Sunday, September 24, 2023
বাড়িUncategorizedরাজনীতিবিদের স্ত্রী

রাজনীতিবিদের স্ত্রী

পাপড়ি রহমান

দুধ-সাদা মুল্মুল কাপড়ের ওপর একটা একটা করে সুতার লাছি ফেলে দেখছিল রেণু। কোন রঙের সুতায় এমব্রয়ডারির নকশাটা ফুটবে ভালো, তা কাপড়ে সুতার লাছি ধরলেই বোঝা যায়। সুতার রং না-হয় নির্বাচন করা গেল, রেণু মুসিবতে আছে রুমালে কী সেলাই দেবে সেটি নিয়ে। লেইজি-ডেইজি, ডালফোঁড় না কাশ্মীরি স্টিচ, না-কি ভরাট সেলাইয়ে আঁকবে সে রুমালের কোণ? রেণু অবশ্য পূর্বেই ঠিক করে রেখেছে রুমালের জমিনে এবার সে আঁকবে সবুজ দুটি পাতা আর লাল গোলাপের একটা আধফোঁটা কুঁড়ি। কিন্তু কোন এমব্রয়ডারিতে এসব আঁকবে তা সে স্থির করেনি। এদিকে হাতে সময়ও বেশি নেই। ১৭ মার্চ আসার আগেই রেণু কাজগুলো শেষ করতে চায়। ১৭ মার্চ মুজিবুরের জন্মদিন। রেণু এবার ভেবে রেখেছে মুজিবুরকে সারপ্রাইজ দেবে। নিজের হাতে সেলাই করে ২৫টা রুমাল মুজিবুরকে উপহার দিতে চায় সে। রুমালের সাথে কিছু তাজা গোলাপও দেবে। কিন্তু রেণু চাইলেই তো আর হবে না! মুজিবুর ব্যস্ত মানুষ- দেখা গেল জন্মদিনের দিনই হয়তো সে পার্টির কাজে কলকাতায় চলে গেছে। নইলে চলে গেছে কোনো জনসভায় বক্তৃতা করতে। তখন কোথায় থাকবে জন্মদিন, কোথায় লাল গোলাপের কুঁড়ি আর কোথায়ই-বা কী? যার জন্মদিন সে যদি পাশে না-থাকে তখন শুধু তাজা গোলাপ নয়, মনের ভেতরে ফুটন্ত সমস্ত ফুল বাগানটাই মরে যেতে কতক্ষণ?
তাজা গোলাপ কিংবা ফুল বাগানের মরণ-বাঁচন নিয়ে আরও পরে ভাবা যাবে, আপাতত এমব্রয়ডারি নিয়ে ভাবা যাক। রেণু লেইজি-ডেইজি দিতে চায় না রুমালে। কারণ এটা একটা ফাঁকিবাজি সেলাই। তাছাড়া এই সেলাইয়ে গোলাপ ভালো করে ফুটবেও না। কাশ্মীরি সেলাইতেও না। গোলাপ ফুটে ওঠে ভরাট সেলাইয়ে। রেণুর মনে আরও একটা সুপ্ত ইচ্ছে রয়েছে- দুটি সবুজ পাতা আর লাল গোলাপের কুঁড়ির নিচে নিজের নামের আদ্যাক্ষর ইংরেজি ‘আর’ অক্ষরটা বসিয়ে দেবে। এই ‘আর’ সে বসিয়ে দেবে নীল সুতায়। ধীরে-সুস্থে। একেবারে নিখুঁতভাবে সেলাই করে। যাতে লাল-সবুজের নিচে নীল ‘আর’ ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে। নিজের নামের আদ্যাক্ষর রেণু রুমালের কোণে সেলাই করে দিতে চায়- কারণ মুজিবুর যেখানেই যাবে ‘রেণু’ নামটা যেন তার সাথে সাথে যেতে পারে। এ কাজটা করার আগে রেণু অনেকবার ভেবে দেখেছে- মুজিবুর তার এই ছেলেমানুষি দেখে হো হো করে হেসে উঠতে পারে। হাসতে হাসতেই হয়তো বলবে-
রেণু, এখনও কী যে ছেলেমানুষি তোমার? আমি যেখানেই যাই তুমি আমার সাথেই থাকো। থাকোই। থাকবে চিরদিনই। তুমি সদাই থাকো এই এইখানে- এই যে এইখানে।
বলে মুজিবুর হয়তো নিজের বুকের ওপর নিজের ডান হাতের তর্জনী ঠুকে দেবে।
দৃশ্যটা কল্পনা করে রেণুর মুখে লালচে-আভা জাগে। কেন সে আগেভাগেই এতকিছু ভাবছে? আগে রুমালগুলোর সেলাই সম্পন্ন হোক তো।
রেণু নিপুণ হাতে মুল্মুল কাপড়ের টুকরোটা ছোট ছোট স্কয়ার রুমালের শেইপে কেটে নেয়। এখন এই কাপড়ের কোণে টাইট করে কাঠের-ফ্রেম সেঁটে রেশমি সুতোর ফোঁড় দিয়ে গোলাপ ফুটাবে সে। আধ-ফুটন্ত গোলাপ কুঁড়ির তলায় দুটি সবুজ-সতেজ পাতা! আর তার নিচে একটি ছোট্ট অক্ষর- ‘আর’!
সেই কবে পুতুল খেলার বয়সের আগেই বিয়ে হলো রেণুর। বাবা-মা হারা রেণুর বয়স তখন তিন। আর মুজিবুরের বয়স চৌদ্দ। মুজিবুরের দাদাজান বড় হাউস করে এই বিয়ে দিয়েছিল। মুজিবুরও তখন সদ্য কিশোর মাত্র। দাদাজানের হাউস দেখে মুজিবুরের বাবা আর কিছু বলতে পারেননি। তাছাড়া দাদাজানের ইচ্ছের বাইরে কোনো কথা বাবা কোনোদিনই বলেননি। সেই পুতুল-খেলার বরবধূ ক্রমে বড় হলো। মুজিবুর যুবক হলো আর রেণু বালিকা থেকে হলো হলো কিশোরী। কিশোরী থেকে সংসারি। সংসারী রেণু হলো সত্যিকার অর্থেই মুজিবুরের সাধিকা!
পুতুলের মিছেমিছির সংসার ফেলে নিজেদের সত্যিকার সংসারের কর্তা-কর্ত্রী হয়ে উঠল তারা দুজন। সেই সংসারে ছোট ছোট জীবন্ত পুতুলদের আনাগোনা শুরু হলো। কিন্তু রেণুকেই শক্ত হাতে ধরতে হলো সংসারের হাল। মুজিবুর রইল সংসারের বটবৃক্ষ হয়ে। অনড় এক বটবৃক্ষ! শুধু তার বিশাল ছায়া আর মায়ার বিস্তার টের পায় রেণু। মুজিবুরের ঘোর-সংসারী হয়ে থাকার উপায় কই? যে সারাক্ষণই স্বাধীন দেশের স্বপন-বিভোর, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইয়ে রত তাকে সংসার নামক কুয়োতে ফেলে রাখাকে অপরাধই মনে করে রেণু।
মুজিবুর যাক, ছুটে যাক মহাসমুদ্রের টানে- কল্যাণ বয়ে আনুক পৃথিবীর মানুষের জন্য, রেণু তাতেই সুখী।
কবি নজরুলের সেই বাণীটি সদাই মনে রাখে রেণু-

“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”

আর রেণুর স্বামী তো অন্য নারীদের স্বামীর মতো জগাইমগাই কেউ নয়, রেণুর স্বামী মস্তবড় একজন রাজনীতিবিদ। দেশের জন্য, দশের জন্য নিবেদিত একজন মানুষকে রেণুও নিজের আঁচলে বেঁধে রাখতে চায় না। রেণু অত স্বার্থপর নয়। অবশ্য মুজিবুর এ নিয়ে প্রায়ই আক্ষেপ করে বলে- আমি তো তোমাদের একদম সময় দিতে পারি না রেণু, কী করি কও তো? রেণু মুজিবুরের ঘনকালো-রেশমি চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলে-
আরে যা করতেছো করো না। এতকিছু ভাইবো না তো।
বলেই রেণু আনমনা হয়ে যায়। মুজিবুরকে সে বা তার বাচ্চারা সেভাবে কাছে পায় না- এ কথা সত্য। মুজিবুরকে তো তার বাবা-মাও তেমন করে কাছে পায় না।
বাবা-মায়ের মন খারাপ হলেও তারা হয়তো বুকে পাথর বেঁধেই থাকেন। মুজিবুরের রাজনীতি করা নিয়ে তার বাবাকেও অন্যেরা কথা কম শোনায় না। রেণু গোপালগঞ্জে থাকাকালীন সময়ে একদিন বেশ কিছু গণ্যমান্য লোকেরা এসে বাবাকে মুজিবুরের বিরুদ্ধে উসকাতে শুরু করেছিল। তারা বাবাকে বলেছিল-
আপনার ছেলে যা শুরু করেছে তাতে তো তার জেল খাটতে হবে। নিজের জীবনটা এই রাজনীতি করে করেই নষ্ট হয়ে যাবে দেইখেন।
এসব কথা শুনে বাবার কোনো চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখেনি রেণু। বরং বাবা কঠিন মুখে তাদের বেশ করে শুনিয়ে বলেছিল-
মুজিবুর দেশের কাজ করছে, করুক না। যদি এতে ওকে জেল খাটতে হয় আমি কোনোদিনই দুঃখ পাব না। রাজনীতি করছে বলে ওর জীবনটা নষ্ট না-ও হতে পারে, এমন ভাবনা কেন আপনাদের আসে না? আর আমার মনে হয় দেশ স্বাধীন করতে না-পারলে আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকবে না। মুজিবুর যা করছে তা ওকে করতে দিন।
বাবার শক্ত-জবাব শুনে ঘর থেকে সকলেই দ্রুত উঠে চলে গিয়েছিল।
সেইদিন থেকে রেণুও বাবাকে শতগুণ বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। যার সন্তান সে-ই যদি এত নির্বিকার থাকতে পারে, তাহলে রেণুকেও পারতে হবে। এবং রেণু তা পারবেও।
রেণু দেখেছে মুজিবুরের সঙ্গে বাবার বোঝাপড়াটাও অত্যন্ত চমৎকার। রাজনীতির নানান বিষয় নিয়ে মুজিবুর প্রায়ই বাবার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-সালাপ করে।
আর মা তো ‘খোকা’ বলতেই অজ্ঞান। মায়ের কাছে মুজিবুর ‘চিরকালের খোকা’। রেণু খুব ভালো করেই জানে মায়ের এই ‘খোকা’ কোনোদিনই বড় হয়ে উঠবে না।
রেণু দ্রুত হাতের কাজ গোছায়। সব কয়টা সুতার-লাছি সে মুল্মুলের ধপধপে সাদা রুমালগুলোর ওপর ফেলে দেখেছেÑ লাল, সবুজ আর নীলের বাইরে অন্য কোনো রঙের দিকে রেণু দৃষ্টি দিতেই পারল না! কাঁচের ঢাকনাওয়ালা একটা চৌকোনা বাক্সের ভেতর রুমাল আর সুতাগুলো যতœ করে রেখে দেয় রেণু। রাখে একেবারে চোখের সমুখে, যাতে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এই বাক্সটা মুজিবুর তাকে গত বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিল সঙ্গে অরিজিন্যাল মুক্তার একগাছা মালা। রেণুর এই চাইনিজ বাক্সটা ভারি পছন্দ হয়েছে। মোটা কোরা-রং কাচের ওপর নীল রঙের ছোট ছোট ড্রাগনের নকশা আঁকা। বাক্সটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই ভাবে রেণু- মুজিবুরের চারদিকে তো আরও বড় বড় ড্রাগন কিলবিল করছে। তাদের অগ্নি-চক্ষু দিয়ে লকলকে আগুনের হল্কা বের হচ্ছে! আচ্ছা, মুজিবুর কি পারবে এতসব শত্রুদের মাঝ থেকে নিজেদের একটা আলাদা স্বাধীন দেশ, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে?
নিশ্চয়ই পারবে। মুজিবুরকে পারতেই হবে!


