রাজিয়া সুলতানা
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোট উৎপাদনের প্রায় ২৪ শতাংশ আসে সরাসরি কৃষি থেকে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ। প্রতিনিয়ত কাজ হচ্ছে কৃষির সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন নিয়ে। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় ব্যতিব্যস্ত নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবনের ছক নিয়ে। এর সুফল এসেছে দানা ফসল উৎপাদনে। ৫০ বছরে জাত উন্নয়নে দানা ফসলের ফলন বেড়েছে কয়েক গুণ। এরই ধারাবাহিকতায় বিনা ধান-২৩ নামে বীজ উন্মোচন নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এই জাতের ধান লবণাক্ত ও নিমজ্জনশীল অঞ্চলেও সহনশীলভাবে উৎপাদিত হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছে। যা বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলবর্তী সুবিশাল লবণাক্ততা (২ মিলিয়ন হেক্টর) ও জলমগ্ন জমিতে ধান চাষের এক বিশাল দুয়ার উন্মোচন করেছে।
প্রায় এক দশক আগে বিনার বিজ্ঞানী ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম প্রতিকূল পরিবেশে উৎপাদনশীল ধানের জাত উন্নয়নে গবেষণা শুরু করেন। এর নিমিত্তে তিনি ধানের নির্দিষ্ট জাতের পরাগ ও চারার ওপর বিভিন্ন মাত্রার গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করেন। গামা রেডিয়েশন হলো এক ধরনের তেজস্ক্রিয় রশ্মি। যা বিভিন্ন মাত্রায় মাতৃগাছে প্রয়োগ করে আরোপিত মিউটেশন ঘটানো হয়। কিন্তু জীবে প্রতিনিয়ত নিজে নিজে প্রাকৃতিক মিউটেশন ঘটতে থাকে। বিনা হলো বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই কৃষি খাতে পারমাণবিক কৌশল কাজে লাগিয়ে আরোপিত মিউটেশনের মাধ্যমে ফসলের নানা জাত উদ্ভাবন করছে। এ প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবনে বাহ্যিকভাবে গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করে জিনগত পরিবর্তন করেন। রেডিয়েশন প্রয়োগের পর বিজ্ঞানীরা মাতৃগাছের ফেনোটাইপিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে। যেসব গাছে এরপর কাক্সিক্ষত পরিবর্তন পাওয়া যায়, তা নির্বাচনের মাধ্যমে ব্রিড লাইন সাজানো হয়। অতঃপর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট লাইনকে জাত হিসেবে ছাড় দেওয়া হয়।
বিজ্ঞানী ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম এই গবেষণায় গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মিউট্যান্ট সৃষ্টি করেছেন। এরপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এম৬ জেনারেশনে ৩টি উন্নত মিউট্যান্ট শনাক্ত করেন। প্রাপ্ত মিউট্যান্টগুলো মাতৃগাছ অপেক্ষা উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এদের মধ্যে তিনি বিনা ধান-২৩ জাতটিকে সকল যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে জাতীয় বীজ বোর্ডে জাত হিসেবে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন। জাতীয় বীজ বোর্ডের সভায় বিনা ধান-২৩ জাতটি কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। জাতটি জোয়ার, লবণাক্ততা ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় আমন মৌসুমে চাষের উপযোগী। জাতটি ৮ ডিএস/এম মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এবং ১৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্ন অবস্থায় বেঁচে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতটি খুবই সময়োপযোগী। কারণ বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবেশ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। হারিয়ে যেতে পারে ৩০০০ মিলিয়ন হেক্টর চাষের জমি। ফলে উৎপাদন হ্রাস পাবে প্রায় ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১.৪০ বিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে ১.০ মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ত। লবণাক্ত জমিগুলো সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অবস্থিত। লবণাক্ততার কারণে এক সময় এ অঞ্চলে ধান চাষ হতো না। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ মতেÑ বাংলাদেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি জলমগ্ন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন কারণে কখনও কখনও বিভিন্ন অঞ্চলে এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত জলমগ্নতা স্থায়ী হয়। ধানের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কৃষকদের নতুন করে চাষ করতে হয়; আবার কখনও বা জমি পতিতই থেকে যায়।
ঊর্ধ্বমুখী জনসংখ্যার দেশ, বাংলাদেশ। বাড়তি জনসংখ্যার জন্যও প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। প্রতি বছরই সরকারকে কৃষি পুনর্বাসনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ-কারণে খাদ্য ঘাটতিরও সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে বিনা ধান-২৩ এক যুগোপোযোগী আবিষ্কার। এই জাতের ধান লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহনশীল হওয়ায় বাংলাদেশে সামগ্রিক ধান চাষের এলাকা বৃদ্ধি পাবে, যা কৃষকদের মধ্যে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। পাশাপাশি এই জাতের ধানের ফলনও বেশি (৫.৫ টন)। তাই কৃষকরা আমন মৌসুমে কোনো ঝুঁকি ছাড়া এই জাতের চাষ করতে পারবে। এই জাতের পাতা গাঢ় সবুজ, ডিগ পাতা খাড়া, ডালপালা, পাতা ও কা- খুবই মজবুত, ঝড়ো হাওয়ায় হেলে পড়ার প্রবণতাও বেশ কম। পাকা ধানের রং স্বাভাবিক সোনালি। ধানের শীষ মাঝারি আকারের, নন-স্টিকি এবং সুস্বাদু।
আরোপিত মিউটেশনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত জাত পাওয়া গেলেও জিনোমের কোথায় ডিএনএ-র পরিবর্তন হয়েছে তার ব্যাখা বিজ্ঞানীরা শুরুতে জানতে পারেননি। ফলে বিনা ধান-২৩ এর সম্পন্ন জীবন রহস্য উদঘাটনে শুরু হয় গবেষণা। এই কাজে যৌথভাবে যুক্ত হয় বিনা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। সাধারণভাবে কোনো জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম দ্বারা; যা ক্রোমোজোম দিয়ে তৈরি, যা অসংখ্য জিন দিয়ে তৈরি। জিনগুলো সাধারণত ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড দ্বারা তৈরি। আর ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড হলো চার ধরনের নিউক্লিওটাইডের বেজ; যেমনÑ অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থাইমিন দিয়ে তৈরি। সকল জীবের ক্রোমোজমে এই ৪টি বেইজ ঘুরে-ফিরে বিভিন্ন কম্বিনেশনে থাকে। আর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য আবিষ্কার করতে হলে তার সম্পন্ন জিনোমসের বেজ ৪টির সম্পূর্ণ বিন্যাসের আবিষ্কার করতে হয়। বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রম গবেষণায় ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ আবিষ্কৃত হয়েছে বিনা ধান-২৩ এর জীবন রহস্য। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম এই ধানের জীবন রহস্য আবিষ্কার করেছে। এর আগেই অবশ্য ২০১৯ সালে মাতৃগাছ এবং নির্বাচিত ৩টি মিউট্যান্ট ধানের জীবন রহস্য আবিষ্কার হয়েছিল।
বিনা ধান-২৩ এর জীবন রহস্য আবিষ্কার সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেন, দেশের ২ মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ত, যেখানে বছরে একটি মাত্র ফসল উৎপাদিত হয়। খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করতে ও ভবিষ্যতের ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বর্তমান সরকার লবণাক্ত ভূমি, হাওরসহ প্রতিকূল অঞ্চলে বছরে ২-৩টি ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছি। বিনা ধান-২৩ জাতের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচনের ফলে লবণাক্ত ও জলমগ্ন অঞ্চলে উৎপাদন সহজতর হবে। ফলে আগামীতে আমরা আরও নতুন জাতের ধান আবিষ্কার করতে পারব।
আমাদের বিশ্বাস, অন্যান্য ফসলের জীবন রহস্য আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের দেশে বিজ্ঞানীরা আগামী ফসলেরও উন্নত প্রজাতি উৎপাদন করতে সক্ষম হবেন। যা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কৃষি গবেষণার মাধ্যমে শুধু নতুন জাত উদ্ভাবন করলেই হবে না। এই গবেষণালব্ধ জাতগুলোকে যথাযথভাবে প্রান্তিক চাষিদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে হবে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়নে কৃষি গবেষণা কার্যক্রমকে যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে; তা নিশ্চিতভাবে প্রশংসনীয়। কৃষি এবং অর্থনীতিতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদেরও উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি, নতুন জাত প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি নিবিড় পর্যবেক্ষণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
raziasultana.sau52@gmail.com