করে ফেলতে পারে। এছাড়া এই ব্যবস্থায় কোনো অঞ্চল যদি তার নতুন শিল্প খাতকে অন্য অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে চাইত, তাহলে সে তার শিল্প খাতের উৎপাদনসামগ্রী বা উৎপাদনে ভর্তুকি দিতে পারত। ব্যাপারটা এমন হতো যে প্রতিটি অঞ্চলই যেন একেকটি স্বাধীন দেশ। এভাবেই প্রতিটি অঞ্চল কার্যকরভাবে তার ইচ্ছেমতো অর্থনৈতিক যে কোনো খাতকে অন্য অঞ্চলের প্রবেশাধিকার বা প্রতিযোগিতা থেকে আলাদা করে রাখতে পারত। ৬-দফা কর্মসূচিতে এসব সুযোগের কথা অন্তর্নিহিত ছিল।
অঞ্চলগুলোর মধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই মেটানোর কথা বলা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি অঞ্চল বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে যা আয় করবে, তা যেন তার নিজের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। অন্যথায়, ঘাটতিতে থাকা অঞ্চল যদি একক মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে, তবে উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে ঘাটতি অঞ্চলে সম্পদ বা পুঁজির পাচার ঘটবে। ৬-দফায় এ-ধরনের সম্পদ পাচারের সম্ভাবনাকে পরিষ্কারভাবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে, যদি একক মুদ্রা থাকে কিন্তু একেক অঞ্চলের মুদ্রানীতি ও সুদের হার বিভিন্ন রকম হয়, তাহলে উচ্চ সুদহার অঞ্চলের বাসিন্দারা নিম্ন সুদহার অঞ্চল থেকে ধার করতে পারবে না। কারণ, এতে নিম্ন সুদহার অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণমূলক সুদ/আর্থিক নীতি নষ্ট হবে। একই সঙ্গে, প্রতিটি অঞ্চল একটি বিস্তৃত লেনদেনের ভারসাম্যের হিসাব বজায় রাখবে এবং তার দেখভাল করবে। এই হিসাবে পণ্য ও সেবা বাণিজ্যের পাশাপাশি সব ধরনের আর্থিক লেনদেনের হিসাব থাকবে। আর্থিক লেনদেনের হিসাবে বৈদেশিক ও আন্ত-অঞ্চল লেনদেনও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দুই অঞ্চলে একই ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের যদি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা বা শাখা থাকে, সেক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে একক মুদ্রা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। তার মানে শুধু নামেই একক মুদ্রা। অর্থাৎ একক মুদ্রা চালু রাখার কোনো বাস্তবিক তাৎপর্য থাকবে না। আরেকটি বিষয় থেকেও ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যায়। যদি এমন ঘটে যে একটি অঞ্চলের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি আছে, কিন্তু অন্য অঞ্চলের সে-রকম ঘাটতি নেই অথবা উল্টো উদ্বৃত্ত আছে, তাহলে কী হবে? সে-জন্যই প্রতিটি অঞ্চলের আলাদা বিনিময় হার থাকা দরকার। তা না হলে একক মুদ্রার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যেহেতু প্রতিটি অঞ্চলের স্বাধীন বা আলাদা বিনিময় হারের ব্যবস্থা নেই।
৬-দফা কর্মসূচির আরও দুটি দিক ছিল। এই দিকগুলো কেন্দ্রীয় সরকার-ব্যবস্থার দুর্বলতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এর স্থায়িত্বকে করে তুলেছিল আরও বেশি বিপন্ন। একটা দিক হলো কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নের ব্যবস্থাবিষয়ক। অন্যটি আঞ্চলিক আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো স্বাধীন আয়ের উৎস ছিল না। তাকে তাই নির্ভর করতে হতো দুই অঞ্চলের আর্থিক অনুদানের ওপর। আর এই অনুদান এমন অনুপাতে হওয়ার কথা বলা হয়েছিল যেন তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সংবিধানে যুক্ত করা হয়।
তবে চুক্তিতে ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। যদি পূর্ব পাকিস্তান বলত যে সে এই ব্যবস্থায় থাকবে না এবং যেটুকু অর্থ দেওয়ার কথা সেটা দেবে না, তাহলে কী ঘটত? যদি কোনো একটি অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা থেকে বের হয়ে যেতে চাইত, তাহলে দুই অঞ্চলকে একসঙ্গে রাখার জন্য সাংবিধানিক বিধান প্রয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল না। এই সূত্রে বলা যায় ৬-দফা কর্মসূচির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যেগুলো তত বেশি পরিষ্কার করে আলোচিত হয়নি।
প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান যেমন আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ দুটোতেই জনসংখ্যার ভিত্তিতে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব রাখার কথা বলা হয়েছিল। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ার কর্তৃত্ব থাকত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের হাতেই। কারণ, জনসংখ্যার বেশির ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। এর অর্থ দাঁড়াত এমন যে সশস্ত্র বাহিনীতেও পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ অংশগ্রহণ থাকত। এছাড়া সেনাবাহিনীর আকার, গঠন ও শক্তি নির্ধারণ এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হতো। এর ফলে যদি এমন পরিস্থিতি দেখা দিত যে পূর্ব পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার থেকে বের হয়ে যেতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে চাইলে সেটা ঠেকানো সম্ভব ছিল। দ্বিতীয়ত, বলা ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব বেসামরিক সেনা বা আধা-সামরিক বাহিনী থাকবে। এই বাহিনীর আকার, গঠন ও শক্তি নির্ধারণের কর্তৃত্ব থাকবে সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানের হাতেই। ফলে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনো সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ ঠেকাতে সক্ষম থাকবে।
ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা কৌশলগতÑ যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, ৬-দফা কর্মসূচির প্রস্তাব ছিল মূলত দুটো আলাদা রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি দুর্বল সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় জোট। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে প্রস্তাবিত সংযোগ বা সম্পর্ক এতই ভঙ্গুর ছিল যে, যে কোনো অঞ্চল চাইলেই তাতে ছেদ ঘটাতে পারে।
সাধারণ মানুষের কাছে এবং আপাত অর্থে ৬-দফা কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচি, যার মাধ্যমে পূর্ব বাংলা তার বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এছাড়া সরকারের আয় ও ব্যয়ের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মুদ্রা বা পুঁজির পাচার হবে না। কিন্তু ওপরে বর্ণিত ৬-দফার বিস্তারিত বর্ণনা এবং এর অর্থনৈতিক বিধানগুলো ছিল অর্থশাস্ত্রের বিষয়। তাই সবার কাছে তা সহজবোধ্য ছিল না। ফলে বিশেষজ্ঞরা ছাড়া অন্যদের বোঝার উপায় ছিল না যে ৬-দফা আসলে স্বাধীনতার পথে বিরাট একটি পদক্ষেপ।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ১৯৭১-পরবর্তী পাকিস্তানের সংবিধানে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৬-দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণ করার কাজ তিনি দিয়েছিলেন আমার কিছু সহকর্মী এবং আমাকে। তার কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগীসমেত তিনি ৬-দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুমোদনের কাজে খুবই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে তার নিজের যে লক্ষ্য বা আকাক্সক্ষা ছিল, সেটা মিলে গিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য ছিল, সহজেই ভেঙে দেওয়া যায় এমন একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত জোট বা সংঘ তৈরি করা।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব তাদের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় শুরু থেকেই ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের অর্থ কী। তারা বুঝতে পেরেছিল এর ফলে নামেই কেবল পাকিস্তান এক দেশ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে এটা হবে একটা বিরাট পদক্ষেপ। সে-জন্যই বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে যখন ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ৬-দফা বা সিক্স পয়েন্ট দাবির মোকাবিলা করবেন ওয়ান পয়েন্টের মাধ্যমে। সেটা হবে গান পয়েন্ট। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে দমনের ব্যাপারে পাকিস্তানের নেতারা মনস্থির করে রেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানে অভিযানের লক্ষ্যে তারা সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেন, যা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত চলে। রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আলোচনার আড়ালে তারা আসলে তাদের সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
১৯৭০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও তার ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞদের কাজ গোপনে শেষ করে ফেলার কথা ছিল। আলোচনার স্থান বারবার পরিবর্তন করা হয়। আশা করা হয়েছিল যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এই গোপন সংবিধান তৈরির কাজটি সম্পর্কে জানতে পারবে না। সংসদ অধিবেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ৬-দফা অন্তর্ভুক্ত করে খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন, এভাবে পূর্বাঞ্চল সংসদের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রাখবে। আর পশ্চিমাঞ্চলকে শুধু বিতর্ক এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ দেওয়া হবে। পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাধিক্যের বলে সংবিধানটিকে সংসদে গ্রহণ বা অনুমোদন করানোর আগাম পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল।
এ সময় আমাদের আলোচনায় কারও কারও মনে হয়েছে যে আমরা যেভাবে ৬-দফা ব্যাখ্যা করছি এবং এর যুক্তিসংগত পরিণতি হিসেবে যা ভাবছি, তার সঙ্গে খোন্দকার মোশতাক একমত নন। তিনি যেসব প্রশ্ন করতেন এবং যেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা দাবি করতেন, তা আমাদের মধ্যে সন্দেহ জাগাত। আলোচনার একপর্যায়ে আমার মধ্যেই প্রশ্ন জাগে যে পরিচালনা কমিটির সবাই ৬-দফা দাবি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন কি না এবং এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যে একেবারে দুর্বল এবং খুবই সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হবে, সেটি সঠিক অনুধাবন করতে পেরেছেন কি না? আমরা তাদের ৬-দফা বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের বিষয়ে অবগত করানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করি। যখন