ইতিহাস কলঙ্কিত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট, রোজ রবিবার (তখনকার সরকারি ছুটির দিন) লালবাগ চৌরাস্তায় লালবাগের সাহসী আওয়ামী লীগারদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী বিখ্যাত হাসমত বাবুর্চি আওয়ামী লীগকে ভালোবাসতেন বলেই পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিঃস্বার্থভাবে পাতলা খিচুড়ি রান্না করে দেবার পর বিতরণের সময় চলে আসে পুলিশের বাধা। দুই ডেক খিচুড়ি এলাকার অলিগলিতে বিতরণ করা হয় আর বাকি তিন ডেক খিচুড়ি ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রিকশাওয়ালারা সবাই ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাদের সঙ্গে ইব্রাহিম আর খুব সম্ভবত জাহাঙ্গীর আলম রিকশার পিছনে পিছনে হলগুলোতে গিয়ে খিচুড়ি বিতরণে সহযোগিতা করেছেন। এই কাঙ্গালি ভোজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আবদুল জলিল হীরা চাচার বড় ভাই লাকি চাচা। লাকি চাচার সাইকেল ও রিকশার পার্টস বিক্রির দোকানে আড্ডা চলত সারা লালবাগ এলাকার আওয়ামী লীগারদের নিয়ে। লাকি চাচা, রিয়াজুদ্দিন চাচা, কবির চাচা কাঙ্গালি ভোজ কীভাবে সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে তার দায়িত্ব দিলেন সাহসী আওয়ামী লীগার আবদুল জলিল হীরা চাচাকে। হীরা চাচার সাথে যেমন কথা হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে হীরা চাচা, আরেক সাহসী যোদ্ধা কবির চাচাকে সঙ্গে নিয়ে সাহসের সাথে লালবাগ চৌরাস্তায় কেল্লার পূর্ব গেটের পার্শ্ববর্তী জায়গায় সাহসী বাবুর্চি হাসমতকে নিয়ে সফলতার সাথে রান্না করেন গরুর মাংস ছাড়া সুস্বাদু পাতলা খিচুড়ি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরে হায়েনাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই জাতির পিতার হত্যাকা-। ঐ সময়টায় দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায় না থাকায় গ্রাম থেকে আসা অনেক গরিব-কাঙ্গালি আশ্রয় নেয় ঢাকায়। তাদের অনেকেরই বাস ছিল পলাশী থেকে নীলক্ষেত যাওয়ার মুখী রাস্তায়। সেসব কাঙ্গালিই খিচুড়ি সংগ্রহের লাইনে আধিক্য হওয়ায় তাদের খিচুড়ি বিতরণের সময় পুলিশি বাধায় চৌরাস্তায় খিচুড়ি বিতরণ সম্ভব না হলেও ওখানে অপেক্ষমাণ গরিব-কাঙ্গালিদের নিয়ে আমরা আমাদের গলি-উপগলিতে বিতরণ করে দেই। সেই ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট, রোজ রবিবার ইতিহাস রচিত করে যে কাঙ্গালি ভোজের সূচনা তা আমাদের লালবাগ চৌরাস্তা থেকেই। যাদের পরিকল্পনা ও নিজস্ব অর্থায়নে কাঙ্গালি ভোজের সূচনা, তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই, বেঁচে আছি আমরা সে-সময়ের ডানপিটে ও সাহসী তিন কিশোরÑ আমি, ইব্রাহিম ও জাহাঙ্গীর আলম। আমার সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগারদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় খুব কাছে গিয়ে বসতে পারতাম। লাকি-হীরা চাচাতো ছিলেন আমার সাথে ডাল-ভাত। হীরা চাচা তার বড় ভাইকে যথেষ্ট সম্মান করতেন বিধায় সামনে তেমন একটা ভিড়ত না। তাদের দু-ভাইয়ের দূতিয়ালি করতাম আমি। লাকি চাচা একটু শারীরিক অসুস্থ থাকলেও আওয়ামী লীগের জন্য দু-হাত উন্মুক্ত। হীরা চাচা ও লাকি চাচা একই দোকানে ব্যবসা করতেন। ব্যবসার আয়-ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল লাকি চাচার কাছে, তাই লাকি চাচার টাকার কমতি ছিল না। হীরা চাচা আর লাকি চাচা তাদের মা’র সাথেই থাকতেন। একই সংসারে থাকায় হীরা চাচা পেতেন সাপ্তাহিক খরচ। তো যাই হোক। একদিন লাকি চাচাকে বললাম, চাচা খিচুড়িতে গরুর গোস্ত দিলেন না কেন? লাকি চাচা আমাকে বললেন, শোন গরুর মাংস খায় কারা? আমি বললাম, মুসলমানরা। লাকি চাচা এবার বললেন, বঙ্গবন্ধু কাদের নেতা ছিলেন? আমি বললাম, বাংলাদেশিদের। চাচা আবার বললেন, বঙ্গবন্ধুকে কি শুধু মুসলমানরাই ভালোবাসে? আমি বললাম, না। বঙ্গবন্ধু সারা বাঙালিদের। এবার তিনি বললেন, সারা বাঙালিদের মধ্যে কি হিন্দু বা অন্য ধর্মের লোকেরা নেই, যারা গরুর মাংস খায় না। আমি বললাম, হুম আছে তো। লাকি চাচা আমাকে এবার যে উপমা দিলেন, তা আমি আজও ভুলিনি। তিনি বললেন, মাংস ছাড়া খিচুড়ি এজন্যই রান্না করলাম, যাতে সব ধর্মের মানুষ খেতে পারে। কারণ তিনি সবার বন্ধু আর তিনিই হলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। এরপর বহুবার লালবাগ চৌরাস্তায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে। একবার ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা কামরাঙ্গীরচরে বন্যার্তদের মাঝে যে খিচুড়ি বিতরণ করেছিলেন সেটিও ছিল আমাদের লালবাগ চৌরাস্তায় রান্না করা খিচুড়ি। সেই সময়ে বৃহত্তর লালবাগ থানার সব নেতাই কাঙ্গালি ভোজে উপস্থিত থাকতেন। আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘উত্তরণ’-এর গবেষক, লেখক আনিস আহামেদ সংক্ষিপ্ত আকারে কাঙ্গালি ভোজের সূচনার ইতিহাস তুলে এনেছেন, এজন্য গবেষককে ধন্যবাদ। আগামী প্রজন্মের কাছে রেখে গেলাম বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কাঙ্গালি ভোজের সূচনাকার ইতিহাস। সেসব নির্লোভ প্রয়াত আওয়ামী লীগের সাহসী সন্তানদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
নিজাম সাজু হ ২৩/২, লালবাগ রোড, ঢাকা