ড. এম আবদুুল আলীম: মাতা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি- সকলের কাছেই প্রিয়। এসবের অপমান-অবমাননা কেউই সহ্য করতে পারে না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চালালে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই ক্ষোভের সূত্র ধরেই গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন। বলা যায়, ভাষা-সংস্কৃতির গৌরবে বলীয়ান ও দীর্ঘকালের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি আপন অস্তিত্বের অহঙ্কারে তীব্র আক্রোশ আর বীরত্বের হুঙ্কারে প্রথম জেগে উঠেছিল ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালির এই জাগরণের মূলে ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর দরদ ও ভালোবাসা। দুর্যোগ-দুঃশাসনকবলিত বাঙালির বাঙালিত্বের অহমিকা এমন বজ্রকঠিনরূপে আর কখনও প্রকাশ পায়নি। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বাংলা মায়ের তেজোদীপ্ত সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ’৫৪-র নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করে তিনি হয়ে ওঠেন এই ভূখ-ের মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শুধু তাই নয়, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের মূল নায়ক ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান নেতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে লাভ করেছেন গৌরবোজ্জ্বল স্থান। স্বীয় নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সংগ্রামী জীবনের শ্রেষ্ঠ ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে লাভ করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং ‘জাতির জনক’-এর মর্যাদা।
আটচল্লিশের ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা
টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ শেখ মুজিব অতি অল্প বয়সে রাজনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হন। শৈশবেই তার মধ্যে জাগ্রত হয় অন্ন-বস্ত্রহীন মানুষের প্রতি দরদ ও গভীর মমত্ববোধ। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শেখেন। ধীরে ধীরে বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই রাজনৈতিক অঙ্গনে বৃদ্ধি পায় তার বিচরণ। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে তার মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাধিকারবোধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা ও নেতৃত্বদানের গুণাবলি। জাতির মুক্তি আকাক্সক্ষা আর পরাধীনতার জটাজাল ছিন্ন করতে তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। কলকাতায় অবস্থানকালে নেতাজী সুভাষ বসু হয়ে ওঠেন তার রাজনীতির প্রেরণাপুরুষ। যুক্ত হন হলওয়েল মনুমেন্টবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর তথা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের বিজয়লাভে রাখেন বিশেষ অবদান। এভাবে ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গদেশে যৌবনকালেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের অব্যবহিত পরে শেখ মুজিব স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে নতুন ধারার কল্যাণধর্মী রাজনীতি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। প্রগতিশীল ও উদার রাজনৈতিক বলয়ের বন্ধু-বান্ধব ও সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে কার্যনির্বাহী কমিটিতে যুক্ত হন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি প্রথম থেকেই প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সরকারি নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণের পাশাপাশি লিফলেট ছেপে তা জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করেন। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে আয়োজিত সর্বদলীয় সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠনে কাজ করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘটের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে এক সভায় ১১ মার্চের কর্মসূচিতে কে, কোথায়, কী দায়িত্ব পালন করবেÑ তা নির্ধারণ করেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ১১ মার্চ সকালে কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি জেনারেল পোস্ট অফিস ও ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পিকেটিং করেন। পিকেটিং করার সময় পুলিশি হামলার শিকার ও গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবসহ অনেককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
১১ মার্চের ধর্মঘটে পুলিশের লাঠিচার্জ ও নির্বিচারে গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলন আরও প্রবল রূপ ধারণ করে। এই আন্দোলন প্রশমন এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর শান্তিপূর্ণভাবে করার লক্ষ্যে সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ৮-দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির শর্তগুলো যথাযথ হয়েছে কি না তা কারাগার থেকেই দেখে দেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। এদিকে “শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৬-৩-৪৮-এ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এস এন একাডেমি এবং এম এন ইনস্টিটিউটের ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নাজিমুদ্দীন নিপাত যাক’, ‘মুজিবকে মুক্তি দাও’, ‘অন্য গ্রেফতারকারীদের মুক্তি দাও’ ইত্যাদি সেøাগান দেয়।” তবে তার আগেই ১৫ মার্চ ১৯৪৮, তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন : “বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সংশোধনীগুলি গৃহীত হলো এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলো।” সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইনসভার সামনে লাঠিচার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে।’ ২১ মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম।” ১৬ মার্চের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্ব করা প্রসঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন : “১৬ তারিখ সকাল থেকে আমরা সভার ব্যাপারে কাজকর্ম করতে থাকলাম এবং বেলা দেড়টা দুটোয় সভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুরু হলো। সভায় সভাপতিত্ব করলো শেখ মুজিবর রহমান। সেই বক্তৃতা করলো এবং একটি মিছিল নিয়ে আমরা Assembly House-এর দিকে গেলাম।”
