Wednesday, October 4, 2023

স্বপ্ন হলো সত্যি

  • মঞ্চসারথি আতাউর রহমান

আমরা, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা এক মহৎ শিল্প ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গে বর্ধিত হয়েছি। আমরা কখনই বিত্তশালী ছিলাম না; কিন্তু আমাদের ছিল সহজ ও সুন্দর জীবনাচরণ, যার পরিপূর্ণ স্ফুরণ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম এক ‘মহামানবের’ মধ্যে। জগৎসভার সেরা বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার একটি গানের কথায় আছে “ওই মহামানব আসে; … মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।” তার গানের সত্যিকার রূপায়ণ করলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি সত্যিকার অর্থে ছিলেন একজন মহামানব। সেই মহামানবেরই নেতৃত্বে আমরা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের জিঞ্জির ভেঙে দেশকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা একের পর এক নিগৃহীত হয়েছি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এবং সর্বশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অমানবিক পীড়নে। বিলেতের সাহেবেরা ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের জাল গুটাবার আগে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের জুড়ে দিল হাজার মাইল দূরে পাকিস্তানিদের সাথে। আমরা হলাম পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব ও পশ্চিম দুই দেশ মিলে হলো এক দেশ, যার নাম হলো পাকিস্তান। যদিও আমরা ছিলাম একই দেশের অধিবাসী, সত্যিকার অর্থে আমরা হয়ে পড়লাম পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দু ভাষাভাষীদের ক্রীতদাসের সমতুল্য, যাদের সাথে আমাদের জীবনাচরণের কোনো ক্ষেত্রে মিল ছিল না। তার মধ্যে প্রধান ছিল খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির বিশাল বিভাজন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা নিগৃহীত হতে লাগলাম পাকিস্তানি প্রভুদের হাতে, যেভাবে নিগৃহীত হয়েছিল আফ্রিকার কৃষ্ণবর্ণের মানুষেরা শ্বেতকায় সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের হাতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই ছিলেন প্রকৃতির সন্তান এবং গণমানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি। তিনি তার সহযোগী নেতৃবৃন্দ হাতে হাত রেখে একের পর এক জীবনের জটিল গ্রন্থি ও অধ্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের শৃঙ্খল ভঙ্গ করে দেশকে মুক্ত করে আমাদের জন্য স্বাধীনতা ও বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। সেই দুর্বিষহ ২৫ বছরের জীবন আমাদের জন্য ছিল একটি কৃষ্ণপক্ষের দুঃস্বপ্নের রাতের সমতুল্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন একটি শ্মশানতুল্য দেশকে পুনর্নির্মাণে নিজের সমগ্র সত্তাকে সর্বান্তকরণে উৎসর্গ করেছিলেন, তখনই আবার শকুন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের এই বাংলায়, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। সেই দেশীয় শকুনেরা বিদেশি কুচক্রীদের সাথে হাত মিলিয়ে জাতির পিতা এবং তার পরিবারের সবাইকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় অবস্থিত তার নিজের বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেলকেও ওরা রেহাই দেয়নি। অগণিত মানুষ রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনদের ইজ্জত বিসর্জনের বিনিময়ে যে দেশটি একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তা আবার অন্ধকারে নিপতিত হলো।
সৌভাগ্যক্রমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে দুই বোন দেশে ফিরে এলেন এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও মৃত্তিকালগ্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দলের সবারই সম্মতিক্রমে দল-প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। উনি পিতার হাতের আলোকবর্তিকাটি নিজ হাতে তুলে দেশকে ক্রমাগত উন্নতির সড়কে নিয়ে চলতে শুরু করলেন। দেশে ফিরে আসার পরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বদান করেছিলেন। অতঃপর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত উনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন। মাঝখানে আপদকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করে। ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করে চলেছেন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রশংসনীয় কাজের জন্য দেশ-বিদেশের একাধিক সংস্থা কর্তৃক বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দান এবং আরও অনেক সুকৃতির জন্য বিশ্ব মানবতার ‘মা’ হিসেবে তার একটা বিশেষ পরিচিতি আছে। আমরা কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে মাত্র ১,৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার ভূমির বাংলাদেশে যেখানে প্রায় ১৭ কোটি লোক বসবাস করে, সেই দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘস্থায়ী কোভিড-১৯ ভাইরাস রোগে যখন সমগ্র পৃথিবী আক্রান্ত, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে বিরাট খরা নেমেছে; তখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সদাজাগ্রত প্রয়াসে এবং জনগণের সতর্কতার কারণে আমরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হইনি।
চলতি এই জুন মাসে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সুবর্ণ অধ্যায় উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে। তা হলো পদ্মা বহুমুখী সেতু। পদ্মা বহুমুখী সেতুর অন্তরে লুকিয়ে আছে অনেক দুঃখ আর বিড়ম্বনার কাহিনি। পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সিংহভাগ অর্থের জোগান দেওয়ার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসমূহের। আমাদের দেশের কয়েকজন কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গ ও তথাকথিত রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্রে ও কুমন্ত্রণায় উল্লিখিত অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের শত্রুরা ভেবেছিল দেশবাসীর ললাটে চির-দুঃখের ছাপ এঁকে দেবে তারা এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবদমিত করে তার পতন ঘটাবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো ট্রাস ব্রিজের সর্বমোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২০,১৮০ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৫৯.৬০ ফুট, স্প্যানের সংখ্যা ৪১। এই সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা এই বছর; ২০২২-এর জুন মাসের ২৫ তারিখে। পদ্মা সেতু অনাদিকালের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়ে থাকবে একটি বিজয়ের স্মারক হিসেবে। দেশের জনগণের জন্য খুলে যাবে একটি সুবর্ণ দ্বার। শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে জয় হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার। সর্বোপরি জয় হয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের। উল্লেখ্য, আমাদের নিরাসক্ত প্রধানমন্ত্রী সব প্রলোভন ও প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে সেতুটির নাম রেখেছেন ‘পদ্মা সেতু’। এখানে নদী মাতৃক দেশের নদীই প্রাধান্য পেয়েছে, নির্মাণে প্রধান শক্তি ও অনুপ্রেরণা দানকারী নয়। এক্ষেত্রেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্লোভ সত্তার জয় হয়েছে।

লেখক : সদস্য, উপদেষ্টাম-লী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘কখনও মাথানত করিনি, করব না’
পরবর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগের ৭৩ বছর
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য