Sunday, September 24, 2023
বাড়িএকাদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর-২০২০স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু: একটি অসাধারণ মুহূর্ত

স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু: একটি অসাধারণ মুহূর্ত

দী প ক র ঞ্জ ন দ ত্ত:  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন অবিসংবাদিত নেতা, যার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৯ সাল। সঠিক মাস দিন তারিখ মনে করতে পারছি না। তবে সময়টা ছিল আনুমানিক অপরাহ্ন/বিকাল ২ ঘটিকা-২.৩০ ঘটিকা। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ থানা একটি অনুন্নত এলাকা, নোয়াখালী-চট্টগ্রাম মেইন রোড হতে আনুমানিক ৫ কিমি ভিতরে। পায়ে হেঁটে বা রিকশায় মেইন রোড থেকে যেতে হয়। রাস্তাটি মেইন রোড হতে কানকির হাট-বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে সেনবাগ থানা পর্যন্ত ইট বিছানো ছিল। উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় যাতায়াত এত সহজ ছিল না। সকালবেলা দুটো বাস কিছু সময়ের ব্যবধানে কানকির হাট হতে সেনবাগ হয়ে নোয়াখালীর হেড কোয়ার্টার মাইজদী শহর পর্যন্ত যাওয়া-আসা করত। ঐ বাসে চড়েই এলাকার জনসাধারণ তাদের প্রয়োজনে চৌমুহনী ও মাইজদী পর্যন্ত যাতায়াত করত। বিশেষ করে সেনবাগ এলাকার কলেজ পড়–য়া ছাত্ররা সে-সময়ের একমাত্র কাছাকাছি কলেজ (প্রায় ১৫ কিমি দূরে) চৌমুহনী কলেজে ঐ বাসে যাতায়াত করত।
সেনবাগ হাই স্কুল ভবনটি ছিল পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বী এবং দক্ষিণমুখী। দশম শ্রেণির ক্লাস হতো রাস্তার পাশে (পূর্ব মাথায়) প্রথম কক্ষ। একেবারেই গ্রাম্য পরিবেশ। দুপুর ১টা-দেড়টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাজারের প্রায় সকল দোকানপাট বন্ধ থাকত। দোকানদাররা দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে যেত। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম সেরে বিকালে এসে দোকান খুলত। স্কুলের পশ্চিম দিকে কাছাকাছি অর্জুনতলা গ্রাম যেখানে সাব-রেজিস্টার অফিস। রেজিস্ট্রি কাজে কিছু লোকের সমাগম সেখানে সব সময় থাকত। রেজিস্ট্রি অফিসের পাশেই (পশ্চিম দিকে) একটি বড় পুকুর ছিল। আশপাশে বসবাসকারী গ্রামের লোকজনের গোসল ও খাওয়ার পানি এই পুকুর ছিল একমাত্র অবলম্বন।
আমি সেনবাগ হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস চলছিল। হঠাৎ দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখি একটি সাদা প্রাইভেট কার কলেজ মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। দৃশ্যটি আমার নজরে আসে।
মাঠে এসে দাঁড়ানো সাদা প্রাইভেট কারের দিকে আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। মূল আকর্ষণ প্রাইভেট কার। তিনজন ব্যক্তি কার হতে বের হলেন। এর মধ্যে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী ভদ্রলোকের দিকে প্রথমে দৃষ্টি চলে গেল। সেনবাগে সে-সময় দৈনিক খবরের কাগজ সচরাচর পাওয়া যেত না। হয়তো প্রকাশের দিন সন্ধ্যায় অথবা পরের দিন পত্রিকা দেখার সুযোগ পেতাম। পত্রিকায় সে-সময়ের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও ছবি দেখেছি। তবে এগুলো বেশির ভাগই জানার সুযোগ হয়েছিল ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে। এর মধ্যে রাখাল বণিক ও আজিম ভাই (চৌমুহনী কলেজের সেই সময়ের ভিপি) উল্লেখযোগ্য। সেনবাগ আমার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ৬-৭ কিমি দূরে। আমি সেনবাগেই থাকতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে শান্তি বাবুর মিষ্টির দোকানে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা আড্ডা দিতেন। একপাশে টেবিলে বসে রাজনৈতিক আলোচনা শুনতাম। বুঝতে দেরি হলো না যে সাদা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটি বঙ্গবন্ধু। আমি বঙ্গবন্ধু বলে চিৎকার দিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে মাঠে দৌড়ালাম। বঙ্গবন্ধুর পায়ে ধরে সালাম করতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কোন ক্লাসে পড়িস রে, তোর নাম কী?” আমি মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দিলাম। বঙ্গবন্ধু সস্নেহে আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। স্কুলের অনেক ছাত্র দৌড়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে চলে এলো। ‘বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু’ শুধু একটা আওয়াজ সকলের মুখে। বঙ্গবন্ধু সকলকে হাত তুলে সালাম ও অভিবাদন জানান। জানতে চান এখানে পুলিশের গুলিতে যারা নিহত হয়েছে তাদের কবরস্থান কোথায়? স্কুলের পাশের বাড়ির একজন কৃষক গুলিতে নিহত হয়েছিল। তার কবর আমরা বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। অপর দুজনের কবর এক থেকে দুই মাইল দূরে সেটিও বঙ্গবন্ধুকে জানালাম। বঙ্গবন্ধু পকেট হতে একটি সাদা রুমাল বের করে মাথায় বাঁধলেন। আর দুজন সঙ্গীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কবর জিয়ারত করলেন। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর সাথে চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন এবং ফেনীর তৎকালীন ছাত্রনেতা জয়নাল হাজারী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আগমনে স্কুল এবং চতুর্দিকে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সে-সময় মোবাইল ফোন ছিল না। এমনকি সেনবাগ থানা এলাকায় কোনো টিএন্ডটি ফোন ছিল না। খন্দকার এজেন্সিতে একটি টিএন্ডটি ফোন ছিল। যেটার হ্যান্ডেল ঘুরালে চৌমুহনী টিএন্ডটি অফিস অপারেটর ধরত। সেখান হতে Trunk Call করে দেশ-বিদেশে ফোন সংযোগ পাওয়া যেত। বাজারের একটি স্টুডিও থাকলেও সে-সময় বন্ধ ছিল। চারদিক হতে শুধু মানুষ আর মানুষ। দৌড়িয়ে মাঠের দিকে আসছে বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য। কৃষক লাঙ্গল কাঁধে কাস্তে বা কোদাল হাতে আসছে। মহিলা যারা গোসল করে বাড়ি ফিরছে বা পুকুর ঘাটে ছিল তারা এবং গ্রামবাসীরা শুনে দৌড়াচ্ছে স্কুলের দিকে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে মাঠ প্রায় ভর্তি। বঙ্গবন্ধু কবর জিয়ারত করে মাঠে ফিরে আসেন। কোনো কথা না বলে সবাইকে হাতে অভিবাদন জানিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার পরও অনেক লোক খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল। তাদের আফসোস ছিল বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে পাননি। সম্ভবত, সে-সময় রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নিষেধাজ্ঞা ছিল।
কীভাবে তিনজন লোক পুলিশের গুলিতে মারা গেল। সম্ভবত, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস হবে। সে-সময় দেশে ‘মার্শাল-ল’ চলছে। সেনবাগ হাই স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে সেনবাগের জনগণ চৌমুহনী কলেজ ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে সামরিক সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে মিছিল বের করে। উক্ত মিছিলে আমরা অংশগ্রহণ করি। থানা ঘেরাও হয়। এক পর্যায়ে থানার ছোট দারোগা গুলি ছোড়ে। গুলিতে দুজন ছাত্র ও একজন কৃষক/শ্রমিকসহ তিনজন নিহত হয়। এর মধ্যে স্কুলের পাশে যার বাড়ি ছিল তিনি বাড়ির আঙিনায় বসেছিলেন। তাদের কারও নামই আমার মনে নেই। ঐ আন্দোলনে আমরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেøাগান দিই। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। থানার (দুটি টিন শেড ছিল) একটি ঘর আগুনে জ্বলে ভস্মীভূত হয়। থানায় দুজন কর্মকর্তা ছিল। একজন বড় দারোগা। আরেকজন ছোট দারোগা। পাকিস্তান আমলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। শোনামতে, এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সড়কযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ফেনীতে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করেন। তিনি জেলে থাকাকালীন নোয়াখালী জেলার সেনবাগে মার্শাল-ল’ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে, থানা জ্বালিয়ে দেয়। সে-সময় উত্তেজিত ছাত্র-জনতার ওপর থানার ছোট দারোগা গুলি ছোড়ে। এতে তিনজন নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু ফেনীতে এসে সেনবাগ আসার সিদ্ধান্ত নেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ঘটনাটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন উদার ও মানবতাবাদী। দুঃখী শ্রমিক, কৃষক ও বাঙালি জনসাধারণের অকৃত্রিম বন্ধু। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে বাঙালি জনগণের স্বার্থ তিনি বড় করে দেখতেন। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। বাংলার জনগণের জন্য তার ত্যাগ অসাধারণ। ফেনী হতে সেনবাগ থানার দূরত্ব হবে প্রায় ৩০ কিমি। রাস্তার অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। কোনো প্রটোকল বা দলীয় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াই তিনি সেনবাগ আসার সিদ্ধান্ত নেন।
ঐদিন বঙ্গবন্ধুর সেনবাগ আগমনের স্মৃতি হয়তো আমরা ক্যামেরাবন্দি করতে পারিনি। সেদিন উপস্থিত অনেক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং আছেন। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি নিজেই ইতিহাস। ঐ সময়ে গুলিতে যে তিনজন শহিদ হয়েছেন। বিলম্বে হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধুর আগামী জন্মশতবার্ষিকীতে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। খোঁজ করলে এ-রকম আরও অনেক স্মৃতি আমাদের মাঝে বের হয়ে আসবে।

লেখক : নির্বাচন পরিচালনা কার্যালয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য