Sunday, September 24, 2023

সামান্য স্মৃতি

হা রু ন হা বী ব:

এক
আমাদের প্রজন্মের চোখের সামনে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী জাতীয় জীবনের যে ঘটনাবলি ঘটেছে, তা বিস্মৃত হওয়ার অধ্যায় নয়। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য বন্দি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে সবে ঢাকায় ফিরেছি, সহযোদ্ধাদের প্রায় সবার হাতে একটি করে অস্ত্র, বেশির ভাগই রাইফেল, কারও কারও হাতে স্টেনগান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো পরিত্যক্ত। চারদিকে মুক্তির উল্লাস, স্বাধীনতার জয়গান। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এলো বুধবার, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। এত আনন্দ-উল্লাসের মাঝেও তাই বিশাল এক শূন্যতা; দেশ স্বাধীনতা পেল কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি, রাষ্ট্রের জনক নেই!
এমএ শেষ পর্বে পড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে টাকারও জোগান কম। অতএব বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (বিপিআই) নামের ছোট্ট একটি সংবাদ সংস্থায় যোগ দিলাম রিপোর্টার হিসেবে। ব্যক্তি মালিকানার এই পাকিস্তানি সংবাদ সংস্থার ঢাকা ব্যুরো অফিসটি নাম বদলে নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। যেদিন কাজে যোগ দিলাম, সেদিন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। ঘটনাক্রমে সেদিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাকতালীয়ভাবে আমার পেশাগত জীবনের প্রথম ‘রিপোর্টিং অ্যাসাইনমেন্ট’ও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহের কাজ দিয়ে।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু পিআইএ-র বিশেষ ফ্লাইট-৬৩৫এ Ñ চেপে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছলেন। উঠলেন লন্ডনের ক্লেরিজেস হোটেলে। এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিলেন রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে চেপে ঢাকার পথে যাত্রা করলেন বিজয়ী মহানায়ক। ১০ জানুয়ারি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রা বিরতি করলেন। রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-সহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্য ও শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের জাতির পিতাকে অবিস্মরণীয় অভ্যর্থনা জানালেন। ২১ বার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হলো, ওড়ানো হলো বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হলো দুই দেশের জাতীয় সংগীত। ঘণ্টা কয়েক বাদে ঢাকায় পৌঁছলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
কারাগারে বন্দি থেকেও যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে স্বাধীন দেশে স্বাগত জানালো লাখো মানুষ। দেখলাম, সব রকমের নিরাপত্তা বেষ্টনি উপেক্ষা করে হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছে বিমানবন্দরে। রয়্যাল এয়ারফোর্সের কমেট বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর ঘিরে রাখল উদ্বেলিত জনতা, যা দেখার সৌভাগ্য হলো আমার মতো অনেক সংবাদকর্মীর।
স্বদেশের মাটিতে পা রাখার আগে বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে বিমানের জানালা দিয়ে তার প্রাণপ্রিয় ‘সোনার বাংলা’ দেখলেন, যাকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গোটা মুজিবনগর মন্ত্রিসভা, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব, শীর্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বদেশের মাটিতে আবেগময় অভ্যর্থনা জানালেন। নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী তাকে অভিবাদন জানাল। সম্মান জানালেন ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ কয়েকটি দেশের শীর্ষ কূটনীতিক। এরপর ধীর গতিতে এগিয়ে চলল বঙ্গবন্ধুর মোটর শোভাযাত্রা। সড়কের দুই পাশে হাজারো উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত মানুষ, সবাই এক নজর দেখতে চায় বঙ্গবন্ধুকে অসীম আবেগ ও ভালোবাসায়। জাতির পিতা পৌঁছলেন রমনা রেসকোর্সে।
এই সেই ইতিহাসের রমনা রেসকোর্স, যেখানে অসামান্য এক ভাষণ রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, যা গোটা জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।” আরও বললেন, “ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।”
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সময়টা নবীন বাংলাদেশের এমন এক সময়, যা আমাদের মতো নবীন সংবাদকর্মীদের আবেগে উচ্ছ্বসিত করেছে, আবার ভয়ঙ্কর সব ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। পেশাগত জীবনের আনুষ্ঠানিক শুরু যেহেতু বিপিআই নামের ক্ষুদ্রায়তনের বার্তা সংস্থায়, সেহেতু নবীন রিপোর্টার হয়েও বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের খবর লেখার সুযোগ হয়েছে আমারÑ হয়তো অতি সামান্যই।
স্বভাবতই জ্যেষ্ঠ রিপোর্টারগণই বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠান ‘কভার’ করার সুযোগ পেতেন। জুনিয়ররা কদাচিৎ। বড় সভা-সমাবেশ হলে যখন একাধিক রিপোর্টার যুক্ত করার প্রয়োজন হতো, তখন অবশ্য সুযোগ মিলত। এরপরও বলতে হয়, আমার ভাগে সুযোগ কিছুটা বেশিই হয়েছিল। সেই সুবাদে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বা গণভবনের কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছি। তবে ১৯৭৫ সালে বাসস-এর সঙ্গে বিপিআই-র আত্মীকরণের পর সে-সুযোগ তেমন থাকেনি।
