নূ হ – উ ল – আ ল ম লে নি ন
“সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে তুই অমূল্যনিধি বর্তমানে…।
– লালন শাহ
মনের মানুষ
সে আমাদের মনের মানুষ। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাকে আমি অন্তরে লালন করি। এই ঘোর অন্ধকারে তিনি ধ্রুবতারা হয়ে আমাকেÑ আমাদের অনেককে চালনা করছেন মানুষের মুক্তি সাধনায় সুকঠিন পথে। আমি ও আমরা অনেকেই যে এখনও অর্থবিত্ত, ক্ষমতার মোহে দিগ্ভ্রষ্ট ও আদর্শচ্যুত হইনি, তার পেছনে রয়েছে আমার মনের মানুষের জীবনের শিক্ষা, প্রেরণা ও ভালোবাসা। আমি তাকে ভালোবাসিÑ তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এবং বাংলাদেশের স্থপতি বলেই নয়, তিনি এই বাংলার ভূমিপুত্র ও এক অনন্য সাধারণ ‘সহজ মানুষ’ বলে।
বাংলার মাটিতে অনেক মনীষী, অনেক মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে। তারা তাদের চিন্তা, কাজ এবং আদর্শ দিয়ে বাঙালির চিত্তভূমি ও জাতিসত্তার ভিত্তি রচনা করে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে কেবল অগ্রগণ্যই নন, ব্যতিক্রমও বটে। তিনি আধুনিক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রথম জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন, তা নয়; তিনি ছিলেন রাজনীতির এক অনন্য জাদুকর।
বৌদ্ধ ও বাউল দর্শনে সহজ মানুষ হওয়া সবচেয়ে কঠিন। জীবনভর তপস্যার কাজ। সহজ মানুষ তিনি, যার চিন্তা ও কাজের কেন্দ্রে রয়েছে একমাত্র মানুষ। সে মানুষ মনের মানুষ। ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ বৌদ্ধ দর্শনের এই উপলব্ধিরই অভিব্যক্তি মধ্যযুগের বাঙালি কবি চ-িদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ সহজ মানুষদের জীবনদর্শন হচ্ছে ‘মানুষ ভজনা’- মানববন্দনা। মানুষের কল্যাণ, তাদের জাগতিক ও পারলৌকিক মুক্তি সাধনই সহজিয়া দর্শনের মূল কথা। এর সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের ধর্মবিশ্বাসের কোনো মৌলিক বিরোধ নেই। ‘আখলাকুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব বলে ইসলাম ধর্মও মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সমগ্র জীবন এই মানুষের কল্যাণের জন্যই উৎসর্গ করেছিলেন। মানুষকে তিনি ধর্মের দৃষ্টিতে বা জাতপাতের দৃষ্টিতে বিচার করেননি। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি অভিব্যক্ত হয়েছে আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদে, যেখানে লেখা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে…।” ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি করেছিলেন, তার মূলেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সর্বজনীন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বলাবাহুল্য, মানুষের মধ্যে কেবল হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের ভেদাভেদই নয়, আশরাফ-আতরাফ আর ধনী-গরিবের ভেদাভেদকেও বঙ্গবন্ধু মানেননি। মানেননি বলেই মুষ্টিমেয় শোষককে তিনি মানুষের মূলধারা থেকে পৃথক করেছেন। বলেছেন, শোষক-শোষিতে বিভক্ত এই পৃথিবীতে আমি শোষিতের পক্ষে। অসাধারণ রাজনৈতিক-দার্শনিক বীক্ষা থেকে তিনি এদেশের হতদরিদ্র-শোষিত-বঞ্চিত মানুষদের চিহ্নিত করেছেন ‘দুখী মানুষ’ হিসেবে। এই দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত।
স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধী ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতে বিভক্ত ভারতের দরিদ্র মানুষকে ‘দরিদ্র-নারায়ণ’ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অচ্ছ্যুৎ শুদ্রদের ‘হরিজন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এই দুটি ধর্মাশ্রিত বিশেষণ দিয়ে তিনি তাদের দেবতাতুল্য বা ভগবানের বন্ধু হিসেবে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি ‘দরিদ্র’ ও ‘হরিজন’কে সমাজের প্রান্তসীমা থেকে ওপরে তুলে আনতে চাইলেও ভারতের হাজার বছরের পুরনো বর্ণাশ্রম প্রথা নির্মূল করতে চাননি। অধ্যাত্ম চেতনাই ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল প্রেরণা।
পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা কোনো ধর্মচিন্তা বা অধ্যাত্ম চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতাকে যেমন তিনি ধর্মহীনতার নামান্তর বা ধর্মবিশ্বাসের বিপরীত মনে করতেন না; তেমনি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারেরও তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। বস্তুত শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির সংশ্লেষণের ধারার আধুনিক রূপকার।
‘দুখী মানুষ’, হিন্দু না মুসলমান, ব্রাহ্মণ না অস্পৃশ্য, আশরাফ না আতরাফ, খ্রিষ্টান না বৌদ্ধ, বাঙালি না অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষ তা তিনি বিচার করেননি।
আমি তাকে যুগপৎভাবে আমাদের মনের মানুষ এবং জাতির পিতা বলে মানি, কারণ তিনি জাতিসত্তার মর্যাদাকে যেমন সমুন্নত করতে জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, তেমনি জাতিসত্তার ওপরে তিনি স্থান দিয়েছেন মানবসত্তার মর্যাদা।
তাঁর সান্নিধ্য তাঁর স্মৃতি
আমার কিশোর বয়স থেকেই শেখ মুজিব আমার পরিচিত। আমার বাবা রাজনৈতিক কারণে অন্তত দুবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবের সহবন্দি ছিলেন। বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত নিষিদ্ধ থাকায় ১৯৪৯ সাল থেকে বাবা আওয়ামী লীগ করতেন, মুন্সিগঞ্জ জেলার তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে আমৃত্যু ন্যাপ করেছেন। বাবা পাকিস্তানি আমলে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেছেন, জেল খেটেছেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথমবার কারাবরণ করেন এবং রাজবন্দিদের মর্যাদার দাবিতে দীর্ঘদিন অনশন পালন করেন। তরুণ শেখ মুজিবের সঙ্গে তখনই ঢাকা জেলে বাবার পরিচয়। বাবা দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় এবং তৃতীয়বার ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে ৯২-ক ধারা জারি করে। সে-সময় শেখ মুজিবসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ‘আবদুর রহমান মাস্টার’ নামে খ্যাত আমার বাবা ও কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ একইসঙ্গে গ্রেফতার হন। এই তৃতীয়বারের বন্দিজীবনের গল্পই আমরা বেশি শুনেছি।
শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উদীয়মান জাতীয় নেতা। যে কোনো মানুষের ঘনিষ্ঠ পরিচয়, তার চরিত্রের উদারতা, মহত্ত, সংকীর্ণতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, দুর্বলতা, সাহস, ভীরুতা, জ্ঞান ও বিশ্বাসের গভীরতা অথবা অন্তঃসারশূন্যতা সহবন্দিদের প্রতি সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ এবং রসবোধ ইত্যাকার বিষয়গুলো জেলজীবনে যতটা অকৃত্রিমভাবে জানা যায়, বাইরে তা জানা সম্ভব হয় না। বাবার কাছ থেকে সহবন্দি অনেকের জীবনের রোমাঞ্চকর কথা যেমন শুনেছি, তেমনি বন্দিজীবনের প্রাত্যহিকতার ছোট ছোট নানা ঘটনা, বন্দিদের মধ্যকার খুনসুটি, আলাপচারিতা ও স্বপ্নের কথা বাবা আমাদের শুনিয়েছেন। দেখেছি, তখন থেকেই শেখ মুজিবের প্রতি বাবার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেই ষাটের দশকের গোড়াতেই, আইয়ুব খানের মার্শাল ল’-এর সময় শেখ মুজিব এবং আমাদের রাজনৈতিক কুলগুরু জিতেন ঘোষ যখন গ্রেফতার হলেন, বাবা গ্রেফতার এড়াতে কিছুদিন আত্মগোপনে চলে গেলেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন তার গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন আবার স্বাভাবিক শিক্ষকতার জীবনে ফিরে এলেন। আমাদের তখন কৈশোরের উত্তেজনা। বাবা বলতেন, শেখ মুজিব ’৫৪ সালেই জেলখানায় বলতেন, পাঞ্জাবিদের সঙ্গে থাকা যাবে না। বাংলার স্বাধীনতার স্পৃহা তিনি গোপন করেননি। কৃষক নেতা জিতেন ঘোষের কাছেও একই কথা শুনেছি। জিতেন ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী। বাবাও। শেখ মুজিব এসব বিপ্লবী ও বয়োজ্যেষ্ঠ বন্দিদের খুব শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন। যে কোনো বিপদে-আপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন।
বাবার কাছ থেকেই শেখ মুজিবের উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত জাদুকরি ব্যক্তিত্বের কথা শুনেছি। সত্য বলতে কী তখন থেকেই ওই মানুষটির প্রতি আকর্ষণবোধ করেছি। বিপ্লবের নেশায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শজ্ঞান এবং কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্যকে অভ্রান্ত মনে করলেও, শেখ মুজিবের প্রতি যে একটা অজানা টান অনুভব করতাম, তাতে কখনোই টোল পড়েনি।
তবে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্য আমাকে ’৭২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ১৯৬৭ সাল থেকে। ১৯৬৭ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সে-বছর একই বিভাগে ভর্তি হন। বিভাগীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরস্পর প্রতিপক্ষ দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে আমাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ পরিচয় গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনা নিজে প্রার্থী না হলেও ছাত্রলীগ প্যানেলকে সাংগঠনিকভাবে নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে আমিও প্রার্থী হইনি, তবে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলে জয়লাভের জন্য কাজ করি।
চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বিভাগীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগীয় নির্বাচনের বেশ কিছুদিন পর আমরা জানতে পারি, বেগম মুজিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সাধারণ বা ভিআইপি ক্যাবিনে না থেকে তিনি ছিলেন ডাক্তারদের জন্য সংরক্ষিত ক্যাবিনে। একদিন দুপুরে ক্লাস বাদ দিয়ে আমরা কয়েকজন সতীর্থ হাসপাতালে ‘খালাম্মাকে’ (আমরা তখন শেখ মুজিবকে বলতাম মুজিব ভাই, আর আমাদের সহপাঠীর মা বলে বেগম মুজিবকে সম্বোধন করতাম খালাম্মা বলে) দেখতে যাই। বেগম মুজিবের পাশে শেখ হাসিনা। আটপৌরে শাড়ি পরা বেগম মুজিব গভীর মাতৃস্নেহে আমাদের আপন করে নিলেন। আমরা তার জন্য কিছু নিয়ে যাইনি। উল্টো তিনি আমাদের ফল কেটে খাওয়ালেন।
সেবারে হাসপাতালে আমি আরও দুদিন গিয়েছি। ওখানেই পরিচয় হয়েছে শেখ কামালের সঙ্গে।
পরে শুনেছি, বেগম মুজিব অসুস্থ ছিলেন বটে। কিন্তু ডাক্তার ক্যাবিনে থেকেছেন গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবের (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি) সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য। ঢাকা মেডিকেলে তখন প্রায়শ রাজবন্দিরা হয় চিকিৎসাধীন থাকতেন অথবা চেকআপের জন্য আসতেন।
ডাক্তারদের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণেচ্ছু রাজবন্দিদের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ হতো এবং চেকআপ শেষে জেলে ফিরে যাওয়ার সময় তার মাধ্যমে বেগম মুজিব খবরাখবর পেতেন এবং শেখ মুজিবকে প্রয়োজনীয় খবরাখবর পাঠাতেন।
১৯৬৮ সালে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে আমার স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কের ছেদ ঘটে।
১৯৭২ সালে প্রকৃতপক্ষে প্রথম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলার সুযোগ পাই। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন এবং ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এ দুটি সম্মেলনেই প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ত্রয়োদশ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। ছাত্র ইউনিয়ন তখন ছাত্রলীগের সমান্তরাল জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগের বিভক্তির (মূল ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে আ. স. ম. রবরা ছাত্রলীগ বিভক্ত করে ও জাসদ গঠন করে) সুবাদে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় সহজ হয়।
ছাত্র ইউনিয়ন বামধারার বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হলেও বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্র ইউনিয়নকে বিশ্বাস করতেন এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতি তার আস্থা এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের প্রতি স্নেহের দৃষ্টি বামধারার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী এবং বামধারার ছাত্রদের কাছে বঙ্গবন্ধু ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন।
’৭২-থেকে ’৭৫ পর্যন্ত বহুবার আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে তার কথা শুনেছি। কখনও ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে আবার কখনও পুরাতন (বর্তমান রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘সুগন্ধা’) ও নতুন গণভবনে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে আমাদের।
বাংলাদেশের স্থপতি ও নতুন প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের আড়ালে যে মানুষটি তিনি কেমন ছিলেন? বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দু-একটি টুকরো ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা এখানে উল্লেখ করছি, যা থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
সত্য বটে, যারা বঙ্গবন্ধুকে অতি কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তাদের পক্ষে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন তা বলা সহজ। আমার জানার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘আপাত গুরুত্বহীন’ তথ্যগুলো বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
অনুস্মৃতি-১ : যাপিত জীবন
সময়াভাবে একাধিকবার বঙ্গবন্ধু পুরনো গণভবনে দুপুরের খাওয়ার সময় আমাদের ডাক পড়ে। প্রথমবারের কথাই বেশি মনে পড়ছে। পুরনো গণভবনে দীর্ঘক্ষণ আমরা বসেছিলাম। ‘লাঞ্চ টাইমে’ বঙ্গবন্ধু নিচের অফিস থেকে দোতলায় উঠে এলেন। তখনই আমদের (সেলিম, মুকুল, মাহবুব ও আমি) ডাক পড়ল। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে কৌতুকের সুরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘চল খাওয়ার টেবিলে। খেতে খেতে কথা হবে। দেখবি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কী খায়!’
দেখলাম একটা মাঝারি সাইজের অ্যালোমিনিয়ামের অতি সাধারণ টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার বের করে সাজানো হলো। ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে স্বয়ং বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পছন্দ অনুযায়ী প্রাত্যহিক খাবার পাঠাতেন। সাদা ভাত, দু-রকমের ভর্তা, করলা ভাজি, মলা মাছের চচ্চরি এবং কৈ মাছের ঝোল ও ডাল। আমি যে খুব বিস্মিত হয়েছি তা নয়। কেননা প্রধানমন্ত্রী হলেই কেউ প্রতিদিন পোলাও মাংস বা দামি দামি খাবার খাবেন, এমন তো নয়। তবে বিস্মিত হয়েছি খাওয়ার পরিমাণ দেখে। গড়পরতা বাঙালির চেয়ে লম্বা, সুঠাম দেহী পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ তো পরিমাণে এর চেয়ে বেশি খাবেন। আমরা শেরেবাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর ভোজন রসিকতার গল্প শুনেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভোজন বিলাসিতার কোনো গল্প নেই।
অত্যন্ত সাদাসিধে ছিল তার জীবন। তার একমাত্র বিলাসিতা ছিল পাইপে তামাক সেবন। বাঙালি সমাজে এটা একটা ব্যতিক্রম। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি, গায়ে মুজিব কোর্ট এবং হাতে পাইপ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমাÑ এই তো বঙ্গবন্ধুর দৃশ্যচিত্র (পরিচিত পোট্রেট) আর দশ জন বাঙালির মতোই ঘরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকতেন। ঘুমোতেন। শীতকালে যথারীতি চাদর ও অন্যান্য বাঙালিয়ানা শীতবস্ত্র পরিধান করতেন। বিদেশে গেলে, শীত থাকলেই কেবল ঐতিহ্যবাহী পোশাকের কিছুটা ব্যতিক্রম হতো।
বস্তুত চালচলনে তিনি ছিলেন ষোলোআনা বাঙালি। বিলাসিতা ও জৌলুস তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরের আঞ্চলিক উচ্চারণ ও শব্দচয়ন সংবলিত বাক্ভঙ্গিটি ছিল একান্তই তার নিজের। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির আসবাবপত্রের মধ্যেও কোনো জৌলুস বা আভিজাত্যের ছাপ ছিল না। একেবারেই আটপৌরে। কোথাও বাহুল্য নেই, নেই আতিশয্য। সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ছিল তার যাপিত জীবন। ছিল বটে সর্বত্র সুরুচি ও পরিমিতিবোধের ছাপ। অতীতে মুসলমান অভিজাত শ্রেণি থেকে আগত তথাকথিত ‘নবাব’, ‘নাইট’, ‘খান বাহাদুর’ জমিদার অথবা বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার সাহেবদের মতো গণবিচ্ছিন্ন ছিলেন না তিনি। এলিটরা নিজেদের সাধারণ মানুষের থেকে পৃথক মনে করতেন। তারা নিজেদের ‘প্রভু’ বা উঁচু শ্রেণির বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের ভেতর থেকে উত্থিত, তাদের একান্ত আপনার জনÑ তাদের বন্ধু। সে-জন্য তিনি ছিলেন যথার্থই ‘বঙ্গবন্ধু’।
বিশ্বাসে, আদর্শবাদিতায়, জীবনচর্যায়, আচার-আচরণে এবং বাস্তব কর্মকা-ে এক অতুলনীয় জনঘনিষ্ঠতাই তাকে ‘সহজ মানুষ’ করে তুলেছে। ভোগ-বিলাসিতা নয়, রাজনৈতিক কর্মীÑ দেশকর্মীদের জীবন যে ত্যাগ-তিতিক্ষার, ‘বঙ্গবন্ধু’র জীবন ছিল তারই প্রতিচ্ছবি।
অনুস্মৃতি-২ : ঔদার্য
বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলের কর্মী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। তাদের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দ-বেদনার অংশীদার ছিলেন তিনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মীটিরও খোঁজখবর রাখতেন। প্রয়োজনে সাহায্য করতেন।
ছাত্র ইউনিয়ন বামধারার বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হলেও বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ছাত্র ইউনিয়নকে বিশ্বাস করতেন এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের প্রতি তার আস্থা এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের প্রতি স্নেহের দৃষ্টি বামধারার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী এবং বামধারার ছাত্রদের কাছে বঙ্গবন্ধু ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন।
নিজ দলের কর্মী-সহকর্মীদের জন্য অনুরাগ বা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করাটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভিন্ন দলের, ভিন্ন মতের এমনকি রাজনীতি ও আদর্শগত প্রতিপক্ষের নেতাদের বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো তো কেবল ব্যতিক্রমই নয়, অসাধারণও বটে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট দুই প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঔদার্যের কথা বলা যেতে পারে। দেশভাগের আগে তরুণ শেখ মুজিব মুসলিম লীগ অনুসারী মুসলিম ছাত্রলীগ করতেন। কলকাতায় ছাত্র আন্দোলনে তার সহকর্মী ছিলেন চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং বামপন্থি যুবনেতা মোহাম্মদ তোয়াহা। ফ. কা. চৌধুরী আজীবন দক্ষিণপন্থি মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, পাকবাহিনীকে সহযোগিতা, হত্যা-অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অভিযোগে স্বাধীনতার পর কুখ্যাতি অর্জন করায় ফ. কা. চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় ফ. কা. চৌধুরী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ফ. কা. চৌধুরীর অপরাধের প্রতি এবং তার আদর্শগত অবস্থানের প্রতি বঙ্গবন্ধু বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাননি। কিন্তু কারাগারে আটক একদার রাজনৈতিক সহকর্মী ফ. কা. চৌধুরী বাড়তি কষ্ট ভোগ করতে না হয় সেদিকে বঙ্গবন্ধু খেয়াল রাখতেন। ফ. কা. চৌধুরী একটি বিশেষ কোম্পানির দামি চুরুটে অভ্যস্ত ছিলেন। শুনেছি বঙ্গবন্ধু তার জন্য জেলখানায় নিয়মিত চুরুট কিনে পাঠাতেন। কেবল তা-ই নয়, জেলে ফ. কা. চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পরিবারটি যাতে আর্থিক কারণে পথে না বসে সে-জন্য বঙ্গবন্ধু ফ. কা. চৌধুরীর পুত্রদের ব্যবসায়িক কাজে নানাভাবে সহায়তা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ফ. কা-র অকৃতজ্ঞ পুত্র সা.কা-রা অবশ্য এ জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাটুকু দেখায়নি।
অন্যজন কট্টর বামপন্থি নেতা ‘কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা’। তোয়াহা সাহেব ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। পঞ্চাশের দশকে তোয়াহার সঙ্গেও শেখ মুজিবের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনাপন্থি তোয়াহা সাহেবের ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। তোয়াহা সাহেবের দ্বিমতের কথা শোনা গেলেও তার তৎকালীন চীনাপন্থি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের (পাকিস্তানি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণি) লড়াই’ বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ হিসেবে গ্রহণ না করা এবং নকশালপন্থা গ্রহণ করে গলাকাটা রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ হওয়ায় স্বভাবতই তোয়াহা সাহেব পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। তিনি আত্মগোপন করেন। আত্মগোপনে থেকেও তোয়াহা সাহেবরা গোপনে তার দলের কর্মকা- চালাতেন। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত করা ছিল তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। দল গোপন হলেও এ-সময়ে প্রকাশ্যে ‘গণশক্তি’ নামে তাদের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আত্মগোপনে থাকা সত্ত্বেও তোয়াহা সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ছিল। তীব্র আওয়ামী লীগবিরোধী বিতর্কিত এহেন বামপন্থি তোয়াহা সাহেবের পরিবারকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানাভাবে সাহায্য করেছেন। পরিবারটি যাতে কষ্টে না থাকে তার প্রতি খেয়াল রেখেছেন। ‘সাপ্তাহিক গণশক্তি’ পত্রিকায় কর্মরত তোয়াহা সাহেবের মেয়েকে পুলিশ গ্রেফতার করলে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালে তোয়াহা সাহেব গোপনে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে উগ্র হঠকারী সশস্ত্রপন্থা ত্যাগ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য এবং প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৭৩ সালেই তোয়াহার গোপন পার্টির কংগ্রেসে বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার এবং প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
রাজনীতিতে দ্বিমত এবং বৈরী সম্পর্ক থাকলেও বঙ্গবন্ধু তার এককালের সভাপতি মওলানা ভাসানীর জন্য নগদ অর্থ ছাড়াও মাঝে মধ্যেই মওলানা সাহেবের পছন্দের খাদ্যদ্রব্য পাঠাতেন। এসব যেমন আমি শুনেছি, দেখেছি, তেমনি বঙ্গবন্ধুই আমাদের তা বলেছেন।
অনুস্মৃতি-৩ : পিতৃস্নেহ
এবার নিজেদের কথা বলি। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন আহূত ভিয়েতনাম দিবসের সমাবেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে মতিউল ও কাদের নামের দুজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী নিহত হয়। প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে ইউসিস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠাগার) ভবনের (বর্তমানে পাট মন্ত্রণালয়ের অফিস) সামনে ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এই সমাবেশের ওপরে পুলিশের গুলিবর্ষণে দুজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মৃত্যু সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আমরা ছাত্র ধর্মঘট ও হরতাল আহ্বান করেই ক্ষান্ত থাকিনি, আমরা যারা তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলাম, উগ্র হঠকারী নীতি গ্রহণ করি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে নুরুল আমিনের সঙ্গে তুলনা করে। এমনকি পল্টনের জনসভায় তৎকালীন ডাকসুর নেতারা বঙ্গবন্ধুর আজীবন ডাকসু সদস্যপত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন। এই সিদ্ধান্ত কীভাবে ডাকসুর সহ-সভাপতি নিলেন আজও আমার কাছে অজ্ঞাত। স্বভাবত ছাত্র ইউনিয়নের এই বাড়াবাড়ি যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে বিক্ষুব্ধ করে। তারা ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সারাদেশেই ছাত্র ইউনিয়ন আক্রমণের শিকার হয়।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আওয়ামী লীগের সহযোগী বামপন্থি ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং স্বয়ং বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপের ফলে এই উত্তেজনা একপর্যায়ে প্রশমিত হয়।
যুবলীগ ছাত্রলীগের হামলার মুখে ৩ জানুয়ারি থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক কাইয়ুম মুকুল, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান এবং সহ-সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে জানুয়ারির মাঝামাঝি একদিন আমরা চারজন ও ১ জানুয়ারির গুলিতে আহত বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় সম্পর্কের বোন, রোকেয়া হলের ভিপি রীনা খান গুলিতে আহত বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় ইউকসু’র সহ-সভাপতি, বুয়েটের ছাত্র আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই।
গম্ভীর মুখে বঙ্গবন্ধু এলেন। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “আমি জানি তোরা এই কাজ করতে পারিস না। তোদের মধ্যে এজেন্ট প্রোভোকেটর ঢুকে পড়েছিল, তারাই পুলিশকে লক্ষ করে বোমা মেরেছে। পুলিশ আমাকে কিছুই জানায়নি। আত্মরক্ষার নামে গুলি করেছে, আমার দুটি ছেলেকে হত্যা করেছে। আহ্ কী যে ক্ষতি হয়ে গেল! আমার দুটি ছেলে …।”
বঙ্গবন্ধুর আবেগতাড়িত এই মন্তব্য শুনে আমরা সবাই স্তম্ভিত! লজ্জায়, অপরাধবোধে, দুঃখে, যন্ত্রণায় আমাদের তখন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করেছে।
কারণ আমরা তো জানতাম, ইউসিসের লাগোয়া ন্যাপ অফিসের (পরবর্তীকালে এনএসআই’র অফিস ছিল) দোতলার ছাদে বসে ছাত্র ইউনিয়নের কিছু অতি উৎসাহী কর্মী মলোটভ ককটেল বানিয়েছিল এবং তারাই ইউসিস ভবনে তা নিক্ষেপ করেছিল। এটা ছিল এক চরম হঠকারিতা। আমার ও কাইয়ুম মুকুলের পরীক্ষা থাকায় সেদিন আমরা মিছিলে ছিলাম না। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্বের দু-একজন ছাড়া বোমা বানানোর ঘটনার কথা কেউই জানতেন না। যারা জানতেন তারাও এ-ধরনের হঠকারী কর্মকা-ে বাধা দেননি।
ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিশ্বাস করতেন। প্রয়াত কাজী আকরাম হোসেনের (মুক্তিযোদ্ধা ও আমার পরে ১৯৭৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন) কাছ থেকে ১ জানুয়ারি বিকেলেই আমি মলোটভ ককটেল বানানোর ঘটনাটি প্রথম জানতে পারি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে সাহস করে সেদিন আমাদের সেই অপরাধের কথা আমি বলতে পারিনি। আমরা ভুল স্বীকার করেছি, বঙ্গবন্ধুর ডাকসু সদস্যপদ ছিঁড়ে ফেলার জন্য আমরা যে অনুতপ্ত, সে কথাও জানিয়েছি। বলিনি যে দুটি প্রাণ ঝরে গেল, যাদের বঙ্গবন্ধু ‘আমার ছেলে’ বলে সম্বোধন করে স্নেহকাতর পিতৃহৃদয়ের সবটুকু শোক প্রকাশ করলেন, তাদের নিহত হওয়ার পেছনে আমাদের দায়-দায়িত্ব ও হঠকারিতার কথা।
বঙ্গবন্ধু তার অসীম ক্ষমায় সেদিন আবারও আমাদের পিতৃস্নেহে তার বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আমরা অভিভূত হয়ে ফিরে এসেছিলাম। আর সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আসনটি আমার হৃদয়ে (আমাদের প্রায় সবার) পবিত্র বিগ্রহের মতো চিরস্থায়ী হয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধু সেদিন আরও বলেছিলেন, “ভিয়েতনামের জন্য আমি কী করিনি। আমরা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আর কোনো দেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমি বিনা ভাড়ায় ঢাকায় তাদের মিশন (দূতাবাস) খুলতে দিয়েছি। আমেরিকা ক্ষিপ্ত হয়েছে। তারপরও আমি তাদের সাহায্য করেছি। কারণ ওরা মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমি কাউকে ভয় পাই না।…” অপরিপক্ব তারুণ্যের উন্মাদনায় বঙ্গবন্ধুর এ কাজটির ঝুঁকি ও গুরুত্ব তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বুঝিনি। বুঝিনি ১৯৭২ সালে প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দক্ষিণ ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট (এনএলএফ)-কে কূটনৈতিক মর্যাদা দিয়ে ঢাকায় তাদের দূতাবাস স্থাপন এবং বিনা ভাড়ায় এজন্য দুটি সরকারি মালিকানার (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) ভবন বরাদ্দ কতটা সাহসিকতাপূর্ণ কাজ ছিল। বুঝেছি ১৯৭৫-এর তার ট্র্যাজিক হত্যাকা-ের পর। মার্কিন শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে কতটা ভয় পেত। আর সে-কারণেই, আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পেছনে কোনো-না-কোনোভাবে সিআইএ যুক্ত ছিল। ১৯৭৩ সালের ১১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র ইউনিয়নের চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “আলেন্দের পরিণতি হলেও শেখ মুজিব সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করবে না।” বঙ্গবন্ধুও তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন সাম্রাজ্যবাদের কাছে তিনি মাথানত করেননি।
অনুস্মৃতি-৪ : স্নেহাশিস
১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দেয়। বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে আমাকে ডাকসু’র সহ-সভাপতি পদে ও ইসমাত কাদের গামাকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্বাচনী প্রচারণার কালে একদিন সন্ধ্যার পর ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম গামা ও আমাকে নিয়ে পুরনো গণভবনে গেলেন। আমাদের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তার দোয়া চাওয়া। বঙ্গবন্ধু পরের দিনই আলজিয়ার্স যাবেন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে। আমরা অপেক্ষা করছিলাম, কখন বঙ্গবন্ধু বাইরে বের হন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলেন। আমরা এগিয়ে গেলাম তার কাছে। যথারীতি শেখ শহীদ ও গামা বঙ্গবন্ধুকে কদমবুছি করেন। আমার তখন বিব্রতকর অবস্থা। কমিউনিস্ট পরিবারে বড় হওয়ায়, আমার মধ্যে পা ছুয়ে সালাম করার ব্যাপারে দ্বিধা ছিল। অথচ পরিবেশটা একেবারেই ভিন্ন। আর কদমবুছি করে আশীর্বাদ চাওয়া হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী রীতি-প্রথা। কিন্তু কমিউনিস্টরা কদমবুছিতে বিশ্বাসী না। আমি তাই দ্বিধায় পড়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমার অবস্থা বুঝে ফেলেন। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই, তিনি আমাকে কদমবুছি করার সুযোগ না দিয়ে তার বিশাল বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। মুখে বলেন, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সরাসরি ভোট চাও। আশা করি তোমরা কামিয়াব হবে। আমাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বিদায় করেন। আমি ঘাম ছেড়ে বাঁচলাম। আমাকে তিনি বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচালেন। আমি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলাম। কদমবুছি করতে আমি কার্পণ্য করলেও আমাকে স্নেহাশিসÑ শুভাশিস জানাতে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি।
অনুস্মৃতি-৫ :
১৯৭৩-এর ডাকসু নির্বাচনের পর থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৭৪-এর একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালনের সিদ্ধান্তও হয় যৌথভাবে পালনের। আমরা দুই সংগঠন সিদ্ধান্ত নেই শহিদ দিবসের প্রভাতফেরি একসাথে করে শহিদ মিনারে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ ও শপথ গ্রহণ করব। বিকালে দুই সংগঠনের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ছাত্র-জনসভা। জনসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি গ্রহণ ও আর্থিক বিষয়ে আলোচনার জন্য ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী এবং আমি গণভবনে যাই। পুরনো গণভবনের দোতলায় বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠানো হয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা দোতলায় যাই। বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ আগ্রহ নিয়ে আমাদের কুশল জানতে চান। আমরা এখন কী করছি তা-ও জিজ্ঞেস করেন। আমরা তাকে শিক্ষানীতি নিয়ে আমাদের অভিমত জানাবার জন্য সময় প্রার্থনা করি। তিনি সম্মতি জানান এবং পরে তারিখ জানাবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেন। তারপর আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দুই ছাত্র সংগঠন শহিদ দিবস পালন ও পল্টনে জনসভা করার ব্যাপারে তার অভিমত জানতে চাই। তিনি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলেন, এখন থেকে তোরা সব কার্যক্রম ঐক্যবদ্ধভাবে করবি। ছোটখাটো ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি থাকলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটিয়ে নিবি।
তিনি বললেন, জনসভা ভালো করে কর। ভালোভাবে প্রচার করবি। জনসভা যেন ভালো হয়। শেষে আমরা আর্থিক সহায়তার কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, পরে হানিফের সাথে যোগাযোগ করবি। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্টভাবে আমাকে বললেন, “তুই দু-একদিন পর হানিফের সাথে দেখা করবি। আমি হানিফকে বলে দেব।” এ-কথা শোনার পর মনিরুল হক চৌধুরীর মুখটা ম্নান হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলার নেই।
সাক্ষাত শেষে আমরা গণভবন থেকে বের হব, এমন সময় হানিফ (পরবর্তীতে ঢাকার মেয়র) ভাই দোতলা থেকে নেমে ইশারায় আমাকে তার কাছে ডাকলেন। মনিরুল হক চৌধুরী তখন একজন আওয়ামী লীগ নেতার সাথে কথা বলছিলেন। আমি কাছে যেতেই হানিফ ভাই আমাকে বললেন, অন্য কাউকে সাথে আনার দরকার নেই। পরশু আপনি একা এসে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাবেন। বঙ্গবন্ধু চাঁদাবাজি যাতে না হয় সে-জন্য নজর রাখতে বলেছেন।
যেদিন টাকা নিতে গেলাম, সেদিন হানিফ ভাই টাকা দেওয়ার সময় জানালেন, বঙ্গবন্ধু আপনাকে বিশ্বাস করেন। আরও টাকার দরকার হলে আপনি জানাবেন। ওরা কিন্তু এ উপলক্ষ্যে চাঁদাবাজি করতে পারে, সাবধানে থাকবেন। ছাত্রলীগ তার নিজের সংগঠন হলেও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের কাউকে কাউকে বিশ্বাস করতেন না। বিশেষত সাত খুনের ঘটনাবলির পর।
অনুস্মৃতি-৬ : আত্মঘাতী বিশ্বাস
খ্যাতিমান প-িত ও লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর দুটি বিখ্যাত বইয়ের নাম যথাক্রমে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ এবং ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’। নীরদ সি চৌধুরী দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে প্রবাস জীবনযাপন করেছেন, সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ছিলেন ইংরেজ ভক্ত। পরিণত বয়সে তার জীবনদৃষ্টিতে এসেছিলে স্বদেশ-চেতনার বিপরীত মাত্রিকতার অভিব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুকে জানলে, তিনি হয়তো আর একটি গ্রন্থ রচনা করে নাম রাখতেন, ‘আত্মঘাতী শেখ মুজিব’।
‘কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে না’Ñ এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্ধ বিশ্বাস। একেবারে সারল্যে ভরা কুসংস্কার! বাঙালির প্রতি ভালোবাসা, সহকর্মীদের প্রতি বিশ্বাসÑ সর্বোপরি নিজের নিরাপত্তার প্রতি চরম ঔদাসীন্য প্রকৃতই বঙ্গবন্ধুকে এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর তা না হলে তিনি খুনি মোশতাককেও বিশ্বাস করেছেন কোন বিবেচনায়?
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মঘাতী বিশ্বাস প্রবণতারই একটি ছোট নজির এখানে আমার ও অজয় দাশগুপ্ত রচিত, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- প্রতিপদের প্রথম বছর’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি।
‘আমি নিজের জন্য ভাবি না’
“দিনটা ছিল রোববার। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। বললেন, ‘১১টার দিকে চলে আয়।’ আমরা তিনজনÑ ডাকসুর সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন এবং সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান ৩২ নম্বরের বাড়িতে পৌঁছলে বঙ্গবন্ধু আমাদের তিনতলার কক্ষে ডেকে নেন। প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী সাহেবকে বিদায় দিয়ে টানা দু’ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা। গভীর স্নেহে নিজের হাতে ফরিদপুরের নলেনগুড়ের সন্দেশ তুলে দেন আমাদের হাতে। তারপর প্রায় একপাক্ষিক অনর্গল কথা বলা। এ এক অন্য শেখ মুজিব। নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর। বললেন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, স্বপ্নের কথা। ‘আমার ত্রিশ লক্ষ মানুষ রক্ত দিয়েছে। কিছু করতে না পারলে এত রক্ত ব্যর্থ হয়ে যাবে। তা তো হয় না। তা তো হয় না। আমার কাজ তো আমি করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। তবু মানুষ আমার কাছেই আশা করে। অনেক সময় লাগবে। আমি তো পারব না। বয়স হইছে। তোরা আছিস। আমি কেবল শুরুটা করে দেব।’ তার স্বভাবজ আঞ্চলিক টান মেশানো স্বরে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন তিনি।
ক্রমেই আমাদের মনে হলো, এক বছর আগে, ১৯৭৪-এর এপ্রিলের দিকে মস্কো থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের যে আভাস তিনি দিয়েছিলেন, আলাপচারিতার সময় সেটা স্পষ্ট করে বললেন। দেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তার অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করল। আমরা তার কাছে গিয়েছিলাম তার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগের কথা বলতে, সেই সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করার পর কী কী পদক্ষেপ তিনি নিতে যাচ্ছেন, সে-সম্পর্কে ধারণা নিতে। কিন্তু সেসব কিছু বলার আগেই তিনি আমাদের মনের কথা সব বলে দিলেন। বাইরের ষড়যন্ত্র, মার্কিনিদের চাপ, দৃষ্টিভঙ্গি, পাকিস্তান ও পেট্রো-ডলারের তৎপরতা এবং এসবের সঙ্গে দলের কারও কারও সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুটা খোলামেলা, কিছুটা আকারে-ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে বললেন। বললেন, আওয়ামী লীগের সীমাবদ্ধতার কথাও। ত্রিদলীয় গণঐক্য জোট বভভবপঃরাবষু কিছু করতে পারেনি, আওয়ামী লীগও একা পারেনি। বললেন, ‘তাই তো সবাইকে নিয়ে নতুন জাতীয় দল করেছি। তোদের সবাইকে মিলে একটা একক ছাত্র সংগঠন করতে হবে। কৃষক, শ্রমিক, যুবÑ সব হবে। সবাই মিলে কাজ করতে হবে। পুরো সিস্টেমের পরিবর্তন করতে হবে।’
তারপর কথার এক ফাঁকে পাইপে নতুন করে টোব্যাকো ভরে দীর্ঘ টান। কপালে চিন্তার বলিরেখা। আবেগঘন হয়ে আসে তার কণ্ঠস্বর। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, ‘কাস্ত্রো পারলে আমি পারব না কেন! কাস্ত্রো তো প্রথমে জাতীয়তাবাদী ছিলেন।’ প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তার দীর্ঘ আলাপচারিতার কথা বললেন। কাস্ত্রো তাকে বলেছিলেন, বিপ্লবের শত্রুদের বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। সুযোগ পেলেই তারা ছোবল হানবে। সতর্ক থাকতে বলেছিলেন কাস্ত্রো।
সতর্কতার কথা উঠতেই আমরা সুযোগ নিলাম। বললাম ৩২ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাহীনতার কথা। তার প্রায় অরক্ষিত অবস্থার কথা। আমরা অনুরোধ করলাম তিনি যেন সপরিবারে গণভবনে উঠে যান।
বিশাল মানুষটি হাসির গমকে কেঁপে উঠলেন। আমাদের কথা পাত্তাই দিলেন না। ধ্যানস্থ হয়ে বললেন, ‘দ্যাখ, আমি আমারে নিয়া ভাবি না। ক্যু-টু হইলেও হইতে পারে, তবে কোনো বাঙালি আমার গায়ে হাত তুলবে না।’ পরিহাসের সুরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমারে বড় জোর ফাদারল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে পারে। সুকর্নর মতো করতে পারে। আমার চিন্তা তোদের নিয়ে। তোদেরকে ছাড়বে না। দেখলি না ইন্দোনেশিয়ায় কী ঘটেছে। কমিউনিস্টদের শেষ করে দেবে। আমি তো সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আমার নিজের জন্য ভাবি না।’
জানি না সেদিন বিধাতা অন্তরিক্ষে নীরবে হেসেছিলেন কি-না! (বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- : প্রতিবাদের প্রথম বছর, নূহ-উল-আলম লেনিন ও অজয় দাশগুপ্ত)”
নিজ দেশের মানুষের প্রতি, বাঙালিদের প্রতি কী অবিশ্বাস্য যুক্তিহীন বিশ্বাস! এই অবাস্তব এবং ভাবাবেগপ্রসূত শিশুসুলভ বিশ্বাস প্রবণতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর এক বড় দুর্বলতা! সত্যিকারের প্রেমিক না হলে, সহজ সারল্যে ভরা হৃদয়বান ‘সহজ মানুষ’ না হলে এ-রকম আত্মঘাতী বিশ্বাস প্রবণতা লালন করা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর বেহিসেবি ভালোবাসা, তাকে রাজনীতিবিদের ঊর্ধ্বে এক অন্ধ প্রেমিকে পরিণত করেছিল; যে প্রেমিক তার আরাধ্য (বাংলার দুখী মানুষ) মানুষের জন্য সব কিছুÑ জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারেন। আর এ জন্যই তিনি জেনে শুনে বারবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে জীবন দিয়েই জীবন জয় করলেন; সিদ্ধি লাভ করলেন অমরত্বের সাধনায়।
লেখক : উত্তরণ সম্পাদক