মফিদা আকবর: বিবর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া ইটের পলেস্তারা যেমন ধীরে ধীরে নীরালম্ব হতে থাকে তেমনি অকস্মাৎ অকস্মাৎ ধূসর হয়ে যায় যোদ্ধা ইভার মন। মনে হয় পৃথিবীর সবকিছু যদি নিজের মতো করে নিজ হাতে বদলে দেওয়া যেত। নিজের ড্রইংরুম যেমন করে সবাই সাজায় তেমনি নিপুণ হাতে যেখানে যা যা প্রয়োজন তেমনি করে। কোথাও কারও না বারণ নেই। কারও অদৃশ্য হাত নেই। অহেতুক অনুরোধ নেই। মাত্রাতিরিক্ত শাসন নেই। কুৎসিত পরামর্শ নেই। পটু হাতে পরিশীলিতভাবে ড্রইংরুম সাজানোর মতো করে পৃথিবীটা যদি কখনও পরিপাটি করে সাজানো যেত। আসলে কিছুই করা হয় না। কিছুই না। প্রতিটি পদক্ষেপেই সীমাবদ্ধতা।
তাই নীরবে-নিভৃতে একা এই পল্লিতে থাকি। নিরক্ষর, সহায়-সম্বলহীন মানুষদের অ-আ শেখাই, নিজের পায়ে ওদের স্বাবলম্বী হবার জন্য পোশাক সেলাই আর নিজেকে মানুষ ভেবে মানুষ হিসেবে বাঁচার মন্ত্র শেখাই। আমি কোনো দলের লোক নই। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি।
ভালোবাসি আমার বাংলা ভাষাকে। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে আমার নাম নেই বলে আমাকে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করেনি এতদিন। তাতে আমার কোনো আফছোস নেই। আমার মেয়ে অলিভ নেই, মা-বাবা-ভাই-বোন কোথাও কেউ নেই। কিন্তু আমার এদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তোÑ এতেই আমার সুখ। কিন্তু একসময় তাও ছিল না। কারণ তখনও আমার এদেশ খাদ্যসহ সবকিছুতে পর মুখাপেক্ষী ছিল। স্বাধীন এদেশে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত মূল্যায়ন পায়নি। মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। তাহলে এ স্বাধীনতা অর্জনের মূল্য কোথায়! আজ আল-কায়দা জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের মতো আজও এদেশে ২১ আগস্ট সংঘটিত হয়। রিমোট কন্ট্রোলে বোমা নিক্ষেপ হয়। এসবই আমাকে চরম দুঃসহ যন্ত্রণায় ফেলেছিল। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখে ইদানীং কিছুটা ভালো লাগছে। আজ বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি ভাতাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এগুলো অনেক সুখের বিষয়। এজন্যই রাজি হলাম তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তবুও যখন একাত্তরের প্রসঙ্গ আসে তখন আমি বদলে যাই। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারি না। ইভা যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার কণ্ঠ মাঝে মাঝে কাঁপছিল, কখনও কখনও উচ্চৈঃস্বরে দাড়ি, কমাবিহীন ননস্টপ কথা বলে যাচ্ছিলেন। কখনও তার কথায় উচ্ছ্বাস, কখনও তার গলায় আর্দ্রতা, কান্নার সুর বেজে চলছিল। আমি চেয়ে দেখছি তার দুচোখের কোণে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই করছে তার বয়স। ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। মাথার চুলগুলো, একেবারেই বকসাদা। সাদা চুলেরও যে এক প্রকার ভীষণ সৌন্দর্য আছে আজই প্রথম তা চোখে পড়ল আমার। আমি দেখছি তিনি নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলে চোখ থেকে চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছে নিলেনÑ হাতের পিঠে চোখটাও মুছলেন। কিছুক্ষণ ঘরটা নীরব। তিনি দম নিচ্ছেন। কিছু ভাবছেনও বোধ করি। কিছুক্ষণ থেমে থেকে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো চেটে ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, কোথা থেকে যে শুরু করি ভাবছিলাম। এরই মাঝে তিনি আবার বলতে শুরু করলেনÑ বুঝলে বাবা শেখর আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে নাÑ কেন করে না জানো, আমি কে? আমার কথা কে শুনবে? তুমি গত একমাস ধরে আমার পেছনে লেগেছ আমার সাথে কথা বলবে বলে! শেষে তোমায় কথা দিলাম শুধু একটি কথার ওপর ভর করেÑ কি তা জানো?
