নির্মলেন্দু গুণ: একটা জিনিস স্পষ্ট হওয়া দরকার। যদিও আমি সরাসরি আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল করি নাÑ কিন্তু আমি মূলত আওয়ামী লীগেরই কবি। আবার আমি মনে করি, একইসঙ্গে আমি জনগণেরও কবি।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির বাঁচার দাবি ৬-দফা ঘোষণা করলেন, তারপর থেকে আমি বঙ্গবন্ধু ও তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই কবিতা লিখিতে শুরু করেছিলাম। ১৯৬৬-২০২০, মানে গত ৫৪ বছর ধরে আমার কবিতা ও গদ্য রচনায় ঐ মূল-ধারাটিই অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
অনেক সময় আমি আত্মমগ্ন প্রেমের কবিতা, কামের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা এবং সাম্যবাদী ধারার বেশ কিছু কবিতাও লিখেছি। সেই কবিতাগুলোকেও বাংলা কবিতার পাঠক “প্রিয়-কবিতা” হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং আমাকে প্রেমের কবিও বলেন। আমি চুপ করে থাকি।
আমি জানি, আমি একইসঙ্গে রাজনৈতিক কবি এবং প্রেমের কবিও।
তবে রাজনৈতিক সংকট চলাকালে আমি বঙ্গবন্ধু ও তার তৈরি করা দল আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করে এসেছি। ১৯৯১ ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছি। এমন কী প্রার্থী হাজী সেলিম হলেও।
১৯৯১-এর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আমাকে নমিনেশন দেয়নি। তাতে কী?
মনের দুঃখে আমি শেখ হাসিনাকে ত্যাগ করিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছি। পরাজিত হয়েছি। কিন্তু দলবদল করিনি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগও আমাকে কখনও ত্যাগ করেনি। করবেও না। কেনই বা করবে? আমি তো আওয়ামী লীগের জন্য এসেট, নট লাইবিলিটি।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে মূলত আমার কবিতাই পাঠ করা হয়। শেখ হাসিনার কণ্ঠে আমার কবিতার আবৃত্তি শুনে আমি খুব খুশি হই। সম্মানিত বোধ করি। তিনি যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে আমার সংগ্রামী ভূমিকার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান, তখন আমি খুশি হই।
আবার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করার জন্য বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছিও। একটু বিলম্ব হলেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবন করে আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। তাতে আমি খুশি হয়েছি, সম্মানিত বোধ করেছি।
এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার, আমি জানি, বিশ্বাস করিÑ আমার কবিতার ঋণ আওয়ামী লীগ কখনও পরিশোধ করতে পারবে নাÑ; আবার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমি যা পেয়েছিÑ যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারÑ এই রকমের বিশাল প্রাপ্তির ঋণও আমি কখনও পরিশোধ করতে পারব না।
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ ও আমার সম্পর্কটা হচ্ছে ইতিহাস-নির্ধারিত। অনিবার্য।
আমি যে মাঝে-মাঝে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সমালোচনা করিÑ তাতে যারা খুশি হন, তারা কেন খুশি হন, আমি তা জানি। আমি তা বুঝি। তাদের প্রশংসায় পথভ্রষ্ট হওয়ার মতো পথভোলা কবি আমি নই, হে বন্ধুগণ। সরি মাই ফ্রেন্ডস।
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের জনগণ দুই শিবিরে বিভক্ত নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষেই আছেন।
আওয়ামী লীগ জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। আমিও আওয়ামী লীগের জন্মদাতা জাতির জনকের দলকেই সমর্থন করি।
আমার কাছ থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান যারা আশা করে, তারা মতলববাজ। আমাকে আওয়ামী লীগের কবি বলে যারা খুশি হতে চান, আমাকে কোণঠাসা করা গেল বা যাবে বলে ভাবেনÑ তাদের স্বপ্নভঙ্গ করার জন্য আমি না থাকলেও, আমার বহু-বহু কবিতাই বেঁচে থাকবে।
লেখক : বিশিষ্ট কবি, নয়াগাঁও, ০১ মে ২০২০