বিপিআই সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদক হিসেবে দেশের কয়েকটি বড় ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন। অধিবেশন বসে তেজগাঁওয়ের পুরনো পাকিস্তান অ্যাসেমব্লি ভবনে। আগে যেখানে ৩০০ সদস্যের বসার ব্যবস্থা ছিল, সেখানে গণপরিষদের ৪৫০ সদস্যকে বসতে হলো। মনে পড়ে, এই সংকটের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “যদি এই অ্যাসেমব্লি ভবনও না থাকত, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেনÑ এই সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি।”
উদ্বোধনী দিনে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপনকালে বঙ্গবন্ধু একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বলেন, “মাননীয় স্পিকার, আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্র্বভৌম গণপরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারছি, সে-সুযোগ এদেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেকদিন থেকে শুরু হয়। জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, তিরিশ লক্ষ ভাইবোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নিশ্চয়ই তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখবো।”
১৯৭২ সালের ১ মে দিবস। সেই উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ভাষণ রাখলেন। আমরা কয়েকজন মিলে বিভিন্ন আঙ্গিকে খবর লিখে চলেছি সংবাদ সংস্থা থেকে। বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা, স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলার মেহনতি মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করেছে, এ জন্যে দেশ ও জাতি আজ গর্বিত।” শ্রমজীবী মানুষের জন্যে, সাম্যবাদী সমাজের জন্যে বঙ্গবন্ধুর আবেগ ও দায়বদ্ধতা সে-সময়কার প্রতিটি ভাষণ ও বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল।
এরই মধ্যে আসে দেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ।
অনেকদিন ধরে অ্যাসেমব্লি অধিবেশনে খসড়া সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলে। বঙ্গবন্ধু অধিবেশনে উপস্থিত থাকেন। সকলের বক্তব্য শোনেন মনোযোগ দিয়ে। নোট নেন। রিপোর্টার হিসেবে আমরাও অধিবেশনে যাই। ১২ অক্টোবর ১৯৭২, খসড়া সংবিধানের রূপরেখা বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বক্তব্য রাখলেন। শুরুতেই বললেন, “জনাব স্পিকার সাহেব : সংবিধান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজ আমার সামনে দুটি জিনিস ভেসে উঠে। একদিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন, অপরদিকে আমার মনে আনন্দ। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন এই জন্য বলি যে, আপনারা জানেন, জনাব স্পিকার সাহেবও জানেন, কারণ আপনি আমার সঙ্গে বিশ বছর রাজনীতি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস আপনার জানা আছে। বিশ বছর পর্যন্ত দেশের জনসাধারণ সংবিধানের জন্য সংগ্রাম করেছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। অনেক রক্তের খেলা হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ মাতৃহারা-পুত্রহারার আর্তনাদ। লাখ লাখ বোন আজ বিধবা। কত রক্ত বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে, সে-কথা চিন্তা করলে বক্তৃতা করতে আমি পারি না।”
এরপর তিনি তুলে ধরেন সেই ইতিহাস, ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে যে ইতিহাস ১৯৭০ এবং ১৯৭১ পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়েছে। বলেন, “২৫শে মার্চ প্রথম আমি বলেছিলাম, যে জাতি মরতে শিখেছে, তাকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। তাই আজ রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। গুদামে খাবার ছিল না। ২৭৮টি রেলব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। সমস্ত রাস্তার ব্রিজ, প্রায় ২৭০টার মতো, ধ্বংস করে দিয়েছিল। চাউলের প্রায় সব গুদামই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্যাংকে পয়সা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কল-কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। গ্রামের স্কুলগুলোর ফার্নিচার জ্বালিয়ে রুটি বানিয়ে খেয়েছিল।… তারা গর্ব করে বলে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের লোক, জয় বাংলা স্বাধীন হবে, কিন্তু এমন ধ্বংস করে দিয়ে যাব, এই দেশের মানুষ আর যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, এবং দুর্ভিক্ষে যেন লাখ লাখ লোক মারা যায়।”
আমাদের প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের সৌভাগ্য যে, আমরা অনেকেই সেদিন প্রেস গ্যালারিতে বসে সংবিধান প্রণয়নের বিতর্ক শুনেছিলাম এবং তার অংশবিশেষ লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। একইসঙ্গে এটিও আমাদের প্রজন্মের দুর্ভাগ্য যে, সেই সংবিধানকে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান যেভাবে ছিনভিন্নœ করেছিলেন, সেটিও দেখতে হয়েছিল আমাদের!
গণপরিষদের পূর্ণ অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন লাভ করে ৪ নভেম্বর ১৯৭২, দেশ স্বাধীনের মাত্র ১০ মাসের মাথায়, যা এক অসামান্য কৃতিত্ব জাতির পিতার। রাষ্ট্র নায়কোচিত গাম্ভীর্যতায় তার বক্তব্য রাখলেন সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনে নিপীড়িত বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরলেন তিনি। তার কণ্ঠে আমরা সেদিন ইতিহাস পড়তে দেখেছিলাম। এমন এক ইতিহাসÑ যা যৌথ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিককে ২৩ বছর ধরে আঘাত হেনেছে, বারবার আশাহত করেছে। আর সেই আঘাতের পথকে প্রশস্ত করেছে আবার বাংলা ভাষাভাষী ক্ষমতালোভী কিছু রাজনীতিবিদ!