আমায় তুমি অহংকারী ভাববে বলে।
আমি হেসে বললাম,
না না আপনি অহংকারী হবেন কেন? বরং আপনি এদেশের অহংকার, গৌরব। আমি কথাগুলো বলার পর তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। দরজা বরাবরই তিনি বসেছিলেন হুইলচেয়ারে। অনেকক্ষণ তিনি বাইরের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
তার বাড়িটাকে অনেকটা ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয় বাইরে থেকে। বাড়ির চারপাশে, লিচু, আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারিগাছে ছেয়ে আছে। পথ চিনে এখানে আসতে আসতে আমার এগারোটা বেজে গিয়েছিল। এখন বারোটা বাজতে চলেছে। যে ঘরটায় আমি বসে আছি সেখানে বসে বোঝার উপায় নেই যে এখন ভরদুপুর। বড়সড় ঘরটির এক কোণে একটি মাঝারি চৌকি গোলাপি এবং লালের মাঝে লাল-কালোর ছোপ ছোপ ছাপার চাদরে আবৃত। এতে দুটো বালিশ এবং একটি পাতলা কাঁথা ভাঁজ করা আছে পায়ের কাছে। চৌকির সোজাসুজি সেকেলে আমলের নড়বড়ে একসেট সোফা। চৌকির সাথে লাগোয়া একটি বড়সড় টেবিলের ওপর সারিসারি বই উঁচু করে রাখা আছে। একটি বই খোলা, তার ওপর চশমা দিয়ে চাপা দেওয়া। মনে হয়, একটু আগেই তিনি বইটি পড়ছিলেন। মাটির দেয়ালের ঘরখানি নিপুণ করে লেপাপুছা। মনে হয়, এই সেদিনই বুঝি লেপেপুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়েছিল দরজা বরাবর প্রশস্ত দেয়ালে লাগানো সেকেলে আমলের চারখানা কাঠের আলমারিÑ এর একটির মধ্যে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় আর অন্যটির মাঝে অল্পবিস্তর কাঁচের তৈজসপত্র। বাকি তিনখানা বইয়ে ঠাসা। দেয়ালে কয়েকখানা ছবিও যত্ন করে রাখা আছে। একখানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ইন্দিরা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ও মহাত্মা গান্ধী। ছবিগুলো তার চৌকি বরাবর। মনে মনে ভেবে নিতে আমার অসুবিধা হয়নি যে, চৌকিতে শুয়ে-বসে বিশ্রামের সময় যেন তিনি ছবিগুলো দেখতে পারেনÑ সে-জন্যই এগুলো এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অজানা তাবৎ জানতে এসেছিলাম ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে। তিনি এর আগে কখনও সাক্ষাৎকার দেননিÑ বিভিন্ন সরকারের প্রতি অভিমান করে। অনেক প্রশ্ন লিখে এনেছিলাম গুছিয়ে; কিন্তু সে-রকম প্লানমাফিক কিছুই হচ্ছে নাÑ তাকে প্রশ্ন করলাম,
আপনার স্মৃতি থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও আপনার সম্পৃক্ততার কথা সংক্ষিপ্ত করে বলুন,
প্রশ্নটি করার সাথে সাথে তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। আমি দেখছি তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। অনেকক্ষণ পর খ্যানখেনে গলায় থে-মে থে-মে তিনি বললেন, কী করে বলি বলো তো?
