নূরুল ইসলাম নাহিদ : নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে শিক্ষায়-দীক্ষায় একটি অগ্রসর দেশ এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের প্রতিশ্রুতি। পাকিস্তান আমলের স্বল্প সময়ের রাষ্ট্র পরিচালনার সময় যেমন এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ছিল, তেমনি স্বাধীনতার পর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই লক্ষ্য অর্জনে গ্রহণ করা হয়েছিল বহুমুখী পদক্ষেপ। ১৯৯৬-২০০১ সালেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। মাঝে সাত বছর বিরতি দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করে আসছে। পরপর ৩টি নির্বাচনেই জনগণের বিপুল সমর্থন লাভ করে, সেই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচিও জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে গত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশ চরম দারিদ্র্যের দেশ থেকে ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উন্নত দেশ হিসেবে অবস্থান লাভে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে আজ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্য অর্জন এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক উন্নত দেশ গড়ে তোলার যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করা। সেজন্য প্রয়োজন আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক যুগের সাথে সংগতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা, জ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা।
গত এক দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শিক্ষাক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
গত এক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন, সংস্কার ও মানোন্নয়ন হয়েছে তা অতুলনীয়। তবে এই সাফল্যে আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে যেতে হবে অনেক দূর। বিশ্বমানের শিক্ষা জ্ঞান প্রযুক্তি দক্ষতায় এখন মান বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ।
ইতোমধ্যে আমরা যে সাফল্য অর্জন করেছি তা বিবেচনা করে দেখলে আমরাÑ এই আস্থা অর্জন করতে পারি যে আগামী দিনগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন এবং আধুনিক যুগের সাথে সংগতিপূর্ণ শিক্ষায় আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমরা স্বল্প সময়ে গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন তার মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো :
১. আমাদের ছাত্র-সমাজ, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দীর্ঘদিনের দাবিÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন। স্বাধীনতার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে এই স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৯৭৩-এ অধ্যাদেশ উপহার দেন। বঙ্গবন্ধু এভাবেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন।
২. বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় তার এক বক্তৃতায় বলেছেনÑ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং জিডিপি’র ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে। আজও আমরা তার অর্ধেকের বেশি বিনিয়োগ করতে পারি নাই। তার এই দূরদর্শিতা আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি। অবশ্য এটা আমাদের লক্ষ্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
৩. মুক্তিযুদ্ধের পরই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র-সমাজের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু ঘাতকের নির্মম হত্যাকা-ে বঙ্গবন্ধু তা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। তবে তারই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১০ সালে আমরা পরিপূর্ণ একটি শিক্ষানীতি তৈরি করে জাতীয় সংসদে পাস করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। এই শিক্ষানীতি দলমত নির্বিশেষে সকলেই মেনে নিয়েছেন। কেউই এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেনি।
৪. স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক সবই ছিল এক ধরনের সরকারি অবহেলার বিষয়। শিক্ষক বেতন পেতেন না বললেই চলত। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।
৫. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারিকরণ করেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো একসঙ্গে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং ১ লাখ ৫ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেন।
২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাক্ষেত্রে যে উদ্যোগ ও কর্মপ্রচেষ্টা এবং নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক কাজ হয়েছে, তা অতীতে কখনও চিন্তা করা যায়নি। এখানে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের কয়েকটি উদাহরণ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. আমাদের দেশের জন্য একটি উপযুক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি ও আন্দোলন অনেক পুরনো। ১৯৬২ সাল থেকে বহু আন্দোলন সংগ্রাম করেও এতদিন একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষার গুরুত্ব অগ্রাধিকার দিয়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে দেন। তারা একটি শিক্ষানীতির মৌলিক বিষয়গুলো প্রণয়ন করলেও তা পরিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করার সুযোগ পাননি। স্বাধীনতা, দেশ ও গণবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্র করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সকল সম্ভাবনাই নস্যাৎ করে দেয়। তারপর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা আবার দায়িত্ব নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করে তাদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ২০০৯ সালে একটি কমিটি করে শিক্ষাবিদসহ সমাজের সকল স্তরের ও রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের মতামত গ্রহণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে অনুমোদন নিয়ে তার বাস্তবায়ন চলছে। ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ সকলের সমর্থ লাভ করেছে, কেউই এর বিরোধিতা করেনি। শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার সার্বিক ক্ষেত্রে মৌলিক নীতি ও দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব গতি লাভ করেছে।
২. সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলোÑ ঐ সময়ে আমাদের শিশুদের অর্ধেকও স্কুলে ভর্তি হয় না। যারা ভর্তি হয়ও তার অর্ধেকই প্রাথমিক স্তরেই ঝরে পড়ে। পরবর্তী বিভিন্ন স্তরে এভাবেই ঝরে পড়া অব্যাহত ছিল। তাই সকল শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসা এবং ধরে রাখার জন্য শেখ হাসিনা সরকার ২০১০ সালে স্কুল, মাদ্রাসা, টেকনিক্যালÑ সকল ধরনের শিক্ষায় প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেওয়া শুরু হয়। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বই পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট বই বিতরণ করা হয়েছে ৩৩১ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৬১৬ খানা। এমন নজির সারাবিশ্বের কোনো দেশে নেই। বরং সবাই শুনে বিস্মিত হয়েছেনÑ এটা কী করে সম্ভব! গত চার বছর থেকে প্রি-প্রাইমারির শিশুদের জন্য বই দেওয়া হচ্ছে। ৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় বই দেওয়া হচ্ছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জন্য ব্রেইল বই দেওয়া হচ্ছে।
বই দেওয়ার ফলে সবাই ১ জানুয়ারি স্কুলে বই নিতে আসে। উৎসাহিত ও আনন্দিত হয়। ইতোপূর্বে যারা স্কুলে আসত তারা সকলে বই কিনতে পারত না। তাও কয়েক মাস পরে অনেক টাকা দিয়ে বই কিনতে হতো। প্রতি বছর ক্লাস শুরু হতো দু-তিন মাস পরে। কিন্তু বই দেওয়ার পর থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই বই পেয়ে শুরু হয়ে যায় সব শিক্ষার্থীর ক্লাস। এটা সারাদুনিয়ার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষাবিদদের জন্য অচিন্ত্যনীয় একটি কাজ।
৩. এখন শিক্ষার্থীকে স্কুলে ধরে রাখা এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেই লক্ষ্যেÑ নতুন পাঠক্রম তৈরি করা হয়েছে, বিকৃত ইতিহাস বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস শিক্ষার্থীরা শিখছে। শিক্ষকদের ট্রেনিং প্রদান করা হচ্ছে নিয়মিত, যাতে মানসম্মত শিক্ষাদানে তারা সক্ষম হন। দেশে-বিদেশে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন স্তরে অনেকগুলো প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে।
৪. বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দূর করে সবক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে-
(ক) বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ক্লাস হচ্ছে। এর জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
(খ) প্রত্যেক শ্রেণির পরীক্ষা নির্ধারিত সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং পরীক্ষার ফলাফলও যথাসময়ে দেওয়া হচ্ছে।
(গ) এসএসসি ও এইচএসসি-সহ সকল পাবলিক পরীক্ষা প্রতি বছর একই তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এবং পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হয়। একবারও এর কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
৫. আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাদানের লক্ষে আইসিটি শিক্ষা, কম্পিউটার শিক্ষার বিস্তারিত কর্মসূচি ও পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রযুক্তি ক্লাসরুমে ব্যবহার করে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
৬. উপযুক্ত স্তরে আইসিটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভে উন্নত মান ও সহায়ক পদ্ধতি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
৭. শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য উন্নত পাঠ্যক্রম, প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগানো প্রভৃতি এখন বহু নতুন ও আধুনিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে।
৮. ভর্তি প্রক্রিয়া সকল ক্ষেত্রে সহজতর এবং নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণ করে হচ্ছে।
৯. কারিগরি শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২০০৯ সালে আমরা যখন দায়িত্ব নেই তখন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১ শতাংশের একটু বেশি পড়াশোনা করত। ব্যাপক পরিকল্পনা করে কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা সেøাগান তুলিÑ “শিক্ষা আমাদের অগ্রাধিকার; কিন্তু অগ্রাধিকারের অধিকার হচ্ছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা”। আমরা লক্ষ্য নির্ধারণ করি, ২০২০-এর মধ্যে আমরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসব। ইতোমধ্যে তা বাস্তবায়নের পথে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয় বাছাই, হাতে-কলমের শিক্ষায় দেশে-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি ব্যাপক কার্যক্রম চলছে।
১০. মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন অতুলনীয়ভাবে এই শিক্ষাকে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল পর্যন্ত কোরআন ও হাদিস এবং বাকি সকল বিষয় আধুনিক শিক্ষা অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসি সিলেবাস পড়ানো হচ্ছে এবং পাবলিক পরীক্ষায় এসব বিষয়ে পরীক্ষা হচ্ছে।
১১. আলেমদের শতবর্ষের দাবি পূরণ করে ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা হয়েছে। ৭২টি মাদ্রাসায় অনার্স ক্লাস চালু করা হয়েছে।
১২. মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর গড়ে তোলা হয়েছে।
১৩. কওমি মাদ্রাসার প্রতি এতদিন কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এবং কওমি মাদ্রাসার আলেমগণ ও নেতৃবৃন্দের আগ্রহে তাদের সাথে ব্যাপক আলোচনার পর কওমি মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’ ডিগ্রিকে ‘মাস্টার্স’-এর সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ-বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল কওমি মাদ্রাসাকে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছেন।
১৪. বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে নারী শিক্ষায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। মেয়েরা পরীক্ষায় ফলাফলেও ভালো করছে। নারী শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে সকল স্তরে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে।
১৫. উচ্চ শিক্ষায় ব্যাপক প্রসার হয়েছে। বর্তমানে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯০টিরও বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেশব্যাপী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান প্রযুক্তি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা, বিশেষ করে আধুনিক জ্ঞান দান, গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাকে আধুনিক যুগের সাথে সংগতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা দক্ষতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলে আধুনিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বের যোগ্য করে তুলতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষা হবে আধুনিক সমপর্যায়ের জ্ঞানচর্চা গবেষণা ও দক্ষতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতা বিশ্বের যোগ্য করে গড়ে তোলা।
১৬. স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, উপবৃত্তি, আর্থিক সাহায্য ও নানা ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে। এছাড়াও নিয়মিত মেধাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
১৭. শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন নতুন বিষয়ের ওপর পাঠদান বিশেষ করে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পাঠদান করার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের জন্য ক্লাসরুম, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, কম্পিউটার শিক্ষা, আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা এবং এসবের জন্য গবেষণাগার অতি জরুরি। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক দশকে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে।
অতি সংক্ষেপে আরও কয়েকটি বিষয় নিম্নে দেওয়া হলো :
১. প্রতি উপজেলায় একটি মানসম্মত মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে মডেল স্কুল হিসেবে ঘোষণা করে বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে মান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা শুরু করা হয় ২০০৯ সালের পরে। এরপর ২০১৮ সালে সকল উপজেলায় একটি মাধ্যমিক স্কুল এবং একটি করে কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে সকল উপজেলায় দুটি মানসম্মত সরকারি কলেজ এবং সরকারি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে।
২. সরকারি উদ্যোগে সকল জেলায় একটি করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে আগে যেখানে ছিল না সেই ২৩টি জেলায় একটি মানসম্মত টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা লাভের সুযোগ লাভ করেছেন। বিভিন্ন স্তরে কারিগরি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যেÑ এই শিক্ষার পক্ষে অতীতের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। এখন অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষার্থী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহী। ২০১৮ সালে প্রতিটি উপজেলায় একটি আধুনিক ও উন্নতমানের সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথমে ১০০টি উপজেলায় প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করা হয়। এবং সেই সময় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেন এরপরে সকল উপজেলায় এ-রকম টিএসসি স্থাপন করতে হবে। ১০০টি টিএসসি-এর কাজ দ্রুত এগিয়ে গেলে সম্প্রতি একনেক-এ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাকি ৩২৯টি উপজেলায় টিএসসি স্থাপনের প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এছাড়াও ব্যাপক সংখ্যক বেসরকারি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আনুমোদন দেওয়া এবং এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত তদারকি করা হয়, ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষালাভ করছে। কয়েকটি জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ৮টি নতুন কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রত্যেক বিভাগে একটি করে মহিলা কারিগরি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে।
৩. প্রায় সকল প্রাথমিক স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে কয়েকটি স্কুলের ভবন নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
৪. ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬ হাজার ২২৩টি হাইস্কুল ও কলেজ ভবন (দোতলা, চারতলা, আটতলা ও দশতলা) শুরু হয়েছে। এর মধ্যেÑ ১২ হাজার ৭১১টির নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে। ১৩ হাজার ৫৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ ২০২১ সালের মধ্যে সমাপ্ত হবে। ২০০৯ সাল থেকে ৫ হাজার মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ২ হাজার ৫০০টি ভবন নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান আছে। এছাড়াও রাজস্ব খাতের আওতায় ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণ এবং ৩ হাজার প্রতিষ্ঠানে সংস্কারকাজ চলমান আছে। প্রশাসনিক ভবন, আধুনিক ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি, হোস্টেলসহ ভবন নির্মাণ হয়েছে।
৫. প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ১১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬টি সরকারি কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরের নিকটবর্তী এলাকায় ২০১৭ সাল থেকে ১০টি সরকারি স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। তিন বিভাগীয় শহরে ৭টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে।
৬. সারাদেশে শহর থেকে গ্রাম অঞ্চলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান। নবনির্মিত ভবন সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি যুগান্তকারী কাজ। বর্তমান উন্নত শিক্ষা এবং প্রযুক্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষার মান উন্নত করার বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার সাফল্য ও অগ্রগতিকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে উন্নত শিক্ষা, উন্নত প্রযুক্তি এবং উন্নত দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ তৈরির মাধ্যমে আমরা সফল হতে পারব।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সমৃদ্ধ একটি আধুনিক, অগ্রসর ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণই হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা-দর্শনের মূল কথা। সবার জন্য শিক্ষা, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের অভীষ্ট। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই অভীষ্ট অর্জনের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে।
লেখক : সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