Thursday, November 30, 2023
বাড়িSlider১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে এলেন, স্বাধীনতা পূর্ণতা পেল

১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে এলেন, স্বাধীনতা পূর্ণতা পেল

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো; কিন্তু মানুষের মুখে ছিল না কোনো হাসি, বিজয়ের তৃপ্তির ছাপ, শুধু জিজ্ঞাসা বঙ্গবন্ধুর খবর কী? বেঁচে আছেন কী না? আসবেন তো ইত্যাদি।

আমির হোসেন আমু এমপি: ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তিলাভ করে স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে সেই বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। এই দিন স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন সূর্যালোকের মতো চির ভাস্বর-উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মহান নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসেন তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ তো কল্পনাতীত; সেটি তো হতো স্বাধীনতার অপূর্ণতা। ঐ সময় যখন বিভিন্ন দেশের কংগ্রেস সদস্য, সিনেটর, সংসদ সদস্য, আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তারা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতেন, তারা শরণার্থীদের জিজ্ঞেস করতেন দেশ স্বাধীন হলে তারা ফিরে যাবে কী না? তারা বলতেন, বঙ্গবন্ধু ফিরলে দেশে ফিরে যাব।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো; কিন্তু মানুষের মুখে ছিল না কোনো হাসি, বিজয়ের তৃপ্তির ছাপ, শুধু জিজ্ঞাসা বঙ্গবন্ধুর খবর কী? বেঁচে আছেন কী না? আসবেন তো ইত্যাদি।
এমনি একসময় ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খবর ভেসে এলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে একটি বিশেষ বিমানে অজানার পথে। পরের দিন ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। ঐ দিন এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য অনুরোধ জানাবে।”
পরিশেষে তিনি বলেন, “আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন আপনি আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন, সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ।”
তখন জাতির পিতা বলেছিলেন, “আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় পরিণত করব।”
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরের দিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, শেখ মুজিব is a Traitor. This time he will not go unpunished. সেই প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিচার করে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হওয়ায় ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ঐ রায় আর কার্যকর হয়নি।
জানা গেল বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরছেন। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে ওখানে উপস্থিত হাজার হাজার জনসাধারণ এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা প্রদান করেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কমেট জেটটি অবতরণ করলে তার সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। অভ্যর্থনা জানান ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তারপর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। পালাম বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা এবং বঙ্গবন্ধু মিসেস গান্ধীর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর, মিসেস গান্ধীর সাথে মতবিনিময় শেষ করে (যে মতবিনিময় মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু ভারতীর সৈন্য প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা নিয়েছিলেন) রওয়ানা হলেন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলার উদ্দেশ্যে। অবসান হলো লাখো মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী কমেট জেটবিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখার সাথে সাথে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত লাখো জনতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। লাখো মানুষের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা Ñ জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে প্রকম্পিত হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস।
বিমানের সিঁড়ি দেওয়ার সাথে সাথে অস্থায়ী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিপরিষদ ও নেতৃবৃন্দ তাকে মাল্য ভূষিত করেন। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে আসার সাথে সাথে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানকে বরণ করা হয়। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়। গার্ড অব অনার নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিদেশি মিশনের সদস্য, মিত্রবাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে করমর্দন শেষ করে যাত্রা শুরু করেন রেসকোর্সের উদ্দেশে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।
নেতার প্রতি অকৃতিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ মাইল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও বাংলাদেশের পতাকা নির্মাণ করে জাতির পিতাকে অভিবাদন জানায়। সুসজ্জিত তোরণ এবং সেই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের গগন বিদারী ‘জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে স্বাধীন দেশের আকাশ-বাতাস হয় প্রকম্পিত। এই পথ অতিক্রম করতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল। স্বচক্ষে অবলোকন না করলে জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত অকৃতিম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসার গভীরতা অনুধাবন করা অসম্ভব। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব ছিল। আবেগপ্রসূত এই দৃশ্য অবিস্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় প্রেরণা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য।
দীর্ঘ টানা ১৪ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্ভীক, তেজস্বী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সফল রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার বাস্তব প্রতিফলন দেখিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাতা ও উন্নয়নের কাণ্ডারি, উন্নত, সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল বাংলাদেশ নির্মাণের রূপকার। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে এবং দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে।
শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে ও ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার মাধ্যমে জনগণের যাতায়াতের সুযোগ বৃদ্ধি হলো এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প, দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
তার সফল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, শান্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জঙ্গি দমন এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বহু মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার নতুন মাত্রা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে একজন নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বে তৃতীয় স্থানের অধিকারী হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, চার মূলনীতি সংবিধানে পুনঃঅন্তর্ভুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এবং যুদ্বাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার অনুষ্ঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাপমুক্ত করেছেন।
বর্তমানে অত্যন্ত সফলতার সাথে করোনা পরিস্থিতি এবং পাশাপাশি উপর্যুপরি বন্যা ও দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হয়েছেন।
আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তার ঘোষিত ২০৪১ সালের আগেই উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার প্রতিফলন ঘটবে।

লেখক : রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের দফা সমাচার
পরবর্তী নিবন্ধবই উৎসব
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য