তোপখানা রোডের পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, অর্থাৎ যেদিন ঢাকার মাটিতে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, সেদিন থেকে নতুন দেশের জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিণত হয়েছে। আমরা নবীনেরা তখনও ক্লাবের সদস্য হইনি, যদিও সিনিয়রদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুবাদে ব্রিটিশ আমলের লাল বিল্ডিংটাতে গিয়ে চা-পুরি খেয়ে আসার ঘটনা অবাধেই চলছিল।
মনে পড়ে, জাতির পিতা সর্বপ্রথম জাতীয় প্রেসক্লাবে আসেন ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে। সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। তার সেদিনের ভাষণটি ছিল স্বাধীনতা-উত্তরকালের সাংবাদিকতা ও বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যময় এক ভাষণ। জাতির পিতা সেদিন অকপটে এমন কিছু সত্য তুলে ধরলেন, যা হয়তো তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেন এই বলে : “আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। আমি অনেকদিন তাঁদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। এবারের সংগ্রামে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নেই।”
সেদিনের ভাষণে একদিকে যেমন স্বাধীনতা-উত্তরকালের সংকট ফুটে উঠেছিল, তেমনি সদ্য-স্বাধীন দেশে কিছু মানুষের হাতে যে দেশবিরোধী তৎপরতা চলে আসছিল, সেদিকেও আলোকপাত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। নানা দৃষ্টান্ত টেনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “রাতারাতি একটা কাগজ বের করে বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে কেউ যদি বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা সহ্য করবেন না। কারণ তা আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করবে। ‘ওভারসিজ পাকিস্তান’ নামে কোন সংস্থা যদি এখান থেকে খবরের কাগজ প্রকাশ করে, তাহলে আমাকে কি করতে হবে? আপনারা সামান্য কিছু লোকের স্বার্থ দেখবেন, না সাড়ে সাত কোটি লোকের স্বার্থ, যে ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে, তাঁদের স্বার্থ দেখবেন?”
বঙ্গবন্ধু প্রায় খোলামেলাভাবে সেদিন নিজেকে মুক্ত করেছিলেন দেশের সাংবাদিক সমাজের কাছে। এমন প্রশ্নও করেছিলেন, “আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন। আমিও বলি। কিন্তু কোন কোন খবরের কাগজে এমন কথাও লেখা হয়, যা সাম্প্রদায়িকতার চরম। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চব্বিশটি বছর প্রগতিশীল সাংবাদিকরা সংগ্রাম করেছেন। আমাদের কর্মীরা, ছেলেরা জান দিয়েছে, জেল খেটেছে। সে নীতির বিরুদ্ধে যদি কোন সাংবাদিক লেখেন তাহলে আপনারা কি করবেন?” এরপর আরও পরিষ্কার করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন তিনি। বললেন, “অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলে থাকেন। যারা আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করেছে তারা না-কি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখার চেষ্টা করছে। এ-ধরনের কথা বলা কি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা? এর নাম কি গণতন্ত্র?”
আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস নির্মাণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। তিনি আরও বললেন, “অনেক কাগজের শিরোনাম আমার কাছে আছে। এই কাগজগুলো ফরমান আলী খানের (পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল) দয়ায় ঢাকায় বসে নয় মাস কাজ করেছে, কিন্তু তাদের আজও ছোঁয়া হয় নাই। অনেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক মা-বোন-বউ ঘরে ফেলে অকূল পাথারে ভেসে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ফরমান আলী খানের অনুগ্রহভাজনরা এখানে বসে আরামে কাগজ চালান এবং হানাদারদের সাথে সহযোগিতা করেন। এরপর স্বাধীনতা পেয়ে তাঁরা রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে গেলেন।… আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না।”
মুুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে সদ্য-স্বাধীন দেশের সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছি। আমরা অনেকেই তখন এমন এক ধারণা পোষণ করছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা পরাজিত হয়েছে, আর কখনোই ওরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু এই বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম হয়েছিলাম যে, যুদ্ধে হেরে আত্মসমর্পণ করেছে শুধুমাত্র পাকিস্তানি সৈন্যরাই, তাদের বঙ্গীয় অনুচরেরা নয়। অতএব স্বাধীন বাংলাদেশেও যে বেশ কিছু ‘পাকিস্তানি ছিটমহল’ বহাল ছিলÑ তা সকলের গোচরে আসেনি। এই ‘পাকিস্তানি ছিটমহল’ রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার অঙ্গনেও বিরাজ করেছিল।
অতএব প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেদিন পরিস্থিতির গভীরতা অনুভব করেছিলাম বৈকি। একদিকে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, মুক্ত তথ্যপ্রবাহের দাবি, অন্যদিকে সেই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার ভয়ঙ্কর সব পরিকল্পিত প্রয়াস! বলা বাহুল্য, সংকটের গভীরতা অনুভব করলেও আমাদের মতো নবীনদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সংকটের বয়ান শুনে আমরা নবীনেরাও ভাবতে শুরু করেছিলামÑ যে কোনো মূল্যে এই সর্বনাশ প্রতিহত করা উচিত।
দেখতে দেখতে আসে ১৯৭৩ সাল। মাসটা মনে নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি শ্রদ্ধাভাজন তোয়াব খান। ফোনে জানালেন পরদিন ভোরে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে। গিয়ে দেখি হেলিকপ্টার তৈরি। ফটো সাংবাদিকসহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। একটু বাদেই বঙ্গবন্ধু এসে সোজা হেলিকপ্টারে চাপলেন। বোঝা গেল তিনি চিন্তিত কিংবা বিরক্ত। মুহূর্তেই হেলিকপ্টার উড়তে শুরু করল। কেউ বলতে পারল না কোথায় যাবেন বঙ্গবন্ধু! তবে এটুকু বোঝা গেল ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ হবে কোথাও।
বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, আরেকজন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। সঙ্গে সম্ভবত, রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন। খানিকটা দূর থেকেই দেখলাম বঙ্গবন্ধু খানিকটা বিরক্ত সহকারে কথাবার্তা বলছেন। বিশাল আকৃতির রাশিয়ান হেলিকপ্টার, কানফাটা শব্দ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আধা ঘণ্টারও বেশি উড়ে হেলিকপ্টার নামল। সফরসঙ্গীদের কেউ কেউ বললেনÑ বেনাপোল, অর্থাৎ বেনাপোল স্থলবন্দর। আমরা অবাক হলামÑ এখানে আবার কী! দেখলাম স্থানীয় প্রশাসনের ত্বরিৎ উদ্যোগে কিছু পুলিশ সদস্যও উপস্থিত হয়েছে।
হেলিকপ্টার থেকে নেমেই হন হন করে হাঁটতে থাকলেন বঙ্গবন্ধু। বোঝা গেল তার কাছে গোপন সূত্রের কিছু খবর আছে। গিয়ে থামলেন একটা বড় স্তূপের সামনে। ভারত থেকে আমদানি করা কাপড়চোপড়ের স্তূপ। খোলা জায়গায় দীর্ঘদিন পড়ে আছে, ক্লিয়ারেন্স নেই। টিভিটার ওপর শ্যাওলা পড়েছে, লতাগুল্ম গজিয়েছে। ভেতরের কাপড়গুলো এরই মধ্যে পচতে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর কড়া ভাষায় নির্দেশ দিলেন কোন্ কোন্ কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ীর গাফিলতিতে এই অপকর্ম হয়েছেÑ তা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ধারণা হলো অভিযুক্তরা ধরা পড়বেন এবং তাদের শাস্তি হবে। খুব বেশিক্ষণ সময় কাটালেন না বঙ্গবন্ধু। হেলিকপ্টার আবার ঢাকার দিকে রওনা দিল।
পরবর্তীতে সেই দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত বা শাস্তি দেওয়া হয়েছিল কি না, জানতে পারিনি। কিন্তু ভারত থেকে ‘পচা কাপড়’ রপ্তানি করা হচ্ছে কিংবা সুযোগ বুঝে ভারত বাংলাদেশে ‘নষ্ট কাপড়’ গছিয়ে দিচ্ছে, এমন একটি প্রচারণা তখন লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র দেশ ভারতের সম্পর্কে বিরূপ প্রচারণা উসকে দেওয়া হয়েছিল। কিছু প্রচারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল দুই দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে, বেশির ভাগ হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির গোপনচারী কর্মিবাহিনী এবং অতি বাম বিপ্লবীদের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে, দৃশ্যতই, যোগ্য পাল্টা প্রচারণার অভাব লক্ষ করা গেছে তখন। ভারত সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবারই তার মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন পরিষ্কারভাবে। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন। সারাদেশ থেকে নেতৃবৃন্দ যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, “আজ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ভারতবর্ষের কথা স্মরণ করছি। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী পাঁচ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে বাংলার মাটিতে থাকতে পারে নাই। এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার সহকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনগণ এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকার বাংলার মানুষকে যদি সেই দিন আশ্রয় না দিত, যদি সান্ত¦না না দিতÑ বাংলার মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকত না। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর লোকেরা আমার দেশের মানুষকে শেষ করে দিত।” একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সতর্ক করেছিলেন এই বলে, “কিন্তু বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এ বন্ধুত্ব এমনি আসে নাই। দুর্দিনে যে লোক আমার পাশে দাঁড়ায় সেই হলো আমার সত্যিকারের বন্ধু। তাই ভারতবর্ষ আমার বন্ধু, আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, ভারত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তার ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করবো না। আমার ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করবে না।”
অন্যদিকে সেদিনকার কমিউনিস্ট চীন সম্পর্কেও দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে খোলামেলা বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, “যে চীন নিজেকে মহান দেশ বলে এবং দুঃখি মানুষের বন্ধু বলে গর্ব করে সে চীন সম্পর্কেও আমার একটা কথা বলার আছে। চীনের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি। আত্মসম্মান বিক্রি করে আমরা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই না। আমরা এমন কিছু করি নাই, যে জন্য চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দিতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। আমরা সেজন্য দুঃখিত। তবুও চীন অনেক বড় দেশ, আমরা তাদের বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু চীন একটা সাম্রাজ্যবাদী ও ক্যাপিটালিস্ট দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে!”
মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে এবং আরও বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ৩১ আগস্ট ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের ১৬ দিন পর।
এরই মধ্যে, সম্ভবত ১৯৭৫-এর এপ্রিল মাস, সরকারের পক্ষ থেকে বিপিআই সংস্থাকে বাসস বা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার আত্মীকরণ করা হলো। বাসস-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদক ফয়েজ আহমদ ছিলেন একনিষ্ঠ বামপন্থি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনই উদারচিত্ত ছিলেন যিনি বিরোধী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদেরও কাছে টানতে পেরেছিলেন অবলীলায়। ফলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বা এপিপি বার্তা সংস্থার পূর্ব পাকিস্তান অফিস যখন বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা বা বাসস-এ রূপান্তরিত হলো, তখন কৃতী সাংবাদিক ও ছড়াকার ফয়েজ আহমেদকে তার প্রধান বানানো হলো। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসস-এর নামও চূড়ান্ত করলেন বঙ্গবন্ধু।
