Wednesday, June 7, 2023
spot_img
বাড়িSliderমোবাইল ফোনের ৫০ বছর

মোবাইল ফোনের ৫০ বছর

স্মার্টফোন আজ বিশ্বের অনেক মানুষের প্রধান কম্পিউটিং ডিভাইস, ক্যামেরা, দৈনন্দিন প্ল্যানিং ও ডায়েরি, এমন কী মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকিং এবং ওয়ালেটও।

সালেহীন বাবু: আজ থেকে ৫০ বছর আগে মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেছিলেন মার্টিন কুপার। তার তৈরি ফোন দিয়ে প্রথম কল করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। দিনটি ছিল ৩ এপ্রিল ১৯৭৩। কুপার একজন আমেরিকান প্রকৌশলী, যাকে সেলফোনের জনক বলা হয়। আবিষ্কারের পর তিনি বলেছিলেন, পকেটের ছোট্ট ডিভাইসটির রয়েছে সীমাহীন সম্ভাবনা। এই প্রযুক্তি একদিন রোগকেও জয় করতে পারে। এভাবে পেরিয়ে গেছে ৫০ বছর। এখনও দাপটের সাথে প্রযুক্তি রাজ্য শাসন করছে সেলফোন।
সময়ের পরিক্রমায় সেই মোবাইল ফোন দিনকে দিন আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। ভাবুন তো মোবাইল ফোন ছাড়া একমুহূর্ত চলতে পারবেন কি না? খুব কম প্রযুক্তিই আছে, যা মাত্র ৫০ বছরে এতটা বদলে গেছে। সময়ের সাথে মোবাইল হয়েছে আরও সহজলভ্য। মোবাইল ধীরে ধীরে ছোট হয়ে পকেটে বহনযোগ্য গেজেটে পরিণত হয়েছে, যা আজ স্মার্টফোন হিসেবে চিনি।
প্রথম সেলফোনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডাইনামিক অ্যাডাপ্টিভ টোটাল এরিয়া কভারেজ’। এই বিশাল বাক্যের সংক্ষিপ্ত করে ‘ডাইনাট্যাক’ নামটি প্যাটেন্ট করে মটরোলা। ‘এটি অ্যান্ড টি’ আলাদা করে গবেষণা না করে বেল কমিউনিকেশনস আর মটরোলা যৌথভাবে কাজ শুরু করে সেলফোন প্রযুক্তি এগিয়ে নেওয়ার কাজে। যদিও প্রথম কলটি করে ১৯৭৩ সালেই মার্টিন কুপারের দল প্রমাণ করে প্রযুক্তিটি প্রস্তুত, সেটি বাজারে পৌঁছানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারহীন যোগাযোগের জন্য নীতিমালা ও আইনের ধারার অভাব। প্রায় ১০ বছর পর ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘ডাইনাট্যাক ৮০০০এক্স’ মডেলের ডিভাইস সবার জন্য উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয় মটরোলা এবং এটি অ্যান্ড টি।
ডাইনাট্যাক ৮০০০এক্স আজকের স্মার্টফোনের তুলনায় খুবই সাধারণ ডিভাইস হলেও ওই সময় মাইক্রো প্রসেসর এবং ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি প্রযুক্তি তেমন অগ্রসর না হওয়ায় ছোট ছোট ইলেকট্রনিকসও ছিল বিশালাকারের। প্রায় সোয়া কেজি ওজনের, ৯ ইঞ্চি লম্বা ডিভাইসটিতে ছিল ৩০টি সার্কিট বোর্ড, তার নিকেল ব্যাটারি চার্জ হতে সময় লাগত প্রায় ১০ ঘণ্টা, আর কথা বলা যেত মাত্র ৩৫ মিনিট সর্বোচ্চ। এখনকার তুলনায় হাস্যকর মনে হলেও ওই সময় ২৫ কেজি ওজনের গাড়ি ফোনের জায়গায় সোয়া এক কেজি ওজনের সেলফোন ছিল এককথায় ‘যুগান্তকারী’। ফোনটির দাম ছিল ৩ হাজার ৫০০ ডলার বা আজকের ১০ হাজার ৬০০ ডলারের সমান। ফোনটি বাজারে আসার সাত বছর পরও প্রতি ১০ লাখে একজন মার্কিনীর কাছে ছিল সেলফোন।
আজ বিশ্বের জনসংখ্যার দ্বিগুণ সেলফোন ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে একাধিক ফোন। এরপর ফোনের নেটওয়ার্ক হয়েছে উন্নত, কলের পাশাপাশি টেক্সট পাঠানোর সেবাও একদিন যুক্ত হয়েছে। নতুন শতাব্দীর শুরুর দিকে সেলফোনে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া শুরু হয়, যার মাধ্যমে স্মার্টফোন ধীরে ধীরে বাজার ধরতে শুরু করে। এরপর ২০০৭ সালে অ্যাপলের আইফোন সেলফোন প্রযুক্তিকেই চিরতরে বদলে দেয়। শুধু কল আর টেক্সট করেই ব্যবহারকারীরা আর সন্তুষ্ট থাকেনি; ক্যামেরা, গান শোনা, ভিডিও দেখা ও অ্যাপ ব্যবহারেও তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়।
তবে মোবাইল ফোন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য, পিঠে বহন করা যায় এমন ব্যাটারিচালিত বেতার যোগাযোগের ডিভাইস মিত্রবাহিনী এবং অক্ষশক্তি দুটি পক্ষই ব্যবহার করেছিল। প্রযুক্তিটি একদিন টেলিফোনের মতো ব্যবহার করা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের বেল কমিউনিকেশনসের তা বুঝতে মোটেও সময় লাগেনি। ১৯৪৭ সালে তাদের ইঞ্জিনিয়ার ডগলাস এইচ রিং একটি মেমোতে আধুনিক সেলফোনের সংক্ষিপ্ত রূপ লিখে ফেলেন। সেই মেমোতে তিনি একটি টাওয়ারে থাকা নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিটার ও রিসিভারের রেঞ্জের মধ্যে থাকা এলাকাকে নাম দেন ‘সেল’। আর একাধিক সেল একত্র করার মাধ্যমে ‘সেলুলার’ নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে বিস্তীর্ণ এলাকায় তারহীন টেলিফোনসেবা দেওয়া যেতে পারে সেটিও প্রমাণ করেন। ব্যবহারকারীদের কাছে থাকা ডিভাইস একটি সেল থেকে অন্য সেলের আওতায় গেলেও নেটওয়ার্কে থাকবে সংযুক্ত, তাই একই টাওয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার যে সীমাবদ্ধতা ওয়াকিটকির রয়েছে, সেটি থাকছে না। সেটিকে তিনি ‘সেলুলার নেটওয়ার্ক টেলিফোন’ আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকেই ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন বা ‘এফসিসি’র কাছে বেল কমিউনিকেশনস আবেদন করতে থাকে তারহীন টেলিফোন নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করার জন্য। প্রায় দুই দশক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পর ১৯৬০-এর দশকে তারহীন যোগাযোগের জন্য নেটওয়ার্ক স্থাপনের অনুমতি পায় বেল কমিউনিকেশনস। তবে সেই নেটওয়ার্ক হাতে বহনযোগ্য সেলফোন নয়; বরং গাড়ি, বিমান বা জাহাজে বহন করার মতো টেলিফোনের জন্য ব্যবহৃত হতো। গাড়িতে টেলিফোন কল করার সেবাই ওই সময় ছিল অকল্পনীয় প্রযুক্তি, হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি সেই সেবা ব্যবহার করতে পারতেন।
মোবাইল ফোন যাতে বাহনে নয়, হাতেই বহন করা যায়, সেই চেষ্টার পথে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভ্যাকিউম টিউব প্রযুক্তি। শব্দকে ডিজিটাল সিগন্যালে রূপান্তর করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে প্রেরণ ও গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন লজিক গেট, আর সেটা শুধু ভ্যাকিউম টিউবের মাধ্যমেই করা সম্ভব ছিল। এখনকার একেকটি স্মার্টফোনের দ্বিগুণের চেয়ে বড় ছিল কিছু ভ্যাকিউম টিউব। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে সেই সমস্যার সমাধান হয় সিলিকন সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করে ট্রানজিস্টর তৈরি করার মধ্য দিয়ে। এই একটি আবিষ্কারের পরই গবেষকরা আশা করেন, হাতে বহনযোগ্য সেলফোন আর বেশি দূরে নেই।
ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার, ডাকনাম মার্টি, ১৯৭০-এর দশকে মটরোলায় ছিলেন কর্মরত। গাড়ির ফোনকে কীভাবে হাতে বহনযোগ্য মোবাইল ফোনে পরিণত করা যায়, সেটাই ছিল তাদের গবেষণার লক্ষ্য। মার্টি ও ডগলাস এইচ রিং কখনোই সেলফোনকে গাড়ির ফোন হিসেবে দেখেননি, তাদের কথা ছিল টেলিফোনের কথোপকথন খুবই ব্যক্তিগত জিনিস, সেটা গাড়িতে বা টেবিলে বসে বলার জিনিস নয়। সেলফোন হতে হবে হাতে বহনযোগ্য। অবশেষে ১৯৭৩ সালে তারা মাত্র তিন পাউন্ড বা দেড় কেজি ওজনের, প্রায় একটা ইটের সমান বড় সেলুলার ফোন বা সেলফোন তৈরিতে সক্ষম হন। সেটি মটরোলার পক্ষে ৩ এপ্রিল কোম্পানির একটি ইভেন্টে সবার সামনে তুলে ধরবেন মার্টিন, এমনটাই ঠিক করা হয়। তখনই তার মাথায় খেলে যায় দুষ্টবুদ্ধি, ডিভাইসটি শুধু উন্মোচন না করে প্রথম সেলফোন কলটিও তিনি সেখানেই করবেন। ওই সময় ‘এটি অ্যান্ড টি’ও মটরোলার প্রতিযোগী হিসেবে সেলফোন তৈরিতে গবেষণা করে যাচ্ছিল, তার প্রধান ছিলেন জোয়েল স্ট্যানলি ইঙ্গেল। তাকেই কল করে বসেন মার্টিন, বলেন, ‘সেলফোন থেকে তোমাকে কলটি করেছি।’ যদিও জোয়েল পরে বলেছেন, তিনি এমন কোনো কল পাননি, মার্টিন ভুল নম্বরে ডায়াল করেছিলেন। তারপরও মার্টিনের সেই কলটিই ছিল বিশ্বের প্রথম সেলফোন কল।
স্মার্টফোন আজ বিশ্বের অনেক মানুষের প্রধান কম্পিউটিং ডিভাইস, ক্যামেরা, দৈনন্দিন প্ল্যানিং ও ডায়েরি, এমন কী মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকিং এবং ওয়ালেটও। আরও ৫০ বছর পর হয়তো আর সেলফোন আকৃতির কোনো ডিভাইসই মানুষের হাতে থাকবে না, কমিউনিকেশন মডিউল সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।

লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রাম-নগরের বিচিত্র সংবাদ
পরবর্তী নিবন্ধ­­­দিনপঞ্জি : এপ্রিল ২০২৩
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য