মো.সিরাজুল ইসলাম : ১৯৬৩ সাল, বগুড়া আজিজুল হক কলেজে আইএসসি পড়ছি। শুনলাম, পোস্টার দেখলাম- বগুড়া সফরে আসছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা তর্কবাগীশ আরও অন্যান্য নেতা। আমার খুব আনন্দ হলোÑ আজকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাব। তখন মুস্তাফিজুর রহমান পটল ভাইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে চুটিয়ে ছাত্রলীগ করি। পটল ভাই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বগুড়া সদর থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নভেম্বর মাসে জেনারেল খালেদ মোশারফের আন্দোলনের সময় খালেদ মোশারফ নিহত হন। সেই সময় এমপি পটল ভাইকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ঘাতক দল এই হত্যাকা- ঘটান। বঙ্গবন্ধুর খুব স্নেহভাজন ছিলেন। পটল বলে ডাকতেন। ১৯৬২-৬৩ সালে হার্নিয়া অপারেশনের সময় বঙ্গবন্ধু পটল ভাইয়ের চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. রাব্বি সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে ভালোভাবে চিকিৎসার সুপারিশ করেন। পটল ভাই বগুড়া ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘ সময়। পটল ভাইয়ের স্ত্রী– এক সময়ের মহিলা এমপি- পুতুল ভাবী এ বছর ইন্তেকাল করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু-কন্যা, দেশরতœ, মানবতার মহান আদর্শ জননী শেখ হাসিনা পুতুল ভাবীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
যে কথা বলছিলাম, আমরা হাজার হাজার লোক বগুড়ার সাত মাথায় জেলা স্কুল প্রাঙ্গণে এবং নবাব বাড়ির রাস্তায় অপেক্ষা করছিÑ শেখ মুজিবুর রহমান এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দেখার ও কথা শোনার জন্য। দুপুর ১টায় ট্রেন বগুড়া পৌঁছার কথা থাকলেও ট্রেন এসে বগুড়া পৌঁছাল ৩.৩০টা-৪টার দিকে। সারা রাস্তায়ই জনগণ ট্রেন থামিয়ে নেতাদের কথা শুনেছেন। তখন যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন রেলপথ। অন্য কোনো যানবাহন ছিল না। নেতৃবৃন্দ এলেন। সবাই অভুক্ত, সোহরাওয়ার্দী সাহেব অসুস্থ। তাড়াহুড়া করে বগুড়া সার্কিট হাউসে খেয়েই মঞ্চে এলেন। হাজার হাজার লোকের চিৎকার- “আমরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তৃতা শুনব।” তিনি উঠে বললেন, “আমি কিছু বলার আগে আমার ছোট ভাই শেখ মুজিব কিছু বলবেন, আপনারা শুনবেন?” সমস্ত জনতা সাগরের গর্জনের মতো গর্জন করে বললÑ “আমরা শুনব।” তরুণ সিংহপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান মঞ্চে উঠলেন, চশমা খুললেন, দু-হাতের পাঞ্জাবির হাতা গুটালেন, শুরু করলেনÑ “আমার স্বাধীন দেশের পরাধীন ভাইয়েরা।” যেন সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার গর্জন করে উঠলেন। লক্ষাধিক মানুষ নড়েচড়ে বসলেন। পিনপতন নীরবতা। মানুষ কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু মুহুর্মুহু করতালি। এক ঘণ্টার বেশি সময় যেন একটি গদ্য কবিতা তিনি পাঠ করলেন। প্রতিটি মানুষের মনের কথাই যেন তিনি বললেন। আর কারও বক্তৃতার দরকার হয়নি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। শেষ মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী সাহেব দু-এক মিনিট কথা বলে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। আজ অবধি আমার জীবনে সে-রকম একটি তেজোদীপ্ত বাঘের গর্জনের বক্তৃতা আমি আর শুনিনি। ৭ মার্চ ১৯৭১-এর বক্তৃতার সময়ও খুব কাছ থেকে শুনেছি। মঞ্চের কাছাকাছিই ছিলাম। দুটো বক্তৃতায় দু-রকমের মাধুর্য। ছোটবেলা থেকে সারা মন-প্রাণজুড়ে যে নেতাকে দেখার ও যে নেতার কথা শোনার আকাক্সক্ষা ও বাসনা ছিলÑ তা যেন কানায় কানায় পূর্ণ হলো। কেন যেন মনে হলো বাঙালি শত শত বছর ধরে এমন একজন বীরপুরুষ নেতার জন্যই অপেক্ষা করছিল, বাঙালির সকল দুঃখ-দুর্দশা-বেদনার লাঘব ও চাওয়া-পাওয়া এই নেতার দ্বারা সম্ভব। তিনিই তো মুক্তির দূত। তিনিই তো ক্ষুদিরাম, এই তো দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ বসু, রাজা রাম মোহন, স্বামী বিবেকানন্দ। তিনিই তো সমাজ সংস্কারক বিদ্যা সাগর- অর্থাৎ তিনি বাঙালির সকল নেতানেত্রীর গুণাবলি নিয়েই এ ধরাদামে এসেছেনÑ হাজার হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। আমার সেদিনের অনুমান ও দৃঢ় বিশ্বাস একটুও মিথ্যা হয়নি। পুরোটাই বাস্তবতা পেয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। বিশ্বের সকল দেশের বড় বড় নেতারা বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিলেন।
১৯৬৩ সালের পরই সোহরাওয়ার্দী সাহেব আস্তে আস্তে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি চিকিৎসার জন্য ভূমধ্যসাগরের তীরে বৈরত নগরীতে গিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মরদেহ ঢাকা এনে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ পাশে, শেরে বাংলার পাশে সমাধিস্থ করা হয়। এই নেতার নামে বঙ্গবন্ধু এ মাঠের নামকরণ করেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’। বঙ্গবন্ধুকে এরপর খুব কাছ থেকে দেখি ১৯৬৭-৬৮ সালে রাজশাহীতে। তখন আমি এমএসসি শেষবর্ষের ছাত্র। এসএম হলে থাকি, প্রভোস্ট ড. মাজহারুল ইসলাম। একজন নির্ভীক আওয়ামী লীগ সমর্থক ও একনিষ্ঠ কর্মী, বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত। স্যারের বাসায় দুপুরের খাবার খান বঙ্গবন্ধু, অতঃপর ঈদগা মাঠে বিশাল জনসভা। এসএম হলের ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমরা কয়েকজন জননেতার সঙ্গে খাবার খাওয়ার সুযোগ পাই। তখন সভাপতি আবু সফিয়ান যার স্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বর্তমানে সরকারের প্রতিমন্ত্রী। নূরুল ইসলাম ঠা-ু ভাই তখন সাধারণ সম্পাদক। ২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন। সুফিয়ান ভাই ১৯৭৪ সালে খুলনার খালিশপুরে শ্রমিক লীগের সভাপতি থাকাকালে দুর্বৃত্তের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জীবনে অনেক দেখেছি; কিন্তু সুফিয়ান ভাই ছিলেন অনন্য সাধারণ, ব্যতিক্রম, বিরল। দুপুরের খাবারের পর আমরা সবাই আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা, বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের কি করণীয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শুধু বললেন, “খবঃ ঃযব ঃরসব পড়সব, সব জানতে পারবি, শুধু এটুকু জেনে রাখ নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে, কেউ আদায় করে দিবে না। কাজ করতে হবে নিরলসভাবে, ভয়ভীতি থাকলে চলবে না। প্রয়োজনে জোর করে বাঙালির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে।” বিশাল ঈদগা মাঠে বিশাল জনতার উপস্থিতিতে অপূর্ব তুলনাবিহীন বক্তব্য শুনলাম। ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ছাড়া কারও পক্ষে এ-ধরনের বক্তব্য সম্ভব নয়। জনতা নিথর, স্তব্দ।
তৃতীয়বার বাঙালির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধুকে দেখি ১৯৭২ সালে তার বেইলি রোডের গণভবন অফিসেÑ তিনি যখন ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। আমি তখন সোনারগাঁও কলেজে রসায়নের অধ্যাপক। প্রিন্সিপাল আলতামাসুল ইসলাম জাহাঙ্গীর সাহেবের নেতৃত্বে মাল্যভূষিত করতে গিয়ে। শত শত দেশি-বিদেশি নেতাকর্মী গণভবন ঘিরে আছে। অল্প সময়। তবুও তিনি চিনতে পারলেন, নাম ধরে ডাকলেন। মন-প্রাণ, অন্তর ভরে উঠল। নেতা বললেন, “তোরা প্রকৃত মানুষ তৈরি করবি, যারা বাঙালির মুখ বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল করতে পারে।” বাঙালির কল্যাণ কামনা ও সাধনা তার চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানের বিষয় ছিল। বাঙালির নিজস্ব সত্তার বিকাশ তিনি সর্বত্র করে গেছেন। তাই তো দোয়েল পাখি বাঙালির জাতীয় পাখি, বিল ও ঝিলের শাপলা ফুল জাতীয় ফুল, সুন্দরবনের বাঘ জাতীয় পশু, বাঙালির সকল মানুষের- ধনী-গরিবের ফল কাঁঠাল জাতীয় ফল, লাল ও সবুজ জাতীয় পতাকার রং এবং সর্বোপরি ‘বঙ্গভঙ্গ’ বন্দের জন্য কবিগুরু প্রতিবাদ স্বরূপ যে গানটি ১৯০৬ সালে লিখেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সেই মধুর গানটিই তিনি বেছে নেন জাতীয় সংগীত হিসেবে।
সর্বশেষ দেখা হয় ১৯৭৩ সালে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলের পর। আমি নিজে একটি ক্যাডারের প্রথম ব্যক্তি। অনেক ধড়পাকড়ের পর দেখা পাই। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি আমাদের দু-একজনকে নাম ধরে ডাকলেন এবং আমাকে বললেন, “কী রে অধ্যাপনা ছেড়ে বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছিস, খুব ভালো হয়েছে। আমার সৃষ্টি ক্যাডার। তোরাই বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস কর্মকর্তা। দেশটাকে সঠিক পথে চালানোর দায়িত্ব তোদের হাতে। স্বার্থপর ও চোর-বাটপারে দেশটা ভরে গেছে। এসব আগাছা সব উপড়ে ফেলতে হবে। সুন্দর শ্যামল সবুজ সোনার বাংলা গড়তে হবে। যা, যার যার কর্মস্থলে গিয়ে সঠিকভাবে কাজ কর।” আমাদের আর কোনো কথা বলারই সুযোগ দেননি। সবাই একে একে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে চলে আসি। নীতি-আদর্শ ঠিক রেখে বাঙালি সত্তার বিকাশ ঘটিয়ে যার যার কর্মস্থলে কাজ করে যাওয়ার উপদেশ দেন। সেই উপদেশ আজও আমার মনে আছে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুগ্মসচিব (অব.); উপজেলা চেয়ারম্যান, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া