Thursday, November 30, 2023
বাড়িSliderযে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

‘সংবিধান অনুযায়ী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নই আমাদের প্রত্যয় হওয়া উচিত।’

উত্তরণ প্রতিবেদন: গত ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হয়। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতা ছিলেন প্রথম সংসদের সংসদ নেতা। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ঢাকার তেজগাঁওয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদ ভবনে। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫। অর্থাৎ, প্রথম জাতীয় সংসদে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৫। প্রথম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন মুহম্মদুল্লাহ এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন বয়তুল্লাহ। পরে মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আবদুল মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেন, যা ৬ এপ্রিল বেলা ১১টায় স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয়।
উল্লেখ্য, গোপালগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি দিবসে কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছরের শুভ মুহূর্তে, সংসদ এ অভিমত পোষণ করে যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কার্যকর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়ন ঘটবে এবং এভাবে গণতন্ত্র সুদৃঢ় হবে, একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সকলের জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এই প্রতিশ্রুতি পূরণে আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব।’ প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘সংবিধান অনুযায়ী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নই আমাদের প্রত্যয় হওয়া উচিত।’
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ৭ এপ্রিল জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে ভাষণদানকালে তিনি এ আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, ‘আসুন, সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যে কোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই।’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতীয় সংসদে দেওয়া তার শেষ ভাষণে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বিপন্নকারী যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ জাতীয় সংসদকে গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের সংসদ সদস্যদের হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে গঠনমূলক, কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ দেন।
প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে বলে রাষ্ট্রপতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদের ইতিহাস নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই বিশেষ অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গত ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ২০০৮ সাল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করছে। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গত তিন মেয়াদে (২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ধারাবাহিক অগ্রগতি, সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করেছে।’ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপনকালে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ-কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এ সুযোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ অনেক সাফল্য অর্জন করেছে যেমন- সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) সফল বাস্তবায়ন, দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনা, বাংলাদেশের ক্রমান্বয়ে টেকসই উন্নয়ন, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্লাবে উত্তরণ লাভের মতো অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। সাফল্যগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন, খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন মানুষ ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, নারীর ক্ষমতায়ন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীরনিবাস (বাড়ি) নির্মাণ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের এক বিস্ময়।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জন্য এই সুযোগ করে দিয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে তিনি (বঙ্গবন্ধু) সারাজীবন দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন এবং আত্মত্যাগ করেছেন।’ দেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর মেয়াদের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা মাত্র তিন বছর সাত মাস তিন দিন সময় পেয়েছিলেন এবং সেই সময়ে তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চারটি মূলনীতি গ্রহণ করেছেন, সেগুলো হলো- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এই নীতির ভিত্তিতে তিনি সংবিধানে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ থেকে শুরু করে সকলের মৌলিক অধিকারের কথা বলেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদের শাসনামলে ৪৬২টি আইন, অধ্যাদেশ ও আদেশ জারি করা ছিল বঙ্গবন্ধুর এক অসাধারণ কাজ।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা করি, আমি ভাবি কীভাবে তিনি এই অল্প সময়ের মধ্যে এত কাজ করতে পারলেন!’ তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করেছেন, অন্যদিকে গণতন্ত্রকে সুসংহত করে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর তিন বছর সাত মাসের শাসনামলে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সদস্যপদ লাভের পাশাপাশি ১২৩টি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল। এছাড়াও, জাতিসংঘও বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘এই অগ্রযাত্রা দেশের জন্য এত সহজ ছিল না, তবে তাকে (বঙ্গবন্ধু) অনেক বাধা অতিক্রম করে সেগুলি অর্জন করতে হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সদিচ্ছা থাকলে কীভাবে একটি দেশের পুনর্বাসন, পুনর্গঠন ও উন্নয়ন করা যায়, বঙ্গবন্ধু আমাদের সবার সামনে একটি বিরল উদাহরণ রেখে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত দেশে পরিণত হতো। জাতীয় সংসদ ৫০ বছরের যাত্রায় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্র- জাতীয় সংসদ বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গণতন্ত্রের অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করছে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সংসদের পথচলা বারবার হোঁচট খেয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংসদ বাতিল করা হয়েছিল এবং সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে তখন সামরিকতন্ত্র চালু করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনের পর প্রকৃতপক্ষে মার্শাল ডেমোক্রেসি চালু করেছিল।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব, তবে যারা ’৭১, ’৭৫ এবং ২০০৪ সালে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল তাদের প্রতিহত করতে হবে।’
গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও ময়মনসিংহ-৬ আসনের সদস্য মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘গণপরিষদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবিচল ছিলেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। মাত্র সাত মাসে তিনি জাতিকে শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। পাকিস্তান তা ২৫ বছরেও পারেনি, ভারত তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে নিয়েছিল তিন বছর।’
গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও নওগাঁ-৪ আসনের সদস্য পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামানিক বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। জাতির পিতা ছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবিচল। তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই। কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি।’
জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনতন্ত্র ও সার্বভোম সংসদের প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে শাসনতন্ত্রকে কাটছাঁট করে এই সার্বভৌম সংসদকে অকার্যকর করে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শাসনতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌম সংসদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন।’
ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর পথচলা মসৃণ ছিল না। বারবার এই সংসদ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সংসদকে অকার্যকর ও ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক এই সংসদকে দিয়ে নিজের ক্ষমতা বৈধ করার অপচেষ্টা করেছে। জিয়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এই সংসদকে কলঙ্কিত করেছে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে দেশের শাসনতন্ত্র ও সার্বভৌম সংসদকে ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা হয়েছে।
গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার আক্ষেপ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। আমরা অঝোরে কেঁদেছি। আমাদের হাতে কিছুই ছিল না, কিছুই করতে পারি নাই। আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের হাতিয়ার ছিল না, কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করেছি।’ তিনি বলেন, ‘জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতো। তার উপরে সব দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বীরউত্তম, বীরবিক্রম সবকিছু। সে যাকে পাইছে, তাকে খেতাব দিছে। এর কোনো হিসাব ছিল না।’ জেনারেল ওসমানী তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিতে মোশাররফ হোসেনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘উনি (ওসমানী) আমাকে টেলিফোন করে আমি জনতা পার্টি করেছি, আপনি আমার দলে থাকবেন। আমি বললাম, কী বললেন? আমি তো দল করি। আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন দল করেন? আমি বললাম, আওয়ামী লীগ করি। সে আমাকে বলে, আওয়ামী লীগ কি এখনও আছে?’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা শুধু একটা মানুষকে হত্যা করেনি, তারা একটি স্বাধীন সংসদকেই নয়, একটা জাতিকে হত্যা করেছিল।’
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, একটি রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ থাকে- নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা এবং বিচার বিভাগ। জাতীয় সংসদ সেই আইন সভা। এই সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত। বঙ্গবন্ধু আমাদের শুধু স্বাধীনতা দেননি। স্বাধীনতার ১০ মাস ১৩ দিনের মধ্যে আমাদের একটি সংবিধান দিয়েছিলেন। এই সংবিধানে তিনি জাতীয় সংসদকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে রেখেছেন। তিনি এই সংসদের মাধ্যমে তিন বছর সাত মাস পাঁচ দিন শুধু আইন প্রণয়ন করেই এই দেশের আইনের ভীত স্থাপন করে দেননি, সংসদের অধিবেশনের মাধ্যমে তিনি সংসদের রীতিনীতি, সংসদীয় প্র্যাকটিস এবং সংসদের মর্যাদা স্থাপন করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমরা দেখেছি সেই সংসদের অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা এবং অকার্যকর করার জন্য স্বৈরাচার সরকার যতরকম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তাই নিয়েছে। এই সংসদেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাস হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি। তিনি এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করেছেন। এতে সংসদের নিকট সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।’
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এই সংসদ আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এই সংসদকে বলা হয় “হাউস অব দ্য ন্যাশন”। অর্থাৎ সমগ্র জাতির ঠিকানা এই সংসদ। এই সংসদকে কার্যকর করতে জাতির পিতা তার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জন্য ছিলেন বিপজ্জনক, আর আমাদের জন্য ছিলেন আশীর্বাদ।’
মেহের আফরোজ বলেন, ‘যে সংসদ জাতির পিতা দিয়ে গিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সেই সংসদকে কলুষিত করেছে।’
জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে যারা সরাসরি জড়িত, তারাই শুধু নয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও অনেকে ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যারা ছিল তাদের খুঁজে বের করতে একটি কমিশন গঠন করতে হবে।’
গণফোরামের সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। জাতির অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখতে জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এই কয়েকটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’
১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আনীত প্রস্তাব (সাধারণ) সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী আনীত প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জাতীয় সংসদের বিশেষ ও ২২তম অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ ১০ এপ্রিল অংশ নেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের অপর নাম, শেখ মুজিবুর রহমান। এটি একটি কঠিন সত্য, যে সত্য বারবার অন্ধকারকে ভেদ করে বাঙালির হৃদয়ে সূর্যালোক পৌঁছে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উন্নয়নে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করায় সংসদের অভ্যুদয় এবং জাতির অস্তিত্ব একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেছে উল্লেখ করে চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, ‘সংসদে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, খুনি, সন্ত্রাসী, কালোবাজারিদের সদস্য করে আনা হয়েছে। সংসদের বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করার পাশাপাশি সংসদের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালি বিঘ্নিত করা হয়েছে। সংসদকে অকার্যকর করার সকল প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে।’
১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সরকার ও দেশের উন্নয়নে স্থিতিশীলতা দেওয়া সত্ত্বেও কতিপয় সংসদ সদস্য অনুচ্ছেদটির বিরোধিতা করায় তিনি তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনুচ্ছেদ ৭০ গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় ও জনগণের কাছে গণতন্ত্রের সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য এটিকে আরও শক্তিশালী করে। কিন্তু আমাদের (সংসদ) সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন এই অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে। কারণ, এই অনুচ্ছেদের জন্য তারা ইচ্ছেমতো সরকার ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে পারছেন না।’ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একাদশ জাতীয় সংসদের ২২তম (বিশেষ) অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ প্রদানকালে তিনি এ-কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানত সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের কারণে ১৯৪৬ এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারগুলোকে উৎখাত করার কথা উল্লেখ করে, তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে কয়েকজন সংসদ সদস্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।’
আমেরিকায় তার প্রথম সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে আন্ডার সেক্রেটারির সাথে সাক্ষাৎকালে আমি বলেছিলাম, ‘আমি এখানে আসার আগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছি, যেখানে লেখা আছে- জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি- যেখানে জেনারেলের জন্য, সেনাদের দ্বারা, সেনাদের সরকার।’ তিনি বলেন, ‘আমি সেই বৈঠকে বলেছিলাম, আমেরিকা আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত তার গণতন্ত্রের চর্চা করে। আটলান্টিক পাড়ি দিলেই কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যায়?’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদের এই প্রশ্নটিও করেছি, কেন আপনারা সামরিক স্বৈরশাসনকে সমর্থন করছেন?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) প্রায়ই গণতন্ত্রের কথা বলে এবং বিরোধী দলসহ কিছু লোক সেইসব সবক শুনে উৎফুল্ল বোধ করে।’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা যে কোনো দেশের সরকারকে উৎখাত করতে পারে। বিশেষ করে, মুসলিম দেশগুলো কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর, পুরো বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে এবং এটাই বাস্তবতা।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেসম্যানের ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেন। সবক্ষেত্রেই তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন। তাদের নিজ দেশের অবস্থা কী?’ এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির তিন কংগ্রেস সদস্যের ঘটনাটি তুলে ধরে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেস সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কারণ তারা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে, এই ধরনের বন্দুক সংরক্ষণ বন্ধ করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই তিনজনকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু, তাদের একজন শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় বহিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘জাস্টিন জন ও জাস্টিন পিয়ারসন- এই দুজনার অপরাধ হলো- তারা কালো। সে-কারণে তাদের আসন শূন্য হয়ে যায়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাহলে এখানে মানবাধিকার কোথায়! আমরা জিজ্ঞাসা করি- এখানে গণতন্ত্র কোথায়!’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী রাশেদ আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। আমি সেখানকার সব প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি। আইনগতভাবে, আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা কূটনীতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। আমি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে “আপনি এই দণ্ডিত খুনিকে আশ্রয় দেবেন না”।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিশু খুনিরা, নারী খুনিরা, রাষ্ট্রপতি খুনিরা, মন্ত্রী খুনিরা, তারা মানবতা লঙ্ঘন করে। আপনারা তাদের আশ্রয় দেবেন না। তাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তারা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না; বরং তাকে আশ্রয় দিয়ে খুনিদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। তারা গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এমন একটি সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চায়, যেখানে কোনো গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব¡ থাকবে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেক্ষেত্রে, আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী- যারা বুদ্ধি বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে এবং সামান্য কিছু অর্থ তাদের প্রলুব্ধ করে।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি ‘সুবর্ণজয়ন্তী’ উপলক্ষে ‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুজিববর্ষ বিশেষ অধিবেশন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য