‘স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন’
মুস্তাফিজ শফি: অমর একুশে গ্রন্থমেলার অনুষ্ঠানমালায় আজ মুর্শিদা বিনতে রহমান রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন’ শীর্ষক গ্রন্থের ওপর এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি বাংলা একাডেমিকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মুজিববর্ষের এই প্রয়াসে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। গ্রন্থটিতে সুস্পষ্ট যে, লেখক অত্যন্ত শ্রমসাধ্য একটি কাজ করেছেন। পাঠকের কাছে তিনি আমাদের ইতিহাসের এক আকর গ্রন্থ তুলে দিয়েছেন। এ গ্রন্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা নিয়েই আজকের এই লেখা। শুরুতেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিতে বইটির যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দরকার ছিল এই লেখাটি হয়তো সে-রকম হবে না। সে-সময় এবং সুযোগই আমার ছিল না। তবে অবশ্যই এখান থেকে বইটি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে ধূমকেতুর মতো উদয় হননি। একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে এসে জায়গা করে নিয়েছেন, এমনও নয়। অবিভক্ত বাংলার কথা যদি বলিÑ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো বৃহৎ নেতৃত্বের ছায়ার মধ্যেও তরুণ শেখ মুজিব ঢাকা পড়েন নি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী কিংবা মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মতো নেতাদের মধ্যেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিব এক বিশিষ্ট অবয়ব। ১৯৪৭ সালের সেই ছবিটি যদি আমরা দেখি, কলকাতায় মহাত্মা গান্ধী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যরা বসে আছেন, পেছনে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব। অনেকের কাছে লেখকসুলভ কল্পনা মনে হতে পারে; কিন্তু এই আলোকচিত্রটিকে আমার কাছে দারুণ প্রতীকী মনে হয়। মনে হয়, বর্ষীয়ান নেতারা তাদের সোনালি সময় ব্রিটিশ ভারতের মুক্তির জন্য ব্যয় করেছেন। সেই দেশ যখন স্বাধীনতার নামে বিভক্ত হচ্ছে, তখনও তরুণ শেখ মুজিব বসে পড়েন নি। তিনি প্রতীকী অর্থেই যেন দাঁড়িয়ে আছেন, ঋজু ভঙ্গিতে, আরেকটি নতুন বাস্তবতার অপেক্ষায়।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা দেখিÑ দেশভাগের দিন থেকেই বঙ্গবন্ধু নতুন ব্যবস্থাকে ‘অসম্পূর্ণ’ মনে করছেন। কেবল বাংলার বিভক্তি নয়, স্বাধীনতার মর্মার্থ বিবেচনাতেও। তিনি বলছেনÑ ‘স্বাধীন দেশের জনগণকে গড়তে হলে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে যে নতুন মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তা এই নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করতে পারলেন না। এদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগকে তাদের হাতের মুঠায় নেবার জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৯০)
পরবর্তীতে আমরা আরও দেখতে পাই, যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের তারুণ্য উৎসর্গ করেছিলেন, সেই পাকিস্তানেই তাকে নানা ছুতোয় কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহিতার অপবাদ। তখনও বঙ্গবন্ধু একজন উদীয়মান নেতা। বড় নেতারা যখন নানা মাত্রিক আপোস করে নতুন দেশের পদ-পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন, তখন ক্রমেই গড়ে উঠছে শেখ মুজিবের আপোসহীন ভাবমূর্তি। নবাব, খান বাহাদুর, ভূস্বামী, অভিজাত শ্রেণির বাইরের বিপুল জনসাধারণের নেতা হয়ে উঠছেন তিনি। নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আশা ও আকাক্সক্ষাকে।
বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখনীতে আমরা দেখতে পাই, তিনি ইতিহাসের নানা বাঁক-বদলের সাক্ষী কেবল নন, কেবল দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা বলছেন না, কেবল নতুন চীনের সঙ্গে নতুন পাকিস্তানের তুলনা করছেন না। এই তিন গ্রন্থের পাতায় পাতায় ফুটে উঠছে মুক্তির আকাক্সক্ষা। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ে তোলার আশা। একটি নতুন জাতির জন্ম-মুহূর্তের বৈভব ও বেদনা। তিনি তখনই স্থির লক্ষ্যÑ বিনা সংগ্রামে, বিনা ত্যাগে মুক্তি আসবে না। আর প্রয়োজন নেতৃত্ব। সমাজের ওপরতলা থেকে পাখির চোখে দেশ দেখা নেতা নয়, গণমানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার নেতৃত্ব। এখন, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, বঙ্গবন্ধুর জš§শতবার্ষিকী উদযাপনের মুহূর্তে আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছিলেন তার সামনে ধরা অদৃশ্য আয়নায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি যদি আমরা দেখি, দেখতে পাই গভীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলছেন শোষকের বিরুদ্ধে নিরলস নেতা হিসেবে। জেল, জুলুম, হুলিয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির মন্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন মানুষের মধ্যেই। নিজে প্রস্তুত হচ্ছেন, জাতিকে প্রস্তুত করছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য।
