নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে- ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে চতুর্থ, মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম।
নূহ-উল-আলম লেনিন: মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ৫১ পেরুলো বাংলাদেশ। উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর দুর্ভাগ্য বাঙালির, তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি। পেয়েছিল নতুন শৃঙ্খল, নতুন আদলে ঔপনিবেশিকতা। ১৯৭১-এ এসে সেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খল ভাঙতে হয়েছে। মাঝখানে অপচয় হয়ে গেছে ২৪টি বছর। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হলেও, বাংলাদেশের প্রকৃত নবযাত্রা শুরু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে। ঐদিন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, এই ৫১ বছরে আমরা কী পেলাম? সহজ উত্তর হতে পারে, আমরা ‘একটা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র পেয়েছি।’ সত্য বটে, এই উপমহাদেশে একমাত্র জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভারত বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানও তাই। সারাবিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি বাংলাভাষী- বাঙালি থাকলেও সবার কিন্তু নিজস্ব ‘জাতি-রাষ্ট্র’ নেই। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সারাদুনিয়ায় বাংলাদেশ আমাদের ‘বাঙালি আত্মপরিচয়’, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। এজন্য আমরা গর্বিত।
কথা হচ্ছে, আমরা কেবল এটুকুতে সন্তুষ্ট নই। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ কেবল স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র বা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেনি, আত্মদান ও আত্মত্যাগ করেনি। স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে, আমাদের গণতান্ত্রিক সংবিধান দিয়ে, আমাদের নিজস্ব পার্লামেন্ট দিয়ে- স্বাধীনতার একটি লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, নিঃসন্দেহে। এসবের পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল, জনগণের ‘ভাত-কাপড়-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের’ নিশ্চয়তা বিধান করা। একটি সুখী, সুন্দর, সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘সোনার বাংলা গড়ে তোলা।’ এই লক্ষ্য অর্জনে, এই অঙ্গীকার পূরণে আমরা কতটা সক্ষম হয়েছি, ৫১ বছর শেষে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বঙ্গবন্ধুর জীবিতাবস্থায় আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন শুরু হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪ ডলারের (মতান্তরে ৮৮ ডলার) মতো। ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৩ ডলার।
দুরতিক্রম্য বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কেবল কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। তা সত্ত্বেও তখন সকল মানুষের ন্যূনতম খাদ্য নিরাপত্তা ছিল না। খাদ্যাভাব, মঙ্গা এবং প্রায়শ দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসত। ৭ কোটি মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ৫১ বছরে এই অতিরিক্ত বাড়তি ১০ কোটি মানুষসহ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সফল হয়েছি। মনে রাখতে হবে, ১৯৭২ সালে দেশে ধান উৎপাদন হতো ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৩ কোটি ৮২ লাখ টন দাঁড়িয়েছে। গম, ভুট্টা ও ধান মিলিয়ে মোট খাদ্য উৎপাদন ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে- ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে চতুর্থ, মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম।
দেখা যাচ্ছে, শুধু দানা ফসল নয়, মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হচ্ছে আমাদের মাটি থেকে। মনে রাখতে হবে, এসব সাফল্য সম্ভব হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার চলমান শাসনকালে।
যে কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জ্বালানি বা শক্তি। খনিজ তেল ও তরলীকৃত গ্যাস ও কয়লার জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রকৃতি আমাদের মাটির তলদেশে যেটুকু গ্যাস দিয়েছে, আমাদের চাহিদার একাংশ পূরণে তা সক্ষম হলেও, এ ক্ষেত্রটিতে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের প্রধান সার কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেক্সটাইল ও শিল্প-কারখানা চালানোর একটা বড় উৎস আমাদের গ্যাসসম্পদ। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গৃহস্থালি কাজে গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে আমাদের রিজার্ভ যাতে দ্রুত ফুরিয়ে না যায়, সে-জন্য সাশ্রয়ীভাবে গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে এবং বর্ধিত চাহিদার জন্য তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে। দিনাজপুরে আবিষ্কৃত কয়লাখনি হতে প্রাপ্ত কয়লা দিয়ে আমরা একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালাচ্ছি। আমাদের আরও কয়লা খনি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য অনন্য। স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৫৮০ মেগাওয়াট। এটা পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের ‘সাফল্য’। বলা বাহুল্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে অন্ধকারে রেখে, এদেশকে চরম পশ্চাৎপদ দেশে পরিণত করেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব প্রদান করে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে বাস্তবে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও বাড়েনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২১ হাজার মেগাওয়াট করা হবে। বাস্তবে এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু ও স্থাপনের এই ধারা অব্যাহত আছে। পাবনার রূপপুরে রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিটি গ্রাম ও বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই সাফল্য আমাদের দেশকে দ্রুত শিল্পায়নের পথে অগ্রসর করে নিচ্ছে। কৃষির কথা আগেই বলেছি। বাংলাদেশে একসময় কর্মক্ষম জনসংখ্যার বেশিরভাগ কৃষিতে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে শিল্প ও অকৃষিজ খাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনশক্তি নিয়োজিত আছে।
অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষদ বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম সেতু। কর্ণফুলি নদীতে নির্মিতব্য সুড়ঙ্গ পথ বা টানেল কিছুদিনের মধ্যেই চালু হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই প্রথম টানেল। বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের আমলেই শত শত মাইল পাকা রাস্তা, শত শত সেতু (গত মাসে একদিনেই একসাথে ‘১০০’ সেতু উদ্বোধন) নির্মাণ করেছে। ঢাকায় চালু হতে যাচ্ছে উড়াল রেল বা মেট্রোরেল। নির্মাণ সমাপ্তির পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলওয়ে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মহাকাশে যোগাযোগ উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট চালু করেছে। দ্বিতীয় স্যাটেলাইট শীঘ্রই চালু হবে।
বাংলাদেশে গড়ে উঠছে শতাধিক বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতোমধ্যে কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত কল-কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা গৌরবের সাথে বলতে পারি, বাংলাদেশ বিশ্বে তৈরি পোশাকে রপ্তানির ক্ষেত্রে সম্মুখ কাতারে রয়েছে। কেবল পোশাক নয়, ঔষধ, সিমেন্ট, চামড়া, চা, সবজি, মাছ এবং সুগন্ধি চালও রপ্তানি হচ্ছে।
উন্নয়নের দুটি সূচকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলাদেশ এ যাবত ছিল দারিদ্র্যপীড়িত স্বল্পোন্নত দেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করতে চলেছে। গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের জনগণের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১১২ টাকা (১৯৭২-৭৩) থেকে ২০ হাজার (২০২০) টাকা। ডলারের হিসাবে ৮৮ বা ৮৯ থেকে (১৯৭২) থেকে ২,৮০০ (১৯২২) ডলার। ২০০১-০৬ সালে গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০০৯-২১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়। কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বিশ্বব্যাপী মন্দার জন্য প্রবৃদ্ধির এই ধারা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৭৩ শতাংশই ঘটেছে গত ১২ বছরে। আইএমএফের হিসাবমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। পক্ষান্তরে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা যদি আজও পাকিস্তানের অধীনে থাকতাম, তাহলে আমাদের এই উন্নয়ন কোনোভাবে সম্ভব হতো না।
আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২১ সালে মোট জিডিপি ৪০৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে ২০০৫ সালের ২৫ শতাংশ থেকে কমে এখন হয়েছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (২০১৯)।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, যে কোনো দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি সামাজিক সূচককে বিচার্য হিসেবে ধরা হয়। গড় আয়ুষ্কাল, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার, শিক্ষার হার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ও টিকাদান প্রভৃতির হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ৫১ বছরের সূচনায়, ১৯৭২ সালে এদেশে গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৪৬.৫ বছর, বর্তমানে সেখানে গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছর। ১৯৭২-৭৩ সালে এদেশের রাজস্ব আয় ছিল ১৬৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০২০-২১ সালে রাজস্ব আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ রাজস্ব আয় বেড়েছে ১ হাজার ৫৬৬ গুণ। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায়। বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৮ গুণ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে আছে। স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে মুক্তি। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছিল- স্কুলে যাওয়ার বয়সী সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হবে। ইতোমধ্যে সেই অঙ্গীকার পূরণ হয়েছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, মেয়েদের বিশেষ করে বৃত্তি ও উপবৃত্তির আওতায় আনার ফলে এখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ হচ্ছে মেয়ে। নারী শিক্ষার এই হার ভারত, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মোট ৬টি। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭। ১৯৭২ সালে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। বর্তমানে অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বর্তমানে শিক্ষার হার প্রায় ৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ছাড়া বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। কোভিড মোকাবিলায় টিকাদানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ ঔষধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং বিদেশে রপ্তানিও করছে।
সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অতীতে জিয়া-এরশাদ-খালেদার নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো এসব ক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাফল্য দেখাতে পারেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রথম (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতাসীন থাকাকালে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের জন্য বিনামূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিল। আর এরই ধারাবাহিকতা ২০০৯-২০২২ পর্যন্ত সময়কালে হাজার হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এই ধারা অব্যাহত আছে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, গৃহায়ন, বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ ও টিসিবির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল, ডাল, চিনি প্রভৃতি বিতরণের মাধ্যমে শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। জেন্ডার গ্যাপ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য গর্ব করার মতো। ক্ষমতা-কাঠামোর সকল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ এখন দৃশ্যমান। পার্লামেন্ট, জেলা পরিষদ (কর্পোরেশন, পৌরসভাসহ), উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, শ্রমশক্তি হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ ৬৬ শতাংশ। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের ৬০ শতাংশ এখন নারী। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশের নারীনীতি নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মুক্তির সহায়ক হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছিল। অনেকে ঠাট্টা-তামাশা করলেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈপ্লবিক সাফল্য সারাবিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে গড়ে তোলা হয়েছে হাইটেক পার্ক। তথ্যের অবাধ প্রবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন নজির স্থাপন করেছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ- বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সংখ্যা ১৮ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ১৩ কোটি মানুষ। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত অর্ধশতাব্দীর সাফল্যের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া এই ছোট্ট পরিসরে সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে- ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে শিল্পোন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। এ-লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। এছাড়া শতাব্দী শেষে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে, সে-লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ব-দ্বীপ’ পরিকল্পনা।
এ-কথা ঠিক, বাংলাদেশের সাফল্য চমকপ্রদ। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে যাত্রারম্ভেই বাংলাদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৫-১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পাঁচ বছর এবং ২০০৭-২০০৮ পর্যন্ত দুই বছর মোট ২৮টি বছর সামরিক শাসন, বেসামরিক পোশাকে সামরিক শাসন, বিএনপি-জামাতের দুঃশাসন, তত্ত্বাবধায়কের নামে সামরিক শাসন আমাদের দেশের উন্নয়নের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করেছে। জাতির জীবন থেকে ২৮টি বছর অপচয় হয়ে গেছে। পাকিস্তানি দুঃশাসনের ২৪ এবং বাংলাদেশের ৫১ বছরের মধ্যে ২৮ বছর এদেশের কাক্সিক্ষত ও স্বাভাবিক উন্নয়ন হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর যদি এই ২৮টি বছর অপচয় না হতো, তাহলে বাংলাদেশ ২০০০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারত।
এতদ্বসত্ত্বেও বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেউ বলছে বাংলাদেশ হচ্ছে ইমার্জিং টাইগার। কারও মতে দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’ প্রভৃতি। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৬টি সবল অর্থনীতির উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান নবম। ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস লিগ টেবল ২০২১’-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অগ্রগতি এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস ফোরামের মতে, পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘বাংলাদেশ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে।’ সত্যি সত্যি বাংলাদেশের ৫১ বছরের অর্জন ও সাফল্য বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো। ১৯৭৪-৭৫ সালে ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকের দুই অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অসম্ভব। স্বয়ং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ সংঘাত, রক্তপাত, স্বৈরশাসন, বিদেশে অর্থপাচার ও লাগামহীন দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেবল ঘুরেই দাঁড়ায়নি, দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার এবং পরনির্ভরশীলতার লজ্জা ঘুচিয়ে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যে-দেশে নিজেদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ লাখ মানুষ আত্মদান করতে পারে, যে-দেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহানায়ককে দেশের স্থপতি হিসেবে পায়, যে-দেশের মানুষ দেশের স্থপতিকে বন্ধু (বঙ্গবন্ধু) হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে, সে-দেশ যে বিশ্বের বুকে রোলমডেল হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! উপরন্তু যে-দেশের মানুষের জন্য ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি সন্তানদের ভূত-ভবিষ্যতের কথা চিন্তা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে মানুষের- দেশের কল্যাণের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে নিবেদন করার মতো মাতৃতুল্য নেত্রী- শেখ হাসিনাকে পেয়েছে বাংলাদেশ। যে-দেশ তার মতো দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব পায়, সে-দেশের উন্নয়ন না-হয়ে পারে না। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর নেমে আসা ঘোর অমানিশা কাটিয়ে আলোকোজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মদান, চার জাতীয় নেতার আত্মদান, ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান এবং কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্ন-প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি। শেষ পর্যন্ত জনগণই হচ্ছে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক। বাঙালির জয়- বাংলাদেশের জয় অনিবার্য।
লেখক : সম্পাদক, উত্তরণ