আমি তো তখন আমি থাকি না। আমার ভেতর সেই যৌবনের রক্তই টগবগ করে নাচন শুরু করে বাবা। মনে হয় যে হাতে রাইফেল চালিয়েছিলাম সেদিন, সেই হাতেই আজ এই দেশটাকে নতুন করে নির্মলতায় ভরে তুলি। সবুজ শ্যামল তৈল-গ্যাসে ভরপুর আমার সোনার দেশ। এই যে বাড়িখানা দেখছ যেখানে আমি বাস করি এটা আসলে আমার বাবার বাড়ি নয়। আমার পৈতৃক বাড়ি গফরগাঁয়ের নিগুয়ারীতে। আমার বাবা গফরগাঁও থানার মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা ছিলেন। আমরা দু-বোন, দু-ভাই। আমার বড় দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। আমি তখন ঢাকা ম্যাডিক্যাল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছি। এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম। ঢাকা ভার্সিটির মেয়েরা ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে তখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলÑ এদের একজন আমিও। সরাসরি যুদ্ধ করব বলেই আমার এ প্রশিক্ষণ নেওয়া। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে যখন ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকহানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিনই বুঝেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম নিজে বাঁচতে হবে এবং দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে হবে। ঢাকাতেই লুকিয়ে চুরিয়ে ছিলাম মাসখানেক। পড়ে দলীয় সিদ্ধান্ত হলো ভারতে যাওয়ার। আমি ভাবলাম, ভারত যাবার আগে কোনোভাবে মা আর ছোট বোনটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আসি। জীবনে যদি কোনোদিন আর দেখা না হয়।
আবার থেমে গেলেন যোদ্ধা ইভা- চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, শাড়ির আঁচলে মুছলেন, হাতের পিঠে চোখটাও মুছলেন। হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে চালিয়ে গিয়ে কাঠের আলমারিটা খুলে একটি হালকা হলুদ রঙের রক্তমাখা শাড়ি বের করে এনে বুকে চেপে ধরে রাখলেন, নাকে চেপে ধরে ঘ্রাণ নিলেন। আবারও তিনি চোখ বুজে নিষ্প্রাণ বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। দরদরিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গণ্ড বেয়ে। আমি স্তব্ধ পাথর মূর্তির মতো বসে থাকলাম। কী করে আবার শুরু করা যায় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আমি বেশ বুঝতে পারছি তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
তিনি ঢোঁক গিললেন। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট দুটোকে আবারও চেটে নিলেন। ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করলেন। যে-রাতে এলাম মায়ের সাথে দেখা করতে কাকতালীয়ভাবে আমার বড়ভাই আজাদও সে-রাতে এসেছিল মায়ের সাথে দেখা করতে। কারণ, তিনিও চলে যাচ্ছেন ভারতে ট্রেনিংয়ে।
রাজাকার-আলবদররা নজর রেখেই ছিল আমাদের বাড়ির ওপর।
তাই ঘটনাটি ঘটল পরের দিন সকালেইÑ সেদিনের কথা মনে হলে আজও কেঁপে উঠি। মনে হয় মানুষ কী করে এমন নিষ্ঠুর হয়? হোক না ভিন্ ভাষাভাষী, জাতিগোষ্ঠীরÑ তারাও তো মানুষ! তারাও কী মানুষ নয় বাবা শেখর?
তুমিই বলো না?
আমিও তখন ভেতরে ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠছি। কী না জানি, ভয়াবহ সাংঘাতিক নৃশংসতার কথা তিনি বলবেন। শরীর হিম হয়ে যায় আমারও। তিনি শাড়িটা মুখের ওপর চেপে ধরে আছেন। আমি নিশ্চল স্থির চোখে তাকিয়ে দেখছি। তার শরীর কাঁপছে, তিনি ফুলে ফুলে কাঁদছেন। ভেবে পাই না কি করে আবার শুরু করা যায় অথবা সান্ত¦না দেওয়া যায়।
অনেকক্ষণ পর তিনি হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে চালিয়ে আমার কাছে এসে থামলেন। আমি দেখছি তিনি কাঁপছেন। সেই একাত্তরের যোদ্ধা ইভাই যেন তিনি। তুমি শুনবে না বাবা আমার কথা! শুনে যাও আজ তুমিÑ কোনোদিন আমার না বলা কষ্টের কথা।
কেমন করে এদেশ স্বাধীন হলো জেনে রাখো।
তাহলে শুরু থেকেই বলি,… তখন অপরাহ্ণ। নিজেকে অসহায় পরাজিত মনে হয়। এ গ্লানিযুক্ত মন কেবলই ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে। তীব্র হতাশায় এ জীবনের অর্থহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বারবার। কি যে করি কিছুই ভেবে পাই না। ক্ষণে ক্ষণে সংকল্প পাল্টাই। যুদ্ধ-পূর্ব এক মাস বাবার চাচাতো ভাই আমীরুল ইসলাম কাকার বাসায় ছিলাম। এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর বর্বর, নৃশংস কায়দায় পাকহানাদাররা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা আমার কাছে মোটেও আকস্মিক ছিল না। ’৭০-এর নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হলোÑ তখনই শুরু হলো পাকিস্তানি মতলববাজ আইয়ুব খানের তালবাহানা।
তিনি কিছুতেই শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বারবার বৈঠকের নামে তালবাহানাই করে যাচ্ছিলেন। পহেলা মার্চ ১৯৭১, হঠাৎ করেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। যে-কারণে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এবং ৭ই মার্চ শেখ মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বস্তুতপক্ষে এই ভাষণ এবং এই ঘোষণার পর থেকেই পূর্ব বাংলার পাকিস্তানি শাসন বিকল হয়ে যায়। এই সময় আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো তিনজন ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকতে শুরু করে। তাদের আচরণে কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। এরপর ক্রমে ঘনিয়ে এলো ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চিরদিনের মতো রাজনীতি থেকে বিদায় গ্রহণ করে, কোনোরূপে এদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বেতার ভাষণে গিয়ে বলল, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বাসঘাতক।
বাংলার মানুষের ওপর শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তান বর্বর হাদানার বাহিনীর নীল নকশা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা শহরের রাস্তায়, এখানে-সেখানে লাশ আর লাশ। শেয়াল-কুকুর, পশু-পাখি বেওয়ারিশ লাশগুলোকে ছিঁড়ে-খোঁড়ে খাচ্ছে। নিরীহ মানুষগুলোর বাড়িঘর পুড়ে ছাই করে দেওয়া হচ্ছে।
এদেশের অসহায় মানুষেরা দল বেঁধে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে সহায়-সম্পদ ফেলে রেখে। হাতে একটি সুটকেস, কোলে-কাঁখে ছোট্ট শিশু। এ দৃশ্য দেখার মতো ছিল না বাবা। আজকাল সবকিছু আমার ভুল হয়ে যায়Ñ তোমায় বলতে ভুলে গেছি যে, ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীরা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর যখন নৃশংসতা শুরু করেছিলÑ এর মধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ সভাপতি এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক দেওয়া স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রচার করেন। পরদিন ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই সাথে আরও ঘোষণা বারবার প্রচার করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন এবং তিনিই যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ৭ই মার্চের ভাষণের নির্দেশমতো জনগণ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং তাদের যা ছিল তা নিয়েই পাকসেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে সারাদেশে।
এরই মধ্যে ১০ এপ্রিল ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সংসদ সদস্যগণ স্বাধীন সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তারা শপথ গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তার অবর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কর্নেল এমএজি ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি।
শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির তখন আর পেছন ফেরার সময় ছিল না। লড়াকু বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। এরই মধ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে কী করে যে বাড়ি ফিরে এলাম জানি না। একটি রাত মা আর বোনের সঙ্গে ঘুমালাম, মা আমার ভালো-মন্দ খাওয়ালেন, আমার মা, ছোট বোন নোভা আর আমি সারারাত সুখ-দুঃখের কথা বলে বলে কাটিয়ে দিলাম। কে জানত যে, সেই রাতই তাদের সাথে আমার শেষ রাত হবে?…
এর পরের ঘটনা আরও নৃশংস। বাংলাদেশের মানচিত্রের আঁকিবুঁকির খাঁজে খাঁজে আমি সেই দৃশ্যগুলো অবলোকন করি আজও।
আমি বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু পানি এনে দিই?