আমরা এখন জানি, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আসলে যেমন নিজেকে চেনাচ্ছিলেন, তেমনই চিনছিলেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ জমিন ও তার রক্তিম ভবিষ্যৎকে। তিনি হয়ে উঠছিলেন বাঙালি জাতির বিশ^াস ও আস্থার প্রতীক। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি করছিলেন। কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিরও প্রেক্ষাপট তৈরি করছিলেন নিজের জীবনের সোনালি সময়গুলো ব্যয় করে।
বঙ্গবন্ধুর সেই ত্যাগ ও সংগ্রাম বৃথা যায়নি। তার নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বিস্ময় ছড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশে^র অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতিরও অনুপ্রেরণার নাম, মুক্তির মন্ত্র।
দুর্ভাগ্য আমাদের, যে স্বপ্নের সোনার বাংলা বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন, সেই সময় তিনি পাননি। সারাজীবন তিনি যে রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ রূপ তিনি দিয়ে যেতে পারেন নি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে কেবল শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারাই নি; গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুমহান আদর্শগুলোও ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ যাত্রা করেছিল পেছনের দিকে, অন্ধকারের অভিমুখে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে মুক্তির আলো আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল ঠিক তার উল্টো পথে। আর এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২১ বছর। রক্ত ঝরেছিল। খালি হয়েছিল অনেক মায়ের বুক।
শারীরিকভাবে অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কিন্তু এখনও আমাদের প্রতিদিনের অঙ্গীকারের নাম। তার অনির্বাণ জীবন ও কর্ম এই দেশ ও জাতির অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু একটি নদীর নাম। সেই নদী অবিরাম বয়ে চলেছে আমাদের ধমনিতে। আর তাগিদ দিচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত, অগ্রসর রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থার। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জীবনব্যাপী কাজ করে গেছেন জাতির পিতা। আমাদের বারবার সেখানেই ফিরে যেতে হবে। সেই আদর্শকে বুকে ধারণ করতে হবে।
স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি বা কাজ না পায়।’
রাজনৈতিক মুক্তির পর আমরা যদি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন করতে চাই, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আঁকড়ে ধরার বিকল্প নেই। স্বীকার করতেই হবে, এদেশে অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এও অস্বীকার করা যাবে না যে, একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্যও। আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তো রয়েছেই। এই সময়ে তাই বঙ্গবন্ধু আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আরও বেশি জরুরি। অর্থনৈতিক মুক্তি সুষম করতে হলে, সাধারণ মানুষকে বৈষম্যের জাল থেকে মুক্তি দিতে হলে আমাদের অগ্রসর হতে হবে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথেই। তাই এখন আরও বেশি প্রয়োজন তার জীবন, কর্ম, আদর্শ ও চিন্ত-ভাবনা চর্চা করার। মুজিব জন্মশতবর্ষ আমাদের সামনে সেই তাগিদ নিয়েই হাজির হয়েছে। আজকের আলোচিত গ্রন্থটি বাংলা একাডেমির এ-রকমই একটি প্রয়াস।
বলাবাহুল্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে তার পূর্ববর্তী বছর তথা ১৯৭০ সালের ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সত্তরের নির্বাচনটি, যে নির্বাচন ঘিরে লেখক গ্রন্থটি সাজিয়েছেন। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাই স্পষ্ট হয়নি, দল হিসেবে কেবল আওয়ামী লীগই জয়লাভ করেনি; বরং এটি ছিল বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধেরও বিজয়। পাকিস্তানের এই সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৬০টিতে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচনে দলটি পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জয়লাভ করে। নজিরবিহীন এই বিজয়ে আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠনের পক্ষে গণরায় লাভ করে।
