প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ : ২৬ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ ১০ লক্ষাধিক জনতার এক উত্তাল জনসমুদ্রের সভামঞ্চ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলা এবং ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে’ প্রস্তুত থাকার জন্য সর্বস্তরের বাঙালিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান, এর পূর্বে ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন, আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্র, ১ মার্চ হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা, প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির বিপ্লবী অভ্যুত্থান, ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা তথা গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়া, পাকিস্তানি কমান্ডোদের হাতে রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-প্রস্তুতকৃত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র বাণী ওয়্যারলেসের সাহায্যে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং এরপর সমগ্র দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে প্রতিরোধ, অতঃপর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে ১০ এপ্রিল ছয় সদস্যবিশিষ্ট ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে সুপরিচিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন, এই সরকারের সফল নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন, ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- এসবই মনে হয় সেদিনের ঘটনা। অথচ ইতোমধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর সম্পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন, “Pakistan has come to stay.” অর্থাৎ পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে তার ঐ উক্তি অসার প্রমাণিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র মাত্র দুই যুগের মতো কোনোক্রমে টিকে ছিল। বর্তমান পাকিস্তান (উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে) জিন্নাহর পাকিস্তান নয়। এটি হচ্ছে আল্লামা ইকবালের পাকিস্তান, যিনি ১৯৩০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এলাহাবাদ সেশনে সভাপতির ভাষণে ভারতের হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক সমস্যার ‘স্থায়ী’ (?) সমাধানকল্পে এরূপ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য, ইকবালের ঐ রাষ্ট্র-ভাবনায় ভৌগোলিকভাবে বাংলা অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি এবং হাজার মাইলেরও অধিক দূরে অবস্থিত দুটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে, ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ঐ রাষ্ট্র সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ বাণী করে বলেছিলেন, this … would not be of ‘long duration’ and that a partition now would anyhow bring East Bengal into Hindustan in a few years.” অর্থাৎ ভারত বিভক্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না আর অন্তত পূর্ব বাংলা (পরবর্তীতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’, বর্তমান বাংলাদেশ) কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দুস্তান (ভারত)-এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
নেহরুর ভবিষ্যৎ বাণী যেমন অংশত সফল হলেও, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার বক্তব্যের শেষ অংশকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে।
১৯৭১ সালেও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নেহরুর মতো বিশ্বের অনেক প-িত পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে খুবই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু তাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের অপেক্ষায় দ্বিগুণেরও বেশি সময় অর্থাৎ ৫০ বছর ধরে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে সমর্থ হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রিয় স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দর থেকে সোজা রেসকোর্স ময়দানে এসে সেখানে অপেক্ষমাণ কয়েক লাখ জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন,
“আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালীও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নেই।”
বঙ্গবন্ধুর এ উক্তি যে কত সঠিক, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালির সত্যিকার ইতিহাস, স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও তার স্বীকৃতি অর্জনে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম সম্বন্ধে সামান্য ধারণা কারও থাকলে বঙ্গবন্ধুর উক্তির যথার্থতা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান যে টিকে থাকবে না এবং পূর্ব বাংলার/বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে অপরিহার্য (Inevitable), তা নেহরুর চেয়েও বঙ্গবন্ধু অধিকতর বেশি করে বুঝতে পেরেছিলেন। কেননা, ১৯৪৭ সালে ভারতের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত পাকিস্তান ছিল একটি অবাস্তব বা অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু এরূপ রাষ্ট্রে আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না। তার বিশ্বাস ছিল, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের বহুমাত্রিক (Plural) রাষ্ট্র ধারণায় (Independent States)। অর্থাৎ বর্তমান পাকিস্তানের অনুরূপ (স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে) ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহ) নিয়ে সেখানে অপর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সে-লক্ষ্যে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিল, যা সোহরাওয়ার্দীর (যুক্ত বাংলার সর্বশেষ মুখমন্ত্রী) ‘স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নামে পরিচিত। সেই উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় এর পক্ষে ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হন, যদিও নানা কারণে ঐ উদ্যোগ সেদিন সফলকাম হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে শুরু থেকেই ’৪৮ ও ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে বাঙালির স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তারই নেতৃত্বে ষাটের দশকে ৬-দফা, ১১-দফাভিত্তিক আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়, ’৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানো, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি কমান্ডোদের হাতে বন্দি হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, অতঃপর ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত ৬-সদস্যবিশিষ্ট ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত প্রথম বাংলাদেশে সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। অর্জিত হয় বাঙালির হাজার বছর ধরে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতায় লালিত স্বপ্ন। তাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জারের কুখ্যাত উক্তি ছিল, “Bangladesh will be an international basket case.” অর্থাৎ বাংলাদেশ হবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য ভিক্ষার ঝুলি হাতে একটি দেশ। তিনি বাংলাদেশকে ‘Bottomless Basket’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি।
