বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, পশ্চাদপদ মূল্যবোধ, মাদক এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ আমাদের গড়ে তুলতেই হবে।
গালাম কুদ্দুছ: বঙ্গবন্ধু-কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপাদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি। জন্মসূত্রে কিংবা ভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাঙালি হওয়া গেলেও খাঁটি বাঙালি হওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না। শাশ্বত বাঙালির নীতি-আদর্শ, মূল্যবোধ, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং জীবনবোধকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে একজন মানুষকে এগোতে হয়। মানবিকবোধ, সম্প্রীতির বন্ধন, দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করার দুরন্ত সাহসই একজন বাঙালিকে খাঁটি বাঙালিতে পরিণত করতে পারে। শেখ হাসিনা সেই খাঁটি বাঙালিদের একজন। পারিবারিক আবহে বাঙালিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। পিতা বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত শেখ হাসিনার পুরো পরিবারটাই তো বাঙালি সংস্কৃতির আবহে সমৃদ্ধ। রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চাকে ধারণ এবং লালন করেছে এ পরিবারটি। রবীন্দ্র-নজরুলের আদর্শে প্রভাবিত বঙ্গবন্ধু লোকসংগীত, গম্ভীরা, ব্রতচারী নৃত্য, ছবি আঁকা, চলচ্চিত্র পছন্দ করতেন এবং এর বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ এবং ভালোলাগাগুলোকে আত্মস্থ করেছেন। ব্যক্তি-জীবনে শেখ হাসিনা সুলেখিকাÑ আমরা সকলেই জানি। সংগীত-অনুরাগী তো বটেই। গলায় সুর যে আছে নিকটজনরা তাও জানেন। বাংলা নববর্ষ, ছায়ানটের অনুষ্ঠান, বইমেলা, নাটক দেখা, গান শোনা, চলচ্চিত্র এবং ছবি প্রদর্শনীতে হঠাৎ উপস্থিত হওয়া তার জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। পরিবারের আবহের কথা বলছি এ কারণে যে, ছোট ভাই শেখ কামাল নাটক করতেন, গানের দল করেছেন, ক্রিকেট খেলতেন, আরও কত কী। শেখ জামাল যে ছবি আঁকতেন, তা তো বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই থেকে আমরা জানি। শেখ রেহানা যে চাইলে ভালো কণ্ঠশিল্পী হতে পারতেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে তার স্বল্প উপস্থিতির গায়কীতে তা স্পষ্ট।
অনেক দুঃখ-কষ্ট-বেদনার পর শেখ হাসিনা যখন জনরায়ে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পেলেন, তখন তার সামনে প্রচুর কাজ। মুক্তিযুদ্ধের পথে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, জনজীবনের সংকট দূর করা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি চেতনার জাগরণ সৃষ্টি করা। অনেক ষড়যন্ত্র এবং প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে তাকে সামনের দিকে এগোতে হচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এবং তার দর্শনে সংস্কৃতি যে গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। আলোচ্য নিবন্ধে সংস্কৃতিক্ষেত্রে তার কিছু ভূমিকা উল্লেখ করতে চাই।
১. সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পুনঃস্থাপন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র ’৭২-এর সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। ‘বাঙালিত্ব’ যে রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধান থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা নির্বাচনে সংবিধান সংশোধনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ২০১১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, জিয়া যে ধর্মনিরপেক্ষতা কেটে দিয়েছিলেন, তা’ও তিনি সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেন। একইসাথে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়।
২. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
এ-কথা আমরা সকলেই জানি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসনামলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়ে ধর্মঘট করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বাহান্নের ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করায় নানা পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম জাতিসংঘে ভাষণ প্রদান করেন এবং সেই ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন বাংলা ভাষায়। ১৯৯৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত শেখ হাসিনা যতবার জাতিসংঘে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রতিবারই পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। শেখ হাসিনা শুধু বাংলায় ভাষণ দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন। আমরা আশা করি, শেখ হাসিনার এ প্রস্তাব একদিন বাস্তবায়িত হবেই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবেদনের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর এক ঘোষণায় ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালি জাতির জন্য এ এক গৌরব আর মর্যাদার বিষয়। এখন থেকে পৃথিবীর সকল দেশের সকল জাতির মানুষ মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মদানকে স্মরণ করে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে ভালোবাসবে, চর্চা করবেÑ এটাই হলো একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শিক্ষা।
৩. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
২০১০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার সরকার ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার কতগুলো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সেগুলো হলো-
(১) দেশ ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ;
(২) পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষা ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ভাষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা;
(৩) বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ;
(৪) বিভিন্ন ভাষা বিষয়ে অভিধান ও কোষ-গ্রন্থ প্রকাশ এবং হালনাগাদকরণ;
(৫) বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার লেখ্যরূপ প্রবর্তন;
(৬) পৃথিবীর সকল ভাষার বিবর্তনবিষয়ক গবেষণা, গবেষণা জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন;
(৭) ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষা;
(৮) বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালন;
(৯) পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস, নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন;
(১০) ভাষা বিষয়ে জাদুঘর নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা।
৪. আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, মঙ্গোলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করায় এটি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। সে-কারণে এ সম্মেলনকে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়।
