ঝর্না রহমান: রানু অনেকটা সামনে চলে গেছে। ও ধীরপায়ে হাঁটছে। তারপরেও আমি পেছনে পড়ে গেছি। বিশাল কমপ্লেক্সের চকমিলানো সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে বুঝি আমার ঘাড় বাঁকা হয়ে যায়। চোখ থ মেরে যায়। পায়ের তলায় কত লাল! কী মসৃণ! বাচ্চাদের মতো আমি বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে তাই এদিক-সেদিক দেখি। ফলে রানু এগিয়ে গেল। আমি পেছনে পড়ে গেলাম।
হাঁটতে গেলে আর্থরাইটিস আমার বাহান্ন বছুরে হাঁটু কামড়ে ধরে থাকে বটে, কিন্তু এ-মুহূর্তে আমি হাঁটুর ব্যথা টের পাচ্ছি না। আমি হঠাৎ আর একটা কী যেন টের পেয়ে গেছি। পাওয়াটা বুঝে নিতে থমকে দাঁড়িয়েছি।
রানুু হেঁটে যাচ্ছে। একবারও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। ও শাড়ির আঁচল টেনে সামনে নিয়েছে। লাল সবুজ শাড়ি। ওর পিঠের ওপরে বিছিয়ে আছে তিনকোণা সবুজ আঁচল। মাঝখানে লাল রঙের বৃত্ত। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা হেঁটে যাচ্ছে। যে-মুহূর্তে আমি পতাকাটিকে সামনে হেঁটে যেতে দেখি সে-মুহূর্তে আমার ভেতর থেকে কিছু একটা ধাক্কা খেয়ে বের হয়ে আসে। সেটা আবেগ না রোমাঞ্চ আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমি চিরকালই একটু বোকা কিসিমের। বিশেষ করে আমার ছোট বোন রানুর তুলনায়।
আমিও লাল সবুজ শাড়ি পরেছি। আমরা আজ পরিকল্পনা করেই শাড়ির রং নির্বাচন করেছি। কারণ আমরা আজ যাব পিতৃভূমিতে। জাতির পিতার বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায়। পতাকাপ্রাঙ্গণে যাব, তাই আমরা দু-বোন পতাকা রঙের শাড়ি পরেছি। রানুর শাড়ির জমিন টানা সবুজ। আঁচলের মাঝখানে বড় লাল বৃত্ত। পুরোই পতাকা! আমার শাড়িতে সবুজের মাঝে লাল কৃষ্ণচূড়ায় ছিটকানো রক্তের মোটিফ।
রানুকে আমি পেছন থেকে ডাক দিই।
– রানু, দাঁড়া!
রানু শুনতে পায় না। ও আপন মনে সামনে হেঁটে যেতে থাকে। ওর পদক্ষেপে কেমন মগ্নতা। রানু যেন একটা মানত পূর্ণ করছে। যেন একটা পুণ্যতীর্থ প্রদক্ষিণ করছে। এ প্রদক্ষিণে থামা যাবে না। থামার নিয়ম নেই।
আমার বোনটি এমনই। ওর চরিত্রে জল আর পাথরের বিন্যাস। কখনো ও গলে যায়। কখনো টং করে শক্ত করে তোলে ওর সমস্ত হাড়গোড়। এখন ও গলে যাচ্ছে। শুধু সামনে বয়ে যাওয়া এখন ওর কাজ।
– রানু, এই রাহনুমা, আস্তে হাঁট।
আমি গলা চড়িয়ে দ্বিতীয়বার ডাক দিই। আর সে-মুহূর্তে জিনিসটি পাই!
সে-মুহূর্তে পতাকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে।
– আয় আপা! রোদ কড়া হয়ে যাচ্ছে। ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে সাদা গম্বুজ। ওখানে ছায়া।
– হুম, ওটাই সমাধি। ওখানে ছায়া।
কাছে এসে রানুর কাঁধে হাত রাখি।
– চল রেহানা, দু-বোন একসাথে যাই।
রেহানা? রানু ভ্রু কুঁচকে এক ঝলক আমাকে দেখে। তারপর হাসে! বলে,
– আর তুই হাসিনা? দারুণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা তোর আপা!
– উদ্ভাবন না, আবিষ্কার!
আমার পিঠেপিঠি ছোট বোন রাহনুমাকে আমরা সংক্ষেপে রানু বলেই বেশি ডাকি। আমার নাম হাসনাহেনা। আমাকেও পারিবারিকভাবে সংক্ষেপে হেনা নামেই ডাকা হয়। কিন্তু রানুকে পুরো নাম ধরে, রাহনুমা বলে ডাকার পরে আমি পেয়ে যাই আমাদের দু-বোনের প্রকৃত নাম! রানু নয়, রাহনুমা নয়, রেহানা! হেনা নয়, হাসনাহেনা নয়, হাসিনা! হাসিনা আর রেহানা দুই বোন এসেছে পিতৃভূমিতে!
