বিশেষ প্রতিবেদন: কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা ‘রিপোর্ট-১৯৭১’ কবিতাটি ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল, যার কয়েকটি চরণ ছিল এ-রকম- “পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলংকিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে চলে আসি/ক্যানাডার বিশাল মিছিলে শ্লোগান শোনাতে/মানুষের জয় হোক/অসত্যের পরাজয়ে খুশী হোক বিশে^র বিবেক/পলাতক শান্তি যেন ফিরে আসে আহত বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে।” একদিকে কবি প্রার্থনা করছেন একটি শান্তিময় দেশের জন্য, ঘরের জন্য। অন্যদিকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের একদল একত্রিত হয়েছিলেন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ১৯৭১-এর সময় রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের সংগীত বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন রুমী তার লেখা ‘রেডিও পাকিস্তানের আমার শেষ দিন’ নামক শিরোনামে লিখেন, “আমরা বেতার কেন্দ্র ছেড়ে চলে যাবার ফন্দি অঁাটছিলাম। যাবই যখন কিছু গানের টেপ নিয়ে পালাতে হবে। তখন আমাদের টেপ লাইব্রেরিয়ান ছিল স্নেহধন্য হামিদুল ইসলাম। আমরা যখন পালাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম ঠিক তখনই বিশ্বস্তসূত্রে খবর পেলাম যে, রেডিও পাকিস্তান ঢাকার ঊর্ধ্বতন অফিসার হেমায়েত হোসেনÑ যিনি খুব সম্ভবত রেডিওর পত্রিকা ‘এলান’-এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি এবং ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকার সম্পাদক আখতার ফারুক সমেত আরও কারা কারা যেন মিলে একটি ‘ব্রডকাস্টিং কমিটি’ গঠন করেছে। কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হলোÑ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রেডিও থেকে কোন কথা বা গান প্রচার হতে পারবে না। প্রচার হলেই তারা তাৎক্ষণিকভাবে পাকসেনাদের জানিয়ে দেবে এবং দেশদ্রোহিতার অপরাধে তাদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে।” এসব বাধা অতিক্রম করে দেশের মুক্তিকামী জনগণ বেতারে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’র লেখক ও পাঠক। তিনি তার ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগষ্ট পঁচাত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জুড়ে যখন বর্বর গণহত্যা চলছে, তখন মাহমুদ আলী ছিলেন পাকিস্তানীদের সব চাইতে বড় দোসর। তাঁর মেয়ে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে যে অশালীন ভাষায় স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুজিববিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা বড়ই কঠিন। গাফ্ফার চৌধুরীর মতো তৎকালীন সময়ে অনেকেই ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকায় এই বিরুদ্ধাচরণে বিরক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১-এর কলমসৈনিক কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়ার ১৩ আগস্ট ১৯৭১-এর দিনলিপিতে তিনি ‘বেতারের বাংলা’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছেন, “ঢাকা বেতারে আজকাল যে হারে বাংলা সংবাদে কথিকায় আর খুটিনাটি ব্যাপারে উর্দুকে অহেতুকভাবে টেনে আনা হচ্ছে, এতে কৌতুকের উদ্রেক করে। আমার মনে হয় খাঁটি বাংলাটা হিন্দুয়ানীতে পূর্ণ মনে করে ঢাকা বেতার এক্ষণে বাংলায় উর্দুর মিশ্রণ ঘটায়ে এটাকে মুসলমানীত্বে পরিণত করতে চাচ্ছে। কাককে ময়ূরের পুচ্ছ পরালে আপামর জনসাধারণের কাছে তা কাকের রূপেই থাকবে।” অথচ যখন তিনি এ-কথাটি লিখছেন তখন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নম্বর বাড়ি থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করে যাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নানা অনুষ্ঠান। এই বাড়িতে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা থাকতেন। কিন্তু বেতারের জন্য অফিসটি ছেড়ে দেন তারা। উল্লেখ্য, পূর্ব বাংলার ঢাকাতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়। ঢাকায় নাজিমুদ্দিন রোডে একটি ভাড়া করা বাড়িতে বর্তমানে যেটি শেখ বোরহানুদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ। বেতার কেন্দ্রটির নাম ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকা ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’।
১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতাযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে। ৩টি পর্যায়ে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (বিপ্লবী) যার শুভ সূচনা হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১, সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে কালুরঘাট (চট্টগ্রাম) প্রচার ভবনে ১০ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে। এই প্রচার ভবন বিমান হামলায় আক্রান্ত হয় ৩০ মার্চ ১৯৭১। এই কেন্দ্রের প্রথম তথা প্রতিষ্ঠা পর্যায়ের স্থিতি ছিল ২৬ থেকে ৩০ মার্চ দুপুর পর্যন্ত। ২৬ মার্চ বেলাল মোহাম্মদের কণ্ঠ থেকে প্রচারিত হয় প্রথম বেতার কথিকা। “হানাদার-দুশমন। ওদের ক্ষমা নেই-ক্ষমা নেই। স্বাধীন বাংলার প্রতিটি গৃহ এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। বাঙালি আজ জেগেছে, জয় নিপীড়িত জনগণের জয়/জয় সব অভিযান, জয় নব উত্থান। জয় স্বাধীন বাংলা।” এরপর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা প্রচার করেন। ২৭ মার্চ সকালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের ১০ জন বেতারকর্মী বসে কাজ করছেন। এর মধ্যে লেফটেনেন্ট শমসের এবং মেজর জিয়া আসেন। মেজর জিয়াকে অনুরোধ করা হয়, বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে একটি ঘোষণা পাঠ করার জন্য। মেজর জিয়া এ প্রস্তাব শোনার পর শমসের আলীর সাথে কথা বলে অনেকক্ষণ পর রাজি হন। ২৭ মার্চ বিকালবেলা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন প্রচার করা হয় ৩ এপ্রিল ১৯৭১-এ রাত ৯টায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বগাফা বিএসএফ ৯২ হেড কোয়ার্টার্সে একটি ২০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গ ট্রান্সমিটার থেকে। ২৪ মে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভারতের তথ্যমন্ত্রী ড. ত্রিগুনা সেন এবং ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী শৎপথী সাহায্য করেন। তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের আশ্বাস দেন যে, অচিরেই প্রবাসী সরকারের অধীন একটি ৫০ কিলোওয়াট মধ্যম তরঙ্গ ট্রান্সমিটার দেওয়া হবে মুজিবনগরে। ২২ মে ১৯৭১, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটি গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত অনেকের মধ্যে থাকেন আবদুল মান্নান, এমআর আখতার মুকুল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনকে সামনে রেখে ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে প্রতি সেকেন্ড ৮৩০ কিলো সাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় বাঙালি জাতির মর্মবাণী। বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এমআর আখতার মুকুল, পটুয়া কামরুল হাসান, আমিনুল হক, আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান। দৈনিক সকাল ৭টা ও সন্ধ্যা ৭টায় দুই অধিবেশনে প্রচারিত হতো অনুষ্ঠান। প্রথম গান বাণীবদ্ধ করেন রংপুর বেতারের তৎকালীন পল্লিগীতি শিল্পী শাহ আলী সরকার।
এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম কোনো স্টুডিও ছিল না। তিন কামরার দোতলার একটি জানালা-দরজা বন্ধ করে রেকর্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়। বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি জিপ গাড়ি করে এই রেকর্ডেড স্পুল টেপ একটি নির্দিষ্ট পোর্ট ফোলিও ব্যাগে পৌঁছে দিতেন। রাতে ঘুমানোর জন্য একটি কি দুটি ঘরে সবার বাসস্থান। যারা বাথরুম এটাচ রুমটাতে থাকতেন সকালবেলা সবাই তাদের টপকে বাথরুমে যেতেন এবং ফিরতেন। আসতে-যেতে শরীরের পানি দিয়ে ঘুম ভেঙে যেত। খাবার-দাবার ছিল যৎসামান্য। নানারকমের অনুষ্ঠান প্রচার হতে লাগল। প্রথম দিনের কর্মসূচি ছিল সকাল ৭টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও তরজমা, ৭.১০ মিনিটে দৈনিক দুটি অধিবেশনের প্রচার সংক্রান্ত ঘোষণা, ৭.১৫ মিনিটে বাংলা সংবাদ, ৭.২৫ মিনিটে ইংরেজি সংবাদ, ৭.৩০ মিনিটে আবৃত্তি ও গানের অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’। সাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘রক্তস্বাক্ষর’, বঙ্গবন্ধুর ভাষণভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘বজ্রকণ্ঠ’ এবং ‘চরমপত্র’। আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান, টিএইচ শিকদার ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় রেডিও স্টেশনের টেপ লাইব্রেরি থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময়কার বেশ কিছু গানের টেপ নিয়ে গিয়েছিলেন বালিশের মধ্যে। এতে স্পুলগুলো ভেঙে গিয়েছিল। তাহের সুলতান সেই স্পুলগুলো সারাদিন পরিশ্রম করে নতুন স্পুলে উঠিয়েছিলেন। এমআর আখতার মুকুলের লেখার নাম ‘চরমপত্র’ দিয়েছেন আশফাকুর রহমান। প্রথম দিনে কোরআন তেলাওয়াত রেকর্ডিং হলো ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদউল্লাহ চৌধুরীর কণ্ঠে। মিসেস টি হোসেন, পারভীন হোসেন ছদ্মনামে প্রথম ইংরেজি সংবাদ পড়লেন। বাংলা সংবাদের দায়িত্বে রইলেন কামাল লোহানী। চিত্রাভিনেতা হাসান ইমাম, সালেহ আহমদ ছদ্মনামে প্রথম ইংরেজি সংবাদ পড়লেন। অনুষ্ঠান ঘোষণা ও প্রোগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয় আশফাকুর রহমানকে। নিউজ রুম কামাল লোহানীর দায়িত্বে রাখা হয়। বেতার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর তিন সপ্তাহের মধ্যে বহু গুণী ব্যক্তি এসে হাজির হলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান ছিল ‘প্রতিনিধির কণ্ঠ’, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের ‘পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘বিচার প্রহসন’, আমির হোসেনের ‘সংবাদ পর্যালোচনা’ ধারাবাহিকভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সৈয়দ আলী আহসানের ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’, ধারাবাহিক কথিকা ডক্টর মাযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের ‘দৃষ্টিপাত’, সাদেকীনের ‘বিশ্ব জনমত’, মাহবুব তালুকদারের ‘মানুষের মুখ’, আবদুল রাজ্জাক চৌধুরীর ‘পর্যালোচনা ও সূর্য শপথ’, মাহমুদুল্লাহ চৌধুরীর ‘দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম’, বদরুল হাসানের ‘বেইমানের দলিল’, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পা-ুলিপি লিখন ও কণ্ঠদান করেন মোহাম্মদ মুসা, নাসিম চৌধুরীর ‘গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল’, চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান স্বকণ্ঠে প্রচার করেন ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’। শওকত ওসমানের ‘ইয়াহিয়া জবাব দাও’। সিকান্দর আবু জাফরের ‘অভিযোগ ইসতেহার’। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’র দায়িত্ব দেওয়া হয় টিএইচ শিকদারকে। সংগীত পরিচালক সমর দাস অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। নাট্যকার কল্যাণ মিত্রের লেখা ‘জল্লাদের দরবার’ ইয়াহিয়ার খানের ভূমিকায় রাজু আহমেদ। বাচ্চাদের জন্য সপ্তাহে দুদিনে ‘ওরা রক্তবীজ’ অনুষ্ঠানটি বেশি দিন স্থায়িত্ব হয়নি। ড. আনিসুজ্জামানের লেখা ‘অমর ১৭ সেপ্টেম্বর’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অমূল্য সম্পদ। জাহিদ সিদ্দিকী ছিলেন উর্দু খবর পর্যালোচক। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী আবৃত্তি করতেন। গুরুত্বপূর্ণ যে গানগুলো কালজয়ী হয়ে আছে তার মধ্যে গোবিন্দ হালদারের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’। শ্রী ভবানন্দের লেখা ‘ও বগিলারে’, কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লিখিত অংশুমান রায়ের কণ্ঠে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’, শ্যামল গুপ্তের লিখিত ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেক নাম’। এই গানগুলো পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা লিখেছেন। এছাড়া যেসব ছাত্রনেতা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মূল্যবান ভাষণ এবং কথিকা প্রচার করেছেন তাদের মধ্যে নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, এমএ রেজা প্রমুখ। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দখলিকৃত এলাকার ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে ভয়াবহ অপপ্রচার চালানোর বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল অন্যতম একটি প্লাটফর্ম। যাদের কথা না বললেই নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম ১০ জন প্রতিষ্ঠাতা কর্মী ছিলেন যারা তারা হলেনÑ বেলাল মোহাম্মদ (দলনেতা, পরবর্তীতে অনুষ্ঠান সংগঠক), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (প্রথম কণ্ঠ, পরবর্তীতে সাব-এডিটর বার্তা), সৈয়দ আবদ্দুস শাকের (প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (অনুষ্ঠান প্রযোজক), আমিনুর রহমান, রাশেদুল হাসান, শারফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী (সবাই প্রকৌশলী সহযোগী), মোস্তফা আনোয়ার (নাটক) ও কাজী হাবিবউদ্দিন (অনুষ্ঠান সচিব)।