Sunday, September 24, 2023
বাড়িSlider২০২১ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা

২০২১ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা

সাইদ আহমেদ বাবু: নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে এক বড় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শত বছর পেরিয়েও যার গুরুত্ব এবং আকর্ষণ অটল। গবেষণার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগের সাফল্যের বিচারে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার। দুয়েরই গুরুত্ব সমান। আসলে তত্ত্বের হাত ধরেই আসে প্রযুক্তি এবং জনজীবনে তার সার্থক প্রয়োগ। নোবেল কমিটির সনদ অনুযায়ী এই পুরস্কারের প্রবর্তক বার্নার্ড আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুদিন ১০ ডিসেম্বরে এক বর্ণাঢ্য সমাবেশে বিজেতাদের স্বর্ণপদক, আর্থিক সম্মানী এবং মানপত্র দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হবে। আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে এই পুরস্কারের পুরো নাম রাখা হয় ‘দ্য সেভেরিজেস রিক্সব্যাংক প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’।

সাহিত্যে নোবেল আবদুল রাজাক গুরনাহ
তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুল রাজাক গুরনাহ এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্যারাডাইস নামে তার চতুর্থ উপন্যাসের জন্য তিনি এ সম্মাননা পেয়েছেন। পুরস্কারে ভূষিত তানজানিয়ার সাহিত্যিক আবদুল রাজাক গুরনাহর নাম ছড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
সুইডিশ একাডেমি বলেছে, আবদুল রাজাক গুরনাহের আপোসহীন ও দরদি লেখায় ঔপনিবেশবাদ, দাসত্বের বেড়াজালে আত্মপরিচয় এবং স্থানান্তরের বিষয়গুলো ঠাঁই পেয়েছে তার সাহিত্যকর্মে। শরণার্থীদের জীবন কীভাবে বদলে যায়, নতুন জীবনের সঙ্গে কীভাবে খাপ খায়, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান কীভাবে প্রভাবিত করে জীবনকে, এসব প্রাধান্য পেয়েছে তার লেখায়। ভূমিচ্যুত হওয়ার বেদনা তাকে উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে। কলম ধরেন ভূমিচ্যুতের বেদনা ও ফেলে আসা স্মৃতি, সত্তাকে আশ্রয় করে। তার চরিত্ররা নিজেদের খুঁজে পায় সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, মহাদেশ থেকে মহাদেশের মাঝে এক শূন্যস্থানে, এক অবলম্বনহীন অস্তিত্বে। ১৭ বছর বয়সে জন্মভূমি ছাড়া আবদুল রাজাক সব সময় শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা চিত্রায়িত করতে প্রয়াসী হয়েছেন তার সাহিত্যপটে।

রসায়নে নোবেল পুরস্কার
রসায়নে এবারের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বেনিয়ামিন লিস্টের জন্ম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে ১৯৬৮ সালে। অন্য বিজয়ী ডেভিড ডব্লিউ সি ম্যাকমিলানের জন্মও একই বছর, যুক্তরাজ্যের বেলশিলে। জৈব-অনুঘটন বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য তাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যৌগ অণুু তৈরি করতে অ্যাসিমেট্রিক অর্গ্যানোক্যাটালিসিস নামে এক বিক্রিয়া আবিষ্কার করেন তারা। এর মাধ্যমে অনুঘটক হিসেবে ধাতু বা উৎসেচক নয়, কার্বনের জৈব যৌগের সাহায্যে একই ধরনের অণু তৈরি করা সম্ভব। এই নতুন আবিষ্কার ইতোমধ্যেই মানবজাতিকে দারুণভাবে সাহায্য করতে শুরু করেছে।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
চলতি বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন। এরা হলেনÑ জাপানি আবহাওয়াবিদ স্যুকুরো মানাবে, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ক্লাউস হাসেলমান এবং ইতালিয়ান পদার্থবিদ জর্জিও পারিসি।
মানাবে দেখিয়েছেন, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বর্ধিত মাত্রা কীভাবে উষ্ণায়ন ঘটায়। হাসেলমান প্রমাণ করেছেন, মানুষের নিত্য ব্যবহারে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর তাপ বৃদ্ধির মূল কারণ। বৈশ্বিক উষ্ণতার পূর্বাভাস প্রদান এবং কমপ্লেক্স ফিজিক্যাল সিস্টেম সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার বিষয়ে যুগান্তকারী অবদানের জন্য তারা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তারা দুজনে এ বছরের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন।
পারমাণবিক থেকে মহাজাগতিক স্তরে ভৌত বস্তুর অন্দরে বিশৃঙ্খলা ও পরিবর্তন ঘটে, তা সহজে করে যে বোঝার পথ আবিষ্কার করেছেন পারিসি। তা আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারের বাকি অর্ধেক পেয়েছেন জর্জিও পারিসি।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ঔষধ গবেষণার ক্ষেত্রে বিরল কৃতিত্বের জন্য দুই আমেরিকান বিজ্ঞানীকে ডেভিড জুলিয়াস এবং আর্ডেম পাতাপৌতিয়ানকে এবার যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাপমাত্রা এবং স্পর্শের রিসেপ্টর আবিষ্কারের জন্য তাদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কীভাবে স্নায়ুতন্ত্র শনাক্ত করে ফেলে তাপমাত্রার তারতম্য? উত্তাপ, শৈত্য, বিভিন্ন ব্যক্তি ও বস্তুকে স্পর্শ করার অনুভূতিগুলো কেন একে অন্যের থেকে আলাদা? তাপমাত্রা ও স্পর্শবোধের অনুভূতির এই রহস্য ভেদ করার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন ডেভিড জুলিয়াস এবং আর্ডেম পাটাপুটিয়ান।
ডেভিড জুলিয়াস আমাদের ত্বকে যেসব নার্ভ আছে তারা তাপের ক্ষেত্রে কীরকমভাবে রেসপন্স করে সেটি দেখিয়েছেন। আর আর্ডেম পাতাপৌতিয়ানও এই ত্বকের নার্ভ চাপের ক্ষেত্রে কীরকম আচরণ করে সেটি দেখিয়েছেন। তাদের এই যৌথ কাজ আগামী দিনে চিকিৎসাবিদ্যাকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই বছরের নোবেল পুরস্কারে বিজয়ীদের আবিষ্কারের কারণে আমরা এটা জানতে পেরেছি যে, কীভাবে তাপ, ঠা-া এবং যান্ত্রিক শক্তি আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি ও বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি। এই অনুভূতি বোঝার জন্য রিসেপ্টর আবিষ্কার করেছেন তারা।

অর্থনীতিতে
অর্থনীতিতে নোবেল ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি বছর এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ডেভিড কার্ড, জোশুয়া ডি অ্যাংরিস্ট এবং গুইদো ডব্লিউ ইমবেন্স। নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পাবেন ডেভিড কার্ড এবং বাকি অর্ধেক পাবেন অন্য দুই অর্থনীতিবিদ। শ্রম অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ডেভিড কার্ড এবং কারণগত সম্পর্ক বিশ্লেষণে পদ্ধতিগত অবদানের জন্য বাকি দুই অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতালব্ধ’ গবেষণার জন্য মনোনীত করা হয়েছে এই ত্রয়ীকে। দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের জানিয়েছে, অর্থনৈতিক বিজ্ঞানকে পুনর্নির্মাণ করেছে তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ গবেষণা। সুইডিশ অ্যাকাডেমি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, শ্রম বাজারের নতুন দিক দেখিয়েছেন ডেভিড কার্ড, জোসুয়া ডি অয়াঙ্গরিস্ট ও গুইডো ডব্লু ইমবেনস প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কারণ ও ফলাফল জানা সম্ভব বলে দেখিয়েছেন তারা।

শান্তিতে নোবেল
এ বছর শান্তিতে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার, বাকস্বাধীনতার পক্ষে আজীবন লড়াই চালিয়ে যাওয়া দুই সাংবাদিক মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাতভ পেলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য দুঃসাহসিক লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। মুরাতভ ১৯৯৩ সাল থেকে কর্মরত ‘নভায়া গেজেতা’র পুরো টিমকে বিশেষ করে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে পাঁচজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন, নিজের অর্জন এই পুরস্কার নিহতদের উৎসর্গ করেছেন মুরাতভ। দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন তারা। এখনও কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠায়। শান্তিতে তাদের নোবেল পুরস্কার অর্জন প্রেরণা জোগাবে বিশ্বজুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মরত সাংবাদিকদেরও। নোবেল কমিটি এ যুগলকে ‘এমন ভূমিকা রাখা সব সাংবাদিকের প্রতিনিধি’ হিসেবে অভিহিত করে।
তাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা সর্বদা ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৎপর থেকেছে। মিথ্যাচারী ও যুদ্ধবাজদের মুখোশ খুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরতন্ত্র, হিংসা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদ করে চলেছেন ফিলিপাইনের ‘র‌্যাপলার’ নামে একটি অনলাইন সংস্থার সিইও রেসা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে প্রশংসনীয় স্থান লাভ করেছেন। তবে কাজ করতে গিয়ে সব সময় তিনি ফিলিপাইন সরকারের রোষানলে পড়েন। প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুর্তেতের সরকার তাকে আটকও করে। যদিও পরে ছাড়া পান রেসা। তিনি সাহসী পদক্ষেপ এবং ভূমিকার জন্য ২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘শতাব্দীর সেরা প্রভাবক মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র শত উৎসাহদাতার তালিকায়ও উঠে আসে তার নাম। ২০২০ সালে তিনি ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করায় তিনি জিতে নেন গোল্ডেন পেন ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও সাংবাদিকতার বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রেসা। অন্যদিকে মুরাতভের বিষয়ে বলা হয়, রুশ সংবাদপত্র ‘নোভায়া গাজেতা’র প্রধান সম্পাদক মুরাতভও সমাজের অন্ধকার, সরকারের অত্যাচার, পুলিশি বর্বরতা, ভোটে জালিয়াতি ইত্যাদি বিষয়ে সরব হয়েছেন সতত। ‘ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও’ কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতা রক্ষায় লড়াই চালিয়ে আসছেন। দিমিত্রি মুরাতভ শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও পরিচিত মুখ। ৫৯ বছর বয়সী মুরাতভ কখনও সত্যের পথ থেকে পিছপা হটেননি। রাশিয়ায় সমালোচকদের অনেককেই ‘ফরেন এজেন্ট’ বলে অভিযুক্ত করা হয়। স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করা দেশটিতে খুবই কঠিন ব্যাপার। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই মুরাতভ কয়েক দশক ধরে রাশিয়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক : সম্পাদকম-লীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য