আমাদের অনুশীলন শেষ হলো, তখন জানা গেল যে ইতোমধ্যে তারা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে এবং তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সবার আগে এবং খুব দ্রুত বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর কারণ এই যে তিনি এ-বিষয়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বেশি সময় ব্যয় করেছেন। বিশেষজ্ঞদের হাতে ৬-দফার সংক্ষিপ্ত বিস্তারিত হওয়ার পর অবশেষে যে রূপ লাভ করে, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট ছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে অত্যন্ত শিথিল এবং সীমিত সম্পর্ক রক্ষার তার যে মূল উদ্দেশ্য, তার সঙ্গে এই পরিকল্পনা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। পরিচালনা কমিটির অন্য সব সদস্য এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুগামী হতে রাজি ছিলেন। তার ওপর তাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মোশতাক। আমাদের কয়েকজনের কাছে মনে হয়েছিল মোশতাক যেন বিষয়টির সঙ্গে নিজেকে পুরোপুরি মেলাতে পারছেন না।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে পাকিস্তানের লাহোরে একটি পত্রিকায় ৬-দফার মূল বিষয়গুলো ছাপা হলে আমরা সবাই অবাক হই। খসড়ার অনুলিপির সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল এবং গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে এটি সরবরাহ করা হয়। সব অনুলিপি কামাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে থাকত। পরিচালনা কমিটির সদস্য রাজনীতিবিদেরা এই অনুলিপি শুধু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার নিতে পারতেন। সবচেয়ে ঘনঘন ধার নিতেন মোশতাক এবং যে সময় ৬-দফার বিস্তারিত বিষয়গুলো ফাঁস হয়ে যায়, তখন মোশতাকের কাছে এর একটি অনুলিপি ছিল। আমাদের কেউ কেউ তাকে সন্দেহ করি।
কিন্তু এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত ছিলাম না। তবে মোটামুটি ধারণা করি যে মোশতাকের মারফতই এটি বাইরে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের গ্রুপের একজন সদস্য, যার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের লোকজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তিনিই প্রথম সেখানকার সংবাদপত্রে ৬-দফা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কথা জানতে পারেন। আমরা ৬-দফার এই অগ্রিম প্রকাশে খুবই অখুশি হই। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তান ৬-দফা প্রস্তাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আগেই জেনে যাওয়ার ফলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে বিরোধিতা করবে এবং তারা নিজেদের জবাব তৈরি করতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সংসদে প্রস্তাব তোলার আগেই পশ্চিম পাকিস্তান সেটাকে ঠেকানোর পরিকল্পনা করার সুযোগ পাবে। কামাল হোসেন, রেহমান সোবহান ও আমি এ-ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তার কাছে অভিযোগ করি যে তার কোনো সহযোগী সম্ভবত এই অনিষ্ট সাধন করেছেন। তিনি বিষয়টিকে রাজনৈতিক জীবনের ঝুঁকি হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং আমাদের আশ্বাস দেন যে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এভাবেই সে-বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটে।
আওয়ামী লীগের সব সদস্য ৬-দফা কর্মসূচির বিস্তারিত জেনে এর পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখতে পারবেন কি না, সে-বিষয়ে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন না। সংসদে যখন এ বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বিতর্ক উঠবে, তখন তারা হয়তো পিছপা হবেন, দোটানায় তুলবেন। পশ্চিমের সংসদ সদস্যরাও নিঃসন্দেহে পূর্বের সংসদ সদস্যদের কাউকে কাউকে লোভ অথবা ভয় দেখিয়ে তাদের পক্ষে টানার জন্য চেষ্টা করবেন। সেই প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা তাদের ছিল। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয় উপলক্ষে ঢাকায় বিশাল এক গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে সমবেত বিশাল জনতার সামনে সংসদ সদস্যদের দিয়ে এ মর্মে শপথবাক্য পাঠ করানো হলো যে ৬-দফা ও পূর্ব বাংলার অন্যান্য দাবি আদায় করার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের যে দায়িত্ব দিয়েছে, সে-ব্যাপারে তারা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবজাত অনুভূতি ও প্রজ্ঞার বলে জনগণের মনের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সামরিক জান্তার হাতে অত্যাচারিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য জাতীয় নেতা ও কর্মী জেলে আটক ছিলেন। দলটি এ-সময়ে দিক-নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। তাকে সেই দলীয় কাঠামো পুনরায় গড়ে তুলতে হয়। দলকে অল্প সময়ের মধ্যে পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিতে হয় এবং দলীয় নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে হয়। ১৯৭০ সাল নাগাদ দলের সদস্যসংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। এই নতুন সদস্যরা পাকিস্তান আমলের নিষ্পেষণের শিকার হননি। সাংসদদের অধিকাংশই ছিলেন নতুন। ৬-দফা সম্পর্কে তাদের বিস্তারিত জ্ঞান এবং এই দাবির প্রতি তাদের অঙ্গীকার সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। সাংসদদের জন্য খুব একটা খুশির বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু গণশপথের মাধ্যমে দলের প্রতি তাদের অবিচল আনুগত্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় এবং তাদের সম্ভাব্য দলত্যাগের ঝুঁকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেন।