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশনের যেসব নারী সংগঠক হিসেবে ছিলেন, তারা হলেনÑ ডা. মঞ্জুলা আনোয়ার, কাজী হোসনে আরা ও বেগম মুশতারী শফী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কিছু কর্মী একটি ট্রান্সমিটারসহ আগরতলায় উপস্থিত হলে ভারতীয় জনগণ ও সরকারের সহযোগিতায় তারা বাংলাদেশের নামে বেতার প্রচারণাও শুরু করতে সমর্থ হয়। তাছাড়া অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র্রের প্রচারকাজ শুরু করেছিল। এসব অনুষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সংবাদ। সংবাদের মাধ্যমে জাতি উদ্বুদ্ধ হতো নতুন নতুন উদ্যোগে। আর এই সংবাদ বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছিল যাদের মাধ্যমে তারা হলেনÑ জারিন (নাসরিন) আহমাদ (ইংরেজি), দীপ্তি লোহানী (ইংরেজি), পারভীন হোসেন (বাংলা), তাজিন শাহনাজ মুর্শিদ, শেফালী দাস প্রমুখ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব নাটকে নাট্যকার, নাট্য প্রযোজক ও নাট্যশিল্পীদের মধ্যে যেসব নারী অংশ নেন, তাদের মধ্যে মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সুমিতা দেবী, করুণা রায়, লায়লা হাসান, কাজী তামান্না, উম্মে কুলসুম, সুফিয়া খাতুন, দিলশাদ বেগম প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত জীবন্তিকা ‘জল্লাদের দরবার’, ‘জনতার আদালত’ ও মীর জাফরের রোজনামচার মধ্যে ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটিতে পাকবাহিনীর হতাশা ও পরাজয়ের চিত্র ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। পুরুষের পাশাপাশি এতে অমিতা বসু এবং আলেয়া ফেরদৌসী চমৎকার অভিনয় করেন। এ নাটকে জারীন আহমাদ ও মুশতারী শফীও অভিনয় করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যারা শব্দসৈনিক ও সুরসৈনিক ছিলেন, তারা হলেনÑ সানজীদা খাতুন, কাজী রোজী, কল্যাণী ঘোষ, নাসরীন আহমাদ, শাহীন মাহমুদ, শেফালী ঘোষ, হেনা বেগম, স্বপ্না রায়, মালা খান, রূপা খান, মাধুরী আচার্য, নমিতা ঘোষ, লায়লা জামান, মনিরা জামান, ডালিয়া নওশীন, ফ্লোরা আহমেদ, বুলবুল মহালনবীশ, মনজুলা দাশ গুপ্তা, ঝর্না ব্যানার্জী, দীপা ব্যানার্জী, কল্যাণী মিত্র, লীনা দাশ, সাকিনা বেগম, অনিতা বসু, রিজিয়া সাইফুদ্দিন, রেহানা বেগম, ভক্তি রায়, অর্চনা বসু, শক্তিশিখা দাস, ভারতী ঘোষ, জমিলা দাস, অরুণা সাহা, মিনু রায়, রীতা ব্যানার্জী, শান্তি মুখার্জী, মিতালী মুখার্জী, পারভীন আক্তার, শীলা মোমেন, কুইন মাহজাবীন, জয়ন্ত নীলা, সীতশ্রী সেন, উমা খান, মিলিয়া আলী প্রমুখ। নমিতা ঘোষ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম নারী শিল্পী।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠান আলী যাকের, ছদ্মনাম আবু মোহাম্মদ আলী নামে পরিচালনা করতেন। আর একজন ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির, ছদ্মনাম আহমেদ চৌধুরী। তারা দুজন অনুষ্ঠান সফল করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন।
সৌভাগ্যজনকভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত সব বীর সন্তানদের মূল্যায়ন করেছেন। লেখা হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতার ৫১ বছরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে জড়িত সকল কলাকুশলীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ বেতার’। এই বেতার কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার শুরু করে ১৯৭১-এর ২২ ডিসেম্বর থেকে। তবে ১৬ ডিসেম্বর বিকালে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই ঢাকা রেডিও স্টেশনের কর্মীরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গান ও কথিকা প্রচার করে।
শেষ করছি ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নিরঞ্জন অধিকারীর লেখা কবিতা দিয়ে, যিনি সবুজ চক্রবর্তী নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। তার কবিতার নাম ছিল ‘এগিয়ে চলো মাঝি’। কবিতার শেষ স্তবক ছিল এ-রকমÑ “তবুও অকুতোভয় তোমাকে এগুতে হবে/তবেই মাঝি তোমার নৌকা ভেড়াতে পারবে/তবেই তোমার যাত্রা হবে সার্থক/বাঁ হাতে মুছে ফেলবে ঘাম/চোখে মুখে ফুটে উঠবে হাসি/বিজয়ী হাসি/মাতাল সমুদ্রকে জয় করবার হাসি।” এই মাতাল সমুদ্র জয় করে বিজয়ের হাসি হেসেছিল বাংলার মানুষ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাক্সিক্ষত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়