Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderস্ট্যালিনের ক্রোমওয়েল বিবর্তন

স্ট্যালিনের ক্রোমওয়েল বিবর্তন

পুঁজিপুষ্ট ধাপ্পাবাজের দলকে বিশ্বাস করতে চান? করুন। তারা এখনও সবগুলো সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষমতায়। তারাই স্ট্যালিনের বিরাটত্ব ও মহত্ত্বের সার্ভে করাচ্ছেন বহু অর্থ খরচ করে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস করে আপনাদের লাভ কোথায়? সমাজতন্ত্র ফিরে আসবে?

শাহাব আহমেদ: সদ্য স্ট্যালিনের জন্মভূমি এবং তার মায়ের সমাধি ঘুরে এসে হাসান ফেরদৌসের ‘স্তালিনবাদকে যারা জিন্দাবাদ দিচ্ছেন’ এবং ওমর তারেক চৌধুরীর ‘স্তালিনকে উপড়ে ফেলা যায়নি’ দুটি প্রবন্ধ পড়লাম। শুনেছি কিছুদিন আগে স্ট্যালিনকে নিয়ে লেখা একটি নাটকও না-কি দেশে বেশ বড় নাটকের সৃষ্টি করেছে।
দুজনেই অনেক তথ্য দিয়েছেন। আমার ‘লেনিনগ্রাদ থেকে ককেশিয়া’ ও ‘ককেশিয়ার দিনরাত্রি’ নামে যে দ্বৈত ভ্রমণোপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
ইতিহাস থেকে আত্তিলা, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, হিটলার কাউকেই ‘উপড়ে ফেলা’ যায়নি। স্ট্যালিনকেও যাবে না। যদি কেউ তা চায়, ধারণা করি সে অযথা দেয়াল ঠেলছে।
এটাও ঠিক যে, পথে-ঘাটে লোকজনকে প্রশ্ন করে বা তথাকথিত ডেমোক্রেটিক নির্বাচনের ওপরে ভিত্তি করে যদি কোনো ব্যক্তির মহত্ত্ব, সততা বা সত্যের বিচার করা হয়, তাহলে ট্রাম্প, মোদি, হিটলার, মুসোলিনিকে মহৎ মানতে হবে। তারা সবাই যথেষ্ট পপুলার ব্যক্তিত্ব এবং গণনির্বাচিত। অন্যদিকে স্ট্যালিন কখনই গণনির্বাচিত ছিলেন না এবং ক্ষমতায় আসার সময়ে পপুলারও ছিলেন না। অনেক বেশি পপুলার ছিলেন ট্রটস্কি। এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকলে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ ও ‘রুশ বিপ্লব প্রবাহ’ বই দুটি খুলে গুনে দেখতে পারেন, কতবার লেনিন, ট্রটস্কি এবং স্ট্যালিনের নাম উল্লিখিত হয়েছে।
রাশিয়ায় জার-কমিউনিস্ট-ডেমোক্রেটিক, যে রঙেরই হোক না কেন, একনায়কত্ব সেদেশের ভোলগা, নেভা, ভলখভ নদীর মতোই সতত বহমান। লেনিন ভিন্নমত প্রকাশ করার সুযোগ দিয়ে কমরেডদের বিশাল ক্ষতি করে গিয়েছিলেন। রুশরা বলে, ‘নতুন ঝাড়–, নতুনভাবেই ঝাঁটায়।’ লেনিনের মৃত্যুর পরে যে পরিস্থিতি বদলে গেছে, ভিন্নমত প্রকাশ করা যে ফ্যাশন বহির্ভূত হয়ে গেছে, তারা তা বুঝে উঠতে পারেননি। এ কারণে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সারাদুনিয়া থেকে কমিনটার্নের ছত্রছায়ায় মস্কোতে জড়ো হওয়া ঘাড় ত্যাড়া বিপ্লবীরা তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করে জীবন বাঁচাতে পারেনি। ভারতবর্ষের তথা বাংলাদেশের গুলাম আম্বিয়া খান লোহানী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অবনী মুখার্জিরা এ কারণেই সেখানে নিহত হয়েছেন। তাই বর্বর বেদুইনরা অতিথির নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও, লেনিন-পরবর্তী মহান আন্তর্জাতিকতাবাদীরা এর ব্যত্যয় ঘটান।
এগুলোও ফ্যাক্ট, কোনো জড় বিশ্বাস নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৯১ সালে। আজ যারা প্রাক্তন সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোর ক্ষমতায়, তারা কেউ ১৯৯১ সালের পরে জন্মায়নি। তারা আগে ছিল ১০০ শতাংশ কমিউনিস্ট। ফ্যাক্টরি বা ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কমিউনিস্ট না হলে কোনো উঁচু পদ পাওয়া যেত না। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রে তো নয়ই।
আমি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত দেশে ছিলাম, এখনও ফিরে ফিরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখেছি যে, এই ক্ষমতাসীন কমরেডদের হাতে অর্থবিত্ত প্রচুর। ক্ষমতার দম্ভও বেশ। তাদের পকেটে ছিল জনগণের অর্থ। কীভাবে এ অর্থ তাদের কাছে এলো?