সভায় গণশপথ নেওয়ার দিন রাতে আমি নবনির্বাচিত দুই সংসদ সদস্যের সঙ্গে একটা ডিনার পার্টিতে ছিলাম। তাদের একজন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি কর্নেল। বুঝতে পারলাম তারা ৬-দফা দাবির অন্তর্নিহিত বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত নন। ওপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে যে বিশেষজ্ঞ নন, এমন লোকের কাছে ৬-দফার বিষয়গুলো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা না হলে তাদের পক্ষে তা বুঝতে পারা বেশ কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। তারা মোটামুটিভাবে জানতেন যে ৬-দফার বাস্তবায়ন হলে পূর্বাঞ্চল নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারের ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিময় খাত এই উভয় ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলের জন্য অধিকতর সুযোগ তৈরি হবে। ফলে পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটবে এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। এমনকি পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যে সম্পদের পাচার ঘটত, তা বন্ধ হবেÑ এত দূরও বুঝতেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি যে ৬-দফার বাস্তবায়ন হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক কতটা সীমিত ও শিথিল হয়ে পড়বে এবং এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তান এই ৬-দফার কতটা বিরুদ্ধাচরণ করবে। তারা বুঝে উঠতে পারেননি যে এটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সম্পদ ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে কত বড় ত্যাগ বা ক্ষতির কারণ হবে। এ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান হয়তো ৬-দফা মেনে নেওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের বিভক্তিই মেনে নেবে। কথাচ্ছলে বুঝতে পারলাম যে এই দুই নব্য সংসদ সদস্য গণশপথের বিষয়ে ও অসন্তুষ্ট। সাংসদদের সঙ্গে স্কুলবালকের মতো আচরণ তারা মেনে নিতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করলে জনরোষের শিকার হবেন বলে প্রকাশ্য জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটিকে তারা মেনে নিয়েছিলেন।
পরিচালনা কমিটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মাঝেমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হতো, তাতে ৬-দফার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম অনুমাননির্ভর মতামত দেওয়া হতো। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই বলতেন যে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। যদি ৬-দফা আদায় করা যায়, তবে পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার দায়িত্ব পূর্ব পাকিস্তানের ওপরই পড়বে। তেমন হলে তিনি নজরুল ইসলাম অথবা তাজউদ্দীন আহমদকে কেন্দ্রে পাঠাবেন। যদি ৬-দফা আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে তার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অর্থহীন। কেননা, তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে তার প্রকৃত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন না। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে অথবা তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখবে। আগেও যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোনো নেতা প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছেন, তখন এমনটাই ঘটেছে। এছাড়া পূর্বাঞ্চলের সদস্যরাও অতীতে ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বিগত দুই দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ। ৬-দফার মূল বক্তব্য ছিল অতীতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা নাকচ করা। বঙ্গবন্ধু পুরনো ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু : পেছন ফিরে দেখা
এত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর কেউ যদি আজ বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন করতে চান, ব্যাপারটা কেমন হবে? তবে একটা সময় পার হয়ে গেলে কোনো কিছুকে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে ও ভারসাম্যমূলকভাবে বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়। আমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগের পর্বটা ছিল অল্প সময়ের, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এখনও সেই সময়টির মূল্যায়নের সুযোগ এসেছে কি না, আমি জানি না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী (’৭১ সালের আগে) সময়ে তিনি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন এবং যেভাবে তা মোকাবিলা করেছেন, সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা। অন্যদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি যে বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ও যেভাবে তা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, তা মূল্যায়ন করা। আমার সীমিত রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে তার মতো ব্যক্তিত্বের যথাযথ এবং সার্বিক ও সন্তোষজনক মূল্যায়ন আমি সাধ্যাতীত বলে মনে করি। তাছাড়া এ-রকম সার্বিক মূল্যায়নের সময় এখনও এসেছে কি না, আমি জানি না।