২০১১ সালের ২৬ জুন শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলা একাডেমি আয়োজন করে ‘দক্ষিণ এশিয়ার সমকালীন সাহিত্য’ বিষয়ে তিন দিনের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে ২০১৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’ নিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশি লেখকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জার্মানির সাহিত্যিক হান্স হার্ভার, ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো এই বাংলা একাডেমিতেই আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। যার উদ্বোধক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন যে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক।” ২০১৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে, তা আজও অব্যাহত আছে।
৫. লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন
লোকঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির প্রতি শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। আজও নববর্ষের মেলা বা চৈত্র সংক্রান্তিকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত আগ্রহ ফুরিয়ে যায়নি। তপ্ত রৌদ্রে মেলায় ঘুরে ঘুরে সামগ্রী দেখা এবং ক্রয় করাও তার জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা সকলে জানি, বঙ্গবন্ধু লোকঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে লালন, বিকশিত করা ও বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ঐতিহাসিক সোনারগাঁওতে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের মানুষটি ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর এই ফাউন্ডেশনের কাজও সীমিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৯৮ সালের ৬ মে জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আইন, ১৯৯৮’ পাস করেন। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কার্যাবলি নিম্নরূপ :
(১) ঐতিহাসিক লোক ও কারুশিল্প সংরক্ষণ করা;
(২) কারুশিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা;
(৩) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা;
(৪) নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত সোনারগাঁওয়ে একটি শিল্প গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা;
(৫) লোক ও কারুশিল্প বিষয়ে গবেষণা এবং গবেষণাবিদ, তত্ত্ব ও তথ্যাদির প্রকাশনার ব্যবস্থা করা;
(৬) লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শনাদির সংরক্ষণ এবং ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পে উৎসাহ প্রদান;
(৭) লোক ও কারুশিল্প উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;
(৮) লোক ও কারুশিল্পের গবেষণায় নিয়োজিত যে কোনো ব্যক্তি ও সংস্থাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা;
(৯) লোক ও কারুশিল্প উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে সরকারকে সাহায্য করা এবং তৎসম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ প্রদান;
(১০) সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক লোক ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই বিষয়ে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা;
(১১) উপরোল্লিখিত কার্যাদির সম্পূরক
ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য কাজ করা।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে দুটি লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর রয়েছে। এ দুটি হলো-
১. লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর;
২. শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর।
শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর
১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। এ জাদুঘরে ৩টি গ্যালারি রয়েছে।
(ক) নিচতলায় নিপুণ কাঠখোদাই গ্যালারিতে কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে কাঠ থেকে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি ও বিক্রির সামগ্রীর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া আকর্ষণীয়ভাবে চারুশিল্পের কর্মপরিবেশ ও বিপণন চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
(খ) দ্বিতীয় তলায় জামদানি, নকশিকাঁথা গ্যালারিতে সোনারগাঁওয়ের তৈরি ও ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় নকশিকাঁথা প্রদর্শন করা হয়েছে। সে-সঙ্গে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বয়নশিল্পের কর্মপরিবেশ ও বিপণন চিত্রে তুলা থেকে বস্ত্র তৈরির সামগ্রিক ধারাবাহিক চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে।
(গ) তৃতীয় তলায় তামা-কাঁসা-পিতলের নিদর্শন ও লোকজ অলঙ্কার প্রদর্শিত হয়েছে।
৬. প্রত্নতাত্ত্বিক খনন
আমাদের এ অঞ্চলে প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতির বৌদ্ধবিহারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতœতাত্ত্বিক খননের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য ও প্রাচীন সভ্যতার উন্মীলনের জন্য শেখ হাসিনার সরকার সব সময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের সহায়তায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন ২০১০ সালে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রঘুরামপুরে প্রতœতাত্ত্বিক খনন শুরু করে। ২০১২-১৩ সালের মধ্যে এখানে একটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়। অতীশ দীপঙ্করের জন্মভিটার ৫০০ গজের মধ্যে ‘বিক্রমপুরী বিহার’ নামে নবম-দশম শতাব্দীর এই বিহারটি আবিষ্কৃত হয়। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১৩-১৪ সাল থেকে মুন্সিগঞ্জের নাটেশ্বর দেউলে খননকাজ শুরু করে। ৫ মিটার গভীরে যাওয়ার পর এখানে ৮টি স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এ আবিষ্কারকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলা হচ্ছে। এবারের আবিষ্কারসহ নাটেশ্বরে পঞ্চমবারের মতো অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ পাওয়া গেল। প-িত অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি নাটেশ্বর দেউলে আবিষ্কৃত প্রতীকী স্থাপত্যগুলো দেখে মনে হয়, প্রায় ১১০০ বছর আগে বিক্রমপুরে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করেছিল। যে অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেহাবশেষ সমাহিত করা হতো। এগুলোকে মন্দিরও বলা হতো।
উয়ারী বটেশ্বর খননকাজ
প্রাচীন সভ্যতার আরেকটি নিদর্শন আবিষ্কৃত হলো উয়ারী-বটেশ্বরে। উয়ারী-বটেশ্বর হলো নরসিংদী জেলার বেলাবো থানার দুটি গ্রামের নাম। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর জানা যায়, এখানে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে এই দুই গ্রামে আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা। ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগের সাথে শেখ হাসিনার সরকারের সহায়তায় ২০০০ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ ব্যাপকতর হয়। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত ধাতব অলঙ্কার, স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, চুন-সুরকির রাস্তা, ইট নির্মিত স্থাপত্য, দুর্গ প্রভৃতি একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার পরিচয় বহন করে। ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা এবং নয়নাভিরাম বাটখারা বাণিজ্যের পরিচায়ক। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল উয়ারী-বটেশ্বর নৌবন্দর।
৭. শিল্পচর্চায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন
মঞ্চ নাটক ও সংস্কৃতির নানা শাখার একান্ত অনুরাগী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংস্কৃতি বিকাশের জন্য নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর মঞ্চ নাটকের জন্য শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় নাট্যশালায় ৩টি মিলনায়তন ও কয়েকটি মহড়া কক্ষ নির্মাণ করেন। নাটক মঞ্চায়ন এবং নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এই হলগুলো ব্যবহার করা হয়। তিনি মঞ্চ নাটক প্রসারে প্রতিবন্ধক ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করেন। জাতীয় চিত্রশালাতে আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে এখানে একটি আধুনিক মিলনায়তনও নির্মিত হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে নির্মিত হয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যের উন্মুক্ত মঞ্চ ‘নন্দন’।
বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক মিলনায়তন। গুলিস্তানে নির্মিত হয়েছে ‘মহানগর নাট্যমঞ্চ’ এবং সূত্রাপুরে ‘জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স’। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমি’র বটতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে নান্দনিক স্থাপত্যের বহুতল ভবন নির্মিত হয়। ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ভবনের উদ্বোধন করেন। নতুন এ ভবনের নামকরণ করা হয় জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ-র নামে। এই ভবনে দুটি মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়। একটি হলো আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন এবং আরেকটি কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তন।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী বাঙালির মননবিকাশের অন্যতম সূতিকাগার হলো বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা। বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ফলে এই মেলা বর্তমানে একাডেমি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েছে।
৮. সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিল্পীদের পাশে শেখ হাসিনা
’৭৫-পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীদের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করা যায়। শুধু হাতেগোনা আজ্ঞাবহ কয়েকটি সংগঠনকে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা হতো। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মূলত সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং অসচ্ছল শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলোÑ প্রকৃত সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিল্পীরা যাতে অনুদান পায়, তার জন্য বাছাই কমিটিতে জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনসমূহের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেড় হাজার সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতি বছর ৩০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান পেয়ে থাকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ব্যতীত অন্যান্য জাতীয়ভিত্তিক ফেডারেশনসমূহ তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে সম্মানজনক বার্ষিক অনুদান গ্রহণ করে থাকে।
প্রায় ৫ হাজার অসচ্ছল শিল্পী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে মাসিক ১৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান পেয়ে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আংশিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
তৃণমূল পর্যায়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে উপজেলা প্রশাসনকে ৫০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়। প্রতি বছর বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি উৎসব এবং বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পদক প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদকে ২ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত প্রদান করেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়া ২০ শতাংশ হারে বৈশাখী ভাতার প্রচলন করেছে। সংস্কৃতির প্রসার ও শিল্পীকল্যাণের জন্য শেখ হাসিনা ‘শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ‘সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন। সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদানের হার ও সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। এফডিসির উন্নয়নের জন্য বহুমুখী কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়।
অসুস্থ শিল্পীদের চিকিৎসার সহায়তায় তার উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ভরসার স্থল। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বরেণ্য শিল্পীদের জন্য হস্ত প্রসারিত করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদ-প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক, দেশের বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফের ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য তিনি ২৫ লাখ টাকা প্রদান করেন। করোনাকালীন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিপন্ন সংস্কৃতিকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের সাহস জুগিয়েছেন।
প্রকৃত অর্থে শেখ হাসিনা আপাদমস্তক বাঙালি সংস্কৃতির এক পূজারি। তার ব্যক্তিগত আগ্রহে সংস্কৃতিক্ষেত্রে অনেক অর্জন হলেও আমাদের যেতে হবে আরও বহুদূর। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, পশ্চাদপদ মূল্যবোধ, মাদক এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ আমাদের গড়ে তুলতেই হবে। এ জাগরণের একমাত্র কা-ারি হতে পারেন শেখ হাসিনা। তার শিল্প-ভাবনা, মানবিকবোধ এবং দেশপ্রেমই পারে সকল অপর্যাপ্ততাকে দূর করে সংস্কৃতির জাগরণকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে। জয়তু শেখ হাসিনা। আপনার জন্মদিন আমাদের জন্য মঙ্গলের বার্তা।
লেখক : গবেষক ও ফেলো, বাংলা একাডেমি