জাতীয় কবিতা উৎসব-২০২০

উত্তরণ প্রতিবেদন: মাঘের হিমশীতল সকালের কুয়াশা ঠেলে কবিদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি প্রাঙ্গণ। শুরুটা সেই ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। সূচনালগ্ন থেকে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংকটে উৎসবকে হাতিয়ার করে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় যেভাবে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন কবিরা তা প্রশংসার দাবি রাখে। ঢাকা মহানগরের নির্বাচনী আমেজ কাটতে-না-কাটতে বরাবরের মতো মহান ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির ২ ও ৩ তারিখ ৩৪তম এই জাতীয় কবিতা উৎসব। দুদিনব্যাপী এই উৎসব কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ নিবেদন শেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, একুশের গান ও উৎসব সংগীতের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান, ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। এরপর আহ্বায়ক কবি শিহাব সরকার ও সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত বক্তব্য রাখেন। কবি মহাদেব সাহা অসুস্থ থাকায় তার উদ্বোধনী ভাষণ পাঠ করেন সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান এবং কবি মুহাম্মদ সামাদ সভাপতির ভাষণ প্রদান করেন। পরে মুক্ত আলোচনা ও কবিতা পাঠ করেন ভারত, উজবেকিস্তান, সুইডেন ও নেপালের কবিরা। এরপর কবিতা পাঠ প্রথম পর্বে কবি দিলারা হাফিজের সভাপতিত্বে নিবন্ধিত কবিবৃন্দ কবিতা পাঠ করেন। দ্বিতীয় পর্বে সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সভাপতিত্বে ভিনদেশি ভাষার কবিরা কবিতা পাঠ করেন। তৃতীয় পর্বে সাহিত্যিক রুবি রহমানের সভাপতিত্বে আমন্ত্রিত কবিরা কবিতা পাঠ করেন। চতুর্থ পর্বে আমন্ত্রিত কবিরা কবিতা পাঠ করেন। প্রথম দিনের শেষে কবিতা আবৃত্তি পর্বে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে দেশবরেন্দ্র আবৃত্তিশিল্পীরা কবিতা আবৃত্তি করেন।
কবিতা উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হয় ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে। কবি কামাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন নাসির আহমেদ, বিশ্বজিৎ ঘোষ, আনিসুল হক, আমীরুল ইসলাম, আনিসুর রহমানসহ দেশের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকরা। এই পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লা সিরাজীর সভাপতিত্বে ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন মফিদুল হক, মুনীর সিরাজ, আমিনুর রহমান এবং সুইডেনের কবি ও বেঙ্ সোদারহল, উজবেকিস্তানের কবি নাদিরা আবদুলাহয়েভে ভারতের বীথি চট্টোপাধ্যায়, সেবন্তী ঘোষ, নীলাঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিত গোস্বামী, দীধিতি চক্রবর্তি, আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র মিত্র, নেপালের কবি ড. তুলাসি দিওয়াসা-সহ আগত কবিরা। এই অংশে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। আয়োজনে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে কবি ও কবিতার ভূমিকার কথা তুলে ধরেন অংশগ্রহণকারী কবি ও বিশিষ্টজনরা।
পঞ্চম পর্বে কবি কাজী রোজীর সভাপতিত্বে নিবন্ধিত ও প্রান্তিক অঞ্চলের কবিবৃন্দ কবিতা পাঠ করেন। ষষ্ঠ পর্বে ফারুখ মাহমুদের সভাপতিত্বে নিবন্ধিত কবিবৃন্দ কবিতা পাঠ করেন। সপ্তম পর্বে ছড়াকার আসলাম সানীর সভাপতিত্বে ছড়া পাঠের আমন্ত্রিত ছড়াকাররা ছড়া পাঠে অংশ নেন। এরপর কবি আহমদ রফিক, গীতি-কবি আব্দুর গফ্ফার চৌধুরী ও কবি বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এই তিনজন ভাষা-সংগ্রামীকে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। এছাড়া গত উৎসবে ঘোষিত ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননা’ প্রদান করা হয় কবি মহাদেব সাহাকে।
অষ্টম পর্বে কবি অসীম সাহার সভাপতিত্বে আমন্ত্রিত কবিবৃন্দ কবিতা পাঠ করেন। নবম পর্বে কবি নির্মলেন্দু গুণের সভাপতিত্বে আমন্ত্রিত কবিবৃন্দ কবিতা পাঠ করেন। এরপর বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের সভাপতিত্বে কবিতার গান পর্বে আমন্ত্রিত শিল্পীদের সুরের আশ্রয়ে কবিতার গান পরিবেশন করেন। ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে এবার নেওয়া হয়েছে ‘মুজিববর্ষ কবিতাবর্ষ’ শীর্ষক বছরব্যাপী এই কর্মসূচি। সেই কর্মসূচিতে ঢাকার পাশাপাশি টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগরসহ দেশের কয়েকটি জেলা শহরে ছড়িয়ে যাবে কবিতা উৎসব। সেই সঙ্গে দেশের বাইরে লন্ডন, ম্যানচেস্টার, কলকাতা, শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবন ও আগরতলা অন্তর্ভুক্ত হবে উৎসবে ‘মুজিববর্ষ’র আয়োজন। কবিতা পরিষদের জেলা ও আন্তর্জাতিক শাখাগুলো এ আয়োজনে সক্রিয় অংশ নেবে।
বঙ্গবন্ধু, স্বপ্ন, সংগ্রাম, মানববন্দনা আর ভালোবাসার কথামালার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ বছরের জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম আয়োজন।