দেখা যাক।
কোনো ফ্যাক্টরি চালাত ৩টি শক্তি :
১. ডিরেক্টর (বাধ্যতামূলক পার্টির সদস্য)
২. পার্টির শাখা (পার্ট অর্গ)
৩. ট্রেড ইউনিয়ন (প্রোফ অর্গ-এর নেতাও পার্টির সদস্য)।
অনেকটা ‘বহু রসুনের একই নিতম্ব’ স্ট্রাকচার।
লোকজন কাজ করত; কিন্তু উৎপাদিত পণ্য যেত কোথায়? তৈরি পণ্যের এক অংশ যেত দোকানে। অন্য অংশ যেত কালোবাজারে। এবং ঐ তিন শক্তি মিলে এই অর্থ কুক্ষিগত করত। দোকানে কতটুকু যাবে, তা নির্ভর করত সেখানকার ক্ষমতার ‘চক্ষুর’ দৃষ্টিশক্তির ওপর। দৃষ্টি ক্ষীণ হলে বেশি যেত বিপথে। কেন্দ্রের কাছে হলে বেশি যেত দোকানে। তাই মস্কোর দোকানে পণ্য ছিল লেনিনগ্রাদের দোকানের চেয়ে বেশি, আর মস্কো থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, তিবিলিসির দোকানে মুক্তবায়ু ছিল বেশি।
আমি এই দেশপ্রেমিক এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী কমরেডদের কিছুর সাথে মিশেছি। মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্ট্যালিন ছিল এদের মুখস্ত। শ্রদ্ধেয় হাসান ফেরদৌস ও ওমর তারেক চৌধুরী এবং আমার মার্কসবাদের গুরু : অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী ও আবদুল হালিমদের চেয়ে জ্ঞান এদের কোনো অংশেই কম ছিল না।
কিন্তু তাদের একটি বড় অসুবিধা ছিল।
সব দেশেই ধনী তার টাকা দেখাতে পারে, প্রাসাদ বানাতে পারে, দামি গাড়ি কিনতে পারে। এমনকি কোরবানির জন্য সবচেয়ে তাগড়া ষাঁড়টিও কিনতে পারে। কিন্তু এই ধনী কমরেডরা ছিলেন অসহায়ভাবে গরিব। তারা টাকা দেখাতে পারতেন না, আছেÑ তাও বলতে পারতেন না। চুরি করা টাকাÑ হালাল টাকা এবং যে কোনো টাকা, এমনকি যা হালাল নয়, তাও লগ্নি চায়। এমন কিছু করা চাই, যাতে টাকায় টাকা বাড়ে। কিন্তু তাদের বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্টক মার্কেট নাই, ফ্যাক্টরি কেনা যায় না, খনি কেনা যায় না, এয়ার লাইন্স, বোয়িং, অস্ত্র কারখানা, খেলার স্টেডিয়াম বা কিচ্ছু কেনা যায় না, এমনকি প্রকাশ্যে বেশ্যার সার্ভিসও কেনা যায় না। একটি প্রাইভেট মুচির দোকান, পান-সুপারি বিক্রির টং বা প্রাইভেট টয়লেটের ব্যবসা পর্যন্ত খোলার উপায় ছিল না। তাহলে পরিশ্রমী এই মানুষগুলো কী করবেন? মানুষের জন্য ভালোবাসার তো একটা সীমা আছে। মার্কস-লেনিনকে মাথায় রাখা যায়, পকেটে তো রাখা যায় না।
টাকা লগ্নি করার সবচেয়ে নিরাপদ স্বর্গ কোথায়?
দুঃখজনকভাবে, পুঁজিবাদে।
হ্যাঁ, লেনিনের সেই পচনশীল, মুমূর্ষু ও দুর্গন্ধময় পুঁজিবাদে।
সুতরাং…
সোভিয়েত দেশকে কে ভেঙেছে?
পুঁজিবাদীরা?
নিয়েৎ কমরেডস, নিয়েৎ! আপনাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। ১৯১৮ সালের দুর্বল ও নিঃসঙ্গ বিপ্লবী রাশিয়াকে তারা ধ্বংস করতে পারেনি, ১৯৮০ দশকের বিশাল সমাজতান্ত্রিক দেশগোষ্ঠীর পরাশক্তিকে তাদের ভাঙতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। তারা শুধু সাহায্য করেছে। তারা বুকের বিকিনি উন্মুক্ত করে দুই হাত বাড়িয়ে লগ্নি-উন্মুখ কমরেডদের আলিঙ্গন করে বলেছে, ‘কমরেড, আমার প্রিয় কমরেড, ও সরংংবফ ুড়ঁ !’
বাংলাদেশের ‘পুকুর চুরি’ দেখে যাদের চোখ ট্যারা হয়, এবার তাদের বলি। পেরেস্ত্রোইকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময়ে আমরা ‘মহাসমুদ্র’ ও ‘মহাকাশ’ চুরি হতে দেখেছি। এত বড় চুরি পথের টোকাই বা ‘পিঠে পেট সাঁটা’ কোনো নিকোলাই-ইকোলাই-ইভান করেনি। করেছে নেতারা, যাদের ছিল মার্কসবাদে অচল বিশ্বাস ও হাতে অদ্ভুত ক্ষমতা।
ক্ষমতা কার হাতে ছিল? পার্টির ও তার পেটোয়া গুপ্ত-সংস্থার হাতে। এখন কার হাতে ক্ষমতা? অন্তত কমিউনিস্ট পার্টির হাতে নয়।
তারা কেন স্ট্যালিনকে এত ভালোবাসে?
তিনি তো ছিলেন পুঁজির বিরুদ্ধে প্রচ-তম পরশুরাম।
তারা কেন অর্থ ‘বিনিয়োগ’ করে সুন্দর সুন্দর পরিসংখ্যানের প্রজনন করে দেখাতে চাচ্ছে রাশিয়ায় তিনি কত জনপ্রিয়? এ-কথা জোরগলায় বলার জন্য সারাবিশ্ব এবং বাংলাদেশব্যাপী কি ‘পিঠে-পেট’ লাগানো তার লাল সাগরেদ কম আছে?
স্ট্যালিনকে নিয়ে একটি অতি দামি অ্যালবামের ছবি দিচ্ছি। ‘উনি যে কত মহান এবং কত বিশাল’ তা দেখানোই এ বইয়ের পবিত্র মিশন। বইটি প্রকাশের অর্থ দিয়েছে ‘ট্রান্সনেফত’ নামে একটি মাল্টি বিলিয়ন ডলার তেলের কোম্পানি। রাশিয়ার জনগণের তেলের খনিগুলো যখন ‘মহাসমুদ্র’ ও ‘মহাকাশ’ চুরির যুগে চুরি হয়েছিল, এ ছিল তারই একটি ‘কিউপিড’ সন্তান। যারা স্ট্যালিনের দেশ ভাঙল, কেন তারা তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে এত সুন্দর জ্ঞানগম্ভীর অ্যালবাম বের করে?
তারা কি স্ট্যালিনের সমাজতন্ত্র ফেরত চায় এবং রাষ্ট্র ‘ট্রান্সনেফত’ তাদের হাত থেকে কেড়ে নিক, তা চায়?
পুঁজিবাদ পুঁজি ও ক্ষমতার স্বার্থে নিজের মাকে বেশ্যা এবং বেশ্যাকে সাধ্বীতে পরিণত করতে পারে। এটুকু বোঝার জন্য বহু ভল্যুম মার্কস পড়ার প্রয়োজন নেই, ১৮৪৮ সালের চটি বই ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ পড়লেই চলে।
রাশিয়া এখন ‘ঈগল পুঁজিবাদী’ দেশ। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা মার্কসবাদ বেশ বোঝে এবং তাকে প্রতিহত করার কলাকৌশলও। সুতরাং যারা গুড়ে বালি মিশিয়ে স্ট্যালিনের প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন-শরবত পান করছেন, তাদের একটু বোঝা উচিত যে তিনি সমাজতন্ত্র নিয়ে আসছেন, না তাকে অতি পরিকল্পিতভাবে ‘তুমি কি কেবলই ছবি’ হিসেবে আনা হচ্ছে?
এ পরিসংখ্যানগুলো হলো সেই খেলার অংশ।
স্ট্যালিন যখন ‘একদেশে সমাজতন্ত্র’ তত্ত্বে পৌঁছান, তিনি ধীরে ধীরে ‘মহান রুশ জাতির’ জয়জয়কার শুরু করেন। আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিবর্তে রুশ জাতীয়তাবাদের ওপরে জোর দেন। রাশিয়ার ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়। রুশ-সাহিত্য, লোক-সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের বিশালত্বে হাইলাইট করে বহু সিনেমা তৈরি করা হয়, যা অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই জাতীয়তাবাদের জোয়ারে তিনি যাকে মহামানবে পরিণত করেন, তিনি হলেন ‘আইভান দি টেরিবল’। যিনি রাশিয়াকে মঙ্গোলদের জোয়ালমুক্ত করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন স্ট্যালিনপূর্ব রাশিয়ার সবচেয়ে নির্মম জার এবং সবচেয়ে রক্তাক্ত ও শক্ত হাত ছিল তার। স্ট্যালিনের প্রয়োজন ছিল আইভান দি টেরিবলের।
বর্তমানে রাশিয়ায় জাতীয়তাবাদকে স্ফীত করা হচ্ছে প্রচ-ভাবে, সেখানে এক ব্যক্তির শক্ত হাতের শাসন স্থাপিত হয়েছে পোক্তভাবে। এই শাসনের ‘কালারফুল’ ইমেজ তৈরি করার জন্য স্ট্যালিনের চেয়ে বড় ক্যান্ডিডেট আর কেউ নেই। জর্জিয়া নয়, আর্মেনিয়া বা আজারবাইজানের নয়, রাশিয়ার শাসকদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্ট্যালিনের। তাই তাকে নিয়ে এত হৈচৈ।
এবার একটি প্রশ্ন করি।
বলশেভিক পার্টির মতো এত সংগঠিত একটি পার্টি, যার প্রতিটি নেতা ছিল শুধু মার্কসবাদ নয়, অর্থনীতি, দর্শন, বিশ্ব-ইতিহাস, বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদিতে মেগা-প-িত এবং যারা এক-দুই-তিন-চার দশক জারের জেলে নির্যাতন সহ্য করেছেন রাশিয়ায় পুঁজিবাদ ধ্বংস করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, তারা সবাই কীভাবে সমাজতন্ত্রের শত্রু হয়? একজন হতে পারে, দুজন হতে পারে; কিন্তু সবাই? শুধু একজন স্ট্যালিন ছাড়া?
আমাদের কি মাথা খারাপ? সব লাল-পিঁপড়ার মগজ? কী অভিযোগে তিনি সবাইকে হত্যা করিয়েছেন? দেশের শত্রু, বিদেশের চর, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের পুনঃস্থাপনের ষড়যন্ত্রকারী।
তিনি হত্যা করাননি?
শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্ত বলেন- না, ইয়াগোদা-ইঝভ-বেরিয়া এবং আমলারা করেছে।
বেশ; কিন্তু কে ছিল তাদের নিয়োগকর্তা এবং ভাগ্যনিয়ন্তা? এবং কার সাধ্য আছে রুশ বিপ্লবের মুখ্য নেতা ট্রটস্কি বা লেনিনের ‘পার্টির প্রিয়তম’ বুখারিনকে হত্যা করার অথবা সোভিয়েত রেড আর্মির ‘গলিয়াথ’ তুখাচেওভস্কিকে, স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত আদেশ ছাড়া?
সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো নিরপেক্ষ ইতিহাস নেই। ইতিহাস লিখতে হয়, সেদেশের ৭০ বছরের ক্ষমতাসীন ‘পিগমির’ দল, নয় পশ্চিমের বিজ্ঞ ছুঁচোরা। একদিকে খুনির দঙ্গল, অন্যদিকে পুঁজিপুষ্ট ধাপ্পাবাজ সন্তের দল।
কাকে বিশ্বাস করবেন?
অবশ্যই খুনিদের। তাদের ভাষ্যের সাথেই আমরা ৫০-৬০ বছর ধরে অভ্যস্ত। পার্টির বিভিন্ন কংগ্রেস ও প্লেনামের মনগড়া খুঁটিনাটি, ১৯৩৬ সালের পৃথিবীর ‘সবচেয়ে মানবিক’ সংবিধানের ধাপ্পা, এন-কে-ভি-ডি ও পার্টিÑ অনুমোদিত ইতিহাস, যেখানে একমাত্র স্ট্যালিনই অভ্রান্ত এবং বাকি সবাই বিভ্রান্ত, এই তো সেই ভাষ্যের মূল সুর। আমাদের আদর্শিক বিশ্বাসের সাথে এটা খুব যায়।
এখানে কোথাও রিপ্রেশন, গুলাগ, বধ্যভূমি, হিটলারের সাথে গোপন চুক্তির মাধ্যমে পররাজ্য দখলের কোনো কথা নেই। এবং স্ট্যালিন তার প্রিয়তম কীরভকে হত্যা করাননি, করিয়েছে কামেনেভ-জিনোভিয়েভ-বুখারিনদের দুষ্ট চক্র।
সেই ভাষ্যে আছে রাশিয়ার শিল্পায়ন ও সমবায়করণের অলৌকিক সাফল্য ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মহাবিজয়ের এপিক গাঁথা।
উৎপল দত্তের (এবং অন্য মহানদের) প্রতিপাদ্য অনুসারে খুন ও হত্যাযজ্ঞের নিয়ন্তা আমলারা; কিন্তু সকল বিজয়ের ধর্মপুত্র স্ট্যালিনÑ কী চমৎকার দ্বন্দ্ববাদী প্রপঞ্চ!
অথচ তার মহান সাম্রাজ্য ৭০ বছরও টিকেনি। রাশিয়া দখলকারী হার্মাদ চেঙ্গিস খানের নাতি, বাতুখানের জুলুমের সাম্রাজ্যও টিকেছিল তিন গুণ বেশি। তারা জুলুম করে ‘মানবতার’ সেøাগান দেয়নি, শোষণমুক্তি, নারীমুক্তির ‘বালিতে মাথা লুকানো’ উটপাখির মতো গলাবাজি করেনি, যেমনটা করেছে অন্যরা।
পুঁজিপুষ্ট ধাপ্পাবাজের দলকে বিশ্বাস করতে চান? করুন। তারা এখনও সবগুলো সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষমতায়। তারাই স্ট্যালিনের বিরাটত্ব ও মহত্ত্বের সার্ভে করাচ্ছেন বহু অর্থ খরচ করে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস করে আপনাদের লাভ কোথায়? সমাজতন্ত্র ফিরে আসবে?
তারা যে স্ট্যালিনের ছবি দেখিয়ে আপনাদের নাচাবে এটুকু বুঝতে কি আসলেই বিশাল মগজ প্রয়োজন?
বরং বিশ্বাস করুন রাশিয়ার জনগণকে। যদিও তারা কিছুই লিখতে পারেনি এবং আপনাদের দাবিমতো কোনো লিখিত রেফারেন্সও দেখাতে পারবে না; কিন্তু অশ্রু ও রক্তের সমুদ্র সাঁতরে তারা মনে রেখেছে লাল-নিপীড়কের মুখগুলো। এবং প্রথম সুযোগে তাদের লাথি মেরে বিদায় করে দিয়ে এখন লিখছে অশ্রু ও কান্নার ইতিহাস।
সব সত্য? হয়তো নয়।
সব মিথ্যা? মোটেও নয়।
কিন্তু ফ্যানাটিকের দল কী বলে? ‘ফলসিফেকেশন। ফলসিফেকেশন।’
কারা এরা?
আমাদের দেশের যারা সেদেশে যায়নি, সেদেশে বাস করেনি, সেদেশের মানুষের কথা শোনেনি, তারা। আর যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মে একই দাবি করছে, তারা বেঁচে থাকল কী করে?
খুব সহজ। চুপ করে অন্যায় সহ্য করে, নয় অন্যায় করে।
সৎ, বিবেকবান, প্রতিবাদীরা তো নিহত হয়েছে, হয় গুলাগে, নয় ফায়ারিং স্কোয়াডে। যুদ্ধও অনেককে লাল শৃঙ্খলমুক্ত করেছে। বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ দশকের জবাইখানায় যারা বেঁচে ছিল, হয় তারা নিজেরা ছিল খুনি অথবা খুনিদের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় সহচর।
যারা সেদিন খুনিদের সাথে ছিল না, বোবা ছিল মৃত্তিকার মতো, তারা আজও বোবা। তারা গলাবাজি করে না। যারা ক্ষমতা বিচ্যুত হয়েছে, ‘টু-পাইস’ চুরি করার সুযোগ হারিয়েছে, তারাই মাঝে মাঝে রাস্তায় নামে বর্তমান ক্ষমতার থেকে কিছু উচ্ছিষ্ট আদায় করার জন্য।

ভ্লাদিমির পুতিনের মন্তব্য
“স্ট্যালিন ছিলেন তার সময়ের প্রোডাক্ট। যত ইচ্ছে তাকে ডেমন হিসেবে দেখানো যায়। আবার যত ইচ্ছে নাৎসিবাদের উপরে বিজয়ে তার অবদানের কথা বলা যায়। তাকে ডেমনাইজ (ফবসড়হরুব) করার প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ক্রমওয়েল নামে একজন নেতা ছিলেন। ভীষণ রক্ত-পিপাসু একজন মানুষ। বৈপ্লবিক ভাঙচুর ও পরিবর্তনের তরঙ্গে ক্ষমতায় এসে তিনি একজন ডিক্টেটর ও নিপীড়কে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ গ্রেট ব্রিটেনের সর্বত্র তার মনুমেন্ট রয়েছে। নেপোলিয়নকে তো প্রায় দেবতুল্য মনে করা হয়। তিনি কী করেছেন? বিপ্লবের ঢেউয়ে ক্ষমতায় এসে শুধু রাজতন্ত্রের পুনঃস্থাপনই করেননি; বরং নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে ফ্রান্সকে জাতীয় বিপর্যয় ও সার্বিক পরাজয়ের প্রান্তে নিয়ে এসেছিলেন। আমার মনে হয় স্ট্যালিনকে অতিরিক্ত নষ্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়াকে আক্রমণের একটি পদ্ধতি। স্ট্যালিনের শাসনামলে অবশ্যই অনেক পজিটিভ দিক ছিল, যদিও তা অর্জিত হয়েছিল অসম্ভব রকমের বেশি মূল্য দিয়ে।”
এ-কথার সাথে দ্বিমত করা যায় না, যদি আমরা একটি বিষয়কে হিসাবের মধ্যে না ধরি, অথবা ভান করি ওটা আর তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তা হলো, ক্রমওয়েল বা নেপোলিয়ন, কখনই শোষণহীন সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেননি। দিলে মার্কসের কষ্ট করে নতুন সমাজের রূপরেখা আঁকতে হতো না এবং অন্যদেরও লাল-ঝা-া হাতে রাজপথ গরম করতে হতো না। মার্কস প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের কথা বলেছেন বটে; কিন্তু কোথাও ‘মার্কসবাদী ক্রমওয়েল’ বা ‘মার্কসবাদী নেপোলিয়নের’ কথা বলেননি।
স্ট্যালিনের স্থান ইতিহাসে। ঠিক সেখানেই, যেখানে তিনি নিজেকে স্থাপন করে গেছেন। তিনি হয়তো ক্রমওয়েল বা নেপোলিয়নের মতোই আবার ফিরে আসবেন বড় বড় মূর্তি হয়ে। কিন্তু তাতে আমাদের দেশের শ্রমিক, কৃষক, নিপীড়িত মানুষ, বা অগ্নিদগ্ধ নুসরাত রাফিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কি?

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক, কবি এবং সাহিত্যিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য