কিন্তু আজ সারাবিশ্ব বাংলাদেশের কী ছবি দেখছে? সব মহলের বিভ্রান্তি আর জল্পনা-কল্পনা অসার বা ভ্রান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ সালে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ বা মুজিববর্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। একই সঙ্গে ২৬ মার্চ ২০২১ উদযাপন করতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী (অর্থাৎ ৫০ বছরের পূর্ণতা)। বাঙালির জাতীয় জীবনে এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ। জাতির পিতার কন্যা ও তার আদর্শের উত্তরাধিকারী জনগণমননন্দিত নেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য, দৃঢ়, বিচক্ষণ ও সৃষ্টিশীল নেতৃত্বে বিগত এক দশকেরও অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্ববাসীর জন্য এক বড় বিস্ময়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশসমূহের জন্য ‘রোল মডেল’।
শুধু উন্নয়নকামী-উন্নয়নশীল দেশের জন্য বলি কেন, অনেক ক্ষেত্রে যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security) বিধান, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মসেতু নির্মাণে সামর্থ্য, কোভিড-১৯ বা করোনা প্যান্ডামিক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা ও নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে জনগণের জন্য ভ্যাকসিনেশনের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের জন্যও অনুকরণীয় ও ঈর্ষণীয় বিষয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) পর সেদেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে যেখানে প্রায় ৯ বছর সময় লাগে, সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সংবিধান মাত্র ১০ মাসে রচনা করা সম্ভব হয়, যা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধু সরকার (১৯৭২-৭৫) ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন সম্পন্ন করে সর্বক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠান-কাঠামের ভিত্তি স্থাপন করে। জাতিসংঘ ছাড়াও (১৯৭৪) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভসহ বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের আমলানির্ভর প্রশাসন ব্যবস্থা স্বাধীন দেশের প্রয়োজন, সমাজ-চাহিদা ও উন্নয়ন-ভাবনা বাস্তবায়নের উপযোগী না হওয়ায়, এর আমূল পরিবর্তন সাধন করে একটি গণমুখী, গণতান্ত্রিক ও বিকেন্দ্রিভূত প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বা সিস্টেম চেইঞ্জের কর্মসূচি গ্রহণ করে দ্রুতপদে সারা জীবনের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’ তথা ‘সোনার বাংলা’ কায়েমে এগিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশি মহলের ষড়যন্ত্রের নীল-নকশায় একদল ঘাতক-খুনির হাতে অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে শাহাদাতবরণ করেন বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য। পরিবারের আদরের কনিষ্ঠ সন্তান, নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, গর্ভবর্তী নারী কেউ খুনিদের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পায়নি। একই বছর ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় একই ঘাতক-খুনি চক্র হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে।
এরপর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সেনাশাসন (১৯৭৫-৯০), বেগম খালেদা জিয়ার জামায়াত-সমর্থিত বিএনপি সরকার (১৯৯১-৯৬)-এর শাসন এবং সর্বশেষে বিএনপি-জামাত জোট সরকার (২০০১-০৬)-এর আমলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে তাকে স্থায়িত্বদানের অপচেষ্টা করা হয়। ২০০৭-০৮ সময়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনা-আমলা শাসন স্থায়ী করার লক্ষ্যে বিরাজনীতিকরণের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী সকল হীন প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। প্রথমে দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এ সরকারের সময়কালে (১৯৯৬-২০০১) মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রাষ্ট্র ও সরকারি পর্যায়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। সরকার এছাড়া অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে নির্বাচনোত্তর সরকার গঠন করে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরপর তিনবার শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন থেকে বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
গত ৫০ বছরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, জেনারেল জিয়ার সেনাশাসন আমলে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা সদস্যদের হত্যা, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর জনসমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মীকে ঘটনাস্থলে হত্যা এবং বহুজনকে আহত ও চিরদিনের জন্য পঙ্গু করা, শাহ এএমএস কিবরিয়া, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মমতাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় এক রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহে ৫৮ সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা, শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে অন্তত ২৪ বার হত্যা-প্রচেষ্টা, দীর্ঘ ২৯ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সামরিক-বেসামরিক পোশাকে পাকিস্তানি ভাবধারার সাম্প্রদায়িক, সেনা-আমলা কর্তৃত্ববাদী, প্রতিক্রিয়াশীল শাসন ইত্যাদি দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা এ সময়ে আমাদের জাতীয় জীবনে সংঘটিত হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে তিন বছর বাদ দিলে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দল তারই কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মোট চার টার্মে এ পর্যন্ত ১৬ বছর সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে যে ভূমিকা ইতোমধ্যে পালন করেছে, তাকে এক কথায় অভিহিত করা যায় উন্নয়নের অভিযাত্রায় ‘স্বর্ণযুগ’।
কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) বাতিল করে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে অনেকের বিচার অনুষ্ঠান ও রায় কার্যকর করা, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার এবং এদের মধ্যে শীর্ষ অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা, ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি (১১ ডিসেম্বর ১৯৯৬), পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (২ ডিসেম্বর ১৯৯৭), খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের বিশ্বে চতুর্থ স্থান এবং সবজি উৎপাদনে পঞ্চম স্থান অধিকার, মানুষের গড় আয়ু পাকিস্তান আমলের ২৭ বছরের স্থলে ৭৩ বছরে উন্নীত, সাক্ষরতার হার পাকিস্তান আমলের ১৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে তা ৭৩ শতাংশের ঊর্ধ্বে উন্নয়ন, নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পদ্মসেতু (৬.১৫ কিমি) নির্মাণ, দারিদ্র্যের হার ৪৪ থেকে ২১ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যে ২২ থেকে ১১ শতাংশে হ্রাস, সেনাবাহিনী, বিচারালয়, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে সকল কর্ম-পেশায় নারীর লক্ষণীয় অংশগ্রহণ এবং সার্বিকভাবে ক্ষমতায়ন, স্কুলগামী শতভাগ শিশুর স্কুলে গমন ও শিক্ষালাভের ব্যবস্থা, ঝরে পড়ার হার রোধ, সংখ্যা বিচারে উচ্চশিক্ষায় বিস্ফোরণ (৩.৮ মিলিয়ন), পাকিস্তান আমলের ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থলে ৪৫টি পাবলিক ও ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেডিকেল, টেক্সটাইল, ম্যারিটাইম, এভিয়েশন সায়েন্সেস, ডিজিটাল ইত্যাদি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিশু ও মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস, গ্রামীণ জনগণের মাঝে চিকিৎসাসেবা প্রদানে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থা বা লোডশেডিং যুগের সম্পূর্ণ অবসান ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করে দেশের ৯৫ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হওয়া, গত এক দশক ধরে প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকা, স্বাধীনতা-উত্তর মানুষের মাথাপিছু আয় মাত্র ১০০ ইউএস ডলার থেকে তা বর্তমানে ২০৬৪ ডলারে উন্নীত, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে যথাক্রমে ২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি, ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছিটমহল বিনিময় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান (৩১ জুলাই ২০১৬), চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে ট্যানেল, পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ঢাকায় মেট্রোরেল যোগাযোগ ইত্যাদি বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প, দশম শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বছরে প্রায় ৩৮ কোটি পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, অক্ষম, দুস্থ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, বৃদ্ধ ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Social Safety Net), ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জন (১৭ নভেম্বর ১৯৯৯), বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তি (৩০ অক্টোবর ২০১৭), সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (৩ জুলাই ২০১১)-এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রপরিচালনার মূল চার নীতি পুনঃস্থাপন, জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি অর্জন (১৫ মার্চ ২০১৭), জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও তৎপরতা কঠোর হস্তে দমন, মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গ্রহণ ইত্যাদি অর্জন এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।
২০২০-২১ সালকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষ হিসেবে জাতি পালন করছে আর ২০২১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ দুটি মাহেন্দ্রক্ষণ একই সঙ্গে বাঙালির জাতীয় জীবনে নদীর স্রোতধারার মতো একই মোহনায় এসে মিশে গেছে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ কবিতার পঙ্ক্তির মতো অবিচ্ছেদ্য, অভিন্ন সত্তায় সমার্থবোধক। বাংলাদেশকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর বুক ভরা আশা আর অনেক স্বপ্ন ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অন্যদিকে চরম বৈরী প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ও স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের মধ্যে পড়ে সৃষ্ট ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষের মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে বেদনার্ত করে। এর মধ্যেও বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি ছিলেন প্রচ- আশাবাদী। স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও উন্নয়ন চাহিদা উপযোগী করে গড়ে তুলতে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তার দ্বিতীয় বিপ্লব বা ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’ কর্মসূচি গ্রহণকালে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“মাটি আছে মানুষ আছে, দেশ আছে, ইনশা আল্লাহ্! কষ্ট হয়েছে আমার মানুষের, না খেয়ে মরেছে, সত্য কথা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে যে সম্পদ আছে যদি গড়তে পারি, অনেস্টলি কাজ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের কষ্ট একদিন দূর হয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
তিনি এও বলেন,
“অন্যান্য দেশ যত বড়ই হোক না কেন, ভবিষ্যতে তারা আমাদের ফলো করবে, যদি আমাদের সিস্টেম সাকসেসফুল হয়।… ‘ইনশা আল্লাহ্, আই সি এ ব্রাইট ফিউচার অব মাই কান্ট্রি।”
বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য অনুযায়ী, সত্যিই ‘অনেস্টলি’ (যা রাজনীতিতে বিরল) ও সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন বলে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অর্জন যে আজ আকাশ ছোঁয়া, সে-কথা বলতেই হবে। সত্যি-সত্যিই, উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের অনেক দেশ বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘ফলো’ করছে, যার ভবিষ্যৎ বাণী জাতির পিতা আজ থেকে ৪৬ বছর পূর্বে করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এও বলেছিলেন, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, “আইসিএ ব্রাইট ফিউচার অব মাই কান্ট্রি।”
সত্যিই, বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে অপার এক সম্ভাবনা। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ যে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’র দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
লেখক : প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়