দুর্ভাগ্য যে, সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের যাত্রাপথ কণ্টকাকীর্ণ করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে অস্থিরতার দিকে ধাবিত করা হয়েছিল। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সরাসরি বাংলাদেশ জন্মের বিরোধিতা করেছে, তারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নাজেহাল করার সব ধরনের ফন্দিফিকির আঁটল। অতএব প্রয়োজনের তুলনায় বিদেশি সাহায্য পাওয়া গেল না। ভারত ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সাহায্য করলেও তা প্রয়োজন মেটাতে পারল না। এদিকে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বসে থাকল না। নানা ছদ্মবেসে এবং উগ্রবামপন্থি রাজনীতির আবরণে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো শুরু হলো। রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট বেশির ভাগ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতএব অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হলো। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠনের মধ্য দিয়ে আঘাত এলো আরেকটি।
নিজস্ব সংবিধানের অধীনে বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস ধরে প্রবল নির্বাচনী প্রচারণা চলল। বঙ্গবন্ধু নিজে দেশের কিছু এলাকায় সভা করলেন। সে-সময় বিপিআই সংবাদ সংস্থার একজন রিপোর্টার হিসেবে সিলেট ও নোয়াখালীর কয়েকটি অঞ্চলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর প্রীতিভাজন বিপিআই সম্পাদক মীজানুর রহমানের সুবাদে।
একে তো হেলিকপ্টারে ওড়ার আনন্দ, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে! সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে ঢাকায় ফিরে টাইপ রাইটারে বসি, ইংরেজিতে খবর লিখি। তখনকার বার্তা সংস্থায় খবর পরিবেশন করার চল ছিল ইংরেজিতে। সেই খবর পত্রিকার অফিসগুলোতে চলে যায় পুরনো আমলের টেলিপ্রিন্টারে। ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করে বাংলা পত্রিকাগুলো সেই খবর প্রকাশ করে। বলা বাহুল্য, তখন থেকেই বাংলা ভাষায় সংবাদ সংস্থার খবর পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে থাকি। অনেক পরে যার বাস্তবায়ন ঘটে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায়, যেখানে এক সময় আমাকে প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মনে পড়ে, যতবারই ঢাকা বা বাইরে গেছি, দেখেছি, বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীদের, বিশেষ করে সাংবাদিকদের খোঁজখবর রাখতেন, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হলো কি নাÑ নিজে পরখ করতেন। জ্যেষ্ঠ সহকর্মী যারা নিয়মিত গণভবনে যেতেন, বঙ্গবন্ধুর বেশির ভাগ অনুষ্ঠান ‘কভার’ করতেন, তাদের কাছেও জাতির পিতার এই বিশেষ গুণটির কথা শুনেছি। অবশ্য পরবর্তী পেশাগত জীবনে এ-রকম আন্তরিকতা খুব বেশি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে বলে মনে হয়নি।
গরিব-নিরন্ন মানুষেরা বঙ্গবন্ধুকে কতটা ভালোবাসতেন তার একটি ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৭৩ কিংবা তারও পরের বছরের কথা। দেওয়ানগঞ্জের খড়মা গ্রামের জবু দোকানদার তখনও হাল ছাড়েননি। গ্রামের বাড়ি গেলে কোনো-না-কোনোভাবে খবর পেয়ে যান এবং বাড়ির সামনে বসে থাকেন, যে পর্যন্ত না আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। তার একটাই দাবি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন, এবং ঢাকাতে যেহেতু তার জানাশোনা লোক একমাত্র আমিই, কাজেই এসে ধরনা দেন! জানতে চানÑ কিছু হলো কি না? সবেমাত্র পেশাগত সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। দূর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখি এবং খবর লেখি। তার মানে এই নয় যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অজপাড়াগাঁয়ের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একজনকে আমি দেখা করাতে পারি! কিন্তু জবু কাকা আমার সংকট বুঝবেন না। তার কথা, তিনি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সৈন্যরা যেদিন গ্রেফতার করে সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়, সেদিন থেকে তিনি নফল নামাজ পড়া শুরু করেন এবং জাতির পিতা দেশে ফিরে না আসেন পর্যন্ত তিনি নামাজ পড়ে গেছেন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন জবু দোকানদার। এলাকার ছোট বাচ্চাদের কাছে মুড়ি-মুড়কি ও বাদাম-লজেন্স বিক্রি করে যে মানুষ জীবন ধারণ করেন, সেই জবু কাকা মানত করেছিলেন পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু বেঁচে দেশে ফিরে এলে তিনি গরু জবাই করে গরিবদের মাঝে গোস্ত বিতরণ করবেন। প্রচ- অর্থিক টানাপড়েনের মধ্যেও সে-কাজটি তিনি সমাধা করেন। অতএব আমার বাল্যস্মৃতির অনেকটা জায়গা জুড়ে যে জবু দোকানদার তার প্রতি সহমর্মিতাবোধ করি বৈকি। কিন্তু আমার করার বেশি কিছু নেই। উপায়ন্তর না দেখে একদিন বিপিআই সংবাদ সংস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই অসামান্য ভক্তকে নিয়ে একটা ছোট্ট প্রতিবেদন লিখি, ছাপাও হয় এক-দুটো দৈনিকে। খবরটি প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া বিভাগের কারও-না-কারও চোখে পড়ে। জবু দোকানদারের আশার পূরণ ঘটে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ পান।
সম্ভবত ১৯৭৪ সাল, দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা চলছে। এ-রকম বড় বন্যার সময় এবং পরে খাদ্যাভাব, রোগব্যাধি ইত্যাদি নানা সংকটের সৃষ্টি হয়। অতএব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু। আমার নিজের জেলা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জসহ যমুনার ওপারের কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা সেবারকার বানে সয়লাব। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ভেসে গেছে, লোকজন রেললাইনসহ বিভিন্ন উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। ঠিক সে-সময়েই বঙ্গবন্ধু বন্যা উপদ্রুত এলাকা দেখতে ছুটলেন। রিপোর্টার হিসেবে আমারও সুযোগ হলো যাবার। হেলিকপ্টারে উঠেই দেখা মুক্তিযুদ্ধে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠজন কৃষক লীগ নেতা ইসলামপুরের এমপি রাশেদ মোশাররফের সঙ্গে। দেওয়ানগঞ্জের সদ্য-প্রতিষ্ঠিত কলেজ মাঠে হেলিকপ্টার নামতেই হাজারো মানুষ ঘিরে ধরল। জনপ্রতিনিধি, জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে রিলিফ বিতরণ নিয়ে কথা বললেন বঙ্গবন্ধু, দ্রুত রিলিফ ও ওষুধ বিতরণের কার্যক্রম হাতে নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলেন।
বঙ্গবন্ধু আমাকে চিনতেন না, চেনার কারণও ছিল না। তবে সেদিনটি আমার বিশেষভাবে মনে থাকার। কারণ নিজের এলাকার পরিচিতি লোকজন যারা দেখলেন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী, তারা রীতিমতো অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন আমাকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হেলিকপ্টার আবারও উড়ান দিল উত্তরবঙ্গের বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলের দিকে।

দুই
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্ট পর্যন্ত, বঙ্গবন্ধুর অনেক যুগান্তকারী ভাষণ ও কিছু কিছু অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ হয় আমাদের সংবাদকর্মীদের। পরবর্তীতে সেইসব ভাষণ যখন পড়ি, বুঝবার চেষ্টা করি, কতটা অন্তর দিয়ে রাষ্ট্রের স্থপতি তার জন্মভূমিকে ভালোবেসেছিলেন, কতটা আবেগ ও উপলব্ধি দিয়ে তার দেশকে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সত্যিই অবাক হই।
১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি। আরও একবার সুযোগ আসে সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার। কুমিল্লা সেনানিবাসে দেশের সামরিক একাডেমির প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান সেদিন। একদল ক্যামেরাম্যানের সাথে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক পৌঁছলাম সেখানে, যেখানে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম মিলিটারি একাডেমি, এরপর স্থানান্তরিত হয় চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে।
বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টার থেকে নামতেই চারদিক ধুলায় ঢেকে গেল। কিছুই দেখার উপায় নেই। কিন্তু লক্ষ করা গেল, সেই ভীষণ ধূলিঝড়ের মধ্যেও এক হাতে মাথার টুপি ধরে, অন্য হাতে আচকান সামলে খন্দকার মোশতাক এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দৌড়ে গেলেন হেলিকপ্টারের কাছে। গিয়েই খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন, হাত টেনে চুমো খেলেন। এরপর সালাম-কদমবুচি করলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। বলা বাহুল্য, যারা সেই দৃশ্য দেখছিলাম তাদের কাছে ওই দুজনের আচরণ বাড়াবাড়ি রকমের মনে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে মোশতাক ও তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুকে সম্মান-শ্রদ্ধা করে গেলেন। সেদিনের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ ও উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ সিনিয়র সেনাধ্যক্ষরা সকলেই বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানালেন।
বলা বাহুল্য, আমাদের মতো নবীন সংবাদকর্মীর পক্ষে সেদিন কিছুতেই চিন্তা করা সম্ভব হয়নি যে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় এই খন্দকার মোশতাক ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরেরা কী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছিল, যার পূর্ণতা লাভ করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে।
বঙ্গবন্ধু সামরিক একাডেমির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখলেন, ক্যাডেটদের সাথে করমর্দন করলেন। একাডেমির ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে ভাষণ রাখতে গিয়ে বললেন, “আমরা পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে সামরিক একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য বহুকাল সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। আজ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই জন্যই আজ বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই উপলক্ষে আমি স্মরণ করি সেই সমস্ত শহীদ ভাইদের, যাঁরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। আমি স্মরণ করি বাংলার ৩০ লক্ষ মানুষকে, যারা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। তাদের জন্য গর্বে আমার বুক সত্যই ভরে ওঠে। তাদের জন্যই বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ।”
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রের উপযোগী একটি আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন ও সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধুর। কারণ তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংকট অনুধাবন করেছিলেন মর্মে মর্মে। ৯ মাসের সর্বাত্মক যুদ্ধের পর প্রায় পরিপূর্ণভাবে বিধ্বস্ত তখন জাতীয় অর্থনীতি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইন সরাবার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের সব প্রান্তের ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ-কালভার্টগুলোর বেশির ভাগের মেরামত শেষের পথে। রেলওয়েও চলতে শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জোগান দিতে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল-গম আসতে শুরু করেছে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে কিছু খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়েছে, যদিও প্রয়োজন আরও বেশি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘পিএল ফোর এইট্টি’ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্যসামগ্রী পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এসে পৌঁছায়নি। বোঝাই যাচ্ছিল সংকট বাড়াতে চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন।