বলা চলে, একাত্তর-পূর্ব বঙ্গবন্ধুর সকল কর্মকা-েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুকিয়ে ছিল। তারপরও প্রশ্ন, সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কীভাবে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হন? এর উত্তরে হয়তো সবাই বলবেন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবি হয়ে ওঠে। কিন্তু লেখক যে আঙ্গিকে বিষয়টির বিশদ বর্ণনা করেছেন, সেটি একটু ভিন্ন। সেটা কতটা যথার্থ সে-প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তবে লেখক শুরু করেছেন ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুর কারাবরণ দিয়ে। প্রথম অধ্যায়টির শিরোনামÑ বঙ্গবন্ধুর মানসজগতে স্বাধীন বাংলাদেশ। লেখক লিখেছেনÑ ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট দৈনিক ইত্তেহাদে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে উঠে আসে মানুষের মুক্তির বিষয়টিÑ ‘১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা যে আজাদী লাভ করেছি, সেটা যে গণ আজাদী নয় তা গত এক বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’ এ অধ্যায়ে যেমন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা এসেছে। তেমনি এসেছে ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন প্রসঙ্গও।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর দিক-নির্দেশনা শীর্ষক গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক ছিষট্টির ৬-দফার প্রেক্ষিতে আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর কারাবরণ, মুক্তি এবং তার পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইযুব খানের পদত্যাগের পর আসেন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯ সালের যে গণ-অভ্যুত্থানের কারণে আইয়ুুব খান পদত্যাগ করেছিলেন সেই গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান বলেন, আমি কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করবো না, সবাইকে যার যার পদে রাখা হোক। এর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর কর্মতৎপরতা চলমান ছিল। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতা-ভাষণে নানা দিক-নির্দেশনা দেন। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকের এক সমাবেশের কথা আলোচ্য গ্রন্থে লেখক এনেছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। আরও বলেছেন, শোষক-শ্রেণির একটানা শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জনসাধারণের স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধু বলেছেনÑ সকল প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন।
এবার আসি ‘স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন’ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে। অধ্যায়টির শিরোনামÑ ১৯৭০-এর নির্বাচনী ভাষ্য। পাঁচ অধ্যায়বিশিষ্ট গ্রন্থটির মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়; কলেবরে মূলগ্রন্থ (পরিশিষ্ট ছাড়া) প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার মধ্যে প্রায় ১৩০ পৃষ্ঠা জুড়েই রয়েছে এ অধ্যায়টি। গ্রন্থটির (স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন) নামের ন্যায্যতা লেখক এ অধ্যায়ের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যে কথাটি আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, যে লেখক একটা ভিন্ন আঙ্গিক থেকে সেটা বর্ণনা করেছেন। আঙ্গিকটা হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতি, আবেদন, নিবেদন তথা বঙ্গবন্ধুর মুখনিসৃত যে কোনো কথা এবং লেখা; সেটা চিঠিই হোক বা অন্য কিছু। বিষয়টির ইঙ্গিত প্রথম অধ্যায়েই লেখক দিয়েছিলেন। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছেনÑ ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশ বিপ্লবের প্রতি জনগণের মনোভাব দৃঢ়ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে তার ১৯৭০-এর নির্বাচনী ভাষণ ছিল অগ্রপথিক।’ ফলে তৃতীয় অধ্যায়টি তিনি সেভাবেই সাজিয়েছেন।
অধ্যায়টির শুরুর এক স্থানে লেখক বলেছেনÑ ‘১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি পুরোদেশ সফর করেছেন জনগণকে জাগ্রত করতে।… বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী ভাষণ থেকে আমরা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাংলার মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা এবং দাবি আদায়ের সংগ্রামের দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে স্পষ্টতই জ্ঞান লাভ করতে পারি।’ এ অধ্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর জনসভার বক্তব্যকে সরণি, মানচিত্র ও বর্ণনাসহ সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। যেমন-

