Monday, December 4, 2023
বাড়িত্রয়োদশ বর্ষ,নবম সংখ্যা, আগস্ট-২০২৩মোহাম্মদপুরে গোলার আঘাতে যারা শহিদ

মোহাম্মদপুরে গোলার আঘাতে যারা শহিদ

স্বজন-পরিজন হারিয়ে ফেলা পরিবারগুলোর চোখে আগস্ট মাস এলে নীরবে অশ্রু ঝরে। এই জল দেখার কেউ নেই। পরিজন হারিয়ে যাওয়ার অনুভব করারও কেউ নেই।

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা: ৭ অক্টোবর ২০২১, সকালে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মোহাম্মদপুরে গোলার আঘাতে যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের খোঁজে। পত্রিকায় প্রকাশিত বাড়ির ঠিকানা অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তাও মনে হয়েছে পথ অনেক কঠিন। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। মোহাম্মদপুরে ৮ নম্বর শের শাহ সুরি রোডের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে পেয়ে গেলাম, জানতে চাইলাম, এখানে গোলা পড়ে কেউ কি মারা গিয়েছিলেন? উত্তরে জানালেন : হ্যাঁ, হাবিুবর রহমান নামে একজন মারা গিয়েছিলেন, তিনি সড়ক ও জনপথে চাকরি করতেন এবং এখানে থাকতেন। আমি তার পরিজনের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে তিনি তার পরিবারের মুঠোফোনের নম্বর দিলেন।
এরপর তার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করি। জানতে পারি, তার তিন ছেলের নাম- রবি, শফিক, রাজ্জাক। মৃত্যুর দুদিন পর তার স্ত্রী খবর পান। তিনি এসে লাশটি পাননি, আসার আগেই তাকে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। যদিও এখন কবরটির নির্দিষ্ট স্থান মনে নেই তার। বাবা এবং শ^শুরবাড়ি থেকে সহযোগিতা পেয়ে সন্তানদের তিনি মানুষ করেছেন। হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর সময় বড় ছেলের বয়স ছিল ১০ বছর, মেজো ছেলের বয়স ছিল সাত বছর এবং ছোট ছেলের বয়স ছিল সাত মাস। স্বামীর অনেক স্মৃতিই তার মনে আছে। এর মধ্যে একটি স্মৃতি তাকে ভীষণ তাড়া দেয়, সেটি হলো- তার স্বামী সাইকেল নিয়ে তেজগাঁও অফিসে যেতেন। একই সময়ে ফার্মগেটের মোড়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহর যেত। প্রায়ই সময় বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বাম দিকে তাকাতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার চোখাচোখি হতো। বাসায় এসে খুব খুশিমনে বলতেন, প্রতিদিনই তার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়।
এ গল্পটি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। ১৯৬৩ সালে রহিমা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে চাকরি করতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কাশ্মীরের সীমান্তে তিনি ধরা পড়েন। এরপর পাকিস্তানের কারাগারে ১০ মাস আটক থাকেন। স্বাধীনতার পর আটকেপড়া বাংলাদেশিদের সাথে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন। তার বড় ছেলে ২০২১ সালের ৩ জুন আফগানিস্তানে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। ছেলের লাশটিও হাবিবুর রহমানের স্ত্রী দেখতে পারেননি। কারণ, ছেলেকে আফগানিস্তানে সমাহিত করা হয়েছে। হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর কয়দিন পূর্বে পারিবারিক ছবিগুলো ঢাকায় নিয়ে এসেছিল লেমিনেটিং করার জন্য। কিন্তু সেই ছবিগুলো সেদিন গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়। যে-কারণে হাবিবুর রহমানের পরিবারের কাছে একটিমাত্র সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের ছবি স্মৃতি হিসেবে আছে।
রহিমা খাতুন বলেন, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে শুক্রবার ছিল। হাবিবুর রহমান টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানা ওয়াসি ইউনিয়ন বড়টিয়া গ্রাম থেকে একদিন বেশি সময় ছুটি কাটিয়ে মঙ্গলবার কর্মস্থলে আসেন। হাবিবুর রহমান শের শাহ সুরি রোডে যেখানে থাকতেন, সেখানে কিছু টিনের ঘর ছিল, সেই টিনের ঘরগুলো গোলার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। শের শাহ সুরি রোডে হাবিবুর রহমান ছাড়াও ৯ নম্বর শের শাহ সুরি রোডে ছয়জন মৃত্যুবরণ করেছেন, তারা হলেন- আনোয়ারা বেগম, ময়ফুল বিবি, রফিকুল, আবদুল্লাহ, সাবেরা বেগম এবং শাফিয়া খাতুন। যারা ঐ বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তাই তাদের ছবি এবং ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন ওই বাড়ির মালিক মো. মুকুল।