১৯৭১-পূর্ববর্তী সময়টায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অব্যাহতভাবে যে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে যে সাহসের পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন, সেটাও বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার এই লক্ষ্য অর্জনে দেশকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তার সমসাময়িকদের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক ওপরের স্তরের। এক্ষেত্রে তার সাময়িক রাজনীতিক এবং অধস্তন বা দলের অন্য নেতাদের ভূমিকা কার্যকর হলেও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার সঙ্গে তা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তিনি বহু বছর পাকিস্তানের অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। সে-জন্যই তিনি জাতির পিতা বা স্থপতি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অবশ্য পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্নরকম হয়ে দাঁড়ায়। তখনকার সমস্যাগুলো ছিল খুবই জটিল; তাছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে সে-সময় বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ গড়ে তোলার জন্য অনেক ক্ষেত্রে একই সঙ্গে অনেক উপযুক্ত এবং সামর্থ্যবান সহকর্মী বা নেতার উদ্যোগের প্রয়োজন হয়। তার জন্য কেবল একজন নেতার ক্যারিশমা বা আকর্ষণীয় চারিত্রিক গুণ এবং জনগণকে জাগিয়ে তোলার বা উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতাই যথেষ্ট নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে বহুমাত্রিক লক্ষ্য অর্জন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তা তার একক প্রচেষ্টায় অর্জন সম্ভব ছিল না। সে-জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত ও সমর্থ রাজনৈতিক সহযোগীর, যারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাসহ তার সব দায়-দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারতেন। তার সহকর্মীদের উচিত ছিল নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও নির্মম সত্যটি হচ্ছে, তার কাছাকাছি যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব ছিল। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল মাত্র কয়েকটি বছর। এই অল্প সময়কালের মধ্যে সরকার নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে ও সংগঠিত হয়েছে। তবে এ-সময়ে যা করণীয় ছিল তার তালিকাও অনেক দীর্ঘ। অনেকের মনে হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে কোনো জটিল নীতি-সংক্রান্ত বিষয় তিনি খুব দ্রুত ধরে ফেলতে ও উপলব্ধি করতে পারতেন। কীভাবে কাজটি করতে হবে, সে-সিদ্ধান্তও নিতে পারতেন।
বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল। এটা সবাই জানত। আমার সঙ্গে যদি কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ হতো বা আমাকে যদি তিনি কোনো নির্দেশনা দিতেন, তা কয়েক মাস পরও মনে রাখতে পারতেন। বিভিন্ন সময় আমাকে নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হয়েছে। আমি দেখেছি যে তিনি তার সামনে উপস্থাপিত বিষয়টির আসল দিকটি খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারতেন। তিনি যে জাতীয়করণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা তিনি এর সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন থেকেই নিয়েছিলেন। তিনি জাতীয়করণ করা শিল্পগুলোকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত করার যুক্তিকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের। কাজেই তিনি বিষয়টি শিল্পমন্ত্রীর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। টাকার অবমূল্যায়ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে মূল ভিত্তিটি কী হবে, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। খাদ্য ও সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিলে অর্থনৈতিক বিবেচনায় কী লাভ-ক্ষতি হবে, সে-ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায়ও তিনি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরিকল্পনা কমিশন এবং এর বাইরে সরকারের বাকি অংশের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে তার ভালো ধারণা ছিল এবং কেন এই দুই অংশের মধ্যে বিরোধ ছিল, তাও বুঝতে পারতেন।
বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি তার সব বিদেশ সফরের সঙ্গী ছিলাম। আমি দেখেছি যে বিভিন্ন বিদেশি নেতার সঙ্গে বৈঠক, আলোচনা ও সমঝোতার সময় তিনি অনেক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি তার উষ্ণ ও ক্যারিশম্যাটিক বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের গুণে তাদের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একনিষ্ঠ ও আপসহীন জাতীয়তাবাদী। তার লক্ষ্য ছিল বৃহৎ শক্তিসহ সব ধরনের রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখা। যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল, আমার ধারণা, তারাও ১৯৭৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খানিকটা হারিয়ে ফেলেছিল। মোটামুটিভাবে একটি জোটনিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর চেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়নকে খুশি করেনি। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাদের অবদানের জন্য তাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে। আমার সঙ্গে সোভিয়েত কর্মকর্তারা আর্থিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনার সময় আমাকে তাদের অবদানের কথা প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও নয়াচীন নীতির কারণে নিক্সন প্রশাসনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে খুবই নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছিল। এটা ১৯৭১ সালেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ-সম্পর্কটা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছিল।
১৯৭২-৭৫ সময়টায় পাকিস্তানের সঙ্গে অনেক অমীমাংসিত বিষয়ের ব্যাপারে সমঝোতার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শক্ত অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব খুশি ছিল না। স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের গাঁটছড়ার কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়েও উদ্বেগের মধ্যে ছিল। জোরালো জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কারণে ১৯৭৫ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধু আসলে কোনো বৃহৎ শক্তির কাছেই আর বিশেষ ঘনিষ্ঠ বা আপন দলের ব্যক্তি বিবেচিত হননি। কোনো শক্তিমান দেশের আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষা করার জন্য তিনি তাদের কারও সঙ্গে সম্পর্ক করতে উৎসাহী ছিলেন না। তার দৃষ্টিতে যে কোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। এবং একই সঙ্গে তিনি এটাও বিবেচনায় রাখতেন যে এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে যাতে অন্য তৃতীয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তিনি দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রশংসা করতেন এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বকে মূল্য দিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টির উল্লেখ করে বিরোধী পক্ষ সব সময়ই এই প্রচারণা চালাত যে বঙ্গবন্ধু ভারতের দাবি পূরণ করতে ও ভারতকে ছাড় দিতে আগ্রহী। কিন্তু এই ধারণা সত্য ছিল না। ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা ব্যারাজ, সীমান্ত বাণিজ্য, যৌথ শিল্প স্থাপন ও পাটের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি খুবই দক্ষতার সঙ্গে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে পারতেন। নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোতে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের তৎকালীন অবস্থান থেকে বুঝতে পারা যায় বঙ্গবন্ধুর নীতি কী ছিল।
দুই দেশের মধ্যে সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির ওপর নির্ভর করত সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান। কয়েক বছর আলাপ-আলোচনার পর সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এই ব্যাপারটি নিরপেক্ষ সালিশের কাছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। স্থল সীমান্ত ও ছিটমহলের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু নিজে উদ্যোগ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বললেন যে পাকিস্তানের সময়কার এই অমীমাংসিত সমস্যার ব্যাপারে সমাধান দরকার। ভারতের মতো বিশাল দেশের পক্ষে সামান্য জমি বা ছিটমহল নিয়ে দর-কষাকষি শোভা পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এই সমস্যার সমাধান দরকার, যেহেতু বাংলাদেশের আয়তনের বিচারে এটা সামান্য বা উপেক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর এই কথায় ভারতের অবস্থান নমনীয় হয় এবং আলোচনার পরিবেশের উন্নতি ঘটে। পরে মীমাংসা সহজতর হয়। ফারাক্কার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও ফারাক্কা ব্যারাজ সম্পূর্ণ চালু করতে দিতে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। সাময়িকভাবে কিছু পানি ছাড়ার ব্যাপারে দুই পক্ষ রাজি হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য নদীর পানি প্রবাহ কীভাবে বর্ধিত করা যায়, যাতে দুই দেশের পানির প্রয়োজন মেটে, সে-বিষয়ে আলোচনা করবে বলে দুই পক্ষ সম্মত হয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একনিষ্ঠ ও আপসহীন জাতীয়তাবাদী। তার লক্ষ্য ছিল বৃহৎ শক্তিসহ সব ধরনের রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখা। যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল, আমার ধারণা, তারাও ১৯৭৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খানিকটা হারিয়ে ফেলেছিল। মোটামুটিভাবে একটি জোটনিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর চেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়নকে খুশি করেনি।
