Friday, September 22, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,একাদশ সংখ্যা,অক্টোবর-২০২০শেখ রাসেল হত্যা : খুনিদের ক্ষমা নেই

শেখ রাসেল হত্যা : খুনিদের ক্ষমা নেই

ফিদা আকবর : শোকাবহ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। জমাট বাঁধা রক্তের অক্ষরে লেখা বাঙালি জীবনের শোকাবহ নীল বেদনার দিন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর একটি শোকের দিন। এই দিনে মানবতার দুষমন প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকরা আবহমান বাংলা ও বাঙালি জাতির পিতা বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বঙ্গবন্ধুর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলও। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। অবশেষে তার লাশ একটি লুঙ্গিতে মুড়িয়ে ফেলে রাখা হয়। সেদিন শিশু রাসেল বাবা বঙ্গবন্ধু মুজিব এবং মা বেগম মুজিবের সাথে দোতলার একটি রুমে ঘুমিয়ে ছিল।
বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার বাদী পিএ মুহিতুল ইসলামের বর্ণনায় জানা যায়, ঘাতকদের অভিযানের শেষ শিকার ছিল শিশু রাসেল। সবাইকে হত্যার পর তাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। এ সময় রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, ওরা কি আমাকেও মেরে ফেলবে? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ঘাতক আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে রাসেলকে পুলিশ বক্সে আটকায়। এরপর দুই ঘাতক রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শুনতে পাই। মেজর আলাউদ্দিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু রাসেলের লাশ মূলত বেডরুমে তার দুই ভাবীর মাঝখানে পড়ে ছিল। সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে গিয়েছিল। গুলিতে মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো ছিল শেখ রাসেলের লাশ।
বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের ছেলে আবদুর রহমান শেখ ওরফে রমার বর্ণনায়, “আর্মিরা শেখ নাসের, রাসেল ও আমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেখানে সাদা পোশাকে এক পুলিশের লাশ দেখতে পাই। নিচে শেখ নাসেরকে লক্ষ্য করে আর্মিরা জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? পরিচয় দিলে তাঁকে নিচতলার বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরে গুলির শব্দ ও ‘মাগো’ বলে চিৎকার শুনতে পাই। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল মার কাছে যাবে বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছিল, ভাই আমাকে মারবে না তো? এ সময় এক আর্মি শেখ রাসেলকে বলে, চলো তোমার মার কাছে নিয়ে যাই। তাকেও দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই আর্তচিৎকার ও গুলির শব্দ শুনতে পাই।”
মানব ইতিহাসের যে কোনো ধর্মে বা যে কোনো শাস্ত্রে বলা হয় মানুষ হত্যা মহাপাপ। আর যদি সেটা হয় শিশুহত্যা, তাহলে তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিষয়টি কতটা নির্মম ও বর্বর। নিরপরাধ যে কাউকেই হত্যা করা একটি জঘন্যতম অপরাধ এবং নিহত মানুষটি যদি শিশু হয় তখন সে হত্যার নৃশংসতা এবং পাপ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। রাসেলের মতো একটি নিষ্পাপ হাস্যময় শিশুকে একটি বিশেষ পরিবারের সন্তান হওয়ার অপরাধে যারা তাকে হত্যা করল। বোধকরি, এ মরজগতের কোনো বিচারকও ক্ষমা করতে পারবে না। রাসেল হত্যার নৃশংসতা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেগুলোকেও ম্লান করে দেয়।
বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানে অর্জিত সদ্য স্বাধীনতালব্ধ দেশটিতে যে নারকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, সেদিন তা বিশ্বের ইতিহাসের জঘন্যতম ইতিহাস। একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাত্র পাঁচ বছর সময়কালের মধ্যে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের নববধূ সুলতানা ও রোজীসহ যাদের হাত থেকে তখনও মেহেদির রং পর্যন্ত মুছে যায়নি- তাদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে। এমনকি ১০ বছরের নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ শিশুপুত্র রাসেলকে, কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসেরকে নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে খুন করতে নরপিশাচদের একবারও হাত কাঁপেনি।
আজ যদি রাসেল বেঁচে থাকত তার বয়স হতো ছাপ্পান্ন। যে পুণ্যাত্মা পিতামাতা আর শেখ বংশের রক্তধারা যার শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে চলছিল, তারই ধারাবাহিকতায় জাতি একটি মহামূল্যবান রত্নখ-কে হারিয়ে মর্মাহত, শোকাভিভূত, বেদনার্ত ও বাকরহিত। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ আমরা পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে রাসেলের আত্মার শান্তি কামনা করতে গিয়ে অবরুদ্ধ কান্নার স্রোতে ভেসে যাই।
অনেক আশা করে পিতা তার ছেলেটির নামকরণ করেছিলেন দুনিয়ার এক খ্যাতিমান দার্শনিকের নামে। যার নামের গৌরবে সদ্য কিশোরটি যেন প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হতে পারে। পিতা মানুষটির ধারণায় আর স্বপ্নে ছিল শিশু রাসেল হবে ইংরেজ দার্শনিক, ন্যায়শাস্ত্রে প্রভূত ব্যুৎপত্তি, অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী গণিতজ্ঞ ও রচনাকারের মতো যশস্বী।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই প্রত্যুষে ১০ বছরের শিশু রাসেলকে সেদিন যারা হত্যা করেছিল তারা কিন্তু ব্যাপারটি আকস্মিকভাবে ঘটায়নি। ঠাণ্ডা মাথায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত একটি পরিবারের সর্বশেষ চিহ্নটি উপড়ে ফেলার জন্যই তারা এই বর্বর ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল এই কারণেই যে, বাংলাদেশ যেন কোনো অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোনো জীবিত প্রাণীকে প্রতীক হিসেবে না পায়। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় রক্ষা পেয়েছিলেন আর রক্ষা পেয়েছিলেন বলেই আজ ইতিহাসের একটি জঘন্যতম অপরাধের সব তথ্য এক এক করে বেরিয়ে আসার সুযোগ মিলেছে।
আমরা দেখেছি কেমন করে একটি নৃশংসতাকে গৌরবান্বিত করা হয়, কেমন করে গোয়েবলসীয় প্রচারণার ভেতর দিয়ে ইতিহাসকে সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করা হয়, কেমন করে মহান অবদানকে অবমূল্যায়ন করে তার সম্পূর্ণ উল্টো চেহারা তুলে ধরা হয়। কিন্তু অমোঘ সত্যকে কতদিন আড়াল করা যায়? বেশিদিন নয়। আজ সেই খুনিদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। অনেকের বিচারও হয়েছে সময়ের ইতিহাসের ক্রমধারাবাহিকতায়। আমোঘ নিয়মে উদ্ঘাটিত হচ্ছে পঁচাত্তরের সেই ষড়যন্ত্রের জালÑ আর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে রক্তমাখা সময়ের ঘটনাবলি। আমরা চাই ঘাতকদের যারা বাকি আছে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এর বাইরেও আর একটা চাওয়া আছে। সেই চাওয়াটাও গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে। শেখ রাসেল হত্যার বিষয়কে ঘিরে আমরা সকল শিশুর নিরাপত্তা চাই। যদি শিশুহত্যার বিভিন্ন ঘটনায় কারও কারও শাস্তি হয়, তাহলে কেন রাসেল হত্যার বিচার হবে না? শাস্তি হবে না আলাদা করে? বঙ্গবন্ধুর পুত্র হওয়াটাই কি তার অপরাধ? আমরা কিছু জানতে চাই না, আইনের মারপ্যাঁচ বোঝারও কোনো দরকার নেই আমাদের। আমরা শুধু রাসেল হত্যার বিচার চাই।
মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম সশস্ত্র ঘাতকদের দল যখন নিরস্ত্র নিরীহ নিষ্পাপ এ-শিশুটির বুক ঝাঁজরা করে দেয়। এর মূল কারণ ছিল রাজনীতির প্রতি আমার দুর্বার আকর্ষণ। তখনকার বেদনাদায়ক রাজনৈতিক বাস্তবতা। দুনিয়া কাঁপানো ঐক্য, সাহস, স্বপ্ন ও মহত্ত্বের চেতনা নিয়ে যে জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তা আমূল বদলে গিয়েছিল। সেই স্থানটি দখল করে নিয়েছিল অনৈক্য, হানাহানি, কাপুরুষতা, শঠতা ও নিচতার মতো যাবতীয় বদগুণ। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটা জাতি কীভাবে রাতারাতি এতটা বদলে যেতে পারে, তা এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর গণরোষের ভয়ে যে কুলাঙ্গাররা বিবরবাসী হয়েছিল, অশুভ প্রেতাত্মার মতো তারা আবার বেরিয়ে আসতে শুরু করে জনসম্মুখে। সর্বোপরি, চরম দুঃসময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো যেসব মহৎ আদর্শ বা মূলনীতির ভিত্তিতে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল এ জনপদের মানুষ, বিস্ময়করভাবে ঐক্যের সেই মূল ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল রাতারাতি। সেই সঙ্গে বিপজ্জনকভাবে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা ও হানাহানির ঘৃণ্য রাজনীতি। প্রতিক্রিয়ার পুনরুত্থানের এই মারাত্মক ঝুঁকির মুখে সদ্য স্বাধীন এদেশটির একমাত্র রক্ষাকবচ বা ঐক্যের প্রতীক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মিত্ররা না জানলেও শত্রুরা তা ভালো করেই জানতেন। তাই তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল তাদের সকল ষড়যন্ত্র। লক্ষ্য ভয়ঙ্কর। অব্যাহত অপপ্রচার ও মিথ্যাচারে তৈরি করা হচ্ছিল ক্ষেত্র। আর তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছিল দেশি-বিদেশি নানাচক্র।
কোনো বঙ্গসন্তান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে বিশ্বের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষই তা কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গজ ঘাতকরা সেদিন মহৎপ্রাণ সেই মাটির মানুষটিকে শুধু নয়, তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকেই হত্যা করেছিল পাশবিক উন্মত্ততায়। পরে এ উন্মত্ততাকে নানারকম যুক্তির পোশাক পরানোর চেষ্টাও হয়েছে। নির্লজ্জভাবে ‘জায়েজ’ করার চেষ্টা হয়েছে বর্বরতম সেই হত্যাযজ্ঞকে। সেই অপচেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, তা হলোÑ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের বেনিফিসিয়ারি ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল বা দলসমূহের শীর্ষপদে আসীন কতিপয় উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা কিংবা জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিকই শুধু নন, ‘সুশীল সমাজ’-এর তকমাধারী বহু বরেণ্য ব্যক্তিও এতে অংশ নিয়েছেন সগর্বে। একদিকে যখন অবৈধ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা ঘাতকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, অন্যদিকে তখন এই ‘সুশীল’রা তাদের জাতীয় বীর বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বিরামহীনভাবে। বাংলার ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এসব নরঘাতককে ‘সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি তারা।
ভুক্তভোগীদের পক্ষে সেই সময়ের সেইসব অসহনীয় অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া কঠিন। আজও কিছু স্মৃতি দলিল আকারে মুদ্রিত আছে তখনকার পত্রপত্রিকার পাতায়। নিরপরাধ যে মানুষগুলো সেদিন নজিরবিহীন অন্যায়ের শিকার হলেন : তাদের নয়, বরং অন্যায় যারা সংঘটিত করেছে সেই আত্মস্বীকৃত খুনিদের পক্ষ নিয়েছিলেন তারা। এজন্য তাদের সামান্য লজ্জাবোধও হয়নি। কেউ অনুতপ্ত হয়েছে এমনটাও শোনা যায়নি। বরং তারা জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকা-কেই শুধু বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেনইনি, সেইসঙ্গে সেই কালরাতে রাসেলসহ যেসব শিশু ও নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাকেও ‘জায়েজ’ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন।
ঘটনাটি লে. জে. এরশাদের স্বৈরশাসনের পতন পরবর্তী পর্যায়ের। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বে বিএনপি সরকার তখন ক্ষমতায়। এদেশের অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও যারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েন, বক্তৃতা-বিবৃতির তোড়ে জাতির কান ঝালাপালা করে ফেলেন, দাতাদের অনুগ্রহভাজন শান্তি ও মানবাধিকারের সেই ‘সোল এজেন্ট’রা বরাবরই এমন ভাব দেখিয়ে আসছেন যে পঁচাত্তরের সেই কালরাতে কিছুই ঘটেনি! যদি ঘটেও থাকে তাতে তাদের কথিত ‘শান্তি ও মানবাধিকারের’ গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড়ও লাগেনি। অতি মূল্যবান এই ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকার জন্য তারা ইতোমধ্যে নানারকম ‘ইনাম’ও পেয়েছেন দেশে-বিদেশে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এদের অনেকেই এখনও ‘জাতির বিবেক’ সেজে বসে আছে।
বস্তুত এরা হলেন জ্ঞানপাপী। তারা সবই জানেন। সবই বোঝেন। সে-কারণেই অস্ত্রধারী ঘাতকদের চেয়ে এদেরই আমার অধিক বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও তার ঐতিহাসিক বাকশাল বক্তৃতায় এদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আমি ৩টি জিনিসকে ভয় পাই: সাপ, কুমির ও বিশ্বাসঘাতক। এরা তার চেয়েও বিপজ্জনক। কারণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা পারে না হেন কাজ নেই। সেই বক্তৃতার বৃহদাংশ জুড়ে তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এই ‘ভদ্রলোকদের’ সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ভালো হয়ে যেতে। সেই সঙ্গে পরিণতি সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আর বিস্ময়করভাবে তার কয়েক মাসের মধ্যেই তাকেই সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়। এটা ছিল ঠা-া মাথার একটি হত্যাকা-। এর পেছনে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল। ছিল ভয়ঙ্কর একটি নীল নকশা। যারা এ বর্বরতার শিকার হয়েছিল তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত। অন্যদিকে, ঘাতকদের সকলেই ছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সশস্ত্র। বেশিরভাগই পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। আর যাকে তারা হত্যা করতে গিয়েছিল, তিনি কেবল জাতির পিতা বা স্থপতিই নন, দেশের আইনানুগ প্রেসিডেন্টও বটে।
সামরিক বাহিনীর এ কর্মকর্তারা এই মর্মে শপথ নিয়েছেন যে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষা করবেন। নিশ্চিত করবেন দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা। প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই রাষ্ট্র তাদের বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। দায়িত্ব নিয়েছিল তাদের ভরণপোষণের। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়ে তারা দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছিল তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ও নিকটাত্মীয়সহ অনেক নিরপরাধ নারী ও শিশুকে। একসঙ্গে অনেকগুলো অপরাধ করেছিল তারা। প্রথমত, শপথ ভঙ্গ করেছিল। দ্বিতীয়, যে সংবিধানের অধীনে তারা শপথ নিয়েছিল চরম অবমাননা করেছিল তার। তৃতীয়ত, লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশটিকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছিল তারা। ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল তার সকল মান-মর্যাদা ও গৌরব। সর্বোপরি, গণহত্যা সংঘটিত করেছিল যা জঘন্য অপরাধ। ঘৃণ্যতম এ অশুভ চক্রটিকে প্রতিরোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমরা। কেউ কলমকেই অস্ত্র বানিয়েছিল, আর কেউবা সংগ্রামমুখর রাজপথকেই সঙ্গী করে নিয়েছিল স্থায়ীভাবে। অস্ত্র দিয়েও প্রতিরোধ করতে উদ্যোগী হয়েছিল কেউ কেউ। আমাদের হৃদয়-উৎসারিত সেসব উদ্যোগ যে একেবারে বৃথা যায়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার নেমে এসেছিল গোটা দেশজুড়ে। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল শত্রুমিত্র। সেটি হলো, রাসেলকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? যারা এ বর্বরতার পক্ষাবলম্বন করে বা আকারে-ইঙ্গিতে তার পক্ষে ওকালতি করে তাদের পশুর দলভুক্ত করতেও দ্বিধা হয়। পশুদেরও তাদের শাবকদের প্রতি অতুলনীয় মমত্ববোধ আছে। রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি হলো, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে-তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ আমি আজও সেসব ঘাতক এবং তাদের পক্ষাবলম্বনকারীদের ঘৃণা করে চলেছি। আমৃত্যু তাই করে যাব। মানুষকে ঘৃণা করা পাপ। কিন্তু যারা নরাধম তাদের ক্ষেত্রে এ-কথা প্রযোজ্য নয়। শিশু রাসেল জীবন দিয়ে এ সহজ সত্যটি আমাদের চেতনায় স্থায়ীভাবে খোদাই করে দিয়েছিল।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমধুমতীর চাঁদ
পরবর্তী নিবন্ধপুনশ্চঃ সতর্কবাণী
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য