শেখর দত্ত
এক
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার ৪২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১৭ মে সমাগত। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার ১৭ দিন আগে ২৯ জুলাই শেখ হাসিনা তার স্বামীর সঙ্গে পুত্র-কন্যা ও ছোট বোন শেখ রেহানাসহ জার্মানি চলে যান। ফলে সৌভাগ্যবশত তারা বেঁচে যান। দেশ নিপতিত হয় হত্যা-ক্যু আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে। দেশের চরম অনিশ্চিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু-পরিবারের সদস্যদের শতভাগ জীবনের ঝুঁকি থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে। শুরু হয় পরিবারসহ শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্যকবলিত দুঃখ-দুর্দশার প্রবাসী জীবন।
পঁচাত্তরের সেই কালরাত্রির পর ক্ষমতার উত্থান-পতন আর ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়া অস্ত্রের জোরে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে সরিয়ে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেন। ঠাণ্ডা মাথার সুচতুর সেনাশাসক জিয়া যখন মনে করেন নিজের ক্ষমতা সব দিক থেকে নিরাপদ, কুক্ষিগত-নিরঙ্কুশ-দীর্ঘস্থায়ী; তখন তিনি ও তার সহযোগী সেনাচক্র পাকিস্তানি আমলে আইয়ুব খানের মতো হুকুমের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন করে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু করে। দেশ কার্যত ‘মিনি পাকিস্তান’ হয়ে উঠতে থাকে। জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতোই মৃত বঙ্গবন্ধু আরও শক্তিশালী হতে পারে মনে করে তার নাম-নিশানা রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার প্রচেষ্টা চলে। এ অবস্থায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের ঐতিহ্যবাহী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তখন নেতৃত্বশূন্য ও দিক-নির্দেশহীন হয়ে সবদিক থেকে বিপাকে পড়ে। এ অবস্থায় দলকে সামাল দিতে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়।
রাজনৈতিক বিশেষত বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। পিতার আদর্শকে তিনি ধারণ করতেন। প্রবাসে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও পঁচাত্তরের পরাজয়ের পর একাত্তরের রাজনীতি তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে ফিরিয়ে আনতে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই জীবনের সবৈব ঝুঁকি থাকা সত্ত্বে শিশু পুত্র-কন্যাকে প্রবাসে রেখে তিনি দেশে ফিরে দলের হাল ধরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাহসী-দৃঢ়চেতা-দূরদর্শী পিতার কন্যা হিসেবে এই ঝুঁকি নেওয়াটাই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে তার এই সিদ্ধান্ত গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগান্তকারী। শেখ হাসিনার আগমন একাত্তরের পরাজিত প্রতিক্রিয়ার শক্তির আঘাত ও তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রগতির শক্তির ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনাবিন্দু। বঙ্গবন্ধু-কন্যার এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল, তা প্রথমে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
দুই
প্রকৃত বিচারে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে হত্যা করার বিষয়টি কেবল জাতীয় গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ ছিল না। এর সঙ্গে উপমহাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কারণ পাকিস্তানি আমলে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং তারই পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ছিল বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠাণ্ডযুদ্ধ যুগে কেবল বাংলাদেশের জনগণের নয়, মানব সমাজের শান্তি-স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-মুক্তি-প্রগতি তথা মুক্তিসংগ্রামের ফসল।
ক্ষুধা-দারিদ্র্য-শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে মানব সমাজের এই চিরায়ত আকাক্সক্ষা চির বহমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব পরিম-লে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া ও প্রগতির শক্তি যথাক্রমে আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রথম বিশ্ব বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্ব হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে শামিল হয়। এই কালপর্বে পরাধীন দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে এবং মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে অবস্থান নেয়। ভারত বিভক্তির ভেতর দিয়ে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তান তৃতীয় বিশ্বের বাইরে থাকে এবং পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি প্রতিক্রিয়ার কারাগার হয়ে ওঠে। এই দুঃসহ অবস্থার বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য এবং শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
তাই পৃথিবীর বুকে রক্তস্নান বাংলাদেশের জন্ম ছিল জাতীয় ও বিশ্ব পরিম-লে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রগতি ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ ফল। আর এই লড়াইয়ের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতাই ছিলেন না। নবজাত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শূন্য অর্থ ও খাদ্যের ভা-ার নিয়ে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি দিয়ে তিনি দেশবাসীকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে শামিল করেছিলেন।
দেশি-বিদেশি পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীলরা তাই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ছিল- এক. মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী জাতীয় চার নীতিÑ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র থেকে সরিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়া; দুই. দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অর্থনীতির বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ নীতি চালু করে লুটেরা পুঁজিপতি সৃষ্টি করা; তিন. বাংলাদেশকে ও দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে দমন-পীড়ন ও কালিমালিপ্ত করে কোণঠাসা কিংবা ধ্বংস করা এবং সেনাকর্তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শাসন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া; চার. লোভ-লালসা দিয়ে রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ‘ডিফিক্যাল্ট’ করা; পাঁচ. রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে সংহত করা; ছয়. প্রগতির বিপরীতে বিশ্ব প্রতিক্রিয়ার শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগে এই লক্ষ্য-পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছিল কিংবা দেশের অবস্থা কোন্ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল আর তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নিলেই অনুধাবন করা যাবে, তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য। ইতোমধ্যে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪১ বছর শেষ হতে চলল। তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তখন ছিল সাম্রাজ্যবাদ-সমাজতন্ত্রের ঠা-া যুদ্ধযুগ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঘাত-প্রতিঘাতে নব্বইয়ের দশকে সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার একচ্ছত্র-এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা যুগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও এখন বুদবুদে পরিণত হয়েছে। বহুকেন্দ্রিক যুদ্ধোন্মুখ বিশ্ব এখন দৃশ্যমান। দেশে দেশে আজ জাতি ও ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা এবং ব্যক্তিগত লোভ-লালসা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তিত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য বিবেচনায় নিতে হবে।
তিন
জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী তথা বঙ্গবন্ধুসহ লাখ লাখ শহিদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরবেনÑ এটা ছিল দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার কল্পনারও বাইরে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তি তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খুনি মোশতাক আওয়ামী লীগের হয়েই আওয়ামী লীগকে আরও সর্বনাশ করার পথে টেনে নিয়ে যায়। একদিকে ভয় কিংবা লোভ দেখিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মন্ত্রী পদে বসিয়ে নেতৃত্বের বড় অংশকে বিপথগামী ও কলুষিত করে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বস্ত সাথী ও নবীন সহযোগী নেতাদেরসহ তৃণমূলের নেতাদের জেলে নিয়ে এবং অপপ্রচার-মিথ্যাপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত ও হতাশ করে। এভাবে পাকিস্তানি আমল ও মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা নেতৃত্বকে উল্লিখিত দুই পন্থায় শেষ করে খুনি মোশতাক নীলনকশার প্রথম ধাপের সমাপ্তি টানেন এবং ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চ থেকে অপসারিত হন।
একটু খেয়াল করলেই অনুধাবন করা যাবে, খুনি মোশতাক সামরিক আইন জারি করলেও সংসদ বহাল রাখেন এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন না। কিন্তু বিচারপতি সায়েমকে সামনে রেখে সেনাপ্রধান জিয়া ক্ষমতা হাতে নিয়েই সংসদ বাতিল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। সব গুছিয়ে ৯ মাস পর তিনি লাইসেন্স নিয়ে দল করার তথাকথিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেন। ইতোমধ্যে তিনি জাতীয় চার মূলনীতি, মানি ইজ নো প্রবলেমের অর্থনীতি থেকে শুরু করে ধর্মকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অধিকার প্রদানসহ উল্লিখিত লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাকি কাজগুলো ছকমতো অগ্রসর করে নেন। মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রদানকৃত বীরউত্তম উপাধি ব্যবহার করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণীর মর্মমূলে আঘাত করেন।
খুনি মোশতাক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করতে চেয়েছিল; আর জিয়ার সেনাচক্র বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা রাজনীতি থেকে মুছে ফেলার জন্য রাজনীতিতে ‘মৃত বা জীবিত কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভক্তি-বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারা যাবে না’ বলে সামরিক ফরমান জারি করেন। জিয়ার বহুদলীয় রাজনীতির পরিহাস হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো সেই দলকে উল্লিখিত ফরমান মেনে রাজনীতি করার লাইসেন্স পেতে হলো এবং তা পেল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর পর, ৪ নভেম্বর ১৯৭৬। স্বাধীন বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন এমন অবস্থা ছিল যে, বাম-ডান সব দল আছে; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেই।
চার
লাইসেন্স নিয়ে দল করার বাধ্যবাধকতার অর্থ ছিল, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মালিক হচ্ছে সামরিক সরকার। ক্ষমতার পরিচালক হয়ে জিয়ার নেতৃত্বে সেনাচক্র আসলে জনগণের মতামতকে পাত্তা না দিয়ে দেশের মালিকের মতোই আচরণ করতে থাকে। মোশতাক-ওসমানির পছন্দের ফলে সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে বসতে পারলেও তিনি ছিলেন সংসদ নির্বাচনের পক্ষে। রাষ্ট্রপতির এই অবস্থান ক্ষমতালোভী সেনাচক্র সহ্য করেনি। আওয়ামী লীগ অনুমোদন পাওয়ার ১৭ দিনের মাথায় ২১ নভেম্বর জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত, ২৫ দিনের মাথায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ এবং ছয় মাসের মাথায় ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সায়েমকে অস্ত্রের জোরে সরিয়ে দেন। এ-সময়ে ঠা-া মাথায় সুকৌশলে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জিয়া দুটো কাজ করেন।
প্রথমত; বাম-ডানের ভারসাম্যের রাজনীতির ঘোরপেঁচে ফেলে কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে আরও ডান প্রতিক্রিয়াশীল জুজুর ভয় দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দুই রাজনৈতিক দল রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো)-কে খালকাটা বিপ্লব ও জিয়ার প্রতি আস্থাভোটে শামিল করে। আর উগ্রবাম সব সময়ের হয় ডান-প্রতিক্রিয়াশীলের মাসতুতো ভাই। চীনপন্থি সব দল-গ্রুপ কার্যত জিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। জনগণের বিভ্রান্তির মধ্যে নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে একা হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত; পাকিস্তানি আমলের মতো হালুয়া-রুটির টোপ ফেলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে উসকে দেয়। এক্ষেত্রে লোভ-লালসার সঙ্গে জিয়া দুই ইস্যু তথা বাকশাল ও মোশতাকের মন্ত্রিত্বে যোগদানের ইস্যুকে ক্ষমতার ঘুঁটি চালিয়ে ঠা-া মাথায় সুকৌশলে ব্যবহার করেন।
ইতোমধ্যে বাকশাল-পূর্ব কমিটির সভাপতি কামারুজ্জামান নিহত হওয়ার কারণে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জেলে থাকায় সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে কাজ শুরু করে। আওয়ামী লীগকে গুছিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল দলীয় কাউন্সিলের। তাই শুরুতে দলের কাউন্সিল দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করে প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়। শুরু থেকে সভাপতির পদ নিয়ে দলাদলি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। বিশেষত মিজানুর রহমান চৌধুরী এই পদ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
প্রসঙ্গত, ত্রাণমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্যতা ও দুর্নীতির দায়ে বঙ্গবন্ধু তাকে মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। তাই তাকে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে হয় না। এই অপবাদ না থাকার এবং প্রবীণ-নবীন নেতৃত্বের বড় একটা অংশ জেলে থাকার সুযোগ গ্রহণ করতে চান তিনি। কিন্তু সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানী-লোভী হিসেবে চিহ্নিত থাকায় এবং ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের খবর জানাজানি হওয়ায় দলের কাউন্সিলরা তাকে গ্রহণ করেন না। অন্য কোনো নেতাও তখন সভাপতি হিসেবে গ্রহণীয় হন না। সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়েও মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ অবস্থায় ৩ ও ৪ এপ্রিল ১৯৭৭ দলীয় কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিক্রিয়ার মুখে ছাই দিয়ে এ যাত্রায় আওয়ামী লীগ ভাঙন থেকে বেঁচে যায়।
পাঁচ
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশহীন থাকলেও আওয়ামী লীগই ছিল তখন জিয়ার পথের কাঁটা। তাই সামরিক সরকার আওয়ামী লীগকে আরও কোণঠাসা করার জন্য জেল-জুলুম ও অপপ্রচার-মিথ্যাপ্রচার অব্যাহত রাখে। তদুপরি দেশব্যাপী এমন বিরূপ ও উগ্র পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে, যাতে প্রচারসহ বাস্তব কাজে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে না নামতে পারে। এদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য-বিভেদ থাকায় দলটি মাঠে নামতে অসুবিধায় পড়ে। বাস্তবে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি জিয়া নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হওয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের জন্য খালি মাঠ সৃষ্টি করেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল গঠন করেন।
ইতোমধ্যে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক নেতাদের আটকাদেশ বাতিল করতে থাকে। এদিকে সামরিক স্বৈরাচারী সরকার গণতান্ত্রিক মুখোশ পরতে চাইলে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দিতে থাকলে, আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ মুক্তি পান। এ অবস্থায় ৩-৫ মার্চ ১৯৭৮ আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে কাউন্সিলারদের চাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। প্রসঙ্গত, মালেক উকিলও ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। তাই নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করার ক্ষমতা তার ছিল না।
ছয়
২১ এপ্রিল ১৯৭৮ সরকার ঘোষণা করে ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ-সময়ে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল থাকায় আওয়ামী লীগ নিজস্ব প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে নামা সংগত মনে করে না। বাস্তবেও তা কঠিন ছিল। তবে বিনা চ্যালেঞ্জে মাঠ সেনাশাসক জিয়াকে ছেড়ে দেওয়াও সঠিক মনে করে না। ন্যাপ (মো), কমিউনিস্ট পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি ও পিপলস লীগের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে দলকে গুছানোর কৌশল নেয়। প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে ওসমানীকে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী করা হয়।
প্রসঙ্গত, জেনারেল ওসমানী পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে খুনি প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সহযোগী ও সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। তবে জিয়া আমলে তিনি জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের অঙ্গীকারই ছিল গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের গঠন ও জেনারেল ওসমানীকে প্রার্থী দেওয়ার ভিত্তি। তাই বলা যায়, সময়ের প্রতিকূলতা বিবেচনায় আওয়ামী লীগ অনেক ছাড় দেওয়ার কৌশল নিয়ে ঐক্যজোটে শামিল হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব-বিভেদ আরও প্রসারিত ও প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও তার সঙ্গের নেতাদের যেসব এলাকা সফরের এবং কর্মিসভা ও জনসভা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারা তা পালন করেন না। এমন কী দলের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও তিনি বলতে থাকেন, বাকশাল করা ভুল হয়েছিল এবং এই ভুলের জন্য জনগণের কাছে দলের মাপ চাওয়া উচিত।
বস্তুতপক্ষে আওয়ামী লীগ যাতে সংগঠিতভাবে নির্বাচনী কাজে নেমে দলকে গুছাতে এবং জনমতকে পক্ষে টানতে ভূমিকা পালন করতে না পারে, সে-জন্য সরকারের সুতোর টানে পুতুল হিসেবে মিজান চৌধুরী সংগঠনবিরোধী উপদলীয় কার্যকলাপ চালাতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ১০-১৫ জুন কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় মিজান চৌধুরীর কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যে অনড় থাকেন। পরবর্তীতে ১১ আগস্ট মিজান চৌধুরী তার বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে তার নেতৃত্বে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি গঠনের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ (মিজান) নামে দলের জন্ম হয়। ১৭-১৮ আগস্ট আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সংগঠনবিরোধী কাজের জন্য কারণ দর্শাও নোটিস জারি এবং ৪ অক্টোবরের সভায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সাত
স্বাধীনতার পর এটা ছিল আওয়ামী লীগে দ্বিতীয় ভাঙন। প্রথম ভাঙনের নায়ক ছিলেন খুনি মোশতাক। মোশতাকের মতোই মিজান চৌধুরী দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের টানতে ব্যর্থ হয়। মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে দল গঠন করে ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়ে যায়। শুরু হয় মিজান চৌধুরীর আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে ধ্বংসের প্রচেষ্টা। মোশতাক দলকে ব্রাকেটভুক্ত করতে পারেনি। কিন্তু মিজান চৌধুরী দলকে ব্রাকেটভুক্ত করতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগ ( মিজান)-এর সঙ্গে তখন মূল আওয়ামী লীগও (মালেক) নামে পরিচিত হতে থাকে। মিজান চৌধুরী আলাদা দল করার পরও আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলতে থাকে।
সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ছাড়াও সব কয়টি বিরোধী দলেই ভাঙনের খেলা চলে। জাসদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ চলছিল। ইউপিপি দল ভেঙে তিন ভাগ হয়। জেনারেল ওসমানীর জাতীয় জনতা পার্টি অন্তত তিন ভাগে বিভক্ত হয়। মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়। এক কেন্দ্রের দুই দল ন্যাপ (মো) ও কমিউনিস্ট পার্টি তখন দুই দলে পরিণত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মোজাফফর আহমদের সমর্থকরা বের হয়ে ছাত্র সমিতি গঠন করে। মোহাম্মদ তোয়াহার সাম্যবাদী দলে ভাঙন হয়। এসব দলাদলি ও ভাঙনে সেনাচক্র কীভাবে কতটা ‘লম্বা হাত’ প্রসারিত করেছিল, তা বাংলাদেশের রাজনীতির গভীর এক অনুসন্ধিৎসার বিষয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ের পর সেনাচক্রের সরকার তখন সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করে। কারণ হত্যা-ক্যুসহ অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিতে অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে সামরিক শাসনের মধ্যে ফরমান বলে সংবিধান সংশোধনসহ যেসব আইন জারি হয়েছে, সেসব জায়েজ করার জন্য সংসদ একান্তভাবেই প্রয়োজন ছিল। তদুপরি সামরিক কর্তাদের শাসনকে বেসামরিক গণতান্ত্রিক মুখোশ পরানোর জন্য প্রয়োজন ছিল রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। বাস্তবে সরকার আওয়ামী লীগ বিভক্ত না করে সংসদ নির্বাচনে যেতে ভরসা পাচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের ভাঙন ঘটিয়েই সরকার জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল’কে বিলুপ্ত করে। ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন করা হয়। সামরিক আইনের মধ্যে ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে ক্যান্টনমেন্টে বসে জিয়া পাকিস্তানি আমলে আইয়ুব খানের মতোই দল গঠন করে।
আট
১ ডিসেম্বর জিয়া নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর প্রধান পদ পাকিস্তান প্রত্যাগত লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ছেড়ে দেন। এই নিয়োগকে বলা যেতে পারে ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিশোধ। এর ভেতর দিয়ে জিয়া অন্য এক সেনাপ্রধানকে দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে টেনে আনার পথ রচনা করেন। এদিকে সংসদ অধিবেশন সামনে থাকা সত্ত্বেও সরকার ১৫ ডিসেম্বর সামরিক ফরমানে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী অধ্যাদেশ জারি করে। এতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে তখন পর্যন্ত সব হত্যা-ক্যু, সামরিক ফরমান আদেশ ও আইন, যুদ্ধাপরাধীদের দল করার অধিকার বৈধ হয়ে যায়। তবে এটা সাংবিধানিকভাবে জায়েজ করার জন্য তখনও প্রয়োজন ছিল সংসদ নির্বাচন ও সংসদ কার্যক্রমের প্রহসন নাটক।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। এই নির্বাচনে বিএনপি পায় ২০৭টি আসন ও ৪১.১৭ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন ও ২৪.৫৭ শতাংশ ভোট এবং মুসলিম লীগ-ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ জোট ২০টি আসন ও ১০.০৭ শতাংশ ভোট। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপট মিলিয়ে বিএনপির ভোট ও আসন প্রাপ্তি অনেকটা বাড়তি ছিল। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৫.১০ শতাংশ ভোট। এ অবস্থায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি নানাভাবে এমন প্রচার চালাতে থাকে, আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে পাকিস্তানের মুসলিম লীগের মতো। বাস্তবে তেমনটা বলার মতো অবস্থা হতে যাচ্ছিল।
হুকুমের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট দিয়ে প্রথমেই ইতোপূর্বে জারিকৃত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এই আইন পাসসহ জিয়া সরকারের সব কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ নামটাই কেবল থাকে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশ কার্যত ‘মিনি পাকিস্তান’ হয়ে যায়। এ-সময়ে এসে এই সংশোধনী পাসের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের একাংশ বাস্তবায়িত হয়। ইতোমধ্যে বুঝতে পারা যায় যে, মিজান লীগ আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই আওয়ামী লীগকে ভেতর থেকে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস করার প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের পর দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া আরও বেগতিক আচরণ করতে থাকে। ঘুষ-দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। জনজীবনে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ তখন কখনও এককভাবে আবার কখনও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামে। কিন্তু একদিকে দমন-পীড়ন আর অন্যদিকে দলীয় বিভেদের ফলে তা তেমন প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় না। এদিকে সেনাচক্র ক্ষমতার টোপ দিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিএনপিতে নেওয়ার কার্যক্রম জোরদার করে। যোগদান নাটক চলতে থাকে। এরই মধ্যে আসে ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ দলের কাউন্সিল।
নয়
আওয়ামী লীগ কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কোন্দল ও দলাদলি। এই গোলযোগের কতটা সরকারের ঘুঁটির চাল, কতটা নেতাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার টানাপোড়ন, তা গভীর অনুসন্ধিৎসার দাবি রাখে। ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংঘর্ষের ফলে অফিস তছনছ হয়ে যায় এবং কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন ইউসুফ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৮ জানুয়ারি অফিসের সামনে দুই গ্রুপের শোডাউন হয় এবং সারাদিন লাঠালাঠি চলে। ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দুজন এবং ছাত্রলীগের কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী যুবলীগের কংগ্রেস দলাদলির কারণে স্থগিত ঘোষিত হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হৈচৈ ও বাদবিবাদের মধ্যে পাল্টা দুটো কমিটি ঘোষিত হয়।
স্বাধীনতার পর দুবার দুই ধরনের ভাঙনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হবে যে, ওই দুই ভাঙন হয় উপরিতলায়, কেন্দ্রে। কিন্তু এবারের গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূলে। আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এমন বিপাকে দলটি আগে আর পড়েনি। ১৪ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশন শুরুর ভাষণে সভাপতি মালেক উকিল দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার আহ্বান জানান। প্রবাসে থেকে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এক বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকুন। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলে সেøাগান-পাল্টা সেøাগানের মধ্য দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধিত হয়। এতে দলে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রেসিডিয়াম পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। গোলযোগ চলতেই থাকে। কী হবে আর কী হবে না এই প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গন আলোড়িত হয়ে ওঠে।
পরদিন দলের ভাঙন রোধকল্পে দিল্লিতে বসবাসরত বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন ঐক্যের প্রতীক। পঁচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করে খুনি চক্র ও তাদের মাস্টারমাইন্ডরা মনে করেছিল, রাজনীতিতে শেখ মুজিবের কবর রচিত হলো। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, টুঙ্গিপাড়ায় কবরে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শায়িত রয়েছেন ঠিকই; কিন্তু রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। বুলেটবিদ্ধ বঙ্গবন্ধুর রক্ত বাংলার মাটিতে মিশে গিয়েছিল, সেই রক্তই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সময় আবারও ফিরে এসেছে।
দশ
কাউন্সিলের সমাপনী ভাষণে মালেক উকিল বলেন, দলে অনেক উপযুক্ত ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও ঐক্য অটুট রাখতে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। ‘বঙ্গবন্ধুর গন্ধ’ আছে বিধায় তিনি মেনে নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। এ বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট যে, নেতৃত্বের মধ্যে কোন্ ধরনের প্রতিকূলতা থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশের মধ্যে ছিল আরও প্রতিকূলতা। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা তখন দিল্লিতে বসবাসরত ছিলেন। তাই শুরু থেকে ভারতের নির্দেশে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বলে প্রচার জোরদার করা হয়। এমনটা স্বাভাবিকই ছিল। কারণ একাত্তরে পরাজিত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মহল ঠিকই বুঝেছিল যে, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার ভেতর দিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হুবহু বাস্তবায়ন আর সম্ভব নয়। ২৪ জানুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করানো এবং দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা দিল্লি যাত্রা করেন। ওইদিনই অন্য কোনো বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারে সামনে আনা হয়, শেখ হাসিনা বিবৃতিতে বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। ২৫ মার্চ থেকে দিল্লিতে নেতাদের সঙ্গে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক শুরু হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতারা ঢাকা ফিরে অসেন।
৮ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট জিয়া ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অতীতের ন্যায় বিদেশি সাহায্য-সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।’ সহজেই অনুধাবন করা যায়, ক্ষমতার অন্ধ মোহে সেনাশাসক জিয়া ভুলে গিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভারতে থেকে সেক্টর কমান্ডার হতে পেরেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এ-ধরনের কথা বলার পর এমন প্রচার জোরদার হয় যে, ভারতই শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানিয়েছে।
১৭ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত হয়, ভারতের লোকসভায় সিপিএম নেতা জ্যোতির্ময় বসু বলেছেন, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের বিরোধী ষড়যন্ত্র করছে। সিপিএম নেতার এ-ধরনের বক্তব্য ছিল দুর্ভাগ্যজনক। ওইদিনই আওয়ামী লীগবিরোধী ফ্যাসিবাদী দিবস পালন উপলক্ষে জাসদ নেতা মেজর এমএ জলিল বলেন, যে রাজনৈতিক দলের সভাপতি দিল্লিতে বসবাস করছেন, সে-দলের সঙ্গে ঐক্য গড়তে এদেশের মানুষ ভয় পায়। এটা ঠিক, শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় ভয় পেয়েছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি আর ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীরা। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের জনগণ হয়ে ওঠে উজ্জীবিত।
এগারো
সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে শিশু পুত্র-কন্যাকে ছোট বোন রেহানার কাছে রেখে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। সেদিনের প্রকৃতির রুদ্ররূপী ঝড়-ঝঞ্ঝ¦া আর শোকাহত-ক্ষুব্ধ-আশান্বিত জনতার সমাবেশ-সেøাগান দেশের রাজনীতির ইতিহাসে চির অমøান হয়ে থাকবে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই শুভ মুহূর্তে আবেগমথিত ও প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।… আমার হারাবার কিছু নেই।… জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ বঙ্গবন্ধু-কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৩ দিন পর চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হন। হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে জিয়া যেভাবে ক্ষমতায় আসেন, সেভাবেই তিনি ক্ষমতা থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। দেশ আবারও পড়ে ক্যু আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জাতির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ আর একই সঙ্গে জনগণের সবলতা-সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যান সম্মুখপানে। আওয়াজ তোলেন, ভোট ও ভাতের।
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সেনাশাসন তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ এবং সীমিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে ব্যবহার করার নীতি-কৌশল নিয়ে শেখ হাসিনা যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই কৌশলের সফল প্রয়োগ করে তিনি ‘আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে মুসলিম লীগের মতো’ শত্রুদের এ-ধরনের কথার মুখে ছাই দিয়ে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। এরশাদের ‘মিডিয়া ক্যু’ তাতে বাদ সাধে।
স্বৈরাচারবিরোধী গণসংগ্রামের বিজয়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যান এবং বলেন, ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। এজন্য তাকে সমালোচনা করা হয়। কিন্তু এটাই বাস্তব, তখনও রাজনীতি ছিল ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। সেই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তো তখন ক্যান্টনমেন্টে বসেই রাজনীতি করতেন। ক্যান্টনমেন্টের ভূমিকা তখন কী ছিল, তা বিবেচনায় নিলেই শেখ হাসিনার ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ কথাটার মর্ম উপলব্ধি করা যাবে।
বারো
১৯৯১-এর সংসদ নির্বাচনের পরপরই বিশ্ব রাজনীতি পাল্টে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটে। ঠা-া যুদ্ধ যুগের অবসান হয়। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ার যুগ শুরু হয়। যুগধর্ম ধারণ করা ছাড়া যে অগ্রসর হওয়া যায় না এবং বঙ্গবন্ধু যে যুগধর্ম ধারণ করে সেই যুগের বিশ্ব রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছিলেন, তা দূরদৃষ্টি দিয়ে বিবেচনায় নেন। ফলে সমাজতন্ত্রের মূল চেতনা শোষণহীন সমাজের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি পরিবর্তন করেন। ১৯ মার্চ ১৯৯২ তিনি মিশ্র অর্থনীতি থেকে প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতির কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যুগ ও দেশের উপযোগী জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার কর্মসূচি তিনি সামনে রাখেন।
ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নীতির প্রতি সদাজাগ্রত শেখ হাসিনা দলীয় কর্মসূচি পরিবর্তন করার ভেতর দিয়ে দলকে বিশ্ব ও জাতীয় বাস্তবতায় ক্ষমতায় যাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তিনি ব্যর্থ করে দেন। শুরু হয় রাষ্ট্র ও সমাজকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম। ১৯৯৬ সালের জুনের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দলকে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এ আমলে তিনি এমন কতক কাজ করেন, যা রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণযোগ্য। এক. জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। দুই. নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত ব্যক্তি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা। তিন. বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত ও বিচার শুরু করা। তিন. দেশের ইতিহাসে প্রথম সংবিধানের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া।
তারপর নানা বাধা-বিঘœ, সাহস ও বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিনি দুবারে ১৭ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী এবং ১১ বছর বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। ১৯ বার তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। দল ভাঙারও চেষ্টা করা হয়। শত বাধা-বিঘœ ও দলে ‘কাউয়াদের’ উৎপাতের মধ্যেও দেশ আজ উন্নয়নের ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার মধ্যে রয়েছে। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের মতো দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। করোনা-দুর্যোগ ও ইউরোপীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবগত এবং পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে অবিচল। বিশ্ব ও উপমহাদেশের দেশগুলো যখন কেবল দক্ষিণমুখী হচ্ছে, তখন তিনি উজানমুখী ঢেউয়ের উপর দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নৌকাকে অগ্রসর করে নিতে তৎপর থাকছেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য বিবেচনায় নিয়ে তার জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলতে হয়, দেশে ফেরার পর ‘ভোট ও ভাত’-এর যে সেøাগান তিনি তুলে ধরেছিলেন, সেই সেøাগান কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন, তা দিয়ে ইতিহাস তার মূল্যায়ন করবে। জনগণ কায়মনোবাক্যে কামনা করে, তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের কথাগুলো ‘হারাবার কিছু নেই।… জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়’ কথাগুলো তিনি আগামী দিনগুলোতে প্রমাণ করবেন।
জয় বাংলা। জয়তু শেখ হাসিনা।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