প্রচ্ছদ প্রতিবেদন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াদা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ঘর আলোকিত করা হয়েছে মন্তব্য করে বলেছেন, এই দিন আলোর পথে যাত্রার সফলতার সেই দিন। যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলে রেখে গিয়েছিলেন, আজকে সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। ওয়াদা করেছিলাম প্রতিটি মানুষের ঘর আলোকিত করব। প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে। আলোর পথে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আজকের দিনটা সেই আলোর পথে যাত্রা যে সফল হয়েছে সেই দিন। গত ২১ মার্চ পটুয়াখালীর পায়রায় দেশের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধুনিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এবং সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকার কারণেই বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটতে পারছে। মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং আগামীতে রোজা ও ঈদ; এই রোজা-ঈদ সবকিছু সামনে রেখে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আপনাদের উপহার দিয়ে গেলাম। মুজিববর্ষে দেশের প্রত্যেকটি ঘর আলোকিত করেছে সরকার, এটাই সব থেকে বড় সাফল্য।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের পর সেখানে সংক্ষিপ্ত সুধী সমাবেশে অংশ নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিসহ কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি এবং পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি অডিও-ভিডিও উপস্থাপনাও প্রদর্শিত হয়।
পরিবেশবান্ধব আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির সাহায্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ ‘মুজিববর্ষে’ দেশকে শতভাগ বিদ্যুৎ কভারেজের আওতায় আনার সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আরেকটি মাইলফলক অর্জন করল। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এম খোরশেদুল আলম। এ সময় সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সচিববৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের সর্ববৃহৎ এই অত্যাধুনিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার সাফল্য তুলে ধরে বলেন, মুজিববর্ষে দেশের প্রত্যেকটি ঘর আলোকিত করেছে সরকার, এটাই সব থেকে বড় সাফল্য। আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা আলো জ্বালতে পারলাম এটাই হচ্ছে বড় কথা। আমরা আলোকিত করেছি এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঘরকে।
পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর ও উন্নত জীবন পায়, সে-জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা মহৎ কাজ করে যাচ্ছিলেন, আর মহৎ কাজের জন্য মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগ প্রয়োজন। এটাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কথা। সেই কথাটা স্মরণ রেখেইÑ যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে আমার বাবা জীবন দিয়ে গেছেন, মা জীবন দিয়ে গেছেন, ভাইয়েরা জীবন দিয়েছেনÑ আমি তাদের স্বপ্ন পূরণ করে এই বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা, আমি মনে করি মুজিব আদর্শের প্রতিটি সৈনিকের সেটাই স্মরণ রাখতে হবে।
’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলোর এদেশকে এগিয়ে নেওয়ায় কোনো আন্তরিকতাই ছিল না উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০২২ সাল এই দীর্ঘ সময় সরকারে থাকতে পেরেছি সে-জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। ভোট দিয়ে আমাদের তারা নির্বাচিত করেছেন। এই ১৩ বছর একটানা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে, এর মধ্যে ঝড়-ঝঞ্ঝা অনেক এসেছে, বাধা অনেক এসেছে; কিন্তু সেগুলো আমরা অতিক্রম করেছি। এগুলো অতিক্রম করেও আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি বলেই আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে।
সর্ববৃহৎ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতা করায় চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা একে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন, আজকে সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বাস্তবে রূপ দেওয়া হলো। জাতির পিতার উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
’৯৬ সালে সরকার গঠনের সময় দেশের অধিকাংশ অঞ্চল অন্ধকারে ডুবে থাকার এবং মাত্র ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সেই অবস্থা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে ৪৩০০ মেগাওয়াট করে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে বিএনপি-জামাত সরকার ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন তো বাড়াতেই পারেনি; বরং কমিয়ে ফেলে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ৩২০০ মেগাওয়াট থেকে তার সরকার আজকে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত করতে সক্ষম হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, আজকে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা গড়ে তুলেছি, যাতে সকলের কর্মসংস্থান হতে পারে। যে দক্ষিণাঞ্চল এক সময় সব থেকে অবহেলিত ছিল সেখানে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার পাশাপাশি মানুষের চলাচল সহজ করার জন্য রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ আমরা ব্যাপকভাবে করে দিয়েছি। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান সবদিকেই আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি, যা জাতির পিতা করতে চেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, তার সরকার ইতোমধ্যে রাঙ্গাবালী, নিঝুম দ্বীপ, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর নিচ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। আর যেখানে বিদ্যুতের গ্রিডলাইন নেই সেখানে সোলার প্যানেল করে দিচ্ছে। হাওর-বাঁওড়, পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় এই সোলার প্যানেলের সাহায্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো ঘর আর অন্ধকারে থাকবে না, প্রতিটি মানুষের জীবন আলোকিত হবে।
প্লান্টটি তৈরি করছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল), চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এর মধ্যে একটি ৫০:৫০ যৌথ উদ্যোগ। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং এনইপিসি এবং সিইসিসি-এর কনসোর্টিয়াম পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নের জন্য ২৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে ইপিসি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ এবং ৭৪ শতাংশকে বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৫৫১৪ মেগাওয়াট হয়েছে, যা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ৪৯৪২ মেগাওয়াট ছিল। এর মধ্যে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে এবং ১৯৬২৬ মেগাওয়াট স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে।