Monday, December 4, 2023
বাড়িকূটনীতিশান্তি, সমৃদ্ধি এবং অংশীদারত্ব

শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অংশীদারত্ব

সাইদ আহমেদ বাবু 
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৩টি দেশের সংস্থা ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) ২১তম সম্মেলন গত ১২ ও ১৩ মে দুদিনব্যাপী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
এতে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ২৫টি দেশের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্মেলনে যোগ দেন। এছাড়া, ডি-৮, সার্ক ও বিমসটেকের প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৫০ জন বিদেশি অতিথি সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বাংলাদেশ এই সংস্থার চেয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। সংস্থার বিদায়ী চেয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাত। সম্মেলনের আলোচনায় মৎস্যসম্পদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ব্লু ইকোনমিসহ মোট ৬টি বিষয় প্রাধান্য পায়। সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অংশীদারত্ব’। এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরীয় ৫টি সম্মেলন হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথম সিঙ্গাপুরে এ সম্মেলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শ্রীলংকা, ২০১৮ সালে ভিয়েতনাম, ২০১৯ সালে মালদ্বীপ, ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পঞ্চম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত ছয় বছরে এই সম্মেলন শান্তি, নিরাপত্তা, সহযোগিতা, সমুদ্র অংশীদারিত্ব, কৌশলগত, ভূ-রাজনীতিসহ নানা ইস্যুতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (আইওআর) দেশগুলোর শীর্ষ পরামর্শমূলক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
‘বিশ্বের আগামী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত। এখানে জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপত্তা, নন-ট্রাডিশনাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মিলিতভাবে মোকাবিলা করার ওপর নির্ভর করছে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি।’
ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দুদিনের ষষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।’ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সমুদ্র কূটনীতির ওপর জোর দিয়ে ছয়-দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সকল দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সর্বদা সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং এ সীমার মধ্যে সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য “টেরিটরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট, ১৯৭৪” প্রণয়ন করেন। আইনটি “সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন, ১৯৮২” ঘোষণার আট বছর আগে কার্যকর করা হয়েছিল, যখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে সীমিত ধারণা ছিল।’ তিনি বলেন, ‘কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে “শান্তির গ্যারান্টি হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ডায়ালগ, ২০২৩” শীর্ষক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তা সমগ্র বিশ্বের নর-নারীর গভীর আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন ঘটাবে।’ সেই প্রস্তাবে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে জাতির পিতার দেওয়া ভাষণ থেকে ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি রেজুলেশনের ১৪তম অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নীতিমালার অংশ। ঐ ভাষণে তিনি ভারত মহাসাগরকে শান্তিপূর্ণ এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ওপরে বিশেষভাবে জোর দেন। এই উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বৈরিতা নয়’- প্রতিপাদ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রচেষ্টায়ও জাতির পিতার উপর্যুক্ত উক্তিটি একইভাবে প্রাসঙ্গিক।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুসরণ করে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তির একনিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে ‘Culture of Peace (শান্তির সংস্কৃতি)’ সংক্রান্ত ঘোষণা এবং কর্মসূচি রেজুলেশন আকারে উত্থাপন করি, যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, জাতিসংঘ ২০০০ সালকে ‘International Year of Culture of Peace’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০১-২০১০ সালকে ‘Culture of Peace and the Decade of Non-violence’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’-এ ভূষিত করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদের শান্তি পুরস্কারটি ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আমরা জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, আমরা ১.১ মিলিয়নেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছি, যার ফলে এ অঞ্চলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থন কামনা করি।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সংকটের ফলে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেও জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অংশীদারত্ব এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে।’ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজ সিং রূপন, মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রাম মাধব প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়নের জন্য “সামুদ্রিক কূটনীতি” গড়ে তুলতে হবে, যার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’ এ অঞ্চলের অনেক দেশের জলবায়ু ঝুঁকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমাতে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তিনি সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়াদান, অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমসহ ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ চলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এবং তেল পরিবহনের ৬০ শতাংশ এই অঞ্চলের মহাসাগর ও সমুদ্রপথে পরিচালিত হয় এবং বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রকৃত ব্যয় গত ১৫ বছরে তিন গুণ বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মহাসাগর সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে চমৎকার সুযোগ প্রদান করে। তবুও অনেক সম্ভাবনা এখনও অব্যবহৃত রয়ে গেছে।’
এই ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বঙ্গোপসাগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভারত মহাসাগর-সংশ্লিষ্ট বহুপক্ষীয় ফোরামে শুধু বাংলাদেশের ভূমিকাই নয়, এমন কী বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, পররাষ্ট্রনীতি ও এর অবকাঠামোগত পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২টি সমুদ্রবন্দর বিদ্যমান। এর মধ্যে ৩টি : চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বাংলাদেশের জলসীমানায় অবস্থিত। শিগগিই এ সংখ্যা ১৩টিতে উন্নীত হবে। আর নতুন বন্দরটিও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এই বাংলাদেশের সীমানাতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য একটি নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণা করেছে এবং সেই সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যগুলোকে তুলে ধরেছে। সাম্প্রতিক রূপরেখার প্রধান লক্ষ্য হলোÑ এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ নানা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত এবং অন্য সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধান করা। অন্যদিকে বাংলাদেশ চীনের বিভিন্ন দাবি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা দিয়ে অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য মূলত একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তবে বাংলাদেশ বলেছে ‘কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’- এই নীতিতে ইন্দো-প্যাসিফিকের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে। এর লক্ষ্য আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করা, সামুদ্রিক বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, বিনিয়োগের সুযোগ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে নতুন কৌশলগত জোট প্রবর্তন করা। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি এবং সব দেশের সার্বভৌম সমতা বজায় রাখার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্য একটি উন্মুক্ত, মুক্ত এবং ন্যায্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করা। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করতে চায়, বিশেষ করে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রযুক্তিগত নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে।
গত কয়েক বছরে বিশ্ব পরিবর্তিত হয়েছে। যখন ব্লকটি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল, তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক দৃশ্যপট ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থের ন্যূনতম সংঘাত দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু এখন বিশ্ব ধীরে ধীরে মেরুকৃত এবং ক্ষমতা, সম্পদ ও আধিপত্যের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কোয়াড-চীন দ্বন্দ্ব এবং ইউক্রেন যুদ্ধ হলো চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত পরীক্ষা। এ পটভূমিতে, ভারত দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আবার ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এখন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ (কিউএডি), ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস), ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মতো নতুন কৌশলগত ও নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা এবং মানবপাচার বেড়ে যাওয়ায় জোটটি ফের সক্রিয় হয়েছে। সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং ভারত মহাসাগরে সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য অপরাধ মোকাবিলা ভারতের জন্য তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং এ অঞ্চলে সবার জন্য নিরাপত্তা বাড়ানোর মতবাদের অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আইওসি আয়োজনের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হবে। আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারত্ব ও পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে সম্মেলনটির আয়োজন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সক্রিয়তা সম্প্রসারণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ অঞ্চলে যা ঘটবে তার মধ্য দিয়েই অনেকাংশে বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২৭০ কোটি মানুষ বাস করে, যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এবং গড় ৩০ বছর বয়সীদের শতকরা হার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে।
ভারত মহাসাগর বিশ্বের পুরো সমুদ্রপৃষ্ঠের এক-পঞ্চমাংশ। এটি বিশ্বের মানুষ ও অর্থনীতিকে সংযুক্ত করেছে। এর বিস্তীর্ণ উপকূলরেখার মধ্যে রয়েছে হরমুজ প্রণালি থেকে শুরু করে মালাক্কা প্রণালি পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথ। সারাবিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবহনকৃত তেলের চালানের ৮০ শতাংশই ভারত মহাসাগরের জলসীমা অতিক্রম করে থাকে। কিছু মৎস্যভাণ্ডারও রয়েছে এ অঞ্চলে। সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ও বিশ্বজুড়ে মানুষের খাবার জোগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুস্পষ্ট কারণেই, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিকে আমাদের সকলের আগ্রহ রয়েছে।
এ অঞ্চলটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জলবায়ু সংকট আমাদের সবাইকে স্পর্শ করে, তবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে এর প্রভাব অসম। জলবায়ু পরিবর্তন কিছু দেশ, বিশেষত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে অস্তিত্বের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এদিকে জলদস্যুতা, সমুদ্রে সশস্ত্র ডাকাতি ও পাচার সমুদ্র এলাকায় নিরাপত্তার অবনতি ঘটাচ্ছে। তাছাড়া অবৈধ, অজানা ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ শিকার সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির জন্য এটি টেকসই করা প্রয়োজন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বহুপাক্ষিক সংস্থা, সুশীল সমাজ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক পন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। আর এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। সে-কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে দূষণমুক্ত জ্বালানিনির্ভর ভবিষ্যতে উত্তরণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রদানের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
বৈশ্বিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সংকটের ফলে বিশ্বের সব মানুষের জীবনযাত্রায় অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলও জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে আমাদের স্বপ্ন হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি আধুনিক, জ্ঞানভিত্তিক উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার কর্মসূচির ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ নির্মাণ করা এবং ‘ভিশন ২০৪১’ অর্জনের জন্য ভারত মহাসাগরে স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে। এ লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য কৌশল হিসেবে আমরা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সবার জন্য সুযোগ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করছি।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য