লক্ষ করছিলাম, সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে শুনতে বেশির ভাগ মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের কারও কারও চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। পাকিস্তানি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে কত বাঙালির জীবন দিতে হয়েছে, কত মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে, সেই ইতিহাস ভেসে উঠছিল জাতির পিতার প্রতিটি শব্দ ও বাক্যে।
বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রায় স্ববিস্তারে তার আশা-আকাক্সক্ষার কথা উচ্চারণ করেছিলেন, রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, চোরাচালান বন্ধে তার সরকারের শক্ত নীতি-অবস্থানের কথা তুলে ধরেছিলেন এবং নতুন সামরিক অফিসারদের কাছে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ আশা করেছিলেন। স্বাধীনতার পরোক্ষণেই রাষ্ট্রবিরোধী যেসব অপতৎপরতা শুরু হয়েছিল, সেদিকেও শক্ত পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন তিনি।
আজ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে যখন পেছনের দিকে তাকাই, ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে চোখ রাখি, তখন কেবলই মনে হয়, পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি ঘটিয়ে কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই জন্ম দিতে চাননি তিনি, সেই রাষ্ট্রকে আধুনিক ও শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলারও স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্নের পূরণ দেখে যেতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক রাষ্ট্রের, যা গতানুগতিক বা তার ভাষায় ‘শোষকের গণতন্ত্র নয়’, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিপূর্ণ জনগণতান্ত্রিক ও সাম্যের বাংলাদেশের এবং সকল অর্থে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। কিন্তু সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের ষড়যন্ত্রকারীরা, সেই সঙ্গে দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা তখন চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতে সোপর্দ করতে চেয়েছিল।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এই ষড়যন্ত্র ছিল পরিকল্পিতÑ যা সম্পন্ন করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরাÑ যারা স্বাধীনতার পরও ঘাপটি মেরে অবস্থান করছিল রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের বিভিন্ন অংশে। পাকিস্তানি মনোভাবাপন্নরা স্বাধীন দেশের প্রশাসনে নিজেদের আসন শক্ত করে নিতে সমর্থ হয়েছিল, যা ছিল এক বড় বিপর্যয়। ফলে জাতির পিতার মহানুভবতার সুযোগে এবং তার অগোচরে দানা বাঁধতে থাকে ষড়যন্ত্র, চলতে থাকে আগ্রাসী অপপ্রচার। আরও দেখা যায়, এই ষড়যন্ত্র কেবল সিভিল প্রশাসন থেকেই হয়নি, হয়েছিল দেশের সেনানিবাসগুলো থেকেও। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক সেনা কর্মকর্তাও সেই ষড়যন্ত্রে জড়িত হয়েছিলেন। বামপন্থার উগ্র রাজনীতির নামেও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে শক্ত আঘাত হানা হয়েছিল। যে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা না হলে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরতে পারত না আটকেপড়া সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, তাদেরও একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।

তিন
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন প্রথমবার। সাংবাদিকতা বিভাগের সদ্য-প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমরা উৎফুল্ল। বাসস-এ চাকরি করি এবং কলাবাগান ফাস্ট লেনের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকি। দিনকয়েক আগে স্ত্রী রচি কুষ্টিয়ার জগতি সুগার মিলে বাবা-মার কাছে গেছে। মা ও ছোট দুই বোন, কাউছার ও ছোট্ট শাহীন ঢাকায় আমার সাথে। অফিস থেকে ফিরতে রাত প্রায় ১০টা বেজে গেছে। বাড়িতে ঢোকার পর মা খেতে দিলেন এবং পরদিন কখন বাইরে যাব জানতে চাইলেন। বললামÑ সকাল সকাল বেরুব, প্রথমে ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে পল্টনের বাসস অফিস। এরপর ঘুমিয়ে গেছি। ভোরের দিকে কিছু গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। দেখি এরই মধ্যে মা ঘরে ঢুুকেছেন ডাকবেন বলে।
দ্রুত বিছানা থেকে উঠে কলাবাগান ফাস্ট লেন ধরে হাঁটতেই অনেক ভীতসন্ত্রস্ত লোকজনের সঙ্গে দেখা হলো। বিস্তারিত কিছু বলতে না পারলেও সবাই বলাবলি করছেÑ বত্রিশ নম্বরে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গোলমাল শুরু হয়েছে। বিষদ কিছু জানে না কেউই। অতএব অনেকেই আমরা এগিয়ে গেলাম মিরপুর রোডের দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা গেল রাস্তায় একটা কালো ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন সৈন্য ট্যাঙ্কটা ঘিরে লোকজনকে উত্তেজিত স্বরে সরে যেতে বলছে।
সৈন্যদের উত্তেজিত আচরণে একটু পর সড়ক থেকে গলির ভিতরে এসে দাঁড়াই। আদপেই কী ঘটেছেÑ জানার চেষ্টা করতে থাকি। খুব বেশিক্ষণ নয়, জানা গেল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আরও দেখা গেল মিরপুর সড়কে অবস্থানরত সৈন্যরা সেই খবরে আনন্দ প্রকাশ করছে। এ এক অবিশ্বাস্য খবর, যা কেউ কল্পনা করিনি আমরা! কে হত্যা করবে জাতির পিতাকে, বাংলাদেশের জনককে? কী করে তা সম্ভব?
সময় গড়াতে থাকে। রেডিও থেকে মেজর ডালিম নামের একজনের কণ্ঠে সেই খবরের সত্যতা মিলে। দ্রুত চলে আসি বাসায়, মাকে ঘটনা খুলে বলি। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। ছোট বোন দুজন জোরে কাঁদতে থাকে। মা বললেনÑ কোনো ভুল নাই, রাজাকাররাই বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছে। বলেই তিনি আরও জোরে কেঁদে উঠলেন, এবং আমি যেন এ পরিস্থিতিতে কিছুতেই বাইরে না যাই তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু মা বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারেননি আমাকে। জানি, এ পরিস্থিতিতে কিছুই করার নেই, একমাত্র যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া ছাড়া। তবু প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে জর্জরিত করতে থাকে। এ কী ঘটল! স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এ কী ঘটল?
অনেক কষ্টে মাকে বুঝিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। দেখি, অনেকেই তখন বেরিয়েছে। কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। দু-চারটা রিকশার শব্দ ছাড়া গোটা এলাকা প্রায় নিঃশব্দ। হাঁটতে হাঁটতে একবার তোপখানা রোডের সীমানায় আসি। অফিসের টেলিপ্রিন্টার অপারেটরদের এক-দুজন এসে গেছেন তখন। অফিস ক্লিনার রামুকেও দেখা গেল। নিউজ ডেস্কের এক-দুজন এলেন একটু বাদে। মনে পড়ে, সাব-এডিটর কাজী মকসুদুল হাসানকে, পল্টনের কাছাকাছি কোথাও থাকেন। সে অফিসে ঢুকতেই চোখ ভিজে উঠল দুজনের। কেউ কিছু বলতে পারলাম না। কারণ আমরা জানতাম, জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের কেউ কেউ খন্দকার মোশতাক ও তাহের ঠাকুরের ঘনিষ্ঠজন। এরপর একের পর এক ফোন আসতে থাকল। নিজেদের পরিচয় না দিয়ে সবাই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে আগ্রহী।
কিছুক্ষণ পরেই দোতলার জানালা দিয়ে সোরগোলের আওয়াজ কানে এলো। পুলিশের বাঁশি শোনা গেল। সবাই হুমড়ি খেয়ে বন্ধ জানালার কাচ খুলে সামনের সড়কের দিকে তাকালাম। দেখলামÑ পুলিশ-মিলিটারির কয়েকটা গাড়ি দ্রুত প্রেসক্লাবের দিক থেকে তোপখানা রোডের বাসস অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে দৈনিক বাংলা পেরিয়ে বঙ্গভবনের দিকে যাচ্ছে।
স্বাভাবিক কৌতূহলে সবাই অপেক্ষা করতে থাকলাম। কয়েক মিনিটের মাথায় দেখা গেল আগে-পিছে সামরিক যান বেষ্টিত হয়ে একটি কালো গাড়িতে খন্দকার মোশতাক যাচ্ছে। বাসস অফিসের দোতলা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হাত নেড়ে রাস্তার মানুষকে সে নিজের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে। আরও দেখা গেলÑ পরের গাড়িগুলোর একটিতে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং খুনি মোশতাকের কয়েকজন সহচর। মোশতাক ও তার দলবল শাহবাগের রেডিও ভবন থেকে বেরিয়ে বঙ্গভবনের দিকে গেল, যে বঙ্গভবন থেকে প্রায় তিন মাসের ‘ক্ষমতা’ ভোগ করে আর কখনোই বাইরে বেরুবার সাধ্যি হয়নি তার।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সেদিনের ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে খুনিদের আধিপত্য দিনকয়েকের জন্য বন্ধ হলেও পরবর্তীতে মেজর জেনারেল, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাপতি খালেদ মোশাররফ টিকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের আরেক অসামান্য সেনাপতি কর্নেল আবু তাহের, বীরউত্তম, আমার নিজের যুদ্ধাঞ্চল ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক, যিনি সৈনিকদের বন্দিশালা থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন, তিনিও সফল হলেন না। ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেল জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা সেনানিবাসের ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হলো এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর অধিনায়ক বীরউত্তম খালেদ, বীরউত্তম এটিএম হায়দার বীরউত্তম ও বীরবিক্রম কর্নেল নাজমুল হুদাকে হত্যা করল। বীরউত্তম আবু তাহের, মুক্তিযুদ্ধে যিনি একটি পা হারিয়েছেন, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই।
এগুলো সবই আমাদের প্রজন্মের চোখে দেখা ঘটনা, আমার মতো একজনেরই নয়। অনেকেরই নাম ভুলে গেছি, অনেকের মুখ কিছুটা হলেও মনে আছে। তবে অনেক কিছু ভুলে গেলেও সে-সময়ের ভয়ঙ্কর সেই ব্যর্থতার কথা আজও ভুলতে পারিনি, ভুলতে পারিনি জাতির পিতাকে হারাবার কথা, সেই কলঙ্কের কথা।
অনেক বছর পর এলো ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০। তীব্র গণ-আন্দোলনে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ বিদায় নিলেন। দেশের তিন রাজনৈতিক জোটের মনোনীত হয়ে অন্তর্বর্র্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করাই তার কাজ। ৮ ডিসেস্বর ১৯৯০ ঘটল আরেক ঘটনা। প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে গেলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। হেলিকপ্টারে চেপে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার কবরে গেলেন তিনি। সংবাদ সংস্থা বাসস ও ইউএনবি’র প্রতিবেদক হিসেবে আমরা দুজন। সেই প্রথম যাওয়া আমার টুঙ্গিপাড়ায়, যে টুঙ্গিপাড়া বুক আগলে ধরে রেখেছে ইতিহাসের মহানায়ককে।
টুঙ্গিপাড়ায় সেদিন জড়ো হয়েছিল হাজারো মানুষ, সবার চোখে জিজ্ঞাসা, এই বুঝি জেগে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, এই বুঝি তিনি বলে উঠলেনÑ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেদিনকার কেবিনেট সেক্রেটারি এমকে আনোয়ারকে সাথে নিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ফুলের স্তবক অর্পণ করলেন বঙ্গবন্ধুর কবরে। এরপর ধীরে এগিয়ে, মাথা অবনত করে জনাব তোয়াব খানসহ গণমাধ্যমকর্মী আমরা জাতির পিতার কবরের পাশে দাঁড়ালাম, বিনীত শ্রদ্ধা জানালাম। জাতির পিতার কবর তখনও অযতেœ, কোনো সৌধ নেই! মুখে কিছুই উচ্চারিত হলো না আমাদের, নিঃশব্দে ভাবলাম, পঁচাত্তরের ঘাতকেরা ইতিহাস থেকে মুছে দিতে বঙ্গবন্ধুর বুলেটবিদ্ধ শরীরকে ঢাকায় রাখার সাহস পায়নি, অযতেœ-অবহেলায় সমাহিত করেছিল টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে; সেই টুঙ্গিপাড়া আজ আবারও জেগে উঠছে; হয়তো এই টুঙ্গিপাড়াই হয়ে উঠবে বাঙালির আরেক তীর্থভূমি, যেখানে এসে মানুষ এই মহাপুরুষের কবরে দাঁড়িয়ে স্বাধীন সার্র্বভৌম বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখার শপথ গ্রহণ করবে। আমার বিশ্বাস, টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত থেকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ও আগামীকালের জাতি-বিরুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-বিরুদ্ধ সকল আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক হয়ে থাকবেন, যেমনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি সর্বাধিনায়ক ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য