Wednesday, October 4, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,দশম সংখ্যা,সেপ্টেম্বর-২০২০সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে

সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: 
'The medium is the message.'
		- Herbert Marshall McLuhan

বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিনে তার প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন, অভিবাদন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্থ, সফল ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন একজন অন্যতম বিশ্বনেতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ে পরিবারের সবাই নিহত হলে বিদেশে থাকায় তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তী দীর্ঘকাল তাকে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়। পঁচাত্তরের পর ১৯৮১ সালে স্বদেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তারই সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। মাঝে বিএনপি-জামাতের অপশাসনের পর ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।
প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার কর্মব্যস্ততা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। তার দৈনিক ২০ ঘণ্টা পরিশ্রম রবীন্দ্রনাথের ১২০ বছর পূর্বে রচিত পঙ্ক্তিÑ ‘যে প্রাণ-তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়/সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্ বিজয়ে’ সর্বার্থে সমার্থক উচ্চারণ। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ায় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে জনগণের সেবা করাকেই শেখ হাসিনা তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম চালিকাশক্তি, বলা যায় বর্তমান সময়ের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদকে যথার্থভাবে কাজে লাগানোর ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন ও মানবিক সমৃদ্ধি। তথ্যের অবাধ প্রবাহে বিশ্বাসী গণমাধ্যমবান্ধব ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা সর্বদাই তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কানাডার প্রখ্যাত যোগাযোগবিদ ও গণমাধ্যম চিন্তক মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘মাধ্যমই বার্তা’, চমকপ্রদ এই আপ্তবাক্যের প্রতিফলন দেখতে পাই শেখ হাসিনার যোগাযোগ প্রতিমাণ ও তার সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনায়। তিনি ১৬ কোটি মানুষকে প্রতিনিয়ত বচনে ও ভাষণে উন্নয়নের অগ্রবার্তা দিয়ে চলেছেন এবং প্রতিমুহূর্তে অনুসরণ ও অনুভব করছেন দেশবাসীর প্রতিবার্তা। প্রথমবার ১৯৯৬ সালে সরকারপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে শেখ হাসিনা মোবাইল টেলিফোনের মনোপলি ভেঙে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে মোবাইল প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে জাতীয় তথ্য বাতায়ন প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে যেভাবে সারা পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত করেছেন তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এক উজ্জ্বল মাইলফলক। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে কিংবা দ্বিপাক্ষিক কোনো সফর থেকে ফিরে তিনি যে নিয়মিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের অবস্থান বর্ণনা করেন, তাতে প্রমাণ হয় যে শেখ হাসিনা সর্বদাই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জনণগকে সব বিষয়ে অবহিত রাখতে চান। ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ তথ্য অধিকার আইন অনুমোদনের পর জনগণের তথ্য অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য অতি দ্রুততার সাথে তিন মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৯ সালের ১ জুলাই স্বাধীন তথ্য কমিশন গঠন করে ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ’Ñ এই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করেন।
শেখ হাসিনা একজন সক্রিয় তথ্যনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। যে কোনো ক্ষেত্রের বিশদ তথ্য সংগ্রহে তার যেমন সীমাহীন আগ্রহ তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি তার তথ্যভা-ারকে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে থাকাকালীন আমি বেশ কয়েকটি একনেক সভায় দেখেছি যে সভায় উপস্থাপিত প্রতিটি প্রস্তাব অনুমোদনের পূর্বে তিনি কত অনুপুঙ্খভাবে সবিস্তারে সেগুলো মূল্যায়ন করার পর সিদ্ধান্ত দেন।
আমার মনে পড়ে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫তম সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন তাইওয়ানের নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ অধ্যাপক ওয়াই টি লী। যেদিন অপরাহ্নে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন সেদিন সকালে জানালেন যে যখন তিনি যেদেশে যান সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধানের সাথে দেখা করে শিক্ষা নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা জানার একটি কৌতূহল তার মাঝে কাজ করে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার সুপ্ত বাসনা তিনি প্রকাশ করলেন। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা কম জেনেও আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করি। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমাকে জানানো হলো যে তখনই যেন অতিথিকে নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছাই, কারণ জলবায়ু-সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য সেদিন সন্ধ্যায়ই প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা ছাড়ার কথা।
অধ্যাপক লী মূলত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার চিন্তাভাবনার কথা উল্লেখ করছিলেন। শিক্ষা খাতের প্রতিটি বিষয়, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তর নিয়ে যেভাবে তিনি তথ্য পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তার চিন্তাভাবনার কথা বলছিলেন, তাতে অধ্যাপক লী অভিভূত ও বিস্মিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যখন আমরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছি তখন অধ্যাপক লী বললেন যে ‘তোমরা ভাগ্যবান যে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছ। আমি বহু দেশে রাষ্ট্রনায়কদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি; কিন্তু নতুন প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর এত স্বচ্ছ, যৌক্তিক ও সংবেদনশীল চিন্তাভাবনা ও এত বিশদভাবে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত থাকায় পারঙ্গমতা আমি কোথাও দেখিনি। তোমাদের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাকে যে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, তাতে আমি মনে করিÑ বাংলাদেশ অতি দ্রুত উন্নয়নের সোপান অতিক্রম করবে।’
বাংলাদেশ যে আজ সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে তার পেছনে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে শেখ হাসিনার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির সুষম সমন্বয় সক্ষমতা ও সংবেদনশীল মনমানসিকতা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণাকালে শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, তার ফলে এই করোনাভাইরাস মহাসংকটকালে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শারীরিক দূরত্বের মাঝেও আমরা মানসিক নৈকট্য বজায় রেখে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বিশাল বিস্তারের কারণে এই বিষণœ সময়ে বিপন্ন পৃথিবীতে আমরা জনগণের তথ্য অধিকার সমুন্নত রাখতে পারছি। শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৪ জুন আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির জ্ঞানসম্পন্ন তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই এদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর সাথে কন্যা শেখ হাসিনার চিন্তাভাবনা ও পর্যবেক্ষণের অপূর্ব মিল আমরা লক্ষ করি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের আওতায় এনে বঙ্গবন্ধু যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রজাতন্ত্রের সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক, একমুখী ও বাধ্যতামূলক করার যে সাংবিধানিক প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা প্রশাসন দেশে শিক্ষানীতি কাঠামোভুক্ত করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করে চলেছেন।
বিদ্যাচর্চা ও শিশু শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে কত আগ্রহী ছিলেন, তা আমরা উপলব্ধি করি তার রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থটি পাঠ করে। আজ থেকে ৬৮ বছর পূর্বে ১৯৫২ সালে নয়া চীন সফরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখছেন : “একটি বিষয় দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক এক দেশে এক এক প্রকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছেÑ যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘পিভিলেজড ক্লাস’ অন্য দেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাইÑ ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নয়া চীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে। একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়া চীন। ১৫/২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?” (পৃ. ৬০)। বঙ্গবন্ধুর অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ যে কত সঠিক ও যথার্থ ছিল তা আজকের চীনের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমসমূহ ২০০১-০৮ সালে উপেক্ষিত হতে থাকে। শেখ হাসিনা সরকারের যুগান্তকারী সিদ্বান্তে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশ্ব তথ্য বাতায়নে সম্পৃক্ত হতে সাবমেরিন ক্যাবলের বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্বান্ত গৃহীত না হওয়ায় গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগে পিছিয়ে পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তি টাস্কফোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে সর্বাত্মক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ফলে গত এক দশকে দেশে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়। গত এক যুগ বাংলাদেশের ইতিহাস দিনবদলের ইতিহাস। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার অভাব থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারকে দিনবদলের সনদ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ বিদ্যুৎ ও জ্বালানিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, অর্থাৎ ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলের গড় মাথাপিছু আয় ৩৬০ ডলার এখন ২০৩০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গণমাধ্যম ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ, আর্থিক সংগতি ও প্রযুক্তির অভিগম্যতা একান্ত জরুরি।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন দেশে ৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু ছিল। এক্ষেত্রে তার সরকারের উদারনীতি গ্রহণের ফলে বর্তমানে দেশে ৪৪টি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন পেয়েছে এবং অপারেশনে থাকা ২৮টি টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে ২৪ ঘণ্টাই সংবাদ ও অনুষ্ঠানাদি সম্প্রচারিত হচ্ছে। ফলে অবাধ তথ্য ও বিনোদনপ্রবাহ গণমানুষের মন ও মানস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিটিভি’র জন্য ‘সংসদ টেলিভিশন’ নামে পৃথক চ্যানেল চালু হয়েছে। ফলে মহান জাতীয় সংসদের কার্যক্রম এখন সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই দেখতে পারেন। বর্তমানে করোনা সংকটকালে স্কুলশিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখতেও সংসদ টিভি ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও’র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী ও জলবায়ু ভঙ্গুর এলাকায় মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহে কমিউনিটি রেডিও অনন্য ভূমিকা রাখছে। দেশে কোনো সম্প্রচার নীতিমালা ছিল না। একটি সম্প্রচার কমিশন গঠনের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা প্রশাসন কর্তৃক সম্প্রচার আইন ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। প্রস্তাবিত এই কমিশন গঠিত হলে দেশের সম্প্রচার মাধ্যম জাতীয় স্বার্থে, উন্নয়ন অগ্রগতির লক্ষ্যে সমন্বিত ভূমিকা পালন করতে পারবে। অন্যদিকে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার শাসনামলের গত এক যুগে অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ সাধিত হয়েছে। ২০০৬ সালে যেখানে দেশে সংবাদপত্র ছিল ৪০০টি এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল ১৫০টি, তা গত এক যুগে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দেশে পত্রিকার সংখ্যা ১,২৫২টি ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সংখ্যা ১,১৯৬টি। অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়িত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা এখন ১৮৮টি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম মালিক ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। দেশের মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক সকল পত্র-পত্রিকার (ঢাকা ও মফস্বল থেকে প্রকাশিত) সর্বমোট সংখ্যা এখন ৭০৭টি। [সূত্র : চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর]
সাংবাদিকতা এখন আর শহরকেন্দ্রিক নয়। মফস্বল শহরগুলোতে এখন নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এবং প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলও তাদের কাভারেজের আওতায় এসেছে। পাশাপাশি সাংবাদিকতার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশব্যাপী আঞ্চলিক প্রেসক্লাবসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত এক যুগে শেখ হাসিনার সরকার গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কল্যাণে অনেক কাজ করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে এই ট্রাস্ট থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা সাংবাদিকদের প্রদান করা হয়েছে। সরকার প্রদত্ত ২০ কোটি টাকার তহবিল নিয়ে গঠিত এই ট্রাস্টের বর্তমান সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি টাকা। সাংবাদিকদের স্বচ্ছল জীবনযাপন নিশ্চিতকল্পে নবম ওয়েজ বোর্ডের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে এবং ‘গণমাধ্যমকর্মী আইনের’ খসড়া ২০১৮ সালে প্রণীত হয়েছে। এ-বছর মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে অন্যান্য সবার মতো সংবাদকর্মীরাও ব্যাপক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার গণমাধ্যম মালিকদের কর্মী ছাঁটাই বন্ধ ও নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য আহ্বান জানায় এবং পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ায়। অস্বচ্ছল সংবাদকর্মীদের জন্য এককালীন ভাতার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৩৫০ জন সাংবাদিককে মহামারির এ-সময়ে এককালীন অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। সরকার অনলাইন নিউজ পোর্টাল নীতিমালা প্রণয়ন করে এ খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব কার্যক্রমের ফলে দেশের গণমাধ্যম ক্ষেত্রে নানামুখী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, যেমন : (ক) আধেয়ের দিক থেকে গণমাধ্যমের উন্নয়ন ঘটেছে (খ) প্রয়োজনীয় নীতি-কাঠামো তৈরি হয়েছে এবং (গ) কর্মীকল্যাণের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিক্ষেত্রের উন্নয়ন এক স্বর্ণালি অধ্যায় হিসেবে লিখিত থাকবে। গত এক যুগের শাসনামলে তিনি শিক্ষা ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করেছেন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এখন ১৬.