প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে মতিঝিলে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগটির যাত্রা শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে এ উদ্যোগটির প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
সালেহীন বাবু : নতুন বছরের শুরুতে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রবেশ করল ক্যাশলেস দুনিয়ায়। পাল্টে গেল লেনদেন ব্যবস্থা। ‘সর্বজনীন পরিশোধ সেবায় নিশ্চিত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানক সামনে রেখে নতুন বছরের প্রথম মাসেই ক্যাশলেস বা নগদবিহীন সেবা চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সেবা নিতে বা পেতে শুধুমাত্র একটা ব্যাংকের অ্যাপ থাকলেই চলবে। অ্যাপে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে সব ব্যাংকের গ্রাহক পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। এছাড়া বিকাশ, এমক্যাশ, রকেটের মতো মোবাইল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসের অ্যাপ দিয়েও পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা যাবে। কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এই সেবায় যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা কিউআর কোডে অংশগ্রহণকারী যে কোনো ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী গ্রাহক যে কোনো ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টধারী মার্চেন্টকে পণ্য বা সেবামূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। বাংলা কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেনকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিকভাবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, এবি, ইস্টার্ন, ইসলামী, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, দি সিটি, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ও ওয়ান ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। প্রায় ১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে মতিঝিলে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগটির যাত্রা শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে এ উদ্যোগটির প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ লেনদেন করছে ক্যাশলেস মাধ্যমে। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে জুতা বিক্রি করেন রায়হান মিয়া। ভ্যানের ওপরে হরেক রকমের জুতার পসরা সাজিয়েছেন। জুতাগুলোর একপাশে বাক্সের ওপর রাখা মোবাইল ব্যাংকিং রকেটের কিউআর কোড। জুতা কিনে এই কিউআর কোডের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করছেন ভোক্তারা।
চা দোকানি আলম মিয়া। প্রায় সাত মাস ধরে ডাচ্-বাংলার রকেট অ্যাপসের মাধ্যমে কিউআর কোডে দোকানের বিল নেন তিনি। বলেন, ‘এতদিন শুধু রকেটের মাধ্যমে অনেকে চা-বিস্কুট খেয়ে টাকা পরিশোধ করত। জমা হয়ে যেত আমার ডাচ্-বাংলার ব্যাংক হিসাবে। কিন্তু এখন অন্য সবাইও এ সুবিধা পাবেন।’ এটা ব্যবহারে কী উপকার হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারাদিনে কিছু কিছু জমা হয়। প্রতিদিন টাকা তোলার প্রয়োজন হয় না। মাঝে মাঝে ১ হাজার টাকার ওপরেও জমা হয়। এ টাকা জমা করার চেষ্টা করি। দরকার হলে তখন টাকা তুলি। সংসারে বিপদ, প্রয়োজনে এ টাকা খুব কাজে লাগে।’ সেন্যা কল্যাণ ভবনের সামনে জুতা পলিশ করেন গোপাল চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, ‘আগে রোদের মধ্যে কাজ করতাম। আজকে একটা বড় ছাতা দিয়ে গেছে। তার নিচে বসে কাজ করছি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক আজ হিসাব খুলে দিয়েছে। তিনজন জুতা ঠিক করে ৪০ টাকা করে ১২০ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। যা আয় করি জমাতে তো পারি না, এভাবে একটু একটু করে যা জমবে তাই লাভ।’
একই জায়গায় জুতা পলিশ করে আসছেন শাপলা। ক্যাশলেস পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়ে শাপলা বলেন, ‘আগে জুতা কালি কইরা মানুষ হাতে টাকা দিত। সে-সময় খুচরা টাকা না থাকলে জুতা কালি করার পরও কম টাকা নেওয়া লাগত। এহন আর খুচরা টাকার ঝামেলা নাই। কালি করা শেষে মোবাইলে টাকা দিয়া কাস্টমার চইলা যাইব, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বিকাশে টাকা আইয়া পরব। এইটা ভালোই হইছে, কামের ট্যাকাডা মোবাইলে জমা থাকব, এতে বাড়তি খরচ কিছুটা কমব।’
মতিঝিল এলাকার পেয়ারা বিক্রেতা মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য খুব ভালো হইছে। অনেক সময় দেখা যায় ক্রেতার সঙ্গে খুচরা এক-দুই টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়। এখন এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় খুচরা টাকা নিয়ে আর ঝামেলা হবে না। তবে টাকা ওঠানোর সময় ঝামেলা না হলে আর সমস্যা নেই। এছাড়া মোবাইলে পেমেন্ট হলে ছেঁড়া টাকা নিয়ে আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।’
মতিঝিলে ফল কিনতে আসা সাংবাদিক রেজাউল করীম হীরা বলেন, ‘ক্যাশলেস হলে খুব সুবিধা। নগদ টাকা বহন করা ঝুঁকি। অ্যাপের মাধ্যমেই করা যাচ্ছে লেনদেন। খুচরা টাকা নিয়েও কোনো ঝামেলা নেই। বিল যেটা সেটাই পেমেন্ট হচ্ছে।’
‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘শতভাগ মানুষকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসেবার আওতায় নিয়ে আসার অংশ হিসেবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠা সরকারের লক্ষ্য। বর্তমানে প্রায় ৫-৬ কোটি গ্রামবাসীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও জয়লাভ করে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে এবং আমাদের সরকারের পরবর্তী মেয়াদে তারা ক্যাশলেস সমাজে বাস করবেন।’
তিনি বলেন, ‘নেটওয়ার্ক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারের সেবা ডিজিটালাইজড হয়েছে। প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশে বৃহৎ আইটি কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এখন দেশেই ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সেট ও কম্পিউটার মেমোরি চিপস উৎপাদিত হচ্ছে এবং এগুলোর রপ্তানি শুরু হতে যাচ্ছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু, এতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, এখন এক ব্যাংকের কিউআর কোড থাকলে যে কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করা যাবে। এতদিন একটি ব্যাংকের কিউআর কোডে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক পেমেন্ট করতে পারত।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ধরেন চা দোকানির ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। এখন আপনি চা-বিস্কুট খেয়ে বিল দেবেন। কিন্তু আপনার অ্যাকাউন্ট মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বা বিকাশে। এখন কীভাবে বিল দেবেন? এটার সমাধান দেবে সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোড। এখান থেকে যে কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করতে পারবেন। অর্থাৎ দোকানদারকে তার চায়ের বিল ডাচ্-বাংলা কিউআর কোডে সরাসরি পরিশোধ করতে পারবেন।’
১৯৯০ সালের পরে বিশ্বে কিউআর কোডের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বাংলা কিউআর স্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলা কিউআর কোড দিয়ে নির্দিষ্ট যে কোনো ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করা যাবে। ফলে ব্যাংকের গ্রাহকদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের একাধিক কিউআর কোড ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। কিউআর-এর পূর্ণরূপ কুইক রেসপন্স। এটি একটি কন্টাক্টলেস পেমেন্ট পদ্ধতি, যেখানে কিউআর কোডটি মোবাইল অ্যাপে স্ক্যান করে দ্রুত লেনদেন করা যাবে। এর জন্য প্রথমে মোবাইলে ব্যাংক বা এমএফএস বা পিএসপির অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। অ্যাপে পিন টাইপ করে লগ ইন করে যে দোকান বা মার্চেন্ট থেকে কিনতে হবে সেখানে আউটলেট প্রদর্শিত কিউআর কোড স্ক্যান করতে হবে। এরপর পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করার জন্য টাকার পরিমাণ লিখলে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসবে। সেই ওটিপি টাইপ করে লেনদেন সম্পন্ন করা যাবে। লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর পেমেন্টের কনফার্মেশন ও ডিজিটাল রিসিট পাওয়া যাবে।
লেখক : সাংবাদিক