অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে নিষ্ঠুর ঘাতকের বুলেটে নিহত হয় ১০ বছরে শিশু রাসেল। নরপিশাচরা ঐদিন হত্যা করে স্বাধীনতার স্থাপতি বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছাত্রনেতা শেখ কামাল, শেখ জামালসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। শেখ রাসেল ছাড়াও সেদিন ঘাতকের গুলিতে আরও কয়েকজন শিশুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তারা হলোÑ কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ১৩ বছরের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের পুত্র আরিফ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর চার বছরের পুত্র সুকান্ত।
শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৫৭ বছর। নিষ্ঠুর ঘাতকের বুলেট তার বেঁচে থাকার অধিকার স্তব্ধ করে দিয়েছে। যে অক্টোবর মাসে শেখ রাসেলের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে অধিকার হারা শিশুটির জন্ম হয়েছে, সেই অক্টোবরে নানা আয়োজনে বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে থাকি। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার শিশু দিবস পালিত হয়। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২১ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা শিশুদের সম-অধিকার নিশ্চিত করাসহ তাদের প্রতি সহিংস আচরণ ও নির্যাতন বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের ঘোষণার ১৫ বছর পূর্বেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে ‘শিশু আইন’ প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু শাহাদাতবরণের পরবর্তী সময়ে দেশের অন্য নাগরিকদের সাথে শিশুরাও হয় অধিকার বঞ্চিত। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে শিশুদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
সেনাশাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে শিশুরা ছিল অনিরাপদ। পূর্ণিমা, মহিমা, অযুফা, তৃশাদের জীবনদান সম্ভ্রমহানি এ সত্যকে আমাদের সামনে উন্মোচন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে শিশুদের যাতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শিশু দিবস-২০২১-এর প্রতিপাদ্য ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলি’, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। কিন্তু শিশুদের বিষয়টি যখনই আলোচনায় আসে তখনই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে শেখ রাসেলের কথা। ছোট ভাই শেখ রাসেলের জীবনদান হৃদয়ে যে গভীর ক্ষত ও বেদনার সৃষ্টি করেছে, তা সব সময়ই ফুটে ওঠে বড় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কণ্ঠে।
“রাসেল হওয়ার পর আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি হই। যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলত। ওইটুকু একটা মানুষের ছিল খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা গল্প নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “হাসিনা : এ ডটার’স টেল”-এ এভাবেই রাসেলকে উপস্থাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বেদনাবিধুর রাতে পরিকল্পনামাফিক যখন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চলছিল তখন ঘাতকরা শিশু রাসেলকে অন্যদের সাথে নিচে নামিয়ে লাইনে দাঁড় করায়। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল তখন ‘মার কাছে যাবো’ বলে কান্নাকাটি করছিল। বঙ্গবন্ধুর পিএ মুহিতুল ইসলামকে ধরে বলেছিল, ‘ভাই আমাকে মারবে না তো?’ এ সময় একজন ঘাতক শেখ রাসেলকে বলছিল, ‘চল্ তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাই।’ দেশদ্রোহী নিষ্ঠুর কুলাঙ্গাররা নিষ্পাপ নিরপরাধ রাসেলকে বাবা-ভাইয়ের লাশ মাড়িয়ে মায়ের লাশের পাশে এনে হত্যা করে। ঘাতকদের এ নারকীয় হত্যাকা- সীমারের হত্যাকা-কে মøান করে দেয়। অপরাজনীতিকের ঘৃণ্য কূটকৌশল বোঝার বয়স বা ক্ষমতা রাসেলের ছিল না। অন্য ১০টি শিশুর ন্যায় সমাজে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে চেয়েছিল সে। নরাধম ঘাতকরা তাকে রেহাই দেয়নি। শেখ রাসেলের ‘প্রিয় হাসু আপা’ আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলেন তখন তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ছোট ভাই নিষ্পাপ রাসেলের মুখ। এ-কারণেই শিশুদের প্রতি তার আবেগমাখা দৃষ্টি। শিশুদের জন্য কল্যাণকামী সমাজ গঠন করা তার সরকারের অঙ্গীকার। আওয়ামী লীগ সরকার শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০, শিশু আইন-২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩, শিশু আইন-২০১৩ এবং শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র আইন-২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঝরেপড়া শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করার চেষ্টা চলছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য জাতিসংঘ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বেশ ক’বছর ধরে আমরা কলঙ্কমুক্ত পরিবেশে শেখ রাসেলের জন্মদিন পালন করছি। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে আসছিল এবং পাশাপাশি ফুলের মতো শিশু রাসেলের হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা উচ্চারণ করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে জাতি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। দম্ভকারী খুনিরা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। শিশু হত্যার কলঙ্ক থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর নানা সময়ে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এই খুনিরা দম্ভোক্তি করে হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্যে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসে। তাই আজ দাবি উঠেছে জেনারেল জিয়াসহ যারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল তাদের মুখোশ উন্মোচন করার।
শিশুরা জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তারা যাতে ভবিষ্যতে দেশ গঠনে দায়িত্ব নিতে পারে, তার জন্য তাদের নিরাপত্তা বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রাসেল শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই নয়Ñ সে যেন আজ লাখ-কোটি ভাগ্যাহত শিশুদের প্রতিনিধি। খুনিরা রাসেলকে শারীরিকভাবে হত্যা করলেও রাসেল বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। বিশ্বের নিপীড়িত, ভাগ্যাহত, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের মধ্যেই আমরা আমাদের রাসেলকে খুঁজে পাব। পৃথিবীর সব শিশুরাই যেন তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে- শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মবার্ষিকীতে এটিও আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