সাইদ আহমেদ বাবু: কখনো কখনো সময় দারুণ কঠিন। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ পরাশক্তি ও শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করেন তার সম্প্রদায়ের মানুষকে। বাঙালির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতার সূর্যোদয়, সারাবেলাÑ সুউচ্চ আকাশে আমাদের ছাদ করে দিয়েছেন। সেই আকাশের যোগ্য উত্তরসূরি তার দ্বিতীয় সন্তান ‘শেখ কামাল’ দেশের প্রয়োজনে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতির এডিসি। অসীম ধৈর্য ও সাহসের সাথে নিপুণভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে গেছেন নিজ পড়াশোনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। আমরা এবার জানব জাতি-রাষ্ট্র পরিকল্পনা বিনির্মাণের ক্ষণজন্মা এই বীরের কিছু কথা।
১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সদ্য বিবাহিত যুবক। মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে (১৪ জুলাই ১৯৭৫) ক্রীড়াবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ব্লু সুলতানা কামাল খুকুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের মেহেদির রং তখনও মুছে যায়নি। এই ক্ষণজন্মা যুবক মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে জাতির পিতার হত্যাকারী মানবতার ঘৃণ্য শত্রুদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে, যে-মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে-মাসেই ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে তিনি প্রথম শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ লালন করে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, তার গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলো ১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। বনানীর কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ কামাল যদি তার নিজস্ব ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ আরও সৃজনশীল হতে পারত। আজ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৭১ বছর। জাতির পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজে এবং তাদের বাড়ির অন্য সদস্যরা ছিলেন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো। তাদের জীবন ছিল খুব সহজ-সরল। পারিবারিক বন্ধন ছিল অটুট। তার বাল্যকাল কেটেছে শান্ত নিবিড় গ্রাম টুঙ্গিপাড়াতে দাদা-দাদির সাথে। মানুষের প্রতি অসীম মমত্ব ছিল তার। ছোট-বড় সবাইকে আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিল শেখ কামালের। পড়াশোনায় শেখ কামাল ছিলেন খুবই মেধাবী। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার পল্টনের ডনস্ কিন্ডার গার্টেনে। এরপর ঢাকা শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। এ বিভাগ থেকেই সাফল্যের সাথে ১৯৭৩ সালে অনার্স ও মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি সমাজবিজ্ঞানে এমএ শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা মানবিক ও নেতৃত্ব গুণাবলি পেয়েছিলেন শেখ কামাল। এর সঙ্গে শাণিত হয়েছিল সংস্কৃতিবোধ ও ক্রীড়া দর্শন। সংযুক্ত হয়েছিল দেশ ও মানুষের প্রতি অনুপম দরদ এবং দায়িত্ববোধ। খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সংগীতের ভুবন থেকে রাজনীতির ময়দানÑ সর্বত্র ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। ছিলেন বন্ধু ও সতীর্থদের মধ্যমণি। একই সময় সাংস্কৃতিক চর্চা আর খেলাধুলায় সমানভাবে জড়িত ছিলেন শেখ কামাল। খুব ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ভালোবাসতেন। স্কুল ও কলেজ-জীবনেই সম্পৃক্ত হন খেলাধুলায় এবং ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ৬-দফা-উত্তর রাজপথের আন্দোলন তথা ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ ও ’৭১-এর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে ছিলেন দৃপ্তমান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছেন ও ট্রেনিং ক্যাম্পের বাছাই, তত্ত্বাবধান, সাংগঠনিক কাজে যুক্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের অফিসার ছিলেন। ভারতে ট্রেনিং শেষে শেখ কামালকে সংযুক্ত করা হয় মুক্তিবাহিনীর চিফ জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে। জেনারেল ওসমানীর সাথে তিনি যুদ্ধকালীন পুরো সময়টা ছিলেন। বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ৯ মাসে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল নতুন এক সার্বভৌম দেশÑ বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসার কারণে তিনি আবার সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। দেশের পতাকাকে ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে সারাবিশ্বে পরিচিত করার স্বপ্নই লালন করেছেন আজীবন।
বঙ্গবন্ধু যে একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন তা হয়তো অনেকেরই অজানা। জাতির পিতা ফুটবল খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। চল্লিশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের হয়েই ফুটবল খেলেছেন। দেশ স্বাধীনের পর অন্য অনেক কিছুর মতো দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও ছিল বেশ এলোমেলো অবস্থা। সে-সময় শেখ কামাল শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। বন্ধুদের নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় ক্রিকেট, ফুটবলকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে যেতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’। ১৯৭২ সালে ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামকরণ করা হয়।
শেখ কামাল আধুনিকতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল করে তোলেন আবাহনীকে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্রীড়াঙ্গনে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিÑ এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শেখ কামাল। সে-লক্ষ্যে ফুটবল, ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাবার মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন শেখ কামাল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবল, হকি, ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি করেছিলেন নতুন দিনের জন্য, আপাত লক্ষ্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। স্বপ্ন কিন্তু এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আবাহনীর অভিযাত্রা সমৃদ্ধ হয়েছে তার অনন্য প্রজ্ঞা-মেধার মিশেল সম্মিলনে। সে-সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাহনীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ক্লাবটিকে সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। আমাদের দেশের ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মান উন্নয়নে শেখ কামাল অক্লান্ত শ্রম দিয়েছিলেন। ক্রীড়া জগতে তিনি রেখেছেন অপরিসীম অবদান। পাশাপাশি নতুন খেলোয়াড় তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলেছিলেন। শেখ কামালের অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায় আজকের ফুটবল ক্লাব আবাহনীর ইতিহাস থেকেই। শেখ কামাল ক্রিকেট খেলেছেন আজাদ বয়েজ, আবাহনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের হয়ে। ছিলেন ফুটবল-বাস্কেটবলের নিয়মিত সদস্য। আর সেখান থেকেই শেখ কামাল একপর্যায়ে দক্ষ সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পায় বাংলাদেশের ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলাধুলা। ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেটবল টিমের অধিনায়কও। ফুটবল খেলায় তিনি শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা উপমহাদেশেই পশ্চিমা স্টাইলে বিপ্লব এনেছিলেন। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশি কোচ বিল হার্ট-কে এনে ফুটবল-প্রেমিকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! তখন ক্লাব তো দূরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশি কোচ ছিল না। ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশি কোচ আর পশ্চিমা বেশভূষা দেখে সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকদের প্রশংসা পায় এবং পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলায় আবাহনী ক্রীড়াচক্র দর্শকের অবাক মুগ্ধতায় ভূয়শী প্রশংসা অর্জন করেছিল, মাটি কামড়ে ছোট ছোট পাসে মাঠজুড়ে চমৎকার ফুটবল খেলা উপহার দেওয়ার জন্য। শুধু আবাহনীই না, দলকানা দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ইস্ট অ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনীর পাশাপাশি এই ক্লাবগুলোতেও তখন ছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য।
শেখ কামাল শুধু খেলাধুলা নয়। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি, সমাজ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মনোনিবেশ করেছিলেন। সংগীতাঙ্গনে ছিল তার সরব উপস্থিতি। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ওস্তাদ খুরশিদ খানের নিকট থেকে সেতার বাজানোর ওপর প্রশিক্ষণ নেন। ভালো সেতার বাজাতেন তিনি। মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন, এছাড়া মৃদঙ্গ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্রের সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার পান। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ নামে একটি ব্যান্ডদল। এই গানের দলের মাধ্যমে তিনি পল্লীগীতি আর আধুনিক নানা সংগীতযন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করে দেশের সংগীত জগতে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। তার হাত ধরে এদেশে পপসংগীতের সূচনা হয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠিত স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর মধ্য দিয়েই ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদদের মতো জনপ্রিয় পপসংগীত শিল্পীরা এসেছেন। মোট কথা সম্পূর্ণভাবে একজন সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ কামাল। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি জান্তা সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে। তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে অন্যদের সাথে অসহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রাখলেন তিনি। শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনের পুরোধা, ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘নাট্যচক্র’ নামে একটি নাটকের সংগঠন গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই নাট্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন শেখ কামাল। এই নাট্য সংগঠনের অভিনয়শিল্পী হয়েই নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে কলকাতায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন তিনি। নাটক শেষে ফেরদৌসী মজুমদার ও শেখ কামালের অটোগ্রাফ নিতে সেদিন দর্শকরা ভিড় করেছিল।
শেখ কামাল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী ও সংগঠক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ছেষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন অর্জনে ও নির্বাচনে জয়লাভে পুরান ঢাকায় তিনি অবদান রাখেন। মাত্র ২৬ বছরের ছোট জীবনে তিনি নিজেকে উজ্জ্বল উদীয়মান নক্ষত্র হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন ছাত্র-সংগঠক হিসেবে তিনি কখনও নেতৃত্বের শীর্ষে আসতে চাননি। তিনিই ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতেন, প্রেরণা জোগাতেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ছাত্র-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, পরবর্তীতে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
মাত্র ২৬ বছরের জীবনে তিনি বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেন। তার মধ্যে যুক্তরাজ্য (লন্ডন), রাশিয়া (মস্কো), জার্মানি (মিউনিখ ও বার্লিন), সুইজারল্যান্ড (জেনেভা), ভারত (কলকাতা, শিলিগুড়ি, ডুয়ার্স) অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
শেখ কামাল তীক্ষè বুদ্ধিমান দূরদর্শী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। শেখ কামাল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং বেঁচে থাকলে তিনি জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে পৃথিবীর শিখরে দাঁড় করিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাথা উঁচু করে দেন। দেশকে চতুর্মুখী বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্বীয় ঔজ্জ্বল্যে সারাদেশে আলো ছড়িয়ে গেছেন। সূর্যকে আলো ধার করতে হয় না, কিন্তু চন্দ্র ধার করা আলোয় আলোকিত, অর্থাৎ সূর্যের আলোকে আলোকিত। নিজ প্রতিভাবলে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শেখ কামাল জীবিত থাকলে দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আরও অনেক সমৃদ্ধ থাকত। ব্যক্তি শেখ কামালের মৃত্যু হলেও, তার কীর্তি-আদর্শ বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে চিরদিন! বাঙালি তরুণদের জন্য শেখ কামাল এখন রোল মডেল। ৪৫ বছর পরেও শেখ কামালকে কেউ কলঙ্কিত করতে পারেনি। তাই তরুণদের উচিত শেখ কামালের আদর্শ অনুসরণ করা। আজকে দেশে প্রমাণিত, বঙ্গবন্ধু পরিবারই সৎ ও সাহসী রাজনীতির প্রতীক। তাকে হত্যার পর রাজনৈতিক কারণে বহু মিথ্যাচার করে নিন্দা ছড়ানো হয়েছে, যেগুলো পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। খুনিরা হয়তো তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে; কিন্তু তার অবদানকে মুছে দিতে পারেনি।
আজ তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের ফুটবলের এ দুরাবস্থা হতো না, ক্রিকেটের মতো ফুটবলেও আমরা হতে পারতাম পৃথিবী সেরা। শুধু ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, শিল্প-সংস্কৃতির প্রত্যেকটা ধারায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারতাম সামনে থেকে। তাই শেখ কামাল আমাদের নান্দনিক ক্রীড়া সংস্কৃতি এবং মূল সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব।
শেখ কামাল আমাদের মননে চিরভাস্বর। সেই স্মরণের আনন্দিত পুণ্যাহ ৫ আগস্ট দিনটি এক দায়বদ্ধতাও জাগায়। ক্রীড়াঙ্গন, রাজনীতি এবং সংগীতের জন্য তার দানকে, তার সৃষ্টিকে পূর্ণ প্রাণে গ্রহণ এবং সমর্যাদায় সংরক্ষণের যোগ্য উত্তরাধিকার অর্জন করতে পেরেছি কি আমরা? ভাবনাটা আজ শঙ্কিত করে তুলেছে শেখ কামাল অনুরাগীদের। শেখ কামালের মৃত্যুতে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, তার জায়গা তো কেউই পূর্ণ করতে পারছেন না। ঘটনাটা সত্যিই দুঃখজনক, কোনো ক্রীড়া-সংগঠন সেভাবে দাঁড়াতে পারছেন না। তার ৭১ বছর জন্মদিনে স্মরণ করছি, আমরা বিগত দিনের পথের সঞ্চয়ই আজ হয়ে উঠুক আমাদের পাথেয়। সেই হোক তার অকৃপণ আশীর্বাদ।
শেখ কামাল প্রমাণ করেছেন, যে বীর সে জীবনের সমস্ত পর্যায়েই বীর। এই বীরত্ব, সম্মুখযুদ্ধের বীরত্বের চেয়ে সহজ তো নয়ই; বরং আরও কঠিন, ২৬ বছরের যুবক জীবনের যে কোনো দুর্যোগগ্রস্তের কাছে, সর্বার্থেই এক সংগ্রামের প্রতীক। সমস্ত অন্ধকারের মধ্যে এক মশাল বহনকারী। শেখ কামাল তো সাধারণ একজন থেকে গেছেন, ক্ষমতা তাকে স্পর্শ করেনি। একটু বদলাতে পারেনি। ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই ক্ষয় নাই’Ñ শেখ কামাল সবকিছু উৎসর্গ করে গেছেন দেশের জন্য। শেখ কামালের আত্মত্যাগের কথা আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। তার প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়াচক্র ছাড়া অন্য কোনো ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তার জন্মদিনে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে না- এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ বছরই প্রথমবার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে শেখ কামালের জন্মদিন পালন করেছে।
সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন শেখ কামাল। কথায় ও কাজে দেশপ্রেমিকের মতো তার উদাত্ত আহ্বানে সকল সংগঠন ও ক্রীড়াঙ্গনকে উদ্বুদ্ধ ও একতাবদ্ধ করেছে। তিনি সারাদেশের যুবক খেলোয়াড়, শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মীদের হৃদয় স্পর্শ করেছেন এবং কর্মে উদ্যোগী করেছেন। ৭১তম জন্মদিনে আজ আবার মনে পড়ে গেল কবি কামিনী রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতা “পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলই দাও, তার মতো সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।” আজ দেশের জন্য দরকার শুধু নিঃশঙ্ক-নির্ভীক, একজন শেখ কামাল। তার এই সুনির্দিষ্ট সময়টুকু ইতিহাসের পাতায় যাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকে।
লেখক : উত্তরণ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য