Monday, December 4, 2023

সূর্যমুখীতে হাসছে কৃষক, হাসবে দেশ

এই ফসলের জন্য আমাদের দেশের আবহাওয়া খুব উপযোগী। তাছাড়া জাতভেদে এই ফসল সমভূমি, পতিত জমি, পাহাড়ি এলাকা, লবণাক্ত এলাকা, চর এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওড় এলাকা, ছাদে, টবে, গ্রিন হাউসে, দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়েও চাষ করা যায়।

রাজিয়া সুলতানা: আমাদের পাশের বাসায় থাকেন ব্যাংকার আপা শাহনাজ বেগম। দারুণ গড়ন। খুবই চটপটে; নন্দনশ্রী চেহারা, স্বাস্থ্য সচেতন। একদিন কথাচ্ছলে বললেন- এখন আর সয়াবিন, সরিষায় তার মুখ রুচে না। প্রাত্যহিকায় অকৃত্রিম বন্ধু সূর্যমুখী তেল। এই তেল ছাড়া তার আর চলে না। ‘এ কি ভূতের মুখে রাম নাম।’ অথচ বছরখানেক আগেও সরিষার তেল নিয়ে কত্তোলাপ; গুণকীর্তন- কান ঝালাপালা। বড়াই করে বলতেন- ‘জানেন; আমি একেবারে খাঁটি সরিষার তেল আনিয়ে খাই। আমার অফিসের পিয়ন প্রতিমাসে ধামরাই থেকে ঘানিতে ভাঙিয়ে নিয়ে আসে।’ শুধু শাহনাজ বেগমই নয়- বাংলাদেশের অনেকে এখন ভোজ্যতেল হিসেবে প্রায় কোলেস্টেরল ফ্রি সূর্যমুখীকে আপন করে নিয়েছে। এবার কৃষির গল্পকথা সেই সূর্যমুখীকে নিয়ে।
আপাত দৃষ্টিতে সূর্যমুখী একটি শোভাবর্ধনকারী ফুল-জাতীয় ফসল, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দূর থেকে সূর্যমুখী ক্ষেতকে মনে হয় হলুদ-সবুজ গালিচা। আর কাছ থেকে হালকা গড়নের লিকলিকে এক মেয়ে; সবুজ শাড়িতে হলুদ আঁচলে ঘোমটা মাথায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে হা-হা-হি-হি করে হাসছে। মৃদুমন্দ সমীরকরণে দুলছে তার সারাদেহ। টালমাটাল অবস্থা। একবার এদিক তো, পড়ছে উল্টো দিকেও। আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য; খুবই চিত্তাকর্ষক, মনোমুগ্ধকর- কাছ থেকে না দেখলে বুঝা যাবে না।
দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে সূর্যমুখীর আরও একটি বিশেষ পরিচয় এই ফুলের অন্তরালে লুকিয়ে আছে। এটি একটি ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী ফসল, যা শরীরের জন্য বেজায় উপকারী- নাম বনস্পতি, সূর্যমুখী বা সান ফ্লাওয়ার অয়েল, যা পূর্বে ঘি-এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ, যাদের সাধ্যে কুলায় সূর্যমুখীকে ভোজ্যতেলের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছে। এই তেলে শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ খুবই কম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষ ঘানি ভাঙানো সরিষার তেলই বেশি ব্যবহার করত, যা আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকারক ছিল না। এরপর সয়াবিন তেলের দৌরাত্ম্য। তবে যে তেলই ব্যবহার করি না কেন, তার ৯০ শতাংশই আমাদের আমদানি করতে হয়। মাত্র ১০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তাই সরকার উদ্যোগ নিয়েছে- যেভাবেই হোক তেল ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষিবিজ্ঞ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তেল ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন অহরহ। তেল-জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপিও সংশ্লিষ্টদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। তাতে বেশ নাড়া পড়েছে কৃষি মন্ত্রণালয় ও অধীনে বিভিন্ন সংস্থা অধিপ্রতিষ্ঠানে। সে-কারণে সমন্বিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং, বিএডিসি, বিনাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। নিয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প। নাম ‘তেল-জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’। অনুমোদিত টাকা ২৭৮ কোটি। ২০২০-২৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের বাস্তবায়নের ফলাফল আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষিত স্বল্পমেয়াদি আধুনিক জাতের তেল ফসল এ প্রকল্পের আওতায়। যেমন- সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, চিনাবাদাম ইত্যাদি। আবাদ এলাকা বৃদ্ধির পরিকল্পনা ২০ শতাংশ। সংযুক্ত আছে বিএআরআই ও বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত তেল ফসলের আধুনিক প্রযুক্তি। এর সঙ্গেই সহপণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকছে মৌ-চাষ। এ প্রকল্পের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চাষাবাদে তেল ফসলের উৎপাদন বাড়বে হেক্টরপ্রতি ১৫-২০ শতাংশ। মৌ-চাষ পরাগায়ণে সহায়তা করায় বীজের পরিমাণ বাড়বে। উৎপাদিত হবে মধু। সৃষ্টি হবে আলাদা কর্মসংস্থানের। সরকারের হিসাব অনুযায়ী দেশের ২৫০টি উপজেলায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান। প্রকল্পের আওতায় প্রণোদনা হিসেবে রয়েছে বীজ ও সার। সরকারিভাবে বীজ বিক্রয়ের ব্যবস্থা। সর্বোপরি সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির অভাব পরিলক্ষিত হয়, তেল ভাঙানোর মেশিন-উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেই মেশিন ক্রয় করার এবং কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার।
ক্রমাগত আমাদের আবাদি জমি কমছে। এটা নতুন কোনো কথা নয়। ফলে অন্যান্য ফসলের মতো তেল ফসল উৎপাদনেও দেখা দিচ্ছে জমির স্বল্পতা। এটা ঠিক, এখনও বাংলাদেশের ধানি জমির পরিমাণ বেশি। সরকারি তথ্যানুসারে আবাদি জমির ৭৫ শতাংশে দানা-জাতীয় ফসলের চাষ হয়। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল ও স্বল্পকালীন উন্নত জাতের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলোর চাষ করতে পারলে ফলন বেশি হবে। তখন ধানের জমির পরিমাণ কমিয়ে বা দুটি ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে তেল ফসলের চাষ করা যাবে। আর নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কৃষকের কাছে গিয়ে পাশে থেকে তেল ফসল উপাদন বাড়ানোর জন্য নিবিড়ভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। তবে এর ব্যত্যয় ঘটেনি পূর্বেও। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে তেল ফসলকেন্দ্রিক কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশে তেল-জাতীয় ফসলের উৎপাদন এখন প্রায় দ্বিগুণ। ২০০৯ সালে তেল-জাতীয় ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টনে। তেল-জাতীয় ফসল খুবই লাভজনক ফসল। সংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপে দেখা গেছে, এক একর জমিতে প্রায় ৮০০ কেজি বীজ উৎপন্ন হয়। খরচ ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। উৎপন্ন তেল বিক্রি হয় কম-বেশি ৮০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ দ্বিগুণ লাভ। সূর্যমুখী লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সেদিকে ঝুঁকছেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে অনেকে সূর্যমূখী বীজ চিনেই না। কৃষক যখন ধান নিয়ে বাজারে যায়, পাইকাররা গিজগিজ করতে থাকে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার। দরদাম করা যাচ্ছে। সূর্যমূখীর ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীত চিত্র। কৃষক সারাদিন বীজ নিয়ে বাজারে বসে আছে। কেউ একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করে না ‘ভাই দাম কত?’ অগত্যা বাড়ি ফিরে আসা। খোঁজখবর নিয়ে তেল ভাঙানোর মেশিনের খবর না পেয়ে হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবে অবশেষে বিক্রি করা হয়। অথচ শরীরের জন্য কতই না উপকারী এই তেল। এতে রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড, যা দেহের বৃদ্ধি, হৃদপিণ্ডের সচলতা এবং ত্বকের মসৃণতা রক্ষা করে। তাছাড়া সবজির ভিটামিনকে শরীরের জন্য শোষণোপযোগী করতে হলে সবজিকে তেল দিয়ে রান্না করতেই হবে। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ শরীরের জন্য নিরাপদ সূর্যমুখী তেলকে বেছে নিয়েছে। এই তেলে রয়েছে সেলেনিয়াম (কেমিক্যাল), যা ক্যানসার প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এর ম্যাগনেসিয়াম, কপার ও ভিটামিন-ই আমাদের দেহের হাড় সুস্থ ও মজবুত রাখে এবং বাতের ব্যথা দূর করতে সহায়তা করে। এর ম্যাগনেসিয়াম উপাদান আমাদের মানসিক চাপ দূর করে, মাইগ্রেন সমস্যার সমাধান করে এবং আমাদের মস্তিষ্ককে স্থিত রাখে। সূর্যমুখী বীজের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অভাবিত পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
এই ফসলের জন্য আমাদের দেশের আবহাওয়া খুব উপযোগী। তাছাড়া জাতভেদে এই ফসল সমভূমি, পতিত জমি, পাহাড়ি এলাকা, লবণাক্ত এলাকা, চর এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওড় এলাকা, ছাদে, টবে, গ্রিন হাউসে, দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়েও চাষ করা যায়। রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় সফলভাবে সূর্যমূখীর চাষ হচ্ছে। সূর্যমুখী সারাবছরই চাষ করা যায়। তবে শীত মৌসুমে ভালো ফলন হয়। বীজ সারিতে বুনতে হয়। হেক্টরপ্রতি বীজ লাগে ৮-১০ কেজি। প্রয়োজনীয় পরিমাণে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বোরাক্স/বরিক এসিড এবং ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। ‘ভালো বীজে ভালো ফসল, উৎপাদনে বীজই আসল’- এই স্লোগানকে মাথায় রেখে বীজ বপনের পূর্বে, বীজ শোধন করতে হয় ছত্রাকনাশক দিয়ে। প্রয়োজনমতো জমিতে সেচ, আগাছা দমন ও অন্যান্য পরিচর্যা করতে হয়। তবে যখন ফুল ফোটে তখন সবচেয়ে বড় শত্রু সেলফিবাজ মানুষ ও বীজখেকো পাখি। যদি একসাথে অনেক জমিতে এই ফুল চাষ করা যায়; তাহলে এদের হাত হতে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাবে। কারণ অনেক ফসলের ভিতরে গিয়ে মানুষ ফসলের ক্ষতি করতে পারবে না। আর পাখি সাধারণত জমির বাইরের দিকে বসে। তবে বিশাল ক্ষতির আশঙ্কা থাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। সূর্যমুখী গাছ লম্বা। একটু বাতাসেই হেলে পড়ে। তাই ঝড়ঝঞ্ঝার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে খাটো জাতের গাছ নির্বাচন করতে হবে। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫০০-১৮০০ কেজি। বীজ রোদে শুকিয়ে মোটা পলিথিন ব্যাগ অথবা কেরোসিন টিন বা টিনের ড্রামে সংরক্ষণ করতে হয়। বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য এবং গাছ ও পুষ্পস্তবক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ঘানিতে ২৫ শতাংশ ও এক্সপেলারে ৩০-৩৫ শতাংশ তেল নিষ্কাশন সম্ভব।
বাণিজ্যিকভাবে এই তেল সম্প্রসারণ করতে হলে, তেলকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। স্থাপন করতে হবে সরকারিভাবে রিফাইন্ড মেশিন। উদ্যোগ নিতে হবে সরাসরি কৃষক থেকে বীজ কিনার। ফড়িয়াদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে কৃষকদের। বীজ উৎপাদনের সম্পূর্ণ বিষয়টি সরকারিভাবে তদারকি করতে হবে। সূর্যমুখী একটি লাভজনক ফসল। কৃষক যখন বীজ বিক্রয়ের নিশ্চয়তা পাবে তখন তারা এই স্বল্প পরিশ্রমে অধিক লাভের ফসলটি চাষে আগ্রহী হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পুষ্টি নিরাপত্তায় তেল গ্রহণের সঠিক পরিমাণ বজায় রাখতে হলে; ২৪ লাখ হেক্টর জমিতে তেল-জাতীয় ফসল উৎপাদন করতে হবে, বর্তমানে হচ্ছে প্রায় ৮ লাখ হেক্টরে। দেশের মিল-কারখানায় তেল ভাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা যদি করা যায়, তাহলে আমরা দানাদার-জাতীয় ফসলের মতো, তেল ফসলেও স্বনির্ভর হতে পারব।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য