রা মে ন্দু ম জু ম দা র: যারা বঙ্গবন্ধুর বিরল সান্নিধ্য লাভ করেছেন, আমি তাদের মতো সৌভাগ্যবান নই। কয়েকবার হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের কাছে যাবার সুযোগ হয়েছে, সে-সুখস্মৃতিই লালন করে যাব চিরদিন। এখন কেবলই আফসোস হচ্ছে, আহা যদি তার আর একটু কাছে যেতে পারতাম! বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম কাছ থেকে দেখি ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। থাকতাম তেজগাঁও শিল্প এলাকায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের স্টাফ কোয়ার্টার্সে। আমার বড় ভাই রণেন মজুমদার ইনস্টিটিউটে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হঠাৎ ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। আমাদের কোয়ার্টার্সের পাশেই ছিল রেললাইন। একদিন রাতে একটি ট্রেন চলার পথে থেমে গেল। মানুষের আর্তচিৎকার সেখান থেকে ভেসে এলো। বুঝতে পারলাম, দাঙ্গা এখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম।
অধ্যাপক অজিত গুহ ছিলেন আমাদের আত্মীয়। তার কাছে খবরটা পৌঁছলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে বললেন, আমার এক আত্মীয় পরিবার তেজগাঁওতে আটকা পড়েছে, তুমি যদি একটু নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে পার। সকালবেলা দেখলাম একটা জিপ আমাদের ক্যাম্পাসে এসে থামল। জিপ থেকে নামলেন আর কেউ নন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সোজা দোতলায় আমাদের ফ্ল্যাটে এসে বললেন, দু-মিনিটের মধ্যে আপনারা সবাই তৈরি হয়ে আমার সাথে চলুন। আমার দাদা, বৌদি, ছোট বোন রতœা ও আমাদের ঠাকুমা তার নির্দেশমতো নিচে জিপের পেছনে উঠে বসলাম। তিনি সামনের সিটে বসে ড্রাইভারকে বললেন, কোথাও না থেমে সোজা ৩২ নম্বরে চলো। কোয়ার্টার্স থেকে বড় রাস্তায় ওঠার পথে গলির দু-পাশে বস্তি ছিল। সেখান থেকে জিপ লক্ষ করে কেউ একজন একটা ঢিল ছুড়ল। তখন বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধু কেন কোথাও না থামার কথা বলেছিলেন। বস্তির কেউ কেউ আসার সময় বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিল। তাই যাবার সময় জিপে লোকজন দেখে অনুমান করতে পেরেছিল তিনি কোনো পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন।
৩২ নম্বরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারকে তিনি ইতোমধ্যে আশ্রয় দিয়েছেন। বেগম মুজিব পরম যতেœ সবার খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছেন। সন্ধ্যায় খবর পেয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এসে আমাদের তার বাসায় নিয়ে গেলেন।
আমরা অনেকের মুখেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা শুনি। কিন্তু কতজনের জীবনাচরণে আমরা তা প্রত্যক্ষ করি? বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই সাহসী নেতা যিনি তার বিশ্বাসে অটল থেকে বিপদের মুখেও সম্প্রদায় নির্বিশেষে দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ছাত্র থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু সেখানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দিতে কাজ করেছেন।
১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই। আমি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় বসে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির একটা ইংরেজি সংকলন করেছিলাম ‘বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ’ নামে। দিল্লি থেকে সেটা ওরিয়েন্ট লংমান প্রকাশ করে। ঢাকা ফিরেই বঙ্গবন্ধুর হাতে তার কপি দেওয়ার সুুযোগ খুঁজছিলাম। বন্ধুবর আমিনুল হক বাদশা পুরনো গণভবনে তার সাথে দেখা করিয়ে দিলেন। তখন ঘরে বঙ্গবন্ধুর সাথে কেবল বসা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আমি বইটার কপি তাকে দিলে তিনি উল্টেপাল্টে দেখলেন। মনে হলো খুশি হয়েছেন। ভুট্টো সম্পর্কে কয়েকটা মন্তব্য করলেন। আমাকে বললেন, সংকলনটা বাংলায় করতে। সেটা করতে আমার বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে তা আর দেখাবার সুযোগ পেলাম না।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। অনেকেই বন্যার্তদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থ বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমরা থিয়েটারের ‘সুবচন নির্বাসনে’ নাটকের একটি বিশেষ প্রদর্শনী করে ২ হাজার টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলাম। তিনি সবাইকে বললেন, দেখো, দেখো নাটকের ছেলেমেয়েরাও আমার ত্রাণ তহবিলের জন্যে টাকা নিয়ে এসেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের অফিস আছে? আমরা ভাবলাম, সরকারের এখন কত কিছুর প্রয়োজন, সেখানে আমাদের অফিসের ব্যাপারটা তুচ্ছ। আমরা বললাম, না আমাদের এখন অফিসের প্রয়োজন নেই। এখন ভাবি কী দূরদৃষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর, আর কী মুর্খ ছিলাম আমরা। এখন থিয়েটার দলের মহড়া ও থিয়েটার স্কুলের জন্য একটা ঠাঁই জোগাড় করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।
পরের বছরের ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৫-এর মে মাসে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে গেছেন রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন ভবন দেখতে। মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী অভ্যর্থনার সারিতে দাঁড়ানো সকল কর্মকর্তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তরুণ প্রযোজক আবদুল্লাহ আল-মামুনের সামনে এসে ওর দু-গালে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের নাটক কেমন চলছে? মামুনের জবাব, আপনি তো নাটক বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে মামুন সেন্সরশিপ ও প্রমোদকরের ব্যাপারটা বললেন। পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. এআর মল্লিক। বঙ্গবন্ধু বললেন, মল্লিক সাহেব, নাটকের ছেলেদের কাছ থেকে টাকা না নিলে কী আমার সরকার চলবে না? বঙ্গবন্ধু পরের দিন মামুনকে তার সাথে দেখা করতে বললেন।
বঙ্গবন্ধুর তখনকার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন ড. ফরাসউদ্দিন, মামুনের সহপাঠী। আমি আর মামুন পরদিন সোজা গিয়ে হাজির হলাম ফরাস ভাইয়ের দপ্তরে। তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাবার পর বঙ্গবন্ধু দুটো নির্দেশ দিলেন। এক. এখন থেকে নাটকের পা-ুলিপি পুলিশের বদলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অধীনে একটি নাটক সেন্সর কমিটি সেন্সর করবে। দুই. সৌখিন নাট্যগোষ্ঠীগুলোকে কোনো প্রমোদকর দিতে হবে না। মন্ত্রণালয়ে পাঠালে দেরি হতে পারে মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু সরাসরি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করতে বললেন। ২৮ মে ১৯৭৫ তারিখ জারি হলো সেই ঐতিহাসিক নির্দেশ। সংস্কৃতিমনা বঙ্গবন্ধু কত সহজে দূর করে দিলেন নাট্যচর্চার পথে একটা বিরাট বাধা। আর তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে অভিনয় নিয়ন্ত্রণের কালো আইনটি পুরো বাতিল করে নাট্যকর্মীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে রইলেন।
স্মৃতি সততই সুখের। আর সেটা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে হলে তা চির অমলিন।
“অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।”
লেখক : নাট্যকর্মী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি, অভিনেতা, সংবাদ পাঠক ও বাচিক শিল্পী