তিনি শাড়ির আঁচলে আবারও চোখ মুছলেন। ইতোমধ্যে তার কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। মাথা নেড়ে সায় দিলেন পানির জন্য। আমি নিজেই জগ থেকে পানি ঢেলে এক গ্লাস পানি তার হাতে ধরিয়ে দিলে তিনি কাঁপাকাঁপা হাতে গ্লাস নিয়ে ধীরে ধীরে পানিটা খেলেন এবং পাশেই খালি গ্লাসটা রেখে মুখটা আঁচলে মুছে নিলেন সন্তর্পণে এবং আবার বলতে শুরু করলেন।…
আমরা মা-মেয়েরা সারারাত কথা বলেছি তো, তাই অনেক বেলা নাগাদ দু-বোন ঘুমুচ্ছি বলে মা আমাদের ডাকেননি। তিনি নাশতা তৈরি করে বড় ভাইয়া আজাদকে খাওয়াচ্ছিলেন। বোধ করি তখন দশটা-এগারোটা বেজে থাকতে পারে। এরই মধ্যে জনাবিশেক লোকের একটি দল আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলে। এরা সবাই পাকহাদানার আর দু-তিনজন লোক শুধু আমাদের পাশের বাড়ির বাকু মেম্বার এবং নূরুল ইসলাম। এরাই নিয়ে এসেছে আমাদের বাড়িতে পাক-হানাদারদের।
এরপর মুক্তিযোদ্ধা ইভার কাছ থেকে যা জানতে পেরেছিলাম তার সার-সংক্ষেপ ছিল এ-রকম; বড়ভাই আজাদকে খাওয়া থেকে তুলে নিয়ে উঠোনের পাশের আম গাছে বেঁধে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনে ঝলসে দেওয়া হয় সারাশরীর, চোখ দুটো উঠিয়ে ফেলা হয় এবং অবশেষে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মা আর দু-বোন ইভা, নোভা তাদের বেঁধে কোনো প্রকার আড়াল ছাড়াই মা-মেয়েদের সাথে শরীরি কর্মগুলো সমাপ্ত করা হয়।
মা ছালেহা আর ইভা, নোভার চিকন মর্মভেদী আর্তনাদের আকুল আর্তি পাকহানাদারদের নিস্পৃহ শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে আছড়ে পড়ে না। বরং ওদের হিংস্রতা বেড়ে যায়। মা এবং মেয়েদের ওপর একইসাথে উপর্যুপরি ধর্ষণ দৃশ্য প্রতিফলিত হতে থাকে। একজনের নিবিড় প্রতিফলনে নিজেকে আরও ঘনিষ্ঠ করে উষ্ণসুখ ছড়ায় দেহে-মনে। পড়ে থাকে তিনটি দেহ। এর ওপর দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে চলে। লাশ সদৃশ দেহের মধ্যেই চলে সুখস্পর্শের আনন্দঘন বর্বরতা। এমন কদাকার প্রতিবেশের ভিতর শরীরের উষ্ণ খেলার মগ্নতায় ওরা ডুবে যায়। সব ক’জনের পালা শেষ করে বিকৃত নষ্ট হাসি হেসে বিজয়ীর বেশে দপদপিয়ে চলে যায় ওরা।
কয়েক ঘণ্টা পর ইভার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন সামনেই পড়ে থাকতে দেখেন মা আর বোনের নিশ্চল লাশ। ইভার মস্তিষ্কের স্নায়ুতে তখন জমে থাকে গাঢ় কুয়াশা। বিভ্রম চেতনায় নিজের দেহ, সব মিলিয়ে পৃথিবী ধোঁয়াশা। মনের মাঝে কিছু ঠেকে দৃশ্যত আর কিছু অদৃশ্যত। পাড়া-প্রতিবেশীরা লাশ তিনটিকে সৎকার করে।
অতঃপর ধীরে ধীরে জেগে উঠেন ইভা। নতুন করে চিন্তার প্রতিফলন বিস্তার ঘটায় তার মনে। মৃত্যুর ভয়াল থাবা। মা, বোন-ভাইয়ের মৃত্যুছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে ক্রমাগত। তিনি অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে অন্যমনস্ক চলতে চলতে নিজেকে আবিষ্কার করেন যুদ্ধ ময়দানে রাইফেল হাতে। তিনি ভুলে যান নারী না-কি পুরুষ। রণক্ষেত্রে চলতে থাকে যুদ্ধ আর যুদ্ধ। মুক্তির নেশায় যুদ্ধ। কিন্তু মাসদেড়েক পরেই তার শরীরের অন্য এক অস্তিত্বের সবল ভূমিকা মূর্ত হয়ে জেগে ওঠে। শরীরের ভেতর শুরু হয় অন্য খেলা। তিনি তখনও বুঝতে পারেন না অপরিচিত নতুন অধ্যায়ের বিভীষণকে।
নিজের মনকে পোক্ত করে বাঁধেন। নিজের কর্তব্য কাজকে ব্যর্থ হতে দিতে চান না। কিন্তু পরাজিত গ্লানিযুক্ত মন কেবলই ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে। কিছুতেই বুঝতে পারেন না শরীরের অকথিত কথন। পরে যখন বুঝতে পারলেন তখন তীব্র হতাশায় জীবনের অর্থহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছুদিন ঘৃণায় শরীর-মন আচ্ছন্ন থাকে।
কিছুতেই নিজেকে নিজের মনে হয় না। এ সময় সহযোদ্ধা কাজল সহানুভূতির শীতল স্পর্শ আবার বাঁচার স্বপ্নকে মূর্ত করে তোলে যোদ্ধা ইভার মনে। যুদ্ধময়দান থেকে তখন ইভাকে সরিয়ে নেওয়া হয় আহত যোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রƒষার কাজে। ভার বহন করা নিজের অসার শরীর। মাঝে মাঝেই ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে। বেশ বুঝতে পারেন ইভা। তবুও আহত যোদ্ধাদের সেবায় নিজেকে লীন করে দেন তিনি। মনে হয় এটাই যেন তার রণাঙ্গন। একসময় দেশটা স্বাধীন হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশ। অবসাদে নুয়ে পড়া ভারী শরীর নিয়ে কোনোক্রমে ফিরে আসেন ইভা। যদিও চলমান সড়কে তখন তুমুল গতি। কিন্তু ইভার শরীরের যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানের ঘনত্বে সড়কের পরিসর জমে যাওয়া পথে চলতে থাকে স্নায়ু অতি সতর্কে। সব জটিলতা তাকে ক্রমে আঁকড়ে ধরতে থাকে। সব জটিলতাকে সম্বল করেই নিজের বাপ-দাদার ভিটে-মাটিকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে এসে ওঠেন বাবার বাড়ি। মুক্তিযোদ্ধা বাবাও ততদিনে ফিরে এসেছেন। তিনি আসন্ন সন্তানসম্ভবা মেয়ের দিকে নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকান। তার চোখের ভাষা খুব সহজেই যোদ্ধা ইভা পড়ে ফেলেন। কিন্তু বাবার নিবিড় আশ্রয়ের মোহ ছেড়ে কোথাও চলে যেতে পারেন না তিনি। দেশ স্বাধীন হলেও ইভার বাবা মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা নিজেকে স্বাধিকারে স্বাদে আবৃত করতে পারেননি। তীব্র হতাশায় তার জীবন ক্রমে ভেঙে পড়েছিল। ফলে অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি।
ইভার টলায়মান পৃথিবী তখন শেষ অপরাহ্ণের খোঁজে কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। এই ভারী শরীরের বহন যে কত ভারী, এর পরিমাপ তো অন্যরা জানে না। চারদিকের রি-রি-ঢিঢি’র মধ্যেই জন্ম নেয় কুচকুচে অলিভ কালারের ‘যুদ্ধশিশু’ অলিভ।
যোদ্ধা ইভা বলেছিলেন, আতুরঘরেই যাকে শেষ করে দিতে চান। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে মারতে পারেন না। তার চোখের সামনেই কেমন করে বেড়ে উঠতে লাগল তরতর করে অনাদরে-অবহেলায়। তিনি বলেন,
আমার সন্তান হিসেবে যখনই ওকে আদর করে বুকে চেপে ধরতে চাইতাম তখনই মনে পড়ে যেত মা-বোনের সেই ধর্ষণ দৃশ্য। আমার মা, বোনের নগ্ন দেহ। অবশেষে আমি মা হয়েও হন্তারক হয়ে যাই। কখনোই সে আমার বশ মানতে চাইত না। এত ছোট বাচ্চা! তবুও সে যা চাইত তাই করত। সে রাগ আদর-ভালোবাসা কোনোটাই বুঝতে চাইত না। সবকিছুতেই একরোখা ভাব। আমিও ওকে সহ্য করতে পারতাম না। সেও আমাকে নাÑ আমিও তাকে না। একদিন এসব অবাধ্যতার জন্য কষে চড় মারি। চোখের নিমিষেই সে ঢলে পড়ে আমার চোখের সামনেই। আশপাশের শত্রু-মিত্র কারও যেন এই মৃত্যুটা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। অবাক করা ব্যাপার যে, একটি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমার জীবনে কেমন এক স্বস্তি ফিরে এসেছিলÑ সেই থেকে এই একাকী জীবনের পথ চলা…
লেখক : সাংবাদিক ও গল্পকার