এছাড়াও আহতদের মধ্যে শের শাহ সুরির ৬ নম্বর রোডে মো. মোস্তফা (৩০), পিতা : জসিম উদ্দিন; ৮ নম্বর শের শাহ সুরি রোডে আহত হন মোহাম্মদ আলী (২২), পিতা : শামসুল ইসলাম; ৯ নম্বর শের শাহ সুরি রোডে কাসেলা খাতুন (২৫), স্বামী : আহমদউল্লাহ; রুহুল আমিন (৮), পিতা : আবদুল্লাহ; শামসুল হক (৬), পিতা : আবদুল্লাহ; শামসুন নাহার (৩০), স্বামী : মরহুম মুজিবুর রহমান; আবদুর রব মাস্টার (২৪), পিতা : মরহুম জয়নাল আবেদীন; কাসেলা খাতুন (২৫), স্বামী : আহমদউল্লাহ; শামসুন নাহার (৩০), স্বামী : মরহুম মুজিবুর রহমান; ১০ নম্বর শের শাহ সুরি রোডে খায়রুন্নেসা (৪০), স্বামী : আবদুল্লাহ; আবুল কালাম (২৫), পিতা : নুরুল হক মিয়া।
এই তথ্য সংগ্রহের পর যাই- ১৯৭, শাহজাহান রোড, মোহাম্মদপুরে। সেখানে গিয়ে জানতে পারি বাড়ির মালিক মেহেদী আলী খানের বৃদ্ধ স্ত্রী কাশেদা খাতুন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে দোতলায় ঘুমাচ্ছিলেন। বিকট শব্দে একটি স্প্লিন্টার এসে কাশেদা খাতুনের ডান কানের লতি ভেদ করে শ^াসনালী দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাজা মুরগি জবাই করলে যেমন রক্ত বের হয়। কাশেদা খাতুনের শরীর থেকে তেমন রক্তক্ষরণ হয়েছিল। কথাটি জানালেন কাশেদা খাতুনের ছেলে মাহতাব আলী খানের স্ত্রী মুশতারী খানম। তিনি জানান, স্প্লিন্টারের বিস্ফোরণে তাদের চোখ-মুখ জ্বালাপোড়া করছিল। এক ঘণ্টা সময়ের জন্য কারফিউ স্থগিত করলে কাশেদা খাতুনের জানাজা দিয়ে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। কবরের স্থানটুকু তারা নিবন্ধন করেছেন বলে কাশেদা খাতুনের কবরটি তার আত্মীয়-পরিজন চিহ্নিত করতে পারেন।
এরপর ১৯৬, শাহজাহান রোডে মৃত ব্যক্তিদের খবর নিতে গিয়ে জানা গেল, তারা এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এখন বাস করেন মিরপুরের পল্লবীতে। আমি সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে নিহত দুজনের মা আয়শা খাতুনের সাথে সাক্ষাৎ করি। তাদের জবানি থেকে জানা যায়, স্প্লিন্টারের আঘাতে ১৯৭, শাহজাহান রোডের ক্ষতিগ্রস্ত জানালাটি তারা এখনও রেখে দেওয়ার কারণে বোঝা যায়, কতটা শক্তিশালী ছিল সেদিনের গোলার আঘাত। এই বাড়িতে আহত হন মনোয়ার উদ্দিন আহম্মেদ এবং নিহত হন তার দুই ছেলে শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ এবং আমিরউদ্দিন আহম্মেদ। তাদের মোহাম্মদপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মনোয়ার উদ্দিন আহম্মেদ এবং তার স্ত্রী আয়শা খাতুন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ২০০৩ সালে মনোয়ার উদ্দিন আহম্মেদ মৃত্যুবরণ করেন। মনোয়ার উদ্দিন আহম্মেদের স্ত্রী আয়শা খাতুনও তার দুই ছেলেকে হারিয়ে ৪৮ বছর ধরে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। নানা রোগশোকে তিনি এখন শারীরিকভাবে অচল হয়ে পড়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিহত দুই ছেলের জন্য ১ লাখ টাকা এবং আহত মনোয়ার উদ্দিন আহম্মেদকে ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ ঢাকার আসাদ গেটের সোনার বাংলা সার্ভিস স্টেশনের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লেখাপড়া করেছিলেন নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ থেকে। তার বিয়ে স্থির করা হয়েছিল কলকাতার মেয়ে সুলতানা জাবীনের সাথে। তার সাথে আকদও সম্পন্ন হয়েছিল। কেনা হয়েছিল বিয়ের সামগ্রী। স্মৃতি হিসেবে রয়েছে পাসপোর্ট এবং বিয়ের রুমাল। সুলতানা জাবীন আজ পর্যন্ত বিয়ে করেননি। তিনি চিরকুমারী থেকে গেলেন। অন্যদিকে, সাত বছর বয়সী আমির উদ্দিন আহম্মেদ মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। ভীষণ শান্তশিষ্ট ছিলেন। এতটা বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া দুই ছেলের ছবি বুকে নিয়ে মা আয়শা খাতুন বেঁচে আছেন।
একইদিনে তিনি গোলার আঘাতে মারা যান মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তিতে বসবাসকারী রিকশাচালক আবু মুসার এক বছর এক মাসের মেয়ে নাসিমা বেগম এবং তার স্ত্রী রিজিয়া বেগম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হারিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবার। সেই সাথে হারিয়েছেন মোহাম্মদপুরে গোলার আঘাতে ১২ জন। হাওয়াইজার কামান থেকে ছুড়ে ফেলা গোলা ছিন্নভিন্ন করেছে বেশ কয়েকটি পরিবারকে। অতঃপর এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য মোহাম্মদপুর থানায় মামরা দায়ের করা হয় ১৯.১১.১৯৯৬ তারিখে। ধারা নম্বর : ৩২৪/৩২৬/৩০৭/৩০২/৩৪। অদ্যাবধি এই মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। মোট ১১ জন আহত এবং ১২ জন নিহত হন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বজন-পরিজন হারিয়ে ফেলা পরিবারগুলোর চোখে আগস্ট মাস এলে নীরবে অশ্রু ঝরে। এই জল দেখার কেউ নেই। পরিজন হারিয়ে যাওয়ার অনুভব করারও কেউ নেই। গোলার আঘাতে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য