রেণু ঢাকায় এসেছে মাত্র মাস দুয়েক আগে। মুজিবুরের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে শতগুণ। আজ এই মিটিং তো কাল ওই কনফারেন্স। আজ কোনো রাউন্ডটেবিল বৈঠক তো আগামীকাল ক্যাবিনেট মিটিং। এই জেলায় আজ জনসভা তো অন্যজেলায় পরশু কোনো জনসভা। আজকে কলকাতা তো আগামীকাল করাচিÑ এই চলছে হরদম। গোপালগঞ্জে যাওয়ার একেবারেই সময়-সুযোগ পায় না মুজিবুর। ফলে রেণুকেই ঢাকায় চলে আসতে হয়েছে। বাবা-মাকেও আসতে বলেছিল, তারা এখনও আসেননি। মা বলেছেন-
বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তোরা আগে গুছিয়ে বস, আমরা পরে আসবনে, খোকা।
বাবার চিন্তা বাড়িঘর নিয়ে। বাড়িঘর ফেলে সকলে চলে এলে বাড়ির শ্রী আর আগের মতো থাকে না। তাছাড়া জমিজমার খোঁজখবর না-রাখলে বর্গাদাররাও ধান-চাল-পাটের হিসাবে বড় গোলমাল করে ফেলে।
রেণুর না-এসে উপায়ও ছিল না। বাচ্চারা বাবাকে ছেড়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল একেবারে। বাবাকে দেখতে না-পেয়ে বাবার মুখের আদলটাই যেন ভুলে যাচ্ছিল ওরা। এদিকে মুজিবুরেরও খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছিল খুব। অবশ্য রেণু ঢাকায় আসাতে মুজিবুরের খাওয়া-দাওয়া নিয়মিত হয়েছে তেমনও নয়। মুজিবুর তো খাওয়ারই সময় পায় না। খেতে বসলেই কেউ না কেউ চলে আসে। মুজিবুর তখন রেণুকে তাদের জন্য খাবারও টেবিলে দিতে বলে। আবার দেখা যায়, খাবার সময়ে কেউ না এলেও ফোন আসতেই থাকে। দলের কর্মীরা আসে, নানা গোছের নেতারাও আসে। গোপালগঞ্জ থেকেও লোকজন আসে। দিনকয়েক আগে শহীদুল নামক এক আওয়ামী লীগের কর্মী ঢাকায় এলো। এলো তো এলো সে আর ফিরেই গেল না। থেকে গেল রেণু আর মুজিবুরের সংসারে। শহীদুল মুজিবুরকে অত্যন্ত ভালোবাসে। মুজিবুর তাকে বারকয়েক বলেছিল-
কী রে শহীদ বাড়ি যাবি না?
শহীদুল দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝিয়েছে। আর মুখে বলেছেÑ
মুজিব ভাই, আমি থাইক্যা যাই আপনের কাছে। আমার বাড়িতে ভালো লাগে না।
মুজিবুর মনে মনে খুশিই হয়েছে-
থাকুক, নিজের গ্রামের মানুষ থাকতে চাইতেছে থাকুক। মানুষই তো মানুষের কাছে থাকতে চায়!
মুজিবুর লোকজন ভালোবাসে। রেণুও কম কিছু বাসে না। রেণুও তেমন না-হলে মুজিবুর এত নির্ভার হয়ে রাজনীতি করতেই পারত না!
রেণু বড় বুঝদার। মুজিবুরের হাতে সে কোনোদিন বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দেয়নি। পরিবারের সমস্যা কিছু হলে নিজেই সেসবের সমাধানের চেষ্টা চালায়। বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ যা-ই হোক না কেন, রেণু নিজেই সামলানোর চেষ্টা করে। মুজিবুর কত দিকে আর কত কিছু করবে? মুজিবুরের মাথাটাই না নষ্ট হয়ে যায় এতদিকের এত এত চিন্তায়?
কয়েক মাস আগেও খামাখাই মুজিবুরকে ধরে জেলে পুরে রেখেছিল পাকিস্তান-সরকার। এই এক বিপদ, বজ্রপাতের মতো নানান মামলা দিয়ে তাকে জেলে পুরে রাখার চেষ্টায় সদা ব্যস্ত এই সরকার! রেণু দুরুদুরু বুকে রুমালগুলোতে এমব্রয়ডারি করে চলে। সরকারের মতি বোঝা ভার, দেখা গেল নেতা মুজিবুরকে তার জন্মদিনেই গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে!
এর মাঝে রেশমি সুতা ফুরিয়ে যাওয়াতে দুইদিন সেলাই বন্ধ রাখতে হয়েছিল রেণুকে। শহীদুলকে নিউমার্কেটে পাঠিয়ে ফের সে কিছু সুতা আনিয়ে নিয়েছে। এখন ফের চলছে রেণুর গোলাপ ফুটিয়ে চলা।
মুজিবুরের জন্মদিনে রেণু বরাবরই স্পেশাল কিছু রান্না করতে চায়। যেমন ফরিদপুরের নলেনগুড়ের পায়েস। গোপালগঞ্জে থাকাকালীন মা মুজিবুরের জন্মদিনে ঘন দুধে কালিজিরার চাল ফেলে এই পায়েস রাঁধত। রেণুও জানে এই পায়েস খেতে মুজিবুর সত্যি পছন্দ করে। কই মাছ ভাজাও মুজিবুরের পছন্দের খাবার। আর কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ডলে সরষের তেলের ঝাঁজে ঝাল-ঝাল করে মুড়িমাখা। ফলি মাছের কোপ্তা। পোলাও-মাংস সে খেতেই চায় না। মুজিবুরের পছন্দ সাদা ভাত, ডাল, মাছ আর সবজি।
শহীদুলকে গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে রেণু কিছু খেজুরের পাটালি কিনে আনিয়েছে। মুজিবুরের জন্মদিনে মায়ের হাতের রান্না খাওয়ানো না গেলেও অন্তত মায়ের সেই পায়েসটা তো সামনে দেওয়া দরকার! রেণুর সবদিকেই তীক্ষè নজর। মুজিবুর বড় মানুষ তার মাথায় বড় বড় চিন্তা, আর রেণুর শুধু চিন্তা মুজিবুরকে ভালো রাখা। আর মুজিবুরের পছন্দের যা-কিছু সেসবের জোগান দেওয়া।
মুজিবুর অবশ্য চায় না কেউ তার জন্মদিনে ঘটা করে কিছু করুক। দেশের মানুষের মুক্তির চিন্তায় যেখানে সে রাতে ঘুমাতেও পারে না, সেখানে কীসের জন্মদিন পালন আর কীসের কী? রেণুও কিছু করুক তার জন্মদিনকে ঘিরে এটাও মুজিবুর চায় না। রেণুর ওপর বরং সে খানিকটা রেগেই যায়। রেগে গিয়ে বলে-
আচ্ছা রেণু আমি তো এখন আর সেই কিশোর নেই বা অবুঝও নেই, তুমি তাও কেন এতসব কর খামাখাই? এতসব কিছু আমার জন্য কইরো না, প্লিজ।
রেণু মুজিবুরের কথা গায়েই মাখে না। রেণু জানে, মুজিবুর চায় না কোনো কিছুতেই রেণু কষ্ট করুক। কষ্ট পাক। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এমনিতেই বেচারির কোনো অবকাশ মেলে না, সে যদি এমন করে মুজিবুরের দেখাশোনা করে, তাহলে তার শরীর নির্ঘাত খারাপ করে ফেলবে। কিন্তু রেণু মুজিবুরের কথা কানেই তোলে না।
২৫টা রুমালে খুব দ্রুতই গোলাপ ফুটিয়ে ফেলল রেণু। রক্তের মতো টুকটুকে-লাল-রেশমি-সুতায় ভরাট-স্টিচের গোলাপ। রেণুর হাতের কাজ এতটাই সূক্ষ্ম যে, আসল গোলাপ বলে ভ্রম জাগে। মনে হয় কেউ দুধ-সাদা মেঘের চাঙরে মনের ভুলে রক্তলাল-গোলাপ ফুটিয়ে রেখে গেছে। এমব্রয়ডারি করা শেষ হলে রুমালগুলো জেট-পাউডারে ধুয়ে-শুকিয়ে নিয়ে আয়রন করল রেণু। তারপর একটা সুদৃশ্য চন্দন কাঠের কারুকার্য খচিত বাক্সের ভেতর ন্যাপথালিন দিয়ে যতœ করে রেখে দিল।
১৭ মার্চের আগে এই বাক্স কিছুতেই খুলবে না রেণু। মুজিবুর আগেভাগেই দেখে ফেললে সারপ্রাইজটা আর থাকবে না। গিফট আগে দেখে ফেললে দিনটা কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। রেণুর কাছে কেন যেন তেমনটাই মনে হয়।
শহীদুলকে দিয়ে রেণু কিছু কই আর ফলি মাছ এনে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। কই মাছগুলো ডুবোতেলে কড়কড়ে ভাজা হবে। আর ফলি মাছের কোপ্তা রান্না হবে কাঁচামরিচের কড়া ঝালে সামান্য তেঁতুল গোলানো টক আর চিনি দিয়ে। সঙ্গে সাদা জুঁই ফুলের মতো ঝরঝরে ভাত আর করল্লা ভাজি।
জন্মদিনের উইশ রাত ঠিক ১২টায় মুজিবুরকে জানাতে চায় রেণু। কিন্তু তা কিছুতেই হয়ে ওঠে না। মুজিবুর পার্টির কাজ করে এত রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে যে রেণুর তাকে দেখে খুব মায়া লাগে। রেণু তখন চায় মুজিবুর খেয়েদেয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ুক। সকালেই তো তাকে ফের ছুটতে হবে।
ফলে ভোরের শুরুতেই জন্মদিনের শুভ সূচনা হোক। ফজরের আজান অন্তে যখন সুবেহ-সাদিকের পদধ্বনি শোনা যায়। আর পাখিরা গান গাইতে শুরু করে আপন সুরে। বৃক্ষেরা সারারাত সালোকসংশ্লেষণের পরে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে। সূর্যের ধোঁয়াটে আলো ক্রমশ সাদা রঙে ফুটে ওঠে আর ধীরে ধীরে সে আলো পৃথিবীকে দীর্ঘ নিদ্রার পরে জাগিয়ে তোলে!


আজ ১৭ মার্চ। মুজিবুর গত রাতে বাসায় ফেরেনি। রেণু সারারাত জেগে বসেছিল। আগের দিন থেকেই রেণুর বাম চোখের উপরের পাতা ঘনঘন লাফাচ্ছিল। মায়ের কাছ থেকে রেণু শুনেছিল- অধমের উত্তম/উত্তমের অধম। অর্থাৎ বাম চোখের উপরের পাতা আর ডান চোখের নিচের পাতা লাফালে অমঙ্গল ধেয়ে আসে। অবশ্য নতুন করে আর কী অমঙ্গলই-বা হবে? মুজিবুর রাজনীতিতে জড়ানোর পর থেকে তো রেণুর শান্তি বলতে কিছু নেই। নিশ্চিন্তে ঘুম নেই। ঠিকঠাক মতো নাওয়া-খাওয়া নেই। রাজনীতিবিদের স্ত্রীদের শান্তি বলে কিছু থাকেও না। যা থাকে, তা শুধু শঙ্কা আর ভয়। থাকে আতঙ্ক। রেণু যেন নিজের জানটা হাতে নিয়ে বসে থাকে। কী না কী দুঃসংবাদ না জানি তাকে এখুনি শুনতে হয়! কী না কী দুঃসংবাদ না জানি এখুনি ধেয়ে আসে! গত রাতে মুজিবুর ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আটকে গিয়ে বাসায় ফিরতে পারেনি। কিন্তু রেণুকে কমসে কম ১৫ বার ফোন করে সে দুঃখ প্রকাশ করেছে। রেণু শান্ত গলায় বলেছেÑ তুমি এত অস্থির হইও না তো। নিজের কাজ শেষ করে তারপরে আসো। এত অস্থির হইছো কেন?
রেণু বুঝতে পারছে, ভোররাত থেকেই সাদা পোশাকের পুলিশ ঘিরে রেখেছে তাদের বাসা। পাকিস্তান সরকার গত রাতে তাদের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছে। অন্যান্য নেতাসহ মুজিবুরও প্রধান আসামি। পুলিশের বড় হোমরাচোমরারা বেশ কয়েকবার এসে মুজিবুরকে বাসায় খুঁজে গেছে। রেণু জানে যত ঝড়ঝাপটাই আসুক না কেন মুজিবুর তার সাথে আজ দেখা করতে আসবে। বাচ্চাদের দেখতে আসবে, আসবেই। আর মুজিবুর পালিয়ে যাওয়ার মতো লোক নয়। সে নিজেই ধরা দেবে পুলিশের কাছে।
রেণু নিজেকে শক্ত রেখে ফলি মাছের কোপ্তা বানাল। সাদা ভাত আর সবজি রান্না করল। নলেনগুড়ের পায়েসটা সে গতকালই রেঁধে ফ্রিজে তুলে রেখেছিল। বাচ্চারাও এই পায়েস খেতে অত্যন্ত ভালোবাসে। রেণু কই মাছে মশলা মাখিয়ে রেখে দিল, যাতে মুজিবুর এলেই গরম গরম ভেজে পাতে ফেলে দিতে পারে।
শহীদুলকে দিয়ে একগুচ্ছ তাজা গোলাপ এনে শোবার ঘরের ফুলদানির জলে ভিজিয়ে রাখল রেণু।
দুপুর দুইটার দিকে ডোরবেল বাজতেই দৌড়ে খুলে দিল রেণু। মুজিবুর সামনে দাঁড়ানো। মোটা ফ্রেমের চশমায় চোখ দুটি আড়াল করা। রেণু জানে, চোখের অসুখের জন্য অনেক ছোটবেলা থেকেই মুজিবুরকে চশমা পরতে হয়। গ্লুকোমা অপারেশন করাতে হয়েছিল কলকাতায় গিয়ে। বাবাই ওই অপারেশন করিয়ে এনেছিলেন। রেণু জানে, এখন সে মুজিবুরের কান্নাহাসি কিছুই ধরতে পারবে না। চশমার মোটা কাঁচ সবই আড়াল করে রাখবে। যারা চশমা পরে তারা তাদের মানসিক অবস্থা ওই চোখ ঢেকে থাকা কাঁচে আড়াল করে ফেলতে পারে।
বাইরে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে মুজিবুর বাসায় ঢুকল কীভাবে?
রেণুর জিজ্ঞাসা যেন বুঝতে পারল মুজিবুর। ম্লান হেসে বলল-
আমি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশায় এসেছি। ওরা টের পায় নাই।
মুজিবুর গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকতেই রেণু দৌড়াল রান্নাঘরে। দ্রুত হাতে কই মাছ ভাজলো। টেবিলে ভাত সাজাতে সাজাতে শুনতে পেল মুজিবুর কাকে যেন ফোনে বলছে-
আমি জেলে চললাম। তবে এটুকু বলে যাই, আপনারা কোনো অন্যায় মাথা পেতে নিবেন না। প্রকাশ্যে বাধা দিতে হবে। দেশবাসী প্রস্তুত আছে আপনারা খালি নেতৃত্ব দিবেন।
ফের কাকে যেন ফোন করে বলল-
পুলিশ পাঠিয়ে দিন, আমি বাসাতেই আছি।
ফোনের রিসিভার ক্রাডলে রেখে মুজিবুর মাথা নিচু করে টেবিলে এসে বসল।
রেণু আলগোছে চোখ মুছতে মুছতে প্লেটে ভাত সাজিয়ে দিল।
মুজিবুর মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে চলল। কোনো কথাই আর বলল না। খাবার পরে রেণুকে বলল-
কই রেণু গুড়ের পায়েসটা দিলা না?
রেণু যে আজ পায়েস রাঁধবে তা জানলো কী করে সে!
রেণু আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ফ্রিজ থেকে বাটি বের করে পায়েস এগিয়ে দিল।
তারপর শোবার ঘরে গিয়ে চুপচাপ মুজিবুরের ব্যাগ গোছাতে লাগল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে তোয়ালে টেনে হাত মুছে রেণুর কাছে এসে দাঁড়াল মুজিবুর। সস্নেহে মাথার-চুলে হাত রেখে বলল-
দেখো সংসার গোছাতেই পার নাই এখনও, আর আমিই কি না চলে যাচ্ছি। আমি গেলে হয়তো বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে বাড়িতে চলে যেও। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা রেণু, সেই সুযোগ বুঝি আর হলো না। বাচ্চাদের ঢাকায় পড়াতে চাইছিলা, তাও বুঝি আর হবে না।
মুজিবুরের গলা কান্নায় ভেঙে আসতে লাগল। বহু কষ্টে বলল-
নিজের হাতের টাকাগুলো কি খরচ করে ফেলছ? তোমায় আমি আর কী বলে যাব? যা ভালো বোঝো সেটাই করো। এখানে থাকতে না পারলে বাড়িতেই চলে যেও না-হয়।
আর বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে, তাদের এখন আর জাগিও না।
এইবার রেণুর চোখের জল অঝোরে ঝরে পড়তে লাগল। মুজিবুরের মনের অবস্থা ধরা গেলেও চোখের অশ্রু দেখা গেল না। চশমার কাঁচ মানুষের অনেক কান্নাই আড়াল করে রাখে। মুজিবুরের কান্নাও কাঁচের আড়ালে ঢাকা পড়ে রইল।
বাইরে পুলিশের ঘনঘন হুইসেল শুনে রেণু বুঝতে পারল, মুজিবুরের এইবার যাবার সময় হয়েছে।
মুজিবুর ধীরে-সুস্থে সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। শান্তভাবে পুলিশ-ভ্যানে উঠে পড়ল। কিন্তু কেউ তাকে হাতকড়ায় বন্দী করল না! যে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় তাকে কেন হাতকড়া পরাতে হবে? আর তাকেই কেন যে খুন-ডাকাতির মামলায় ফাঁসানো হয় কে জানে?
পুলিশের বড় কর্তারা বারংবার মুজিবুরকে বলতে লাগল-
কী করি বলুন? আমরা হকুমের চাকর মাত্র।
ভ্যান ছেড়ে যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে শহীদুল একেবারে মরা কান্না জুড়ে দিল!
মুজিবুর ভ্যান থেকে নেমে শহীদুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললÑ
কেন কাঁদিস খামাখা? এই তো আমার পথ। আমি একদিন বের হব। হবই। তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখিস।
শহীদুল তবুও জোরে জোরে কেঁদেই চলল।
ভ্যান ছেড়ে দিল। রেণু পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। পথের বাঁকে গাড়ি ঘোরার ঠিক আগে মুজিবুর দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল। বিদায় জানাল রেণুকে।
রেণু প্রথম ভাবল দেখার ভুল! মুজিবুরের হাতে সেই গোলাপ-রুমাল? ভালো করে ফের তাকিয়ে দেখল রেণু-
মুল্মুল কাপড়ের গোলাপ ফোটানো সেই রুমাল নেড়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে মুজিবুর! রেণু খানিকটা ধন্দে পড়ে গেল! চন্দন কাঠের বাক্সে গোপনে তুলে রাখা রুমালগুলোর খোঁজ কে দিয়েছে মুজিবুরকে?
মুজিবুর হাতের গোলাপ-রুমাল নেড়ে নেড়েই চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। মুজিবুর কবে ছাড়া পাবে? আবার কবে তার সাথে দেখা হবে রেণুর? বাচ্চারা হয়তো ফের বাবার মুখের আদল ভুলে যাবে। রেণুকে হয়তো ফিরে যেতে হবে গোপালগঞ্জের সেই বাড়িতে। আহা! মনে বড় আশা নিয়ে সে এসেছিল মুজিবুরের কাছাকাছি থাকবে বলে! কিন্তু আজ মুজিবুরের সাথে রুমালে লিখে দেওয়া রেণুর নামটাই কেবল উড়ে যাচ্ছে। না-কি রেণু নিজেই উড়ে যাচ্ছে মুজিবুরের সাথে সাথে? রেণুর ঠিক বোধগম্য হয় না!
পুলিশ ভ্যানটা পথের বাঁকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে মুজিবুরকে নিয়ে। মুজিবুর ক্রমাগত রুমাল উড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার বহুকালের খেলার সাথীকে। তার প্রাণাধিক স্ত্রীকে।
বহু দূর থেকেও রেণু যেন দিব্যি দেখতে পেল- লাল-সবুজের সেই ঘোরলাগা গোলাপ-পাতার-রং ক্রমশই যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে! ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে…!

লেখক : গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিসেম্বর মাসের দিবস
পরবর্তী নিবন্ধবিছা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য