১ কোটি মোবাইল সিম নিবন্ধিত আছে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। ইন্টারনেটসেবা এখন গ্রামীণ সমাজে পৌঁছে গেছে। সারাদেশে প্রায় ২০০ ধরনের ডিজিটালসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ৫ হাজার ৭০০টি ডিজিটাল সেন্টার ও ৮ হাজার ২০০টি ই-পোস্ট অফিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অপটিক্যাল ফাইবার এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে পর্যায়ক্রমে থ্রি-জি ও ফোর-জি প্রযুক্তির অবকাঠামো ও ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফাইভ-জি সেবা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে।
প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ দমনে সরকার প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করেছে। এক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণিধানযোগ্য। ডিজিটাল অপরাধ দমনে সরকার ডিজিটাল পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তদারকি জোরদার করেছে। ফলে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
প্রযুক্তিকেন্দ্রিক তথ্যউপাত্ত উন্মুক্তকরণের জন্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার ওয়েব পোর্টালের সমন্বয়ে সরকার তথ্য বাতায়ন ব্যবস্থা চালু করেছে। এতে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য মানুষ ঘরে বসেই পাচ্ছে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে নিয়ে এসেছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, বিনোদন ও আবহাওয়া পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। প্রযুক্তি খাতকে উন্মুক্ত করে তিনি প্রযুক্তির গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করেছেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে শেখ হাসিনার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য ২০১৪ সালে ‘সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে ২০১৫ সালে অর্জন করে ‘আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন পুরস্কার’।
বর্তমান করোনা সংকটে দেশের মানুষ গত এক দশকে শেখ হাসিনার গৃহীত গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন কার্যক্রমের সুফল ভোগ করছে। জীবনের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই মানুষ ঘরে বসে ইন্টারনেটে সম্পাদন করছে। দৈনিক চাল-ডালের বাজার থেকে স্টকের কেনাকাটা, অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের যোগাযোগ কার্যক্রম পরিচালনা, টেলিমেডিসিন, বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও অন্তরঙ্গ আড্ডা, একাডেমিক ওয়েবিনার ও লাইভ টকশো স্ট্রিমিং সবই সম্ভব হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। আমরা হয়তো এখনো সুস্থ ও স্বাভাবিক আছি বা থাকতে পারছি দেশে বিদ্যমান তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর কর্মজালের কারণে। এই বাংলাদেশ অন্য এক বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে গৃহীত আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশ যথার্থ অর্থেই বিশ্বে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ। গণমাধ্যমের অভিগম্যতা বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ ও সম্প্রসারণ অপরিহার্য। সে-লক্ষ্যেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় যত অগ্রসর হচ্ছে, আমাদের গণমাধ্যমের ব্যাপ্তি ও পরিধির ততই প্রসার ঘটছে। বর্তমান যুগের ‘বিশ্বপল্লি’ বাস্তবতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ প্রযুক্তি একীভূত হয়ে গেছে। মোবাইল ফোনে সংবাদপত্র পড়া, রেডিও শোনা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র দেখা, বার্তা বিনিময় করা, অর্থ লেনদেন করা আজ অতি সাধারণ বিষয়। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের হাতে মোবাইল ফোন থাকার অর্থই হচ্ছে তিনি শুধু নিজ দেশে নয়, সারা পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত আছেন। শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা যে তিনি একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণের প্রাক্কালেই যোগাযোগের এই অতি শক্তিশালী যন্ত্রটি আমজনতার হাতে তুলে দিয়ে গণমানুষকে তথ্যায়িত রাখার সন্ধান দিয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণেই আমরা বলিÑ “নিত্য যেথা/তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা।” জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাসস ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতি-বিস্মৃতির অশ্রুত কথা
পরবর্তী নিবন্ধকবিতা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য