সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ: ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলন তথা বাংলার ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এ দিন দেশজুড়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলন, মিছিল ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১১ মার্চ ভোরে ছাত্ররা পিকেটিংয়ের জন্য বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে পড়েন। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশে প্রথম সফল হরতাল। এদিনের প্রবল বিক্ষোভের সূত্র ধরেই তৎকালীন খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় এবং এই সংগ্রাম পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে।
সর্বাত্মক আন্দোলন ও হরতালের জন্য ১১ মার্চ তারিখটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ ১৯ মার্চ ঢাকায় আসবেন কায়েদে আজম জিন্নাহ। এ জন্য যতই আঘাত এসেছে, কর্মসূচি ততই বেগবান হয়েছে।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ সকালে ছাত্র-জনতা সচিবালয়ের সামনে সমবেত হতে থাকেন। সচিবালয়ে প্রবেশের দুটি গেট ছিল। আবদুল গণি রোডস্থ প্রথম গেটে পিকেটিং করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ। এই গেট দিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যাতায়াত করতেন। তোপখানা রোডস্থ দ্বিতীয় গেটে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেন শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, মো. বায়তুল্লাহ প্রমুখ।
এদিন গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, বায়তুল্লাহ, রণেশ দাস গুপ্তসহ আরও অনেকে। ১১ মার্চের ধর্মঘট শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বত্র ওইদিন ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন। রাজশাহী ও সিলেটে ১১ মার্চ পিকেটিং করতে গিয়ে অনেকে রক্তাক্ত হন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হরতালের সময় ২০০ জন আহত, ১৮ জন গুরুতর আহত এবং ৯০০ জন গ্রেফতার হন।’ [অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ ১৯৪৮]
১১ মার্চের ঘটনা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন :
১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল।… সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিং-এর সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গণি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিং-এর দিকে ছুটছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিং-এর সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল, তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার-পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিং-এর দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মেইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসলো। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তোয়াহা ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।”
সাংবাদিক, লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস ১১ মার্চের ঘটনা সম্বন্ধে লিখেছেন : “এই গ্রেফতার মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।”
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবরণ।
লেখক : ভাষাসৈনিক শওকত আলীর পুত্র