ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি
ভূমিকা
বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো কৃষি। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবনমানের উন্নয়নে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে সার্বিক কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া, কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহ এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সাথে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদেশের সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি এবং সার্বিক জীবনপ্রবাহও কৃষিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কৃষির এই সার্বিক গুরুত্ব উপলব্ধি করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে।” সাত কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তিনি কৃষিকেই মূল চাবিকাঠি মনে করেছিলেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও উর্বর জমি সারাবছর ধরে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। তাই, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের দেশের জমি এত উর্বর যে বীজ ফেললেই গাছ হয়, গাছ হলে ফল হয়। সে দেশের মানুষ কেন ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাবে।”
বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন-ভাবনা
আবহমানকাল ধরে বাংলা ছিল ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা। বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্পের কারণে এটি ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাঠান, মুঘল, ইংরেজ শাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আমলেও বাংলার কৃষক ছিল অন্তহীন শোষণ ও বঞ্চনার শিকার এবং নিপীড়িত ও অবহেলিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গ্রামের ছেলে হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৈশোর-তরুণ বয়স থেকেই বাংলার কৃষকের দৈন্যদশা স্বচক্ষে দেখেছেন, যা তার কোমল হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধুর সারা রাজনৈতিক জীবনজুড়ে কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ও কল্যাণ-ভাবনা নিবিড়ভাবে কাজ করেছে।
আমরা দেখতে পাই, সেই পঞ্চাশের দশকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষক ও কৃষি উন্নয়নের কথা বলতেন অত্যন্ত জোরালোভাবে। পাকিস্তানের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় কৃষি উন্নয়ন, পাটের মূল্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় সবিশেষ গুরুত্ব পায়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, “এ যাবৎ বাংলার সোনালী আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে।” এখানে তিনি পাটের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, “একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষিপণ্যের অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা নিতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক।”
বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন উদ্যোগ
ষাটের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ‘সবুজ বিপ্লব’ শুরু হলেও তার ছোঁয়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের মাটিতে লাগতে দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। তিনি বলেন, “আমাদের চাষী হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে।” তাই, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই নিলেন কৃষকদের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তাদের সমস্ত বকেয়া খাজনার সুদ মওকুফ করে দিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনাও মওকুফ করার ঘোষণা দিলেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করেন। উদ্বৃত্ত জমি ও খাস জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে বণ্টনের উদ্যোগ নিলেন। পাকিস্তানি শাসন আমলে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেন এবং তাদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মওকুফ করে দেওয়া হয়। দেশের জন্য দ্রুত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করেন প্রথম পরিকল্পনা কমিশন।
বিএডিসির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচযন্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি সারের ব্যবহার ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। যেখানে ১৯৭১-৭২ সালে সারের ব্যবহার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টন, ১৯৭৪-৭৫ সালে তা ৩ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়। নগদ ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কৃষকের মাঝে সেচযন্ত্র বিক্রির ব্যবস্থা করেন। যেখানে ১৯৭১-৭২ সালে অগভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ৬৮৫টি, গভীর নলকূপের সংখ্যা ৯০৬টি এবং পাওয়ার পাম্পের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ২৪৩টি, তা ১৯৭৪-৭৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ হাজার ২৯টি, ২ হাজার ৯০০টি এবং ৪০ হাজারটিতে। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জরুরিভিত্তিতে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে কৃষি উৎপাদনের জন্য ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ ও ১ হাজার ৩৭ টন গমবীজ সরবরাহ করা হয়। প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনাতে কৃষিতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩১ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৭ শতাংশ। পুরো সময়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৭ শতাংশ। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পর সামরিক স্বৈরাচারদের আমলে কৃষিতে বরাদ্দ কমে যায়। যথাযথ দিক-নির্দেশনার অভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ কমে আশঙ্কাজনক হারে। তৃতীয় ও চতুর্থ বার্ষিকীতে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে মাত্র ১.৭ শতাংশ এবং ০.৮৬ শতাংশ। ১৯৭১-৭২ সালে যেখানে খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন, মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪-৭৫ সালে তা উন্নীত হয় ১ কোটি ১৪ লাখ টনে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির জন্য প্রযুক্তি ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি জানতেন কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এগুলোর বিস্তার ঘটানো ছাড়া কৃষির সঠিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের জন্য কোনো শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া, জাতীয় গবেষণা সিস্টেমের অধীনে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ সেবাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গমন একটি চিরস্মরণীয় ঘটনা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সবুজ বিপ্লব ও কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রমী চাষিদের সাথে সাথে মেধাবী কৃষিবিদদেরও প্রয়োজন হবে। তিনি সরকারি চাকরিতে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে কৃষির আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সমবায়ের আন্দোলনকে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও খ–বিখ- জমিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষি কাজে যন্ত্রের ব্যবহার সহজতর করতে তিনি সমবায় চাষাবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভে আমরা জমি নেবো না, জমি মালিকের থাকবে।” কিন্তু দুঃখজনকভাবে সময়ের কারণে সমবায় নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।
কৃষি বিপ্লবে শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও সাফল্য
গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকের ব্যবহার, নানা ধরনের প্রণোদনা এবং সার্বিক কৃষক-দরদি নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল, তার অনুসরণে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদে এবং টানা তৃতীয় মেয়াদে ২০০৯-২০১৪ প্রথম মেয়াদ, ২০১৪-২০১৮ দ্বিতীয় মেয়াদ এবং তৃতীয় মেয়াদের (বর্তমান সময় অবধি) বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে বাংলাদেশ হয়েছে খাদ্য ঘাটতির দেশ। এই খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলা করা হয়েছে হয় খাদ্য আমদানি করে অথবা বিদেশি সাহায্য দিয়ে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলতেন ভিক্ষুকের জাতির কোনো সম্মান থাকে না। বাংলাদেশ অস্বাভাবিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাছাড়া এই দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। একটি দেশের খাদ্য উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সেদেশের চাষাবাদের ভূমি ও পানি। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে (প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে), অন্যদিকে শহর সৃষ্টি, শিল্প-কারখানা নির্মাণ, বাড়িঘর তৈরি ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমছে। ১৯৭১-৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ, তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। কৃষি উন্নয়নে আগে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যেত ওডিএ-এর ১৮-২০ শতাংশ, যা কমে হয়েছে ২ শতাংশেরও কম। দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ায় মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পূরণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে অব্যাহতভাবে।
উপরে উল্লিখিত প্রতিকূল বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিয়ে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং তা টেকসই রাখা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে বিভিন্ন কর্মকা- বাস্তবায়ন শুরু হয়। মাত্র পাঁচ বছরে উন্নয়ন-অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দেশে ৪০ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক ‘সেরেস’ পদকে ভূষিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আবার কৃষিতে স্থবিরতা নেমে আসে। ২০০১-০২ সালে দানাজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ২৬৮ লাখ টন থেকে নেমে আসে ২৬১ লাখ টনে। সূচিত হয় আবার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা।
দেশরতœ শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন। তারপর থেকে কৃষিতে উন্নয়নের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আবার শুরু হয়। দারিদ্র্য বিমোচন করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লক্ষ্যসমূহের অন্যতম। দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল হচ্ছে কৃষি ও পল্লি-জীবনে গতিশীলতা। কৃষিই দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন ও বীজ সরবরাহ, কৃষি উপকরণে প্রণোদনা প্রদান, সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রবর্তন এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, কৃষি খাতের উন্নয়নে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি জমির আওতা সম্প্রসারণ, কৃষকদের ডাটাবেইজ তৈরিকরণ, প্রশিক্ষণ, শস্য বহুমুখীকরণ, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সহায়ক পরিবেশ সৃজন, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি গবেষণার জন্য এনডাউমেন্ট ফান্ড মঞ্জুর এবং উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার্থে জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর অব্যাহতভাবে করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ কৃষি উপকরণেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কৃষি উপকরণের দাম যেমন কমিয়েছে তেমনি সহজলভ্য করে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সরকার সারের মূল্য চার-দফায় কমিয়ে প্রতি কেজি টিএসপি ৮০ টাকা থেকে ২২ টাকা, এমওপি ৭০ টাকা থেকে ১৫ টাকা, ডিএপি ৯০ টাকা থেকে ১৬ টাকা করেছে। এছাড়া, গত ১০ বছরে সার, বিদ্যুৎ, আখ ও ডিজেল ইত্যাদি খাতে মোট ৭৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও প্রতিকূলসহিষ্ণু উন্নতমানের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে। কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত (এনএআরএস) গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫৫টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৫৯১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ও নেতৃত্বে এদেশের বিজ্ঞানীরা সোনালি আঁশ পাটের ‘জিননকশা’ উন্মোচন করেছে, হারিয়ে যাওয়া ‘জগদ্বিখ্যাত ঢাকাই মসলিন’কে ফিরিয়ে এনেছে।
কৃষকরতœ শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও দূরদর্শিতায় সরকারের কৃষি ও কৃষকবান্ধবনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে কৃষি খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ১৯৭০-৭১ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য (চাল, গম ও ভুট্টা) উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বলেছিলেন, “দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না, যদি চাউল খেতে হয়Ñ আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে।” এখন চালের জন্য আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না। বিগত অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। সীমিত জমিতে উৎপাদন হয়েছে ভুট্টা ৫৪ লাখ টন, আলু ১ কোটি ৯ লাখ টন, শাক-সবজি ১ কোটি ৮৫ লাখ টন এবং পেঁয়াজ ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া, বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে।
দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় কৃষিতে সরকারের বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো কৃষিকে আধুনিকায়ন ও লাভজনক করা। সনাতন পদ্ধতির কৃষিতে ফসল উৎপাদনে খরচ অনেক বেশি ও সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া, কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সেজন্য সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সারাদেশে ৫০ শতাংশ ও হাওড়-উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার ৮৬৮টি কম্বাইন হারভেস্টর, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রায় ৫২ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হবে।
দেশি-বিদেশি ফল চাষেও অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। সরকার পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং খোরপোষের কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের জন্য অর্থকরী ফসল ও ফলমূল চাষে গুরুত্ব আরোপ করছে। কফি, কাজুবাদাম, গোলমরিচ, ড্রাগন ফলসহ অপ্রচলিত ফসলের চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে চারা, বীজ, প্রযুক্তি, পরামর্শসহ নানা প্রণোদনা। ফলে, দেশিয় ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে তেমনি ফল আমদানি কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট ফল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ মেট্রিক টন (পোস্ট হার্ভেস্ট লস বাদে ৭৫ লাখ মেট্রিক টন), রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৬৮৬ মেট্রিক টন। অপ্রচলিত ফল কাজুবাদাম ১ হাজার ৩২৩ টন ও কফি ৫৫ টন উৎপাদন হয়েছে। ২০০৬ সালে মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার ছিল ৫৫ গ্রাম, যা বেড়ে ২০১৮-তে হয়েছে ৮৫ গ্রাম। তাছাড়া, পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি চাহিদা পূরণেও কাজ চলমান আছে।
আজ আমরা দানা-জাতীয় খাদ্যের সাথে পুষ্টি-জাতীয় খাবার দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ও ফলমূল শাক-সবজির কথা বলছি, যা বঙ্গবন্ধু সেই সময়ে অনেক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “খাদ্য শুধু চাউল-আটা নয়, মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-তরকারীও আছে। কৃষিতে এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি, পোল্ট্রি যাই বলেন সবদিকে নজর দিতে হবে, প্ল্যানওয়েতে চলতে হবে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রদত্ত বিশেষ অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সকলের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসম্মত খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে সচেষ্ট রয়েছে। সে-জন্য গবাদি পশুপাখির টিকা উৎপাদন, চিকিৎসাসেবা প্রদান, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর ফার্ম, মৎস্য চাষের খামার স্থাপনসহ নানা কার্যক্রমে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। ফলে, দুধ, ডিম, মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টি-জাতীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন যথাক্রমে ২৯.৫০ লাখ টন, ১৯.৯০ লাখ টন ও ৬০৭ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যথাক্রমে ১ কোটি ৬ লাখ টন, ৭৬.৭৪ লাখ টন এবং ১,৭৩৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বিগত ১২ বছরে মাছের উৎপাদন ২৭.০১ লাখ টন থেকে বেড়ে ৪৪.৮৮ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ আহরণে প্রথম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে মাছ আহরণে পঞ্চম এবং গবাদিপশু উৎপাদনে ১২তম স্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ৬২ গ্রাম মাছ, ২৫০ মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। এর বিপরীতে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন জনপ্রতি প্রাপ্যতা হচ্ছে মাছ ৬২.৫৮ গ্রাম, দুধ ১৭৫.৬৩ এমএল, মাংস ১২৬.২০ গ্রাম ও বছরে ডিম ১০৪টি।
চলমান কোভিড-১৯ এর কারণে বিগত এক বছর ধরে সারাবিশ্ব এক চরম ক্রান্তিকাল ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা প্রদান করেন যে, “খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে।” করোনাকালীন খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং তা বৃদ্ধিতে নেওয়া হয় কার্যকর নানা পদক্ষেপ। ফলে কোভিড পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশে কৃষির উৎপাদন ও সরবরাহের ধারা অব্যাহত থাকে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এই দুর্যোগেও বিশ্বে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমবায় ধারণাকে গ্রামীণ উন্নয়ন-ভাবনার সঙ্গে একীভূত করে চালু করেছেন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প, যা গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও দুষ্প্রাপ্য সীমিত সম্পদের ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখছে। গ্রামীণ মানুষের সঞ্চিত মূলধন কীভাবে আরও উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করা যায় সেই উদ্দেশে পল্লি সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পল্লি এলাকায় মূলধন প্রবাহ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটা সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে। বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হলো ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। এসব উদ্যোগ এ লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে।
উপসংহার
আজ আমরা ইতিহাসের এক সোনালি সময় উদযাপন করছি। স্বাধীনতার মহান স্থপতি, সকল উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা-রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি এ-বছর। একই সাথে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। এই মহালগ্নে, যুগসন্ধিক্ষণে আমরা দেখছি, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ‘সোনার বাংলা’ নির্মাণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাস্তবে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এখন মানুষ পেট ভরে খেতে পায়। মুজিববর্ষে আমাদের জাতীয় জীবনে এটি মহা-আনন্দের ও গৌরবের ঘটনা। এ দৃষ্টান্তবহুল ও বিশ্বময় প্রশংসিত অর্জন সম্ভব হয়েছে- আমাদের জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিক-নির্দেশনায়, তার নেতৃত্বে ও প্রেরণায়।
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের এই সাফল্য সারা পৃথিবীতে বহুলভাবে প্রশংসিত ও নন্দিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞগণ, বিশ্বের গণমাধ্যম বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করছে। যারা এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, তারা আজ বলছে, Bangladesh has shown the pesimist world that Bangladesh no longer is a basket case. আরও উল্লেখ করা যায়, আমেরিকায় প্রকাশিত ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর ১৭ জুন ২০১৫ সংখ্যায় বলেছে, “Bangladesh has transformed into something of a food basket and model for hunger reduction for the rest of the world.”
দেশের উন্নয়ন হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, নেতৃত্ব ও সাযুজ্যপূর্ণ নীতিমালার গভীর সংমিশ্রণ। শুধু কৃষি উন্নয়নের এই সাফল্যই নয়; বরং স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের যত কিছু সাফল্য-অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তার সবই এসেছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার হাত ধরে। একটি নিম্ন আয়ের দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়ে উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের এক অভূতপূর্ব উল্লম্ফন ঘটেছে। তার প্রধান কৃতিত্ব শেখ হাসিনা সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। তিনি দেশকে মর্যাদা ও সম্মানে বিশ্ব পরিম-লে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’- এ প্রতিশ্রুত অন্যতম লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ‘সকলের জন্য পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান’। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪২) প্রণয়ন করেছে। কৃষি, কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) কৌশল অনুসরণের ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে উন্নীত হতে চাই। এ লক্ষ্যে কৃষির আধুনিকায়ন, যান্ত্রিকীকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ সাধন, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, সাপ্লাই চেইন/ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা, গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন, বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ এবং কৃষিজ ও অকৃষিজ পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ ইত্যাদি কর্মকা-ের বাস্তবায়ন আরও ত্বরান্বিত ও গতিময় করা হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলোকবর্তিকা তার সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার হাতে। তার নেতৃত্বে আমরা গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সমৃদ্ধ ও শান্তির ‘সোনার বাংলা’।
লেখক : মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রণালয় ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