শুক্র শনি মিলিয়ে পাঁচ দিনের ছুটিতে আমি রাহনুমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
রাহনুমা খুলনায় থাকে। আমি ঢাকায়। আমরা দু-বোনই কলেজে অধ্যাপনা করি। সব সময় ছুটি পাওয়া যায় না। দু-বোনের ছুটির দু-হাত এক করা তো আরও মুশকিল! এবার মেলানো গেছে। আসা-যাওয়া বাদ দিয়ে মাঝের তিন দিন দু-বোনে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াব তার পরিকল্পনা করা আছে। সে-পরিকল্পনার প্রথম দিন আজ। আজ দু-হাজার পনেরো সনের পাঁচ মে।
আমরা ছায়াতলের দিকে হাঁটি। চল্লিশ বছর ধরে এখানে ঘুমিয়ে আছেন পিতা। চল্লিশ বছরে আমাদের কারও এই তীর্থভূমিতে আসার সময় হয়নি। আমরা দুই নাদান কন্যা পায়ে পাথরবাঁধা কয়েদির মতো ধীরে ধীরে ছায়াতলের দিকে হাঁটি।
সেই ভয়াবহ দিনটির স্মৃতি তো আমাদের মনে আছে! ঢাকার বাসাবো এলাকায় আমাদের বাসা ছিল। আমার আব্বা হঠাৎ পাশের রাস্তায় কোলাহল শুনে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার বুকে তখন নরম সকাল নেমেছে। রাস্তা দিয়ে একটু আগে টুং টুং ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গিয়েছিল কেরোসিনওয়ালা আর পাউরুটিওয়ালার গাড়ি। হঠাৎ সব নির্জনতা ছাপিয়ে একটা কোলাহল উঠেছিল।
একটু পরেই আব্বা ফিরে এলেন। ফ্যাকাশে মুখে ফিসফিস করে আম্মাকে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে মার্ডার করা হয়েছে। সম্ভবত হোল ফ্যামিলি কিলড।
আব্বা সেদিন অফিসে গেলেন না। চুপ করে ঘরে বসে রইলেন। আস্তে সাউন্ড দিয়ে চালু রাখলেন রেডিও। আমরা দু-বোন ছোট দু-ভাইকে খাইয়ে পরিয়ে বললাম, চুপ করে থাকো। বাইরে যাবে না। আমরাও বাইরে যাইনি।
তারপর দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ আমরা বাহিরকে আর খুঁজে পাইনি। আমাদের বাহির কালাকানুনের ঝোলায় ভরে ফেলা হয়েছিল। আমরা দু-বোনও লেখাপড়া স্কুল-কলেজ পরীক্ষা বিয়েশাদি সংসার চাকরির নানান ডামাডোলে পড়ে নিজেদেরই হারিয়ে ফেলেছিলাম। কখনো কখনো প্রবল ইচ্ছে হলেও শেষ পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়ায় আর যাওয়া হয়নি। তবে অপরাধবোধে ভুগিনি। মনে হতো গোটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলই টুঙ্গিপাড়া। অথবা টুঙ্গিপাড়াই গোটা দেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্সের লাল সিরামিক ইটের জ্যামিতি পেরুতে পেরুতে আজ এসব দার্শনিক আর তাত্ত্বিক উপলব্ধিগুলো খসে পড়তে থাকে। যেন ধ্যানমগ্ন পুরনো দার্শনিক বৃক্ষ। গা থেকে খসে পড়ছে পোকা খাওয়া জরাজীর্ণ বল্কল! সমাধি কমপ্লেক্সের প্রবেশপথে নির্দিষ্ট দূরত্বে নানারকম শৌখিন গাছ। সোনালু গাছগুলোতে তখন তোড়া বাঁধা ফুলের ঝালর নেমেছে। শান্ত নিরিবিলি সুসজ্জিত এলাকা। চল্লিশ একর জায়গার প্রতি ইঞ্চি মাটি গণপূর্ত বিভাগের সুচিন্তিত পরিকল্পনায় সেজে উঠেছে। লাল সিরামিক ইট আর সাদা কালো মার্বেল ব্লকে নকশা বুনে স্থাপত্যবিদগণ ঢেকে দিয়েছেন মাটি। টুঙ্গিপাড়ার মাটি। পিতৃভূমির মাটি। কী অভাগা দুই বোন আমরা! পিতৃভূমির মাটিতে পা রাখতে পারি না। আমরা দুজন নিঃস্বরিক্ত হাসিনা-রেহানা শ্লথ পায়ে লাল সিরামিক গুনে গুনে পিতার কবরের দিকে এগোই।
– আপা, আম্মা সেদিন জায়নামাজে বসেছিলেন সারাদিন, মনে আছে?
– আর আব্বা সেদিন শুয়ে শুয়ে একের পর এক সিগ্রেট খাচ্ছিলেন। তোর মনে আছে রানু?
– সব মনে আছে। মনে আছে, তুই বলেছিলি, আমাদের দেশ কি আবার পাকিস্তানিরা নিয়ে নিচ্ছে না-কি রে?
– আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বুঝতাম না তখন। মনে হচ্ছিল যিনি দেশ স্বাধীন করলেন, তাকে আবার মেরে ফেলা মানেই তো দেশ পরাধীন হয়ে গেল! নিজের দেশের মানুষ দেশের নেতাকে মেরে ফেলবে, এই রাজনীতি আমি বুঝিনি!
– হুম, তুই তো সারাদিন গান, ছবি আঁকা আর সেলাই নিয়ে থাকতিস আপা! তোর আঁকা বঙ্গবন্ধুর পেনসিল স্কেচটা কে দেয়াল থেকে খুলে ফেলেছিল জানিস? ওটা কিন্তু পড়ে গিয়ে ভাঙেনি!
– তাহলে?
– আমাদের বাসার যে বাড়িওয়ালা ছিল, হাজি ইব্রাহিম, তার একটা মাস্তান টাইপের ছেলে ছিল না, গালপাট্টা বদরুইল্যা? সে! তুই স্কুলে ছিলি। দুপুর বেলা বদরুইল্যা আমাদের বাসায় ঢুকে আব্বাকে বলেছিল, ছবি নামিয়ে রাখতে। নইলে বিপদ হবে। বলে সে নিজেই ছবিটা নামিয়ে ঠাস করে ফ্রেমটা ভেঙে ছবিটা বের করে আব্বার হাতে দিয়ে বলেছিল, রেখে দেন। পরে সুবিধাজনক সময়ে লাগাবেন। এখন অসুবিধা।
– তোর মন খারাপ হবে তাই আব্বা বলেছেন দেয়ালের কাঁটা খুলে ফ্রেমটা পড়ে গেছে।
– তুই এতকাল বলিসনি তো রানু?
– তখন আব্বা মানা করেছিলেন। তাই বলিনি। তারপর ধীরে ধীরে ভুলে গিয়েছিলাম আপা। আব্বাও চলে গেলেন কত বছর!
– হ্যাঁ আমাদের সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বছরের পর বছর। কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে পারতাম না। কলেজে ছাত্রদের সামনে সাবধানে বলতে হতো বঙ্গবন্ধুর কথা। কিছু ছাত্র থাকত যারা বাজে মন্তব্য করত। ওদের ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছিল।
– এই ব্রেন ওয়াশিং এখনও চলছে আপা! এখন ওয়াশড প্রজন্ম বড় হয়ে গেছে। তারা আবার আর এক প্রজন্মকে ওয়াশ করবে। তারা বড় হবে। আবার করবে। কোষ পদ্ধতিতে। একটা ভেঙে দুটো। দুটো ভেঙে চারটা…
গনগনে সূর্যটা মাথার ওপর চলে এসেছে। লাল সিরামিকে আমাদের ছায়া পায়ের কাছে স্তূপ হয়ে পড়ে।
আমরা সমাধি-প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ি। ঢোকার মুখে দেয়ালে খোদিত ‘একটি অমর সমাধি’ শিরোনামের কবিতা পড়ি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এপিটাফের সূচনাশব্দ ‘দাঁড়াও পথিকবর’ দিয়ে শুরু। আমি পড়ে বলি, দুর্বল কবিতা। অনেক বানানও ভুল। রানু কবিতা থেকে চোখ তোলে।
– আপা, এখানে কবিতা খুঁজিস না। এখানে ১৫ আগস্টের রক্তফোঁটাগুলো শব্দ আকারে সাজানো হয়েছে। এই শব্দগুলো আপামর জনসাধারণের জন্য।
রানুর চোখের ভেতরে ছলছলে উদ্ভাসের নিচে দুটো কালো পাথর।
রক্তফোঁটাগুলো চারপাশে বোঁ বোঁ শব্দ করে মৌমাছির মতো উড়তে থাকে। একটি বড় আয়নার বুকে চারপাশের বড় বড় গাছের ছায়া আর রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের ছবি। আয়নার মতো মসৃণ জল টলমল করে। পাশে একটি সাইনবোর্ড। ‘শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী বড় তালাব।’ রানু থামে।
– আপা, পুকুরকে তালাব বলা হয়?
-পুকুরের আর এক প্রতিশব্দ তালাব। ফারসি শব্দ। এ পুকুরটা অনেক বড়, প্রায় দিঘির মতো। সে-জন্য হয় তো শেখ বাড়িতে একে তালাব বলা হতো।
এ পুকুর থেকে ভাঙা বালতিতে পানি তুলে বঙ্গবন্ধুকে শেষ গোসল দেওয়া হয়েছিল। তার দাফন-স্নানের পানিটুকু গরম করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বড়ই পাতা, সুর্মা, কর্পুর আনার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
পানি কলকল করতে থাকে। পানির শব্দে আমরা কিছুই শুনতে পাই না।
রানুকে দেখছি ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। শেষ ধাপে গিয়ে দুই পা জোড়া করে মগ্ন ভঙ্গিতে বসে। পানি ছোঁয় রানু। রেহানা।
মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে বলে, আয় আপা, কবর জিয়ারত করার আগে ওজু করে নিই।
পানি কলকল করতে থাকে। শেষ স্নানে পিতার দেহের রক্তধোয়া জলধারা চল্লিশ বছরের অজস্র বৃষ্টিধারার সাথে এই তালাবে এসেই তো মিশেছে! এই জলকণা এখন তার মেয়েদের ওজুসিক্ত মুখের লোমকূপ দিয়ে সারাশরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের লোমকূপে জলকণার কলকল শব্দ।
ঝাঁকড়া হিজল আম লিচু গোলাপজামের ছায়া আমাদের পথ দেখায়। কালো মার্বেল সাদা মার্বেল ছককাটা জ্যামিতিক নকশার ওপর ঝরা ফুল, হিজলের শুকনো লাল টুকটুকে পাতা। একটা পাতা আমি তুলে নিই। এখানকার মাটি তার শেষ স্নানের জল শুষে নিয়েছিল। তাই এত লাল!
রানু পাতা দেখে মৃদু হাসে।
– আপা, মনে আছে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুর পাড়ে হিজল গাছের কথা? মালার মতো লম্বা ফুল ঝুলতো, আর পানির ওপরে মখমলের মতো ভাসতো ঝরা ফুলের রাশি! সিরামিকের ওপরে পড়া এই হিজলপাতা সুভেনির হিসেবে নিচ্ছিস?
– আরে নাহ! এমনি। দেখলাম আর কি। শহরে তো হিজল গাছ দেখি না, তাই!
– আপা, পরে আমরা হিজলতলা ঘাটে যাব। বঙ্গবন্ধু সেখানে শৈশবে গোসল করতেন। সেখানকার হিজল গাছের পাতা রেখে দিস।
আমি রানুর কথায় সাড়া দিই না। হিজল পাতাটির আঙ্গুল ধরে হাঁটি। আমাদের সামনে শ্বেতশুভ্র টোম্বটি দাঁড়িয়ে। গোল দেয়ালের গায়ে চৌখুপি জাফরি কাটা নকশা। একেবারে চূড়ায়, ওটা কীসের মোটিফ? কবরের? সমাধিগৃহ, তাই কবরের মোটিফ রাখা হয়েছে চূড়ায়!
রানু মাথার কাপড় যতœ করে আগলে ধরে মাথা উঁচু করে চূড়াটা দেখে।
– আপা, ওটা কবর না, মনে হচ্ছে কুঁড়েঘরের মোটিফ। কুঁড়েঘরের চালা। তিনি তো মাটির মানুষ ছিলেন। মাটিতে জন্ম, মাটি তার রক্তে মিশেছে। তার রক্তও মাটিতে মিশেছে। মাটির কুঁড়েঘরের মানুষটিকে চিরঘুমের মাটির ঘরে রাখা হয়েছে!
আমরা চিরঘুমের কুঁড়েঘরে ঢুকে পড়ি।
ঘুমঘরে নীরবতা নেই। বহু দর্শনার্থীর কোলাহল। তারা নানা স্পটে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাতরত হাত আর মুখ কোন অ্যাঙ্গেলে ভালো দেখা যাবে বুঝে নিচ্ছে। বাচ্চারা কবর ঘিরে-দেওয়া কাঠের রেলিংয়ের ওপরে বসে পড়ছে। জাফরিকাটা দেয়াল দিয়ে ছোট ছোট সাদা চড়–ইয়ের মতো রোদের টুকরো ঢুকে পড়েছে। ছাদের ওপরে কাচের জ্যামিতি। সেখান থেকে নীলচে রুপালি আলোর আভায় মায়াবী হয়ে উঠেছে সমাধিস্থল।
আমরা দাঁড়িয়েছি জনকের পায়ের কাছে। কালো গ্রানাইট পাথরের মেঝের ওপর সাদা মার্বেলে চমৎকার চৌকো নকশায় মুড়ে দেওয়া সমাধি স্থাপত্য। কবরের মাঝখানটুকুতে এক ফালি সিনথেটিক সবুজ ঘাস। পায়ের কাছে শে^তপাথরের বড় ফলকে বঙ্গবন্ধুর নাম জন্ম-মৃত্যুর সন-তারিখ।
আমরা দেখি মাটির মানুষটির ঘুমঘরে কোথাও মাটি নেই। পাথর আর সিমেন্টে ঢেকে গেছে সব কিছু।
– চেতনা বলে যে জিনিসটার কথা বলে আমরা গলা ফাটাই, ওটা আসলে পাথর! সবকিছু ইট সিমেন্ট আর পাথরে ঢেকে দিতে হবে! কোথায় তার মাটির উঠোন, মাটির ঘর আর কবরের মাটি?
আমি ক্ষোভের সাথে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার কবরের দিকে আঙ্গুল তাক করি।
– দেখ রানু, তাদের কবর দুটোরও কোথাও মাটি নেই। সাদা টাইলসের চারপাশে রাশি রাশি নুড়িপাথর ছড়ানো!
– আপা, তারা মাটিতে মিশে গেছেন। তাদের কবর তো সংরক্ষণ করতে হবে? ভালো করে বাঁধাই না করলে তো টিকবে না! এই টাইলস, মার্বেল সিমেন্ট, নুড়িপাথর এসবও স্থায়ী হবে না! মোগল বাদশাহ আর তার পরিজনদের সমাধি দেখেছিস না? মমতাজমহলের কবর, আকবরের সামাধি, হুমায়ুন টোম্ব! তেমন স্থায়ী পাথর দিয়ে বাঁধাই করা দরকার ছিল। আপা, মাটিই তো ভূস্তরের চাপে পাথর হয়!
চৌখুপি আলোর কারচুপির ভেতরে দাঁড়ানো রানুকেও একটা প্রস্তরপ্রতিমা মনে হতে থাকে!
আমরা সাহেরা খাতুন ও শেখ লুৎফর রহমানের জোড়া কবরের পদপ্রান্তে দাঁড়াই।
– আপা, কবরের এই পাথরগুলো পাথর থাকত না। রানু গুনগুন করে ওঠে।
– বঙ্গবন্ধুর মা-বাবাকে তার সন্তান আর পরিবারের এই নির্মম মৃত্যু দেখতে হয়নি। তারা তার আগেই পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছিলেন। নইলে, এই পাথর পাথর থাকত না। গলে যেত। নোনা পানির ধারা বয়ে যেত।
আমাদের চোখ থেকে উষ্ণ অশ্রুকুচি ঝরে যেতে থাকে। আমরা বাধা দিই না।
– দেখ রানু, ঠিক যেমন করে জন্মের পরে খোকা মায়ের কোলে তার শাড়ির ওমের ভেতর মা-মা গন্ধে বিভোর হয়ে ঘুমিয়েছিলেন তেমন করেই তিনি তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত রেড ক্রিসেন্টর রিলিফের সাদা শাড়ির কাফন জড়িয়ে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে আছেন!
– খুনি মোশতাক ভয় পেয়েছিল খুব, তাই বলেছিল, গ্রেভ হিম এনিহোয়ার বাট নট ইন ঢাকা! এটা শাপে বর হয়েছিল আপা! টুঙ্গিপাড়া এখন বাংলাদেশের হৃদয়।
বাংলাদেশের হৃদপি-ের ধুপধুপ শব্দ আমাদের হার্টবিটে ধ্বনি তুলতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সংস্কার করা হয়েছে।
ত্রিতল বাড়ির বহির্দেয়ালে তার বিশাল পেইন্টিং। রানু খুব কাছে দাঁড়িয়ে চিত্রটি দেখছে। ওর পিঠের ওপর বিছিয়ে আছে পতাকা। পতাকা এবার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। গ্রিল দিয়ে ঢাকা পুরো বারান্দা। রানু আমার দিকে নীরব প্রশ্ন আঁকা চোখ রাখে।
হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে দাফনের অনুমতি পাওয়ার পর এই বাড়ির বারান্দায় রাখা হয়েছিল তার কফিন? কোন বারান্দায়? কেমন ছিল তখন বারান্দা? ঠিক কোন জায়গার মাটি বুক পেতে দিয়েছিল জাতির মহান এক পুরুষের বুলেট ঝাঁঝরা মরদেহ বুকে ধরে রাখা কফিনটির জন্য? কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন রেডক্রস অফিসের পিয়ন রজব আলী, মৌলভী শেখ আবদুল হালিম, সোনা মিয়া, ইমান উদ্দীন গাজী, কাজী মো. ইলিয়াস হোসেন, গেদু মিয়া সোহরাব মাস্টার! কফিন খোলার জন্য হাতুড়ি বাটাল হাতে দাঁড়ানো দশ বছর বয়সী বালক আইউব আলী তার পিতা হালিম শেখের হাত ধরে কাঁপছিলেন ঠিক কোন জায়গায়? ইদ্রিস আলী দৌড়ে গিয়েছিলেন আশরাফ মোল্লার দোকানে, আর একটা ৫৭০ সাবান কিনে নিয়ে এসেছিলেন তার অমর দেহটি ধোয়ানোর জন্য! সাবান হাতে কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি? ক্ষারের গন্ধ আর ফেনামাখা পানি উঠোনের কতদূর ছড়িয়ে পড়েছিল? গোসল করানোর সময় তার ঝাঁঝরা দেহ থেকে গুলিগুলো বের হয়ে আসছিল। তারা সেখানে বসেই ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন! কোথায় বসেছিলেন?
– হায়! আহা! কেন! আটাশটি গুলি তার দেহ ঝাঁঝরা করেছিল। সেসব তার সমাধিতে রয়ে গিয়েছে!
– এগুলো মহাকালের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আপা! তার দেহ ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকা-ের দলিল! রানু ঘুরে দাঁড়ায়। আমার দিকে তাকায়। বলে, আপা, চোখ মোছ। আমরা কেউ তখন কাঁদিনি! আমরা প্রতিবাদ করিনি! আমরা পাপী! আমাদের চোখে এখন খেজুরকাঁটা বিঁধিয়ে দেওয়া দরকার!
– আমরা তখন ছোট ছিলাম। বালিকা। নাবুঝ।
– আপা, আমাদের অনেক বুঝমান বড়রা ছিলেন। কিন্তু আমরা ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের ঘর থেকে তার ছবি নামিয়ে ভেঙে ফেলা হলো, সেটুকুরও প্রতিবাদ করিনি আমরা। আমরা এই সাহসী মানুষটির কেঁচো উত্তরসূরি আপা!
– ঐ যে আদিবাড়ি! তার পূর্বপুরুষ থাকতেন যে বাড়িতে। তারা সাহসী ছিলেন। দরদি ছিলেন।
রানুর পেছন পেছন আমি হাঁটি। রানুই আমাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে যেন।
আমাদের সামনে বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক ভিটা! লাল ইটের একতলা দালান। টানা বারান্দা। জোড়া জোড়া খিলান। মাঝখানে একটা তোরণ। গথিক স্থাপত্যরীতির গোল থাম। আমার শরীরে শিহরণ জাগে। এখানে শিশু খোকা দৌড়াদৌড়ি করত। বালক খোকা লাফিয়ে নামত উঠোনে। তারপর আর এক দৌড়ে হিজলতলা ঘাটে! বাইগার নদীতে লাফলাফি!
– চল রানু, ভেতরে ঢুকি।
– ঢোকা যাবে? রানু এদিক-ওদিক তাকায়।
– হ্যাঁ, খোলাই তো। টুঙ্গিপাড়ার মেয়রের সৌজন্যে স্থাপিত সাইনবোর্ডটা ভালো করে পড়ি।
– নাহ! কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
জরাজীর্ণ টানা বারান্দা। ধুলোময়লায় ঢাকা। এক পাশে এক বোঝা নারকেল পাতা কেটে স্তূপ করে রাখা। কয়েক কাদি ডাব। এসব নিশ্চয়ই ডাবওয়ালাদের মাল। দর্শনার্থীদের জন্য ভ্যানে করে ডাব বিক্রি হচ্ছে। বারান্দার আর এক পাশে শুকনো ডালপালা ইত্যাদির শেষ প্রান্তে ওগুলো কী! রানু, দেখ তো!
আমরা ভালো করে দেখি। স্তূপ করে রাখা আছে একটি লাশবাহী খাট আর তিনটি কাঠের কফিন। লাশবাহী খাট আর একটি কফিন অনেক পুরনো। বাকি দুটি কফিন অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল।
– এসব কফিন কাদের? এখানে কি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কারও কফিন আছে?
– তাই হবে আপা!
– এমন অযতেœ ফেলে রাখা হয়েছে কেন?
– হয় তো পরে সংরক্ষণ করা হবে!
– আপা, বঙ্গবন্ধুর কফিনটা কিন্তু এখানকার জাদুঘরে রাখা আছে। জাদুঘর দেখার জন্য সময় রাখতে হবে হাতে!
– আমরা কি সেটা ছুঁয়ে দেখতে পাব?
– আপা, ওটা সাধারণের স্পর্শের আওতায় নিশ্চয়ই থাকবে না।
– হুম, সংরক্ষিত থাকবে। কাচের বাকসে। যাতে দর্শনার্থীরা দেখতে পায়।
আদি বাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়ালগুলো আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অনেক দূরে। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল শেখ পরিবার। শতাব্দীপ্রাচীন সীমানা দেয়ালগুলোর খিলান আর ভেতরে ইটের নকশা এখনও খানিকটা অক্ষত আছে। আমরা ইটের পাঁজর খুলে খুলে আটকে থাকা বাতাসের স্পর্শ নিতে চাই।
– দেখ রানু, ইটগুলো কেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে! এগুলো তো সব এদিক-সেদিক চলে যাবে। ঐ যে, প্যাক-কাদার ওপরে পা রাখতে কয়েকটা ব্যবহার করা হয়েছে! অথচ এক-একটা ইট এক একটা ইতিহাসের খ-!
– আপা, আমরা ইতিহাসের ইটের খ-ের পরিণতি দেখে কাতর হই। অথচ ইতিহাস বিকৃতির জন্য কিছু করতে পারি না। দিনের পর দিন স্কুল-কলেজে ছাত্রদের আমরা ভুল ইতিহাস আর বিকৃত তথ্য পড়াতে বাধ্য হয়েছি!
রানু বিড়বিড় করে আরও কী বলে শুনতে পাই না।
একটি অপরিসর পথ বেয়ে আমরা হিজলতলা ঘাটে পৌঁছে যাই। সামনে বয়ে যাচ্ছে চওড়া জলধারা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খাল। কিন্তু বয়ে যাচ্ছে অন্তস্রোত। সে স্রোতে দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে কচুরিপানা আর কলমি দামের ঝোপ। ওগুলো আমাদের সামনে দিয়ে আপনমনে চলে যায়। কাটা ধানের আঁটি বোঝাই একটা নৌকো যাচ্ছে। ওপাড়ে বাঁধানো সড়ক দিয়ে চলে যায় স্কুটার মোটরসাইকেল রিকশা আর পথচারি। যানবাহনের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। স্তব্ধতার মধ্যে আমরা দামাল কিশোর খোকার লাফানো ঝাঁপানো আর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দুরন্ত সাঁতার কাটার শব্দ শোনার দৃশ্য কল্পনা করি। রানু টিফিন বক্স খুলতে খুলতে বলে, আপা এটাই কি বাইগার নদী? এটা তো মনে হচ্ছে খাল! তবে স্রোত আছে। নিশ্চয়ই নদীর সাথে যুক্ত এই খাল!
– এটাই বাইগার নদ! পাড় বাঁধানো বলে খাল মনে হচ্ছে।
– কিন্তু ঘাট কোথায়? আর হিজল গাছ?
রানু এক পিস স্যান্ডুইচ হাতে নিয়ে একটা পুরনো গাছের শেকড়ে বসে। আশপাশে আরও বড় বড় পুরনো গাছ। সিমেন্টের বাঁধানো পাড় ছাড়া বাকিটা সরল গ্রাম্য প্রকৃতি।
আমি স্যান্ডেল খুলে ফেলি। আহ! এখানে মাটি আছে। বঙ্গবন্ধুর শৈশবের মাটির কণা আছে না এখানে? হিজল গাছ কোনদিকে? বন্য ঝোপে জায়গাটা ঘিরে আছে।
রানুও স্যান্ডেল খোলে।
– পা ভেজাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই আঘাটায় নামতে পারব না রে আপা, পায়ে জোর নেই। পিছলে পড়লে সর্বনাশ।
– ঘাট নেই, অথচ লেখা আছে হিজলতলার ঘাট!
– আপা ঘাট হবে! ঐ যে বসার জন্য সø্যাব করা হয়েছে। আরসিসি ব্লকও রাখা আছে কয়েকটা। কাজ চলছে। ধীরে ধীরে বাঁধানো ঘাট হবে। হিজল গাছও লাগানো হবে। গোড়া বাঁধাই করে দেওয়া হবে। তখন বসতে আরাম হবে। যদি বেঁচে থাকি আবার আসব।
– তখন ঘাটে বসে পা ভেজাবি?
– আপা দেখ, ঐ যে!
রানু পা ভেজানোর কথায় পা দেয় না। আমাকে একটু দূরে একটা জায়গা নির্দেশ করে।
সিমেন্টের সø্যাবটার পেছনে একটা বড় ঝাঁকড়া-মাথা গাছের গোড়ায় একজন বৃদ্ধা বসে আছেন। চারদিকে উঁচু হয়ে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন শেকড়। তারই একটাতে বসেছেন বৃদ্ধা। তার পরনে ধূসর সাদা থান। ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল। নাকের গোড়া থেকে কপালের মাঝ বরাবর পর্যন্ত শ্বেতচন্দনে আঁকা রসকলি। গলায় তিন-চার প্যাঁচ দেওয়া রুদ্রাক্ষ। কাঁধে একটা লাল রঙের গামছা। সব মিলিয়ে তাকে মনে হয় উদ্যানের ভাস্কর্য। কিন্তু, এ জায়গাটি উদ্যান নয়। আদিম প্রকৃতি। অকৃত্রিম জঙ্গল। পুরনো গাছ। অজস্র ঝরাপাতা। কেঁচোর লাঙল দেওয়া মাটি। বৃদ্ধা আমাদের টানে।
আমাদের দেখে তিনি সহজ-চোখে চেয়ে থাকেন। কিছু বলেন না।
আমরা আলাপ জমাই।
– গোসল করতে এসেছেন? মানে স্নান?
তিনি প্রবহমান জলধারার দিকে চেয়ে থাকেন। বিড়বিড় করে কী একটা সুর তোলেন।
আমরা তার দুপাশে বসে পড়ি। বলি, আমরা দুই বোন। বঙ্গবন্ধুর সমাধি দেখতে এসেছি। তাতে তার তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না।
– আপনি এখানেই থাকেন? এ বাড়িতে?
তিনি এবার মাথা নাড়ান। না!
– তাহলে?
– উই উদিকে। বৈষ্ণবীর ভিটায়। ঐ যে কচুবন, কলাবতীর ঝোপ!
– বৈষ্ণবীর ভিটা? ওখানে আপনার বাড়ি?
– বাড়ি কই! পোলাডার কুইড়াঘর। শ্যাখের পোলা মজিবরে যেই বচ্ছর মরলো, হেই বচ্ছর অইল আমার পোলাডা। পোলাডার একটা কুইড়াঘর। গরিব মানুষ। আর কেউ নাই।
-তাই? কী নাম আপনার ছেলের?
– পোলাডার একটা কুইড়াঘর। গরিব মানুষ। আর কেউ নাই। একই কথা আবার বলেন বৈষ্ণবী।
– এখানে বসে কী করছেন?
– কিছু করি না। জল দেখি। জল আসে জল যায়। জল ধুইয়া নেয় জলের লেখন।
– আপনি গান জানেন?
বৈষ্ণবী আমাদের দিকে একটু চেয়ে থাকেন। এরপর চুপচাপ উঠে দাঁড়ান। গামছায় মুখটা মুছে নিয়ে ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে কলাবতী কুটিরের দিকে হাঁটতে থাকেন।
– আপা, আমরা তাকে বিরক্ত করেছি। আমাদের অপরাধ হয়েছে।
– আলাপ জমাতে চেয়েছিলাম। আমাদের বয়সীই তিনি। এখানকার মানুষ হলে বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের কাউকে দেখে থাকতে পারেন। জানতে চাচ্ছিলাম।
– আপা, আমরা গবেষণা করতে আসিনি। এসব বাদ দে।
– হুম। তিনি ভাবজগতের মানুষ। তার ধ্যানে বিঘœ ঘটিয়েছি।
বৈষ্ণবীর অপসৃয়মাণ দেহ কলাবতীর আড়ালে চলে গেল।
বেলা পড়ে আসছে। আমরা দ্রুত জাদুঘরের দিকে যাই। জাদুঘর লাইব্রেরি গবেষণাগার ক্যাফেটারিয়া সুভেনির শপ এসব মিলিয়ে বহিরাঙ্গনে আর একটি কমপ্লেক্স। আমরা এবার সেখানে যাব।
সমাধি চত্বরটি পেরুবার মুহূর্তে চোখে পড়ে দেয়ালে উৎকীর্ণ অন্নদাশংকর রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার চার লাইন। রানু মনোযোগ দিয়ে পড়ে।
– আপা, এটা অন্নদাশংকর রায়ের লেখা না?
-হুম। ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতার প্রথম চার লাইন।
– কিন্তু এটা ‘যতকাল’ ‘ততকাল’ ছিল না? এখানে ‘যতদিন’ ‘ততদিন’।
– কবি পরে শব্দ দুটি পরিবর্তন করে যতদিন ততদিন করেছিলেন।
রানু বিড়বিড় করে। এখানে কবি আর কবিতার নাম নেই! বুঝেছি কেন নেই…।
– এটা আর কবিতা নেই। এটা সেøাগান। জয়কার।
এ-কথা শুনে রানু আবার কবিতামুখী দাঁড়ায়। আর একবার পড়ে পঙ্ক্তিগুলো।
আমি ‘পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা’ ঠোঁটে তুলে হাঁটতে থাকি। রানুও গলা মেলায়।
আমাদের যুগল কণ্ঠ উচ্চ হয়। দুটি কিশোরী আমাদের পাশে দৌড়ে আসে। ওরাও গলা মেলায়। তিনজন যুবক আর একজন নারী আমাদের দলে ভিড়ে যায়। এরপর কয়েকজন অবাক বর্ষীয়ান, কতিপয় স্থানীয় মুসল্লি আমাদের সাথে পঙ্ক্তিযাত্রা করেন।
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান…। যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা…
– আপা!
রানু হঠাৎ সেøাগান থামিয়ে আমাকে ডেকে ওঠে। দেখি আমাদের সামনে সেই বৈষ্ণবী! যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে। তাকে একটু আগেই আমরা রেখে এসেছিলাম বাইগার নদের ধারে। কলাবতী কুঞ্জের পথে হাঁটছিলেন তিনি। এত দ্রুত এখানে কীভাবে এলেন! বৈষ্ণবীর ঠোঁট ছন্দায়িত। যেন বলছে শ্যাখের পোলা মজিবর…। শেখ মুজিবুর রহমান…
তবে বোষ্টমীর জয়কার ধ্বনি আলাদা। সেখানে মাটির সুর। গুনগুনানি। কুটিরের বিলাপধ্বনি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক