জাকির হোসেন: পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির অহংকার-আত্মমর্যাদার প্রতীক। বহু প্রতিকূলতা ও দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের মানুষের লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয় ২০২২ সালের ২৫ জুন। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বপ্রথম নিজ হাতে টোল প্রদান করে পদ্মা সেতু পার হন। আবেগে ভাসে পুরো জাতি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আজন্মের কষ্ট ছিল পদ্মা পেরিয়ে যে কোনো প্রয়োজনে রাজধানীসহ উত্তরাঞ্চলের কোথাও গমনাগমন- এক নিমিষেই তা সহজ হয়ে যায়।
জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইস্পাতদৃঢ় মনোবল ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাহাড়সম একাগ্রতায় বাঙালি জাতি দেখিয়ে দিয়েছে- আমরাও পারি। পদ্মা সেতু তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। দেশি ও বিদেশি বহু ষড়যন্ত্রের বাধা পেরিয়ে এই সেতু তৈরি হয়েছে। নিজেদের টাকায় বাংলাদেশ সর্বনাশা পদ্মাকে জয় করে এর দু-পাড়কে এক করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনকালে ২০০১ সালে প্রথম পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিল করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এলে আবারও পদ্মা সেতুর বিষয়টি সামনে আসে। শুরু হয় দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র। এর অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেওয়ার নামে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে একপর্যায়ে অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ফলশ্রুতিতে পদ্মা সেতুতে ঋণ প্রদানকারী অন্য সংস্থাগুলো, যেমন- জাইকা, এডিবি-সহ অন্যরাও ঋণ প্রদানে অসম্মতি জানায়। ঝুলে যায় পদ্মা সেতু প্রকল্প।
বিরূপ পরিস্থিতিতে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের অপরিসীম সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেন। পদ্মা সেতুর বাজেট বরাদ্দ একবারে না দিয়ে ভাগে ভাগে প্রতিবছরের বাজেট থেকে কিছু কিছু প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে গড়ে ওঠে পদ্মা সেতু। তখনও নানামুখী অপ্রপ্রচার চলে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন- দেশের অর্থনীতি চাপে পড়ে যাবে, কেউ কেউ বলেন- ডলার সংকট তৈরি হবে ইত্যাদি।
এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত বাঙালি জাতির স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন অর্থাৎ, ২৬ জুন ২০২২ থেকে যান চলাচল শুরু হয়।
উদ্বোধনের পর কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে পদ্মা সেতু অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবল হবে না। যান চলাচল কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না-ও পারে। তথাপি ২৫ জুন ২০২২ থেকে এ-বছর ২৪ জুন পর্যন্ত এক বছরে মোট ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার যানবাহন পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়েছে। তাতে মোট আয় হয়েছে ৭৯৮ কোটি ২৩ লাখ ৯৬ টাকা। দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৫ হাজার গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
আমাজনের পর পদ্মাকে বিবেচনা করা হয় মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল রিভার হিসেবে। নির্মাণকাজের প্রতিটি ধাপেই ছিল নানান চ্যালেঞ্জ। এতে বিভিন্ন সময় সেতু তৈরির ব্যয় বেড়ে যায়। সূত্রমতে, সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) সরকারের কাছ থেকে সেতু নির্মাণ ব্যয়ের অর্থ বিবিএ ঋণ হিসেবে নিয়েছে। এ ঋণের টাকা ধাপে ধাপে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেবে বিবিএ। ইতোমধ্যে গত অর্থবছরে ৪টি কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট প্রায় ৬৩২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে বিবিএ। চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে হবে। পদ্মা সেতু দারুণভাবে বদলে দিয়েছে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সাথে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সড়ক-সংযোগ। এই সেতুর মাধ্যমে মোংলা, পায়রা পোর্ট, বেনাপোল স্থলবন্দরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এখন সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী।
দ্বিতল পদ্মা সেতুর উপরতলা দিয়ে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলছে। আর নিচতলায় রয়েছে রেললাইন। এই সেতুর মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দরের সাথে রাজধানী ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। এই সেতুর মাধ্যমে এপার থেকে ওপারে চলে গেছে গ্যাস এবং অপটিক্যাল ফাইবার লাইন।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর এক বছর
আরও পড়ুন