এসব উদাহরণ থেকে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ কোনোরকম দুর্বলতার পরিচয় দেয়নি। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার সতর্ক বিবেচনাবোধ কাজ করেছিল। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা এবং কোনো ব্যাপারে নতি স্বীকারের বিষয়টি এড়িয়ে চলতে তিনি সব সময়ই সচেষ্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে সে-ধরনের সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিতেন, যেগুলোতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে পারে। তিনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা একক বা স্বতন্ত্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। সার্বিক রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এটা গড়ে ওঠে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তার ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার কারণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বন্ধু-ভাবাপন্ন ছিলেন। কিছু রাজনীতিবিদ ও বিদেশনীতির সঙ্গে জড়িত আমলাতন্ত্রসহ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা দিক নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। ভারতের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতি কী রকম হওয়া উচিত, সে-ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই সংকীর্ণ ও অনুদার। সেই বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু কখনও ভারতের প্রতি বেশি সহযোগিতাপ্রবণ বা ছাড় দেওয়ার লোক হিসেবে বিবেচিত হননি। অন্যদিকে বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর ভারতের সম্ভাব্য খবরদারির ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদারের ও বড় মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ হিসেবে ইসলামি দুনিয়ায় বাংলাদেশের কার্যকর ভূমিকার যে উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন, তার পেছনে শুধু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে জোরদার করার উদ্দেশ্যেই কাজ করেনি; বরং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জনগণের মধ্যে যে শঙ্কা বা অস্থিরতা ছিল, সেটা দূর করাও ছিল এর উদ্দেশ্য।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যা ছিল প্রচুর। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ-বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়েছে। ১৯৭৪ সাল নাগাদ সামরিক ও বেসামরিক এই উভয় শাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বা পরস্পরবিরোধী লক্ষণ ছিল। তাতেও সামগ্রিক অস্থিরতার ভাব দেখা যায়। এর উল্লেখযোগ্য কিছু দিক হচ্ছে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে একদিকে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ও নেতৃত্বলোভী সেনা কর্মকর্তাদের অসহিষ্ণুতা, সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত হিসেবে বিবেচিত একটি আধা-সামরিক বাহিনী (রক্ষীবাহিনী) গঠন এবং সে-সম্পর্কে সেনাবাহিনীর অসন্তুষ্টি, সীমিত বেতন, মুদ্রাস্ফীতি, সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতা এবং তাদের আর্থিক অনটন। জনগণের ধারণা ছিল যে ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব এবং সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার নিম্নগতি মিলে তাদের জন্য এক দুরূহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছিল। এ ব্যাপারে আগেই উল্লেখ করেছি যে এ-সময় বঙ্গবন্ধু চিন্তা করেছিলেন, তার শক্ত নেতৃত্বে বাকশাল বা একদলীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে।
ঠিক ১০০ বছর আগে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রচ- প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েও তিনি মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশাপাশি স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিরোধী পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ কাজ ছিল না। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেই চেষ্টাই করেছিলেন। জন্মশতবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি রইল অগাধ সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র
১. ততদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এই দলটিই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে সবচেয়ে সাহসী, উচ্চকণ্ঠ এবং প্রধান মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
২. ২১-দফা কর্মসূচির ১৯ নম্বর দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটা পরিষ্কার রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। এই দফায় বলা হয় : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ব বাংলার সরকারের হাতে আনা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
৩. স্বাধীনতার পর তারা সবাই সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন।
লেখক : বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান