ইনাম আহমেদ চৌধুরী
মরহুম এএমএ মুহিত, মুহিত ভাইয়ের তিরোধান আকস্মিক, তা বলা যাবে না। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে অপরিহার্য, মন তা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। আমার (এবং আরও অনেকেরই) জীবনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে তার উপস্থিতিÑ তাই তার অবর্তমানের জীবন তো কিছুটা অকল্পনীয়ই বটে। জাতির একজন দিক-নির্দেশক বাতিঘর হিসেবেও আমাদের নাগরিক অস্তিত্বে তার ব্যাপক উপস্থিতি।
জীবিতাবস্থায় ‘লিজেন্ড’ হওয়ার সৌভাগ্য খুব কম মানুষের জীবনেই হয়। তবে মুহিত ভাইয়ের ৮৮ বছরের সফল সম্পূর্ণ জীবনে সেই ব্যতিক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা- একাধিক স্তরের পারিবারিক পর্যায়ে। তদুপরি বড় ভাই মরহুম ফারুক চৌধুরীর একজন অন্তরঙ্গতম আবাল্য-সুহৃদ ছিলেন তিনি। তবে বেদনা-বিধুর এ মুহূর্তে আমার সংক্ষিপ্ত এই সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণ শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞান-সজ্জাত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবসানে ১৯৪৬ সালে শিলং অধ্যয়নরত আমাদের (ভাই-বোনকে) সংক্ষিপ্তকালের জন্য সিলেট রেখে বাবা উত্তর আসামে চাকরি ব্যাপদেশে যান। তখন জিন্নাহ সাহেব দু-একদিনের জন্য একবার সিলেট এসেছিলেন। তখন তা সিলেটবাসীর মধ্যে দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা টিলাগড়ে এমসি কলেজ মোড়ে জিন্নাহ সাহেবের মোটরবহর থামিয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত সংবর্ধনা জানিয়েছিল। উদ্দীপনা-দীপ্ত মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে তখনই প্রথম পরিচয়, তিনি ছিলেন মুকুল ফৌজের অগ্রসেনা এবং আমাদের জ্যেষ্ঠ। সেই কৈশোরকাল থেকেই মুহিত ভাইয়ের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল পরিদৃশ্যমান। সিলেটের এক অতি সম্ভ্রান্ত সমাজ-সচেতন শিক্ষিত পরিবারেই অবশ্য তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
১৯৫৪ সালে যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, তখন থেকেই মুহিত ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসি। ১৯৫২-৫৩ সালে আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম ও রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত আন্দোলনে বহিষ্কৃতও হয়েছিলাম। মুহিত ভাই ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সমাজে নেতৃস্থানীয়। ১৯৫৪-৫৫ সালের এসএম হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মুহিত ভাই, (মরহুম) মাহবুব আনাম এবং আমি যথাক্রমে ‘হল সংসদ’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই মুহিত ক্যাবিনেটের নেতৃত্বে তখনকার কর্মচঞ্চল ছাত্র জীবনে, বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ও প্রগতিধর্মী সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সংসদ একটি অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছিল। ঐ সময়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ‘নির্বাচনী ইশতেহারে’ দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী হলের পরিবেশিত খাবারের মানোন্নয়নের জন্য আবাসিক ছাত্রদের মাসিক ‘মেস ফি’ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য একটি সদস্যদের আহূত সাধারণ সভায় পেশ করা হয়। কিন্তু তা গৃহীত না হওয়ায় মুহিত ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সবাই কার্যকরী কমিটির স্ব-স্ব পদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করিÑ ‘প্রস্তাবের প্রত্যাখ্যানকে সাধারণ ছাত্রদের ভোটারদের ‘ক্যাবিনেট’-এর ওপর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই অনাস্থা বিবেচনা করে। পদত্যাগ অবশ্য ‘হল কর্তৃপক্ষ’ কর্তৃক গৃহীত হয়নি এবং আমরা নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত কার্যকর থাকি। ব্যাপারটি ক্ষুদ্র, তবে তা যৌবনকালেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি মুহিত ভাইয়ের আস্থার একটি প্রকাশ বলে ধরা যেতে পারে। পরবর্তী জীবনেও মুহিত ভাই তা প্রদর্শন করেছেন। স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে পদত্যাগ করার পরে তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট তাকে অর্থমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। মুহিত ভাই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন শর্তসাপেক্ষে। কথা ছিল, প্রেসিডেন্ট সত্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে শাসনভার ন্যস্ত করবেন। দ্রুত তা হলো না বলে মুহিত ভাই অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
নীতিনিষ্ঠ মুহিত ভাই কেবল একজন সমাজ সচেতন মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না, ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও আজীবন ছিল তার প্রবল উৎসাহ। পরবর্তী জীবনে বাবা (মরহুম গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী) যখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, মুহিত ভাই ছিলেন তার সক্রিয় জেনারেল সেক্রেটারি। তারা সর্ববিধ ক্রীড়ার ক্ষেত্রে শুধু মানোন্নয়ন নয়, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ-সংরক্ষণে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এবিএম মুসা এবং মুহিত ভাই আলাদাভাবে লিখেছেন। অরাজনৈতিক, মূলত সামাজিক। জালালাবাদ এসোসিয়েশনের কর্মকা-ে ছিল মুহিত ভাইয়ের সোৎসাহ অংশগ্রহণ। বাবা ছিলেন ঐ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ঐ দুই ভূমিকায় মুহিত ভাইয়ের প্রশংসনীয় দায়িত্ব সম্পাদনের ভালো কথা বাবার মুখে অনেক শুনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও আমরা মুহিত ভাইয়ের যথাযথ নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছি।
১৯৫৬ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকাল পর্যন্ত অতীব দক্ষতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পাদন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্রে তার বলিষ্ঠ ও ত্যাগী ভূমিকা সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সচিব এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং আইডিবি-তে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেন। পরবর্তীতে সৌভাগ্যক্রমে ঐসব দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছিল আমার কর্মজীবনে। আমি বিশেষভাবেই লক্ষ করেছি, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি তার কৃতিত্বের বলিষ্ঠ পদচিহ্ন ও ‘লিগেসি’ রেখে গেছেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে ব্যাংককস্থ জাতিসংঘ ‘এসকাপ’ কমিশনের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানকালে তিনি অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের আরেকজন কৃতী সন্তান পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এসএএমএস কিবরিয়া তখন জাতিসংঘের এই সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী সচিব এবং আমি ছিলাম কমিশন সচিব। সেখানে দেখেছি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তখনই তিনি পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যাপারে জাতিসংঘের সম্ভাব্য জোরালো ভূমিকার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। পরবর্তীতে আমরা দেখেছি তিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-দুহিতা জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় দুই পুরো মেয়াদে এএমএ মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার মহান উদ্যোগে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিজ্ঞানভিত্তিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর বসবাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে বন ও বনজ সম্পদের উন্নয়ন, জীব্যবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ দূষণরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকসই সার্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে আমাদের নেত্রী ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ’ এবং অন্যান্য পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ভূষিত ও স্বীকৃত হয়েছেন। বিশ্বময় প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ, গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে সুপ্রতিষ্ঠিত ও দ্রুত ধাবমান। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটকে পরিহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহান উদ্যোগসমূহে সক্রিয় সমর্থন, পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সফল অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত।
বাংলাদেশের সর্বদীর্ঘকালীন অর্থমন্ত্রী এবং একজন সুলেখক হিসেবে তার কৃতিত্ব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও পেয়েছে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি। দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে আয়ুষ্কালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি করেছেন তার দায়িত্ব পালন। নির্দ্বিধায় বলা যায়, জীবনের যে ক্ষেত্রেই তিনি পদচারণা করেছেন, সেখানেই তিনি হয়েছেন সফল ও সার্থক। একজন সিভিল সার্ভেন্ট, কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ, লেখক, ক্রীড়া-সমাজ-সাংস্কৃতিক সংগঠকÑ সব ভূমিকায়ই তিনি হয়েছেন সুফলপ্রসূ ও সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বিশ্ব ইতিহাসের ওপর একটি প্রামাণ্য পুস্তক রচনায় তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তার তিরোধান সেই প্রচেষ্টায় যতি টেনে দিল।
আজীবন দেশ ও মানুষের প্রতি সদাহাস্য এই নির্মোহ আদর্শবাদী মানুষের আকর্ষণ ও আনুগত্য ছিল পরিপূর্ণ ও প্রশ্নাতীত। সর্বজন প্রিয় এই ব্যতিক্রমী মানুষকে জাতি সশ্রদ্ধ প্রীতিতে স্মরণ রাখবে চিরকাল।
লেখক : উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