এভাবে আট পৃষ্ঠাজুড়ে ১১১টি জনসভার তথ্য বঙ্গবন্ধুর বার্তাসহ সরণিতে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সেসব জনসভা বাংলাদেশব্যাপী তো ছিলই পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও কয়েকটি জনভায় তিনি বক্তৃতা করেছেন। সরণির পাশাপাশি জনসভার তথ্য এসেছে মানচিত্র আকারেও। যেমন ঢাকা জেলার মানচিত্র অঙ্কন করে সেখানে ১২ পৃষ্ঠাজুড়ে মোট ১২টি মানচিত্রে এলাকাচিহ্নিত করে জনসভার তারিখ বার্তাসহ চিত্রিত করা হয়েছে। উপস্থাপনার দিক থেকে কিংবা পাঠকের সুবিধার্থে এগুলো নিসন্দেহে ভালো আয়োজন। কিন্তু অতিরঞ্জনটা এরপরই হয়েছে, যখন আলাদা করে ‘নির্বাচনী ভাষ্য’ নামে উপশিরোনামে আবার সেই নির্বাচনী তথ্য জনসভার স্থান, তারিখ ও বার্তা বর্ণনা করা হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমি যখন গ্রন্থটি পড়তে গিয়েছি তৃতীয়বারে একই বিষয় পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। এটার হয়তো একটা যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, সরণি কিংবা মানচিত্রে বিস্তারিত বলা যায়নি, এখানে এসে সেটি করা হয়েছে। তারপরও কিন্তু বিরক্তিটা থেকে যায়। তার চেয়ে বড় কথা কলেবর। এখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিস্তারিত বর্ণনা করতেই প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও লেখক এখানে আরেকটা ভালো কাজ করেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলোকে বিষয় ধরে আলাদা করেও দেখিয়েছেন। যেমনÑ নির্বাচন-সংক্রান্ত বক্তব্য, ৬-দফা প্রসঙ্গ, আঞ্চলিক বৈষম্য, আঞ্চলিক সমস্যা, ধর্ম ও সংখ্যালঘু-সংক্রান্ত, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন-সংক্রান্ত কিংবা বন্যা প্রসঙ্গের বক্তব্যগুলো বিষয়ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন অনুচ্ছেদে এনেছেন। এসব বক্তব্যে মানুষকে উদ্দীপ্তকরণের বিষয় এসেছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে সমস্যা সমাধানের বক্তব্য এসেছে, বৈষম্যের বাস্তব নমুনাও দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
চতুর্থ অধ্যায়েও বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা বিবৃতিই এসেছে। তবে এ অধ্যায়ে লেখক সেগুলোই তুলে ধরেছেন যেগুলো বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের একান্ত দলীয় কাউন্সিলে তুলে ধরেছেন। সেসব বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করেছেন। আর নেতা ও জনতা শিরোনামের শেষ অধ্যায়টিতে সেসব জনসভার ছবি এসেছে, যেগুলোর বর্ণনা ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছে। ছবিগুলোতে মানুষের ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি স্পষ্ট। এমনকি কোথাও জনসভাস্থলে ঠাঁই না পেয়ে ভবনের ছাদেও মানুষের অবস্থান দেখা গেছে।
তার মানে স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা লেখক তার ভাষণ, বক্তৃতার মধ্যেই সীমবদ্ধ রেখেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। সত্তরের নির্বাচনের বিষয়গুলো তো আমরা দেখলাম এই গ্রন্থে। আবার বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সর্বজনবিদিত। সে ভাষণটি সে-সময়ের সংগ্রামী জনতাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। ভাষণটি আজও আমাদের কাছে সমান প্রেরণা নিয়েই রয়ে গেছে। ফলে সত্তরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেবল ভাষণ ধরে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা বর্ণনায় লেখক যথার্থ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সত্য। মনে রাখা দরকার, উৎকর্ষতার বিচারে এটি কিছুটা খ-িত। বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য কর্মতৎপরতার আরও বিস্তর আলোচনা করা যেত। তবে আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য লেখককে ধন্যবাদ দিতেই হবে। আমি মনে করি, যে দিকটি তিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন সেটি সুন্দরভাবেই পেরেছেন। পরবর্তী সংস্করণে সার্বিক বিষয় বর্ণনার বিষয়টি নিশ্চয়ই তিনি মাথায় রাখবেন।
মুর্শিদা বিনতে রহমান রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন’ শীর্ষক এই গ্রন্থের সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক; ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দৈনিক সমকাল