১৭ মার্চ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নাইমউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সন্ধ্যার পর ফজলুল হক হলে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র সভা অনুষ্ঠিত হয়, এই সভায় শেখ মুজিব যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঢাকার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনার জবাবে তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলেন : “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়।” তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদকারীদের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার-পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না।’” এরপর ভাষা-আন্দোলন ধীরে ধীরে থেমে গেলেও ভাষার প্রশ্নে চলতে থাকে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা। ঐ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সামনে অনুষ্ঠিত এক সভায় কতিপয় ছাত্রনেতা উর্দুপ্রীতিমূলক বক্তৃতা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতিবাদ জানান।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন। তার সফরকে কেন্দ্র করে “১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক বসে। আজিজ আহমদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আব্দুল মান্নান, আনসার এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।” এতে ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও বিভিন্ন ছাত্র-আন্দোলনের সময় ছাত্রদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে গঠন করা হয় ‘জুলুম প্রতিরোধ কমিটি’। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ‘জুলুম প্রতিরোধ’ কমিটির উদ্যোগে হরতাল, মিছিল ও ছাত্র-সমাবেশ আয়োজন করা হয়।
এভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অতি উজ্জ্বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাংগঠনিক কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বস্তুত, ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তিনি ঢাকার ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হন এবং নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের শক্ত ভিত নির্মাণ করেন।
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। “জেল থেকেই তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্র নেতাদের গোপনে দিক-নির্দেশনা দিতেন।” শুধু তাই নয়, তিনি “জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।” মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছেন : “১৯৫২ সালের একুশের আন্দোলনে তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। কারাগারে থেকে নানাভাবে তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ঐ সময়টায় তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে, তাই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তখন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই ভবনে অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গভীর রাতে রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আলোচনা করতেন।” পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালের ৩০শে আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ সময় আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, চিকিৎসক, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। ১৯৫১ সালের ১৩ই নভেম্বরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঐদিন সকাল ৯টায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তাঁর কয়েকজন পুরনো বন্ধু, আনোয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইন এবং প্রায় ৩০ জন মেডিকেল ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ৩০শে নভেম্বর ১৯৫১ তারিখে সকাল ৯.১৫টায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও জনৈক নজরুল ইসলাম। তাঁরা ৯.১৫টা থেকে ৯.৪৫টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আব্দুস সালাম খান নামক এক গোয়েন্দা সদস্য একটু দূরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও, তাঁরা কি বিষয়ে আলাপ করেন, তা শুনতে পাননি বলে ৩০শে নভেম্বর, ১৯৫১ তারিখের গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন। (সূত্র : Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 123) ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, আজিজ আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী ও সহ-সভাপতি কাজী গোলাম মাহবুুব। তারা সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে নানা আলাপ করেন। এভাবে হাসপাতালের কেবিন থেকে নিরাপত্তা-বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান “পুলিশের নজরকে ফাঁকি দিয়ে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা এবং ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে পরামর্শ প্রদান” করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, সেখানে বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে থাকেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরে এসে ১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি পুনর্ব্যক্ত করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা-বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের। কেবল তাই নয়, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বায়ক যাতে ছাত্রলীগ থেকেই করা হয়, সে-বিষয়েও শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশনা দেন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং বিভিন্ন ভাষণে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন। তিনি লিখেছেন : “আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে।… বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে।… সেখানেই ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত গঠন করতে হবে।”
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় কারাগারে বন্দি অবস্থায় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ হয়েছে, সরাসরি কথা হয়েছে এবং তিনি আন্দোলন সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। এবং সে নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ও ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথেÑ নারায়ণগঞ্জে। তাছাড়া কারাগার থেকে চিঠির মাধ্যমে, টেলিগ্রামের মাধ্যমে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথে নারায়ণগঞ্জে এবং চিরকুট পাঠিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এটিও সত্য। ভাষা-আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন, এটা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কর্মকা-, বক্তৃতা-বিবৃতি ও সমকালীন পত্র-পত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা করলেই প্রমাণিত হয়।
কারাগারে বসে তিনি এবং মহিউদ্দীন আহমদ ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করলে ভাষা-আন্দোলনে কর্মসূচিতে আসে উৎসাহ ও প্রেরণা। তাদের মুক্তির দাবি যুক্ত হয়ে ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি ভিন্নমাত্রা পায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট পালনের যে দাবিনামা দেওয়া হয়, তার একটিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি যুক্ত করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ শরীরেও তিনি গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে প্রাণহানির ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বিবৃতি পাঠান এবং শহিদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে এসে নিরাপত্তা-বন্দিদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : “আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম। ‘হিন্দু ছাত্ররা’ কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, এ কথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচ ছয়জন লোক মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান কি না? এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল, একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের গদিতে থাকার অধিকার নেই।”
১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, “জনসাধারণের ন্যায্য দাবী আন্দোলনকে সরকার রাষ্ট্রের ও এজেন্টদের বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন : এরাও দুশমনের উপর গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করেছেন। আমার বিশ্বাস শত শত মানুষ আমাদের অনুসরণ করিতেছেন। তার মতে রাষ্ট্রে এর চেয়ে আর কোন আইন থাকতে পারে না।”
১৯৫২ সালের জুন মাসে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আদায় করেন এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তাকে দিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করান। বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯শে জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য চীন সফরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন।’ এতে বাংলা ভাষার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে আয়োজিত ঐ জনসভায় বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা কামরুজ্জামান, দেওয়ান মাহবুব আলী, ইব্রাহিম ত্বাহা, সুলেমান খান, আশরাফ ফারুকী, মুহম্মদ এমাদুল্লাহ, গাজীউল হক প্রমুখ।
১৯৫৩ সালের শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন এবং উর্দুকে বয়কট করার ব্যাপারে সোচ্চার হন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি “ঢাকার এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, এ দেশ জুড়ে উর্দু বয়কট করার জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে।” এ বছর ৫ই ফেব্রুয়ারি বগুড়ার একটি জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে : “বক্তৃতার সময় শেখ মুজিব বলেন, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এখানকার স্কুল-কলেজে নূরুল আমীন সরকার উর্দু চালু করেছেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তার স্কুল-কলেজে বাংলা চালু করেনি। তারা যদি বাংলাকে না মেনে নেয়, তাহলে কয়েক মাস পর আমরাও উর্দুকে বয়কট করব।”
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঐদিন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ঢাকার সর্বস্তরের মানুষ প্রভাতফেরি, শোভাযাত্রা, শহিদদের কবর জিয়ারত এবং আলোচনা-সভার আয়োজন করে। এতে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গোলাম মাহবুব এবং ছাত্রলীগ নেতা এমএ ওয়াদুদসহ অনেকে। ঢাকা প্রকাশ-এ শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলা হয় : “আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব মুজিবুর রহমান সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, গত বৎসর ঠিক এমন দিনে পূর্ব্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর ভাষা বাংলাকে আজাদ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীতে ঢাকা শহরে ছাত্র ও জনসাধারণ নির্ভীকভাবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়াছে। তাহারা সেই দিন যে নতুন ইতিহাস রচনা করিয়াছে, সমগ্র জাতি তাহা চিরদিন শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিবে। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে তিনি ‘জাতীয় কারবালা দিবস’ বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে। হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলিয়া মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন। তিনি সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করিবার জন্যও দাবী জানান।”
১৯৫৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি-সংবলিত শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ১১ মার্চ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র উদ্যোগে ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১২ মার্চ দৈনিক আজাদ-এ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবী’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয় : “গতকল্য (বুধবার) শহরের বিভিন্ন ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কর্ত্তৃক রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়। এই উপলক্ষে গতকল্য সর্ব্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম্মপরিষদের পক্ষ হইতে ছাত্র জনসাধারণের নিকট ব্যাজ বিক্রয় করা হয় এবং সন্ধ্যায় বার লাইব্রেরী হলে এক আলোচনা সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব আতাউর রহমান। সভায় অধ্যাপক আবুল কাসেম, পূর্ব্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য আবদুল মতিন, আওয়ামী লীগের জমিরুদ্দীন আহম্মদ, গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবীতে বক্তৃতা করেন।”
স্বাধিকার-সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু একুশের চেতনার লালন ও প্রসারে কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাদানের পাশাপাশি এ ভাষাকে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান যেসব কারণে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তা হলো : ‘(ক) ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ দিবসেই (১৯৪৮, ১১ মার্চ) শেখ মুজিব মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার বরণ করেন। (খ) ১৫ মার্চ মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি খাজা নাজিমুদ্দীনের স্বাক্ষর করা আট-দফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। (গ) বায়ান্নর আন্দোলনে জেলে বসে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের মতের বিরুদ্ধে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ছাত্রলীগের সদস্য ও সমর্থকদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে থাকতে নির্দেশ দেন। (ঘ) তিনিই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বাংলা ভাষার পক্ষে মত পরিবর্তনে বাধ্য করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপদেশে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা আন্দোলনবিমুখ ভূমিকা গ্রহণ করলে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য লাভ দুরূহ হয়ে উঠত। (ঙ) তিনি কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতাদের সরকারের বিশেষ দমননীতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। (চ) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন এবং নেতৃত্ব দেন। (ছ) বাংলায় রোমান হরফ প্রবর্তনের আইয়ুবি চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুনীর চৌধুরীসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তার প্রতি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। (জ) আইয়ুব-মোনেম সরকারের রবীন্দ্র সঙ্গীতবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আওয়ামী লীগের সভায় উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। (ঝ) স্বাধীনতার পর সংবিধানে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিধিবদ্ধ করেন। (ঞ) জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় সর্বপ্রথম ভাষণ দিয়ে বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় উন্নীত করেন।” ভাষা-আন্দোলনের ফলে তার মধ্যে যে চেতনা জাগ্রত হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেন, তা তাকে স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের শক্তি দান করে এবং তাকে অবতীর্ণ করে ইতিহাসের মহানায়কের ভূমিকায়।
এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অসামান্য। মূলত, ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমেই ঢাকার রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জাগ্রত জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন এবং বাস্তবায়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে স্বাধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ও জাতিসংঘে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু যে অবদান রেখেছেন, তার ফলে ইতিহাস তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। বস্তুত, ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক মঞ্চে শেখ মুজিবুর রহমানের যে আবির্ভাব ঘটে, আলোচনা-সমালোচনা কিংবা অন্ধ-বিদ্বেষ দ্বারা তা যেমন খারিজ করা যায়নি, তেমনি অতি মাত্রায় স্তাবকতা করেও তার হেরফের ঘটানো সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তার যে ভূমিকা তা ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই হয়ে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই ভাষা আন্দোলনে তার অবদানকে যারা ইতিহাসের ‘কল্পকাহিনী’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাদের সে প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হয়েছে; তেমনি অতি বন্দনা দ্বারা যারা তাকে সকল কৃতিত্বেও ভাগীদার করতে চেয়েছেন, তারাও ব্যর্থ হয়েছেন। ঐতিহাসিক সত্যের কাছে উভয় পক্ষের সকল দুরভিসন্ধি পরাভূত হয়েছে।
লেখক : গবেষক-প্